হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জীবনী / Muhammad Sallallahu Alaihi Wasallam
হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জীবনী

জন্ম : | ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে (আবাবীলের বছর) আরবের মক্কা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। |
ইন্তেকাল: | ৬২৫ খ্রি. ১২ রবিউল আউয়াল, ৬৩ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। |
সমাধিস্থল |
মসজিদে নববির, সবুজ গম্বুজের নিচের সমাধিক্ষেত্র, মদিনা, সৌদি আরব
২৪°২৮′০৩″ উত্তর ৩৯°৩৬′৪১″ পূর্ব |
ধর্ম |
ইসলাম |
---|---|
আদি নিবাস |
মক্কা |
দাম্পত্য সঙ্গী |
মুহাম্মাদের স্ত্রীগণ দেখুন |
সন্তান |
মুহাম্মাদের সন্তানগণ দেখুন |
পিতামাতা |
|
জাতিসত্তা |
আরব |
যে জন্য পরিচিত |
ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক |
জন্ম ও বংশপরিচয়
হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে (আবাবীলের বছর) আরবের মক্কা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আবদুল্লাহ এবং মাতার নাম আমিনা। তিনি কুরাইশ বংশের হাশিমি গোত্রের সদস্য ছিলেন। জন্মের আগেই তাঁর পিতা ইন্তেকাল করেন এবং মাত্র ছয় বছর বয়সে মাতাকেও হারান। এরপর দাদা আবদুল মুত্তালিব এবং পরে চাচা আবু তালিব তাঁর লালন-পালন করেন।
শৈশব ও যৌবন
ছোটবেলা থেকেই তিনি সততা, আমানতদারিতা ও সদাচরণের জন্য পরিচিত ছিলেন। তিনি ব্যবসা এবং চরিত্রের বিশুদ্ধতার জন্য "আল-আমিন" (বিশ্বাসী) ও "আস-সাদিক" (সত্যবাদী) উপাধি লাভ করেন। তিনি ব্যবসার কাজে সিরিয়া ভ্রমণ করেন এবং তাঁর সততার কারণে খদিজা (রা.) নামক এক ধনাঢ্য নারী তাঁর প্রতি মুগ্ধ হয়ে তাঁকে বিয়ে করেন।
প্রথম ওহি ও নবুয়তপ্রাপ্তি
৪০ বছর বয়সে হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন অবস্থায় জিবরাঈল (আ.) প্রথম ওহি নিয়ে আসেন, যা ছিল সূরা আলাকের প্রথম পাঁচ আয়াত। এরপর তিনি আল্লাহর নির্দেশে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। প্রথমে তাঁর পরিবার ও ঘনিষ্ঠজনরা ইসলাম গ্রহণ করেন। ধীরে ধীরে তাঁর দাওয়াত মক্কার মানুষের কাছে ছড়িয়ে পড়ে।
মক্কায় ইসলাম প্রচার ও প্রতিরোধ
মক্কার মুশরিকরা তাঁর দাওয়াত মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায় এবং তাঁকে কঠোরভাবে নির্যাতন করতে থাকে। মুসলমানরা নানা রকম অত্যাচারের শিকার হয়। এরপর তিনি ইসলামের প্রথম হিজরত করার নির্দেশ দেন, যেখানে কিছু সাহাবি আবিসিনিয়ায় (বর্তমান ইথিওপিয়া) আশ্রয় নেন।
মদিনায় হিজরত
৬২২ খ্রিস্টাব্দে আল্লাহর নির্দেশে তিনি মদিনায় হিজরত করেন। এই ঘটনাকে ইসলামের হিজরি সনের সূচনা ধরা হয়। মদিনায় গিয়ে তিনি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন এবং মুসলমানদের জন্য সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় নীতি প্রবর্তন করেন।
হাদিস
ইসলামি অনুশাসনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎস হলো হাদিস। এখানে নবি মুহাম্মাদের কথা, কাজ এবং অনুমোদিত রীতিনীতির বিবরণ সংরক্ষিত রয়েছে। সর্বপ্রথম সংকলিত হাদিসগ্রন্থ হলো মুয়াত্তা ইমাম মালিক, যার সংকলক ছিলেন মালিক ইবনে আনাস। এতে মুহাম্মাদের বাণী, সাহাবিদের মতামত এবং মদিনার প্রচলিত রেওয়ায়েত অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। মুয়াত্তা কেবল একটি হাদিসগ্রন্থ নয়; এটি সে যুগের ইসলামি বিধান ও সামাজিক রীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবেও বিবেচিত হয়।[৫০]
হাদিস সাহিত্যের মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ হলো সহিহ বুখারী। ইমাম বুখারী বহু বছর অনুসন্ধান ও যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে এই সংকলন সম্পাদন করেন। এতে কেবল সেই হাদিসগুলো অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, যেগুলোর সনদ শুদ্ধ এবং বর্ণনাকারীরা বিশ্বস্ত বলে স্বীকৃত। সহিহ বুখারীতে ইমান, নামাজ, রোজা, হজ, ব্যবসা-বাণিজ্য, নীতিশাস্ত্র এবং দৈনন্দিন জীবনের নানাবিধ বিষয়ে হাদিস লিপিবদ্ধ রয়েছে। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য হাদিসগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে সহিহ মুসলিম, সুনানে নাসাই, সুনানে আবু দাউদ, সুনানে তিরমিজি এবং সুনানে ইবনে মাজাহ। এই ছয়টি গ্রন্থ সম্মিলিতভাবে সিহাহ সিত্তাহ নামে পরিচিত এবং সুন্নি মুসলিমদের কাছে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য হাদিস সংকলন হিসেবে বিবেচিত হয়।
কিছু পশ্চিমা গবেষক হাদিসকে ঐতিহাসিক উৎস হিসেবে ব্যবহারে সতর্কতা অবলম্বন করেন। উইলফার্ড মেডেলুংয়ের মতো পণ্ডিতেরা হাদিস প্রত্যাখ্যান না করে বরং সেগুলোকে ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে মূল্যায়ন করেন। অন্যদিকে, মুসলিম পণ্ডিতেরা জীবনীগ্রন্থের তুলনায় হাদিসগ্রন্থকেই অধিক নির্ভরযোগ্য মনে করেন, কারণ হাদিসে পরম্পরাগত সনদ (ইসনাদ) ব্যবস্থার অনুসরণ করা হয়, যা জীবনীগ্রন্থে সাধারণত অনুপস্থিত।
মৌখিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য
মুহাম্মাদ ও তার সমসাময়িকদের জীবনের তথ্যের প্রধান উৎস হিসেবে হাদিস ও সিরাতকে গণ্য করা হয়। তবে লক্ষণীয় যে, এসব তথ্য মুহাম্মাদের মৃত্যুর ১৫০ থেকে ২০০ বছর পর লিখিত আকারে সংকলিত হয়। এর আগে, এসব ঘটনা মৌখিকভাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে প্রচলিত ছিল। এই দীর্ঘ সময় ধরে মৌখিক প্রচলনের ফলে হাদিস ও সিরাতে বর্ণিত ঘটনাগুলোর নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে ঐতিহাসিক ও গবেষকদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। বহু তথ্যই নিরপেক্ষ বহিঃসূত্র দ্বারা নিশ্চিত নয় এবং অনেক ক্ষেত্রে উৎসগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বিরোধও দেখা যায়। দীর্ঘ সময় ধরে মৌখিকভাবে প্রচারিত হওয়ার কারণে অনেক ঘটনা বিকৃত হয়েছে বা রূপান্তরিত হয়েছে। ফলে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম পেরিয়ে কিছু বিবরণ ইতিহাসের মূল সত্য থেকে অনেকটাই বিচ্যুত হয়ে পড়েছে। অনেক গবেষকের মতে, হাদিস ও সিরাতের মতো প্রাথমিক উৎসগুলোতে পরবর্তীকালে এমন কিছু কাহিনি সংযোজিত হয়েছে, যেগুলোর সঙ্গে মুহাম্মাদের জীবনের প্রত্যক্ষ সংযোগ নেই।
ধারণা করা হয়, এসব বিবরণ পরবর্তীকালের সামাজিক, রাজনৈতিক বা ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে যুক্ত করা হয়েছে, যা মূল ইতিহাসে বিকৃতি ঘটাতে পারে। ফিলিস্তিনি অধ্যাপক সামি আলদীব এই প্রসঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেছেন। তিনি উল্লেখ করেন, খায়বারের যুদ্ধ এবং বনু কুরাইজা গোত্রের অবরোধের মতো ঘটনাগুলো মুহাম্মাদের জীবনে সংঘটিত হয়েছে বলে দাবি করা হলেও, এই ধরনের বিবরণ ইহুদি ধর্মগ্রন্থেও বিদ্যমান। ঐসব গ্রন্থে বলা হয়েছে, ইহুদিরা এমন ব্যক্তিদের হত্যা করেছিল যারা ইহুদি সম্প্রদায়ভুক্ত ছিল না। আলদীবের বিশ্লেষণে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, এই ধরনের মিল ঘটনাগুলোর উৎস নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করে এবং এও বোঝায় যে, পরবর্তী সময়ে মুহাম্মাদের জীবনের বর্ণনায় পূর্ববর্তী ধর্মীয় কাহিনির ছাপ পড়তে পারে।
হাদিস ও সিরাতের মতো ঐতিহ্যবাহী রচনার বাইরে ইসলামের প্রাথমিক ইতিহাস, এর উত্থানের সময়কাল এবং ভৌগোলিক উৎপত্তি ও বিস্তারের স্থান নিয়ে গবেষকদের মধ্যে নানা মতপার্থক্য রয়েছে। প্রচলিত বর্ণনায় ইসলামের সূচনা মক্কাকেন্দ্রিক বলে ধরা হলেও, সাম্প্রতিক কিছু গবেষণায় বিকল্প ভৌগোলিক অবস্থানের কথা উঠে এসেছে, যার মধ্যে পেত্রা বিশেষভাবে আলোচিত। এই বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে পেত্রা, তার উত্তরাঞ্চল, কুফা এবং হিরা যা বর্তমান দক্ষিণ ইরাকে অবস্থিত অঞ্চল। বিভিন্ন উৎস যেমন বাইজেন্টাইন ইতিহাসলিপি, খ্রিস্টান ধর্মযাজকদের দলিল, প্রাচীন মুদ্রা, আব্বাসীয় যুগের হাদিস ও ঐতিহাসিক গ্রন্থ, হিরা ও মদিনার মতো পুরনো শহরের নাম, মুহাম্মাদ ও প্রাথমিক ইসলামের ভৌগোলিক অবস্থানকে দক্ষিণ ইরাকের সাথে সংযুক্ত করে। এছাড়াও, কিছু গবেষক মনে করেন যে, মুহাম্মাদের জীবনী একাধিক ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের জীবনের উপাদান একত্রে মিলিয়ে গঠিত হতে পারে।
প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার
ইসলামি বিশ্বে এমন কিছু নথিপত্র সংরক্ষিত রয়েছে, যা মুহাম্মাদের জীবনের বিবরণ তুলে ধরে এবং সময়ে সময়ে তা প্রকাশ ও প্রচার করা হয়। তবে এসব নথিপত্রের প্রামাণ্যতা এখনো বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত হয়নি। রেডিওকার্বন ডেটিং ও জি
নগত বংশতালিকা বিশ্লেষণের মতো পদ্ধতির মাধ্যমে এগুলোর প্রামাণ্যতা যাচাই করার প্রক্রিয়া এখনও সম্পন্ন হয়নি। এই নথিগুলোর মধ্যে রয়েছে "মদিনার সনদ", যা মুহাম্মাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক চুক্তির দলিল হিসেবে বিবেচিত; আশতীনামা, যা তার দ্বারা প্রদত্ত একটি সুরক্ষা-ঘোষণাপত্র হিসেবে গণ্য হয়; এবং এমন কিছু চিঠিপত্র, যা তার সময়কার বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধান ও গভর্নরদের উদ্দেশে পাঠানো হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। এছাড়াও মুহাম্মাদের চুল, দাড়ি, পরিধেয় জামা, জুতা ও অন্যান্য ব্যক্তিগত জিনিসপত্রকেও এসব ঐতিহাসিক দলিলের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
জিহাদ ও বিজয়
মদিনায় ইসলামিক সমাজ প্রতিষ্ঠার পর মক্কার কাফেরদের সঙ্গে একাধিক যুদ্ধ হয়, যেমন- বদর (৬২৪ খ্রি.), উহুদ (৬২৫ খ্রি.) ও খন্দক যুদ্ধ (৬২৭ খ্রি.)। শেষ পর্যন্ত ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে কোনো রক্তপাত ছাড়াই মহানবী (সা.) মক্কা বিজয় করেন এবং কাবা শরিফকে মূর্তিপূজার অপবিত্রতা থেকে মুক্ত করেন।
বিদায় হজ ও ইন্তেকাল
৬৩২ খ্রিস্টাব্দে তিনি বিদায় হজ পালন করেন এবং সেখানে ঐতিহাসিক বিদায় ভাষণ দেন। এই ভাষণে তিনি মানবাধিকার, নারীর অধিকার, সাম্যের শিক্ষা এবং ইসলামের মৌলিক নীতিগুলো ব্যাখ্যা করেন। একই বছরের ১২ রবিউল আউয়াল, ৬৩ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন।
উপসংহার
হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শুধু ইসলামের নবী নন, বরং তিনি মানবজাতির জন্য সর্বোত্তম আদর্শ। তাঁর জীবন আদর্শ সকল মানুষের জন্য অনুসরণীয়। তাঁর শিক্ষা ও দিকনির্দেশনা চিরন্তন সত্য এবং শান্তি, ন্যায়বিচার ও মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার শ্রেষ্ঠতম উপায়।
What's Your Reaction?






