সালিম আলি এর জীবনী | Biography of Salim Ali

সালিম আলি এর জীবনী | Biography of Salim Ali

May 16, 2025 - 18:24
May 24, 2025 - 12:20
 0  1
সালিম আলি এর জীবনী |  Biography of Salim Ali

সালিম আলী : দ্যা বার্ডম্যান অব ইন্ডিয়া

জন্ম

১২ নভেম্বর ১৮৯৬
মুম্বই, ব্রিটিশ ভারত

মৃত্যু

২০ জুন ১৯৮৭ (বয়স ৯০)
মুম্বই, ভারত

জাতীয়তা

ভারতীয়

দাম্পত্য সঙ্গী

তাহমিনা আলী

পুরস্কার

পদ্মবিভূষণ (১৯৭৬)

বৈজ্ঞানিক কর্মজীবন

কর্মক্ষেত্র

পক্ষীবিজ্ঞান
প্রাকৃতিক ইতিহাস

যাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন

এরউইন স্ট্রেসমান

সালিম মঈজুদ্দীন আব্দুল আলি 

(জন্ম: নভেম্বর ১২, ১৮৯৬ – মৃত্যু: জুন ২০, ১৯৮৭) একজন বিখ্যাত ভারতীয় পক্ষীবিদ এবং প্রকৃতিপ্রেমী। তিনিই প্রথম কয়েকজন ভারতীয়দের মধ্যে একজন যাঁরা ভারতের পাখিদের সম্বন্ধে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে জরিপ পরিচালনা করেন। তার পাখিবিষয়ক বইগুলি পক্ষীবিজ্ঞানের উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। ১৯৪৭-এর পর তিনি বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটিতে গুরুত্বপূর্ণ আসনে জায়গা করে নেন এবং সংগঠনটির উন্নয়নে সরকারি সাহায্যের সংস্থান করে দেন। তিনি ভরতপুর পক্ষী অভয়ারণ্য (কেওলাদেও জাতীয় উদ্যান) প্রতিষ্ঠা করেন এবং তারই উদ্যোগে বর্তমান সাইলেন্ট ভ্যালি জাতীয় উদ্যান নিশ্চিত ধ্বংসের হাত থেকে বেঁচে যায়।

ভারত সরকার তাকে ১৯৫৮ সালে পদ্মভূষণ এবং ১৯৭৬ সালে ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান পদ্মবিভূষণে ভূষিত করে।[] এছাড়াও তিনি ১৯৫৮ সালে রাজ্যসভায় সদস্যরূপে মনোনীত হন।[] পাখি বিষয়ে তার অনবদ্য অবদানের জন্য তিনি "ভারতের পক্ষীমানব" হিসেবে পরিচিত।

প্রারম্ভিক জীবন

সালিম আলী ১৮৯৬ সালে ভারতের মুম্বইয়ে (তৎকালীন বোম্বে) সুলাইমানী বোহরা গোত্রের এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। নয় ভাই-বোনের মধ্যে তিনি সর্বকনিষ্ঠ। তার বয়স যখন এক বছর তখন তার পিতা মইজুদ্দীন মৃত্যুবরণ করেন এবং তিন বছর বয়সে তার মাতা জিনাত-উন-নিসা মৃত্যুবরণ করেন। তার নিঃসন্তান মামা-মামী আমিরুদ্দীন তায়েবজী ও হামিদা বেগম তার লালন-পালনের ভার নেন। তার আরেক মামা আব্বাস তায়েবজী একজন প্রখ্যাত ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন। ছোটবেলায় সালিম তার খেলনা এয়ারগান দিয়ে একটি অদ্ভুতদর্শন চড়ুই শিকার করেন আর সেই চড়ুইয়ের সূত্র ধরে বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটির তৎকালীন সচিব ওয়াল্টার স্যামুয়েল মিলার্ডের সাথে তার পরিচয় হয়।

মিলার্ড চড়ুইটিকে হলদেগলা চড়ুই হিসেবে সনাক্ত করেন। তিনি সালিমকে সোসাইটিতে সংগৃহীত স্টাফ করা পাখির সংগ্রহ ঘুরিয়ে দেখান। তিনি সালিমকে পাখি সম্পর্কিত কিছু বই ধার দেন, তার মধ্যে ইহার কমন বার্ডস অব বোম্বে অন্যতম। সালিমকে পাখির একটি সংগ্রহ সৃষ্টির জন্য তিনি উৎসাহ দেন আর কীভাবে পাখির চামড়া ছাড়াতে হয় ও সংরক্ষণ করতে হয় সে ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রস্তাব দেন। মিলার্ড ছোট্ট সালিমের সাথে নরম্যান বয়েড কিনিয়ারের পরিচয় করিয়ে দেন।

কিনিয়ার ছিলেন বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটির সর্বপ্রথম বেতনভোগী কিউরেটর। নিজের আত্মজীবনী দ্য ফল অফ আ স্প্যারোতে সালিম হলদেগলা চড়ুইয়ের ঘটনাটাকে তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়া ঘটনা হিসেবে অভিহিত করেন। সেই ঘটনাটাই তার পক্ষীবিদ হওয়ার পেছনে ভূমিকা রাখে। তখনকার দিনে ভারতের হিসেবে পেশাটি একটু অন্যরকমই বলতে হবে। অথচ জীবনের প্রথম দিকে তিনি শিকার সম্পর্কিত বইপত্র পড়তেন আর তার ঝোঁক ছিল শিকারের দিকেই। তার পালক পিতা আমিরুদ্দীনের শিকারের প্রতি বেশ আগ্রহ ছিল। তার আশেপাশের এলাকায় প্রায়ই শিকার প্রতিযোগিতা হত। তার শিকারের অন্যতম সহচর ছিলেন পাকিস্তানের প্রথম রাষ্ট্রপতি ইস্কান্দার মির্জা, যিনি নিজে খুব ভাল শিকারী ছিলেন।

 সালিম আলি তার প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন জেনানা বাইবেল মেডিকেল মিশন গার্লস হাই স্কুল থেকে। পরবর্তীতে তিনি বোম্বের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন। তের বছর বয়স থেকে তিনি প্রায়ই মাথাব্যথায় ভুগতেন। সে কারণে তিনি স্কুলে অনিয়মিত ছিলেন। তার এক আত্মীয়ের পরামর্শে তিনি সিন্ধুতে চলে যান। অনিয়মিত শিক্ষাজীবনের জন্য তিনি কোনমতে ১৯১৩ সালে বোম্বে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।

বার্মা ও ইউরোপের জীবন

সালিম আলি তার বোম্বের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের প্রথম দিনগুলো বেশ সমস্যার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করেন। কলেজ বাদ দিয়ে তিনি বার্মার তেভয়ে (তেনাসেরিম) চলে যান তার পারিবারিক টাঙস্টেনের খনি ও টিম্বারের ব্যবসা দেখাশোনার জন্য। সে এলাকার অনন্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য ও অসাধারণ সম্বৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য তার প্রকৃতিপ্রেমী সত্ত্বাকে (একই সাথে শিকারী সত্ত্বাকেও) জাগ্রত করে। সেখানে জে সি হোপল্যান্ড আর বার্থোল্ড রিবেনট্রপের সাথে তার পরিচয় হয়। তারা দু'জন তখন বার্মার ফরেস্ট সার্ভিসে কর্মরত ছিলেন। সাত বছর পর, ১৯১৭ সালে সালিম আলী ভারতে ফেরত আসেন।

তিনি তার অসমাপ্ত পড়াশোনা শেষ করার সিদ্ধান্ত নেন। দেবরের কলেজ অফ কমার্সে তিনি বাণিজ্যিক আইন আর হিসাববিদ্যায় ভর্তি হন। তার আগ্রহ ঠিকই সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের ফাদার এথেলবার্ট ব্লাটার-এর নজরে আসে। তিনি সালিমকে জীববিদ্যা পড়ার জন্য উৎসাহ দেন। সকালে দেবর কলেজে ক্লাস করে পরে সেন্ট জেভিয়ার্সে ক্লাস করতে যেতেন সালিম। এতসব প্রতিকূলতার মধ্যে তিনি ঠিকই জীববিদ্যার কোর্স সফলভাবে পাশ করেন। ১৯১৮ সালের ডিসেম্বরে তার এক দুঃসম্পর্কীয় আত্মীয়া তাহমিনার সঙ্গে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।

ছোটবেলা থেকেই মোটরসাইকেলের প্রতি সালিমের তীব্র আকর্ষণ ছিল। তেভয়ে তিনি প্রথমবারের মত একটি ৩.৫ অশ্বশক্তির NSU কেনেন। পরবর্তীকালে বিভিন্ন সময়ে তিনি একটি সানবিম, তিনটি মডেলের হার্লে-ডেভিসন, একটি ডগলাস, একটি স্কট, একটি নিউ হাডসন, একটি জেনিথ এবং আরও অনেক মোটরসাইকেল কেনেন।

একবার ১৯৫০ সালে সুইডেনের উপসালায় অর্নিথোলজিক্যাল কংগ্রেস থেকে তিনি আমন্ত্রণ পান। বোম্বে থেকে এস এস স্ট্রেথডেনে করে তার সানবীম নিয়ে তিনি সুইডেনে নামেন আর সেটা নিয়ে সমগ্র ইউরোপ চষে বেড়াতে শুরু করেন। জার্মানির প্যাঁচানো সব রাস্তায় ছোটখাটো দুর্ঘটনা ছাড়াও ফ্রান্সে তিনি অ্যাক্সিডেন্ট করে জখম হন। পুরো ইউরোপ ঘুরে যখন তিনি ঠিক সময়ে সুইডেনে প্রথম অধিবেশনে যোগ দেন, তখন সবাই বলাবলি করতে শুরু করে যে লোকটা ভারত থেকে গোটা পথ পাড়ি দিয়ে এখানে এসে পৌঁছেছে। সেবার একটা বিএমডব্লিউ সাথে না থাকাতে সালিম আলীর খুব আফসোস হয়েছিল।

কোন প্রাতিষ্ঠানিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি না থাকাতে জ্যুলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ায় পক্ষীবিদের পদ পেতে সালিম আলী ব্যর্থ হন। তার পরিবর্তে এম এল রুনওয়াল পদটি পেয়ে যান। ১৯২৬ সালে নবনির্মিত মুম্বাইয়ের প্রিন্স অব ওয়েলস মিউজিয়ামে তিনি গাইড লেকচারার পদে চাকরি পান। তখন তার মাসিক বেতন ছিল ৩৫০ রুপি।[][১৪] তবে নতুন কাজে তিনি বেশিদিন স্থায়ী হন নি।

দুই বছর পর, ১৯২৮ সালে তিনি শিক্ষা অবকাশ নিয়ে জার্মানি চলে যান। সেখানে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান জাদুঘরে অধ্যাপক এরউইন স্ট্রেসমানের অধীনে তিনি কাজ করার সুযোগ পান। বার্মা থেকে জে. কে. স্টানফোর্ড সংগৃহীত বিভিন্ন নমুনা বিশ্লেষণ করা ছিল তার অনেকগুলো কাজের মধ্যে একটি। স্টানফোর্ড বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটির একজন সদস্য ছিলেন। তিনি সালিমকে কারো অধীনে কাজ না করার জন্য উৎসাহ দেন এবং বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি থেকে সবরকম সহায়তা দেওয়ার আশ্বাস জানান।

 স্টানফোর্ড ক্লড টাইসহার্স্টের সাথে এ ব্যাপারে কথাবার্তা বলেন। একজন ভারতীয়কে বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটিতে জড়ানোর বিষয়টি টাইসহার্স্টের মনঃপূত হয় নি। আবার একজন জার্মানের (স্ট্রেসমান) সংশ্লিষ্টতাও তাকে ক্ষুব্ধ করে। বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটিতে তিনি চিঠি লিখে জানান যে স্ট্রেসমানের সংশ্লিষ্টতা তার কাছে ব্যক্তিগতভাবে অপমানজনক। তার মন্তব্য অবশ্য পরবর্তীকালে আমলে নেওয়া হয়নি। জার্মানিতে সালিম বের্নহার্ট রানশ্, অস্কার হাইনরোথ, আর্নস্ট মায়ারের মত তৎকালীন জার্মানির সেরা সেরা পক্ষীবিজ্ঞানীর সংস্পর্শে আসেন। বার্লিনে তার সাথে বিপ্লবী চম্পাকর্মণ পিল্লাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ হয়। জার্মানিতে অবস্থান তার পাখি বিষয়ক আগ্রহ আরও বৃদ্ধি করে, সাথে সাথে তার অভিজ্ঞতার ঝুলিকেও সম্বৃদ্ধ করে।

পক্ষীবিজ্ঞানে অবদান

১৯৩০ সালে সালিম আলী ভারতে ফিরে আসেন। ভারতে এসে তিনি আবিষ্কার করলেন, তার গাইড লেকচারারের পদটি তহবিলের অভাবে বিলোপ করা হয়েছে। উপযুক্ত চাকরির অভাবে সালিম ও তাহমিনা মুম্বাইয়ের নিকটে কিহিম নামক একটি সমুদ্রতীরবর্তী গ্রামে চলে যান। সেখানে তিনি দেশি বাবুইয়ের জন্ম ও প্রজনন প্রক্রিয়া খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পান। তিনি আবিষ্কার করেন, এদের প্রজনন প্রক্রিয়া আসলে অনুবর্তী বহুগামী। পরবর্তীকালে বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেন যে এ তথ্য বহু আগে মুঘল প্রকৃতিবিদরা আবিষ্কার করেন।

 কে. এম. অনন্তন নামে এক অবসরপ্রাপ্ত সামরিক চিকিৎসকের নিমন্ত্রণে তিনি পরের কয়েকটি মাস কোটাগিরিতে কাটিয়ে দেন। এর কিছুদিন পরে তিনি হায়দ্রাবাদ, কোচিন, ত্রিবাঙ্কুর, গোয়ালিয়র, ইন্দোর  ভূপালসহ আরও কয়েকটি করদ রাজ্যে নিয়মতান্ত্রিক পক্ষী-জরিপ চালানোর অভিনব এক সুযোগ পেয়ে যান। এসব পক্ষী-জরিপের খরচ পুরোপুরি বহন করে এসকল রাজ্য। এ জরিপে তিনি হিউ হুইসলারের অসীম সহায়তা পান। হুইসলার নিজে পুরো ভারতজুড়ে এ ধরনের জরিপ কাজ চালিয়েছিলেন ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন।

প্রথম দিকে হুইসলার অবশ্য একজন অচেনা ভারতীয়ের এ ধরনের যোগাযোগে বিরক্ত হয়েছিলেন। হুইসলার তার দ্য স্টাডি অব ইন্ডিয়ান বার্ডস-এ উল্লেখ করেছিলেন- বড় ভিমরাজের লেজে লম্বা পালকগুলোতে রক্তনালী জালকের মত বিস্তৃত নয়। সালিম আলী তাকে চিঠি লিখে জানান যে তথ্যটি সঠিক নয়। হুইসলার এ অচেনা ভারতীয়ের মন্তব্যে বেশ ক্ষুব্ধ হন। পরে অবশ্য তিনি তার নমুনাগুলো আবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেন এবং তার ভুল স্বীকার করে নেন। তারা দু'জনে পরবর্তীতে ভাল বন্ধু হয়েছিলেন।

হুইসলার রিচার্ড মেইনার্ৎসেনের সাথে সালিমের পরিচয় করিয়ে দেন। তারা দু'জনে মিলে আফগানিস্তানে অভিযানে যান। সালিমের ব্যাপারে মেইনার্ৎসেনের একটু ঋণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গী থাকলেও তারা দু'জনে ছিলেন ভাল বন্ধু। সালিম প্রথম দিকে মেইনার্ৎসেনের পক্ষী-চর্চা নিয়ে তেমন কিছু না বললেও পরে প্রমাণ করেন তার পাখি বিষয়ক তথ্যাদিতে বেশ গলদ রয়েছে। মেইনার্ৎসেনের ডায়েরি আর সালিমের আত্মজীবনীতে তাদের পারস্পরিক দৃষ্টিভঙ্গী সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।

দ্য বার্ডম্যান অব ইন্ডিয়া

ভূপৃষ্ঠ থেকে শত শত ফুট উচ্চতায় আকাশে ভাসমান বাজপাখির দৃষ্টিকে কিছুতেই এড়াতে পারে না এর শিকার। যেভাবেই হোক, শিকারের গতিপ্রকৃতি লক্ষ করে সঠিক সময়ে আঘাত হানবেই সে। আকাশের বাজপাখির মতো উড়ে বেড়াতে না পারলেও, ভূমিতে একই স্থানে স্থির বসে থেকে দূর আকাশে চোখ মেলে রেখে জীবন পার করে দিয়েছিলেন একজন ব্যক্তি।

তিনি যখন পাখি দেখায় মগ্ন, তখন তার চোখের দৃষ্টি বাজপাখিকেও হার মানাতো। কৃশকায় ভ্রূজোড়ার নিচে অপলক চোখ দুটি সর্বদা থাকতো মোটা ফ্রেমের চশমার আড়ালে। আর তার খরগোশের মতো চিকন থুতনিতে বরফ শুভ্র নূর দাড়ি দেখতে পাখির পালকের মতোই মনে হতো। শুধু যে দৃষ্টি সুদূরে মেলে দিয়ে এক ধ্যানে বসে থাকেন, তা কিন্তু নয়। তার কান দুটি থাকতো সর্বদা সজাগ। পাখির ডানা ঝাপটার শব্দ শুনেও যেন বুঝে ফেলতেন, সেটি কোন পাখি! বলছিলাম ‘দ্য বার্ডম্যান অব ইন্ডিয়া’ সলিম আলির কথা।

অনেক কিছু বিবেচনাতেই পক্ষীবিজ্ঞান কিংবা পরিবেশ রক্ষায় ভারতে ও বিশ্বে সলিম আলি ছিলেন নিজেই নিজের প্রতিযোগী। তার ধ্যান-জ্ঞানের চর্চায় মুখর ছিল বিশ্ব। কিন্তু একজন সলিম আলির বিদগ্ধ মস্তিস্ক সদাই বিনয়ে অবনমিত থাকতো। তোষামোদ আর আমুদে প্রশংসাবাক্য, কোনোটাই তার বিশেষ পছন্দ ছিল না। যশ-খ্যাতির চূড়ায় উঠেও মুম্বাইয়ের পালি হিলের একটি একতলা বাড়িতে নীরবে, নিভৃতে জীবন কাটিয়েছেন। সে এলাকায় হাতে গোনা কয়েকটি মধ্যবিত্তের বাড়ি ছাড়া সবই সুউচ্চ ভবন। কিন্তু, সলিম আলি নিজেকে রেখেছেন ধরণীর কাছাকাছি! এ ব্যাপারে তিনি একবার বলেছিলেন,“কাজের জন্য স্বীকৃতি পাওয়া চমৎকার ব্যাপার। কিন্তু, তার জন্য আমি খুশিতে লাফাতে বা নাচতে শুরু করবো না নিশ্চয়ই! পক্ষীবিজ্ঞানের জগতে আমার কাজ অতি সামান্য। আর আমি সেখানে কুয়োতে আটকে থাকা একটি ব্যাঙ,কিংবা অন্ধদের জগতে একজন একচোখা মানুষ।”

পক্ষীবিজ্ঞানের উপর সলিম মোট ৮টি বই লিখেছেন, যেগুলোর মধ্যে ‘দ্য হ্যান্ডবুক অব দ্য বার্ডস অব ইন্ডিয়া অ্যান্ড পাকিস্তান’ বিশ্বজোড়া খ্যাতি লাভ করে। বইটি প্রকাশে তাকে সহায়তা করেছেন ডিলন রিপ্লি। বিনয়ী সলিম, রিপ্লিকেও সহলেখক হিসেবে সম্মান দিয়েছেন। এই বইটি রচনা করার জন্য তিনি পুরো ভারতীয় উপমহাদেশে যে পরিমাণ ভ্রমণ করেছেন, পুরো বিশ্বেই আর কোনো পক্ষীবিদ কিংবা বাস্তুসংস্থানবিদ এরকম ভ্রমণ করেছেন কিনা সন্দেহ রয়েছে। ১৯৬৮-৭৪ সাল পর্যন্ত ৬ বছরে ১০ খণ্ডে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হয় তার এই হ্যান্ডবুক অব বার্ডস।

এই বিশাল গ্রন্থটি পক্ষীবিজ্ঞানে এক নতুন ধারার সূচনা করে। এর পূর্বে পর্যন্ত পক্ষীবিজ্ঞান মানেই ছিল নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে পাখির শ্রেণিবিভাজন এবং কিছু ল্যাবরেটরি ভিত্তিক গবেষণা। পাখি পর্যবেক্ষণের ব্যাপারটিকে তখন নিছক সময় নষ্ট মনে করা হতো। এ ব্যাপারে একটি প্রবাদও প্রচলিত ছিল- “যার নাই কোনো কাজ, তার পাখি দেখাই কাজ!

অথচ এই ‘সময় নষ্টের’ ব্যাপারটিই এখন পক্ষীবিজ্ঞানের মূল অংশ হয়ে উঠেছে। এই পরিবর্তন কেবল সলিম আলির জন্যই সম্ভব হয়েছে। পাখি দেখাকে একটি নিছক অলস সময় কাটানোর প্রক্রিয়া থেকে বিজ্ঞানভিত্তিক প্রক্রিয়ায় রূপান্তর করেছেন তিনি। তার প্রতিটি বই হাজারো ব্যবহারিক পর্যবেক্ষণের ফলাফল। পাখির বাস্স্তুসংস্থান, আচরণ, খাদ্যাভ্যাস, প্রজননের মতো ব্যাপারগুলো জানতে পাখি দেখার কোনো বিকল্প নেই। সাত দশক ধরে অনবরত পাখি দেখা সলিম আলি হয়ে ওঠেন একটি ভ্রাম্যমাণ বিশ্বকোষ, পাখি বিষয়ে একটি মৌলিক বই!

সলিম আলি যখন পাখি নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন, তখন পৃথিবীতে পাখির ৮,৫৮০টি স্বীকৃত প্রজাতি ছিল। এর মধ্যে ১,২০০ প্রজাতির পাখি পাওয়া যেত ভারতে। কিন্তু বিজ্ঞানের অন্যান্য দিকে এক পা দু’পা করে এগোতে থাকা ভারত পক্ষীবিজ্ঞানে পিছিয়েই ছিল। পাখি দেখা বা পাখির একটি যথাযথ শ্রেণীবিভাজন করার প্রতি আগ্রহ ছিল না কারোরই। এই কাজটি শুরু করবার সাহস দেখিয়েছিলেন তরুণ সলিম আলি। তিনি ভারতীয় পক্ষীবিজ্ঞানে নিয়মতান্ত্রিক জরিপের সূচনা করলেন। ভারতকে দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থের ভিত্তিতে ভাগ করে শুরু করলেন তার সাত দশকব্যাপী অবিশ্বাস্য এক পর্যবেক্ষণমূলক ভ্রমণ। প্রতিকূল আবহাওয়া আর অসমতল ভূমি উপেক্ষা করে হেঁটে চললেন অমরত্বের পথে। তার পাখি প্রেমের গল্প লেখা হয়ে যায় ইতিহাসের পাতায়।

তিব্বত-নেপালের সীমান্তে এককালের নিষিদ্ধ রাজ্যখ্যাত মুসটাং-এ ট্রেকিং করে কালীগণ্ডকী নদীর দিকে নামছি, পথের পাশে দেখা মিলল এক নির্ভীক চঞ্চল চড়ুইয়ের, উড়ে বেড়াচ্ছে পথের ধারের ঝোপগুলোতে, কিন্তু কী যেন একটা আলাদা ব্যাপার আছে তার চকচকে মসৃণ পালকগুলোতে। 

কেমন হলদে রঙের, সাধারণ চড়ুইয়ের চেয়ে আলাদা। হাইকিংরত পাখিবিশেষজ্ঞ ইনাম আল হককে পাখিটি দেখাতেই এক গাল হাসি দিয়ে বললেন- এই পাখিটিই তো সালিম আলীকে সালিম আলী করে তুলেছিল!

ছোট্ট সালিম আলী মনের সুখে পাখি শিকার করতেন এয়ারগান দিয়ে, তার গুলিতে ঘায়েল হয়েছিল এক আজব ধরনের চড়ুই, সেটার মাংস হালাল কিনা তা জানার জন্য পকেটে নিয়ে সোজা চলে গেলেন চাচা আমিরুদ্দিনের কাছে, তখন ১৯০৮ সাল, আমিরুদ্দিন ছিলেন বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটির আদি সদস্যদের একজন, তারই সুপারিশপত্র দুরুদুরু বুকে নিয়ে বালক সালিম দেখা করলেন সোসাইটির সেক্রেটারি জনাব মিলার্ডের সাথে। 

মিলার্ডের অমায়িক ব্যবহারে সালিম বুঝলেন জগতের সব শ্বেতাঙ্গ এক ধরনের হয় না, যেমনটা তিনি শুনে এসেছেন, সেই সাথে প্রথম দর্শনেই পাখিটির ঠিকুজি জানা গেল ইয়েলো থ্রোটেড স্প্যারো (Yellowthroated Sparrow, বৈজ্ঞানিক নাম- Petronia xanthocollis)। শুধু তাই না তিনি তার বিশাল সংগ্রহশালা উম্মুক্ত করে কৌতূহলী বালককে দেখালেন নানা ধরনের চড়ুই পাখি স্টাফ করা মৃতদেহ।

খুলে গেল তার মনের দরজা, শুরু হল এক নতুন যুগের – খামোখা এয়ার গান দিয়ে মনের সুখে গুলি করে বেড়ানো ব্যাদড়া বালক ঝুঁকে পড়লেন পাখি এবং প্রকৃতি নিয়ে বিশদ ভাবে জানতে, পরিণত হলেন ভারতীয় উপমহাদেশের সেরা পাখিবিশেষজ্ঞে। তারই কিচিরমিচিরে রচিত হয়েছে দ্য ফল অব আ স্প্যারো (The Fall of A Sparrow), প্রকৃতির স্নিগ্ধ পরশ বুলানো সুখপাঠ্য আত্মজীবনী। ঢাকাতেই পেয়েছিলাম অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসের ছাপা ইলাস্ট্রেটেড সংস্করণ, ভাষার সাথে সাথে আলাদা মজা জুগিয়েছিল অসাধারণ সব পাখির স্কেচ এবং অলঙ্করণ। 

মৃত্যু: 

পাখি নিয়ে কাজ করে তিনি তার জীবনে যত পুরস্কার লাভ করেছেন, সেগুলোতে প্রাপ্ত মোট অর্থ ১০ লক্ষ ডলারেরও বেশি! খ্যাতি আর বিত্তের সাথে নিজের কাজের প্রতি পরিপূর্ণ সন্তুষ্টি সাথে নিয়েই ১৯৮৭ সালের ২০ জুন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সলিম আলি। পক্ষীবিজ্ঞানের ইতিহাসে তিনি অমর হয়ে থাকবেন একজন পুরোধা হিসেবে।

What's Your Reaction?

Like Like 0
Dislike Dislike 0
Love Love 0
Funny Funny 0
Angry Angry 0
Sad Sad 0
Wow Wow 0