শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন এর জীবনী | Biography of Shilpacharya Zainul Abedin

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন এর জীবনী | Biography of Shilpacharya Zainul Abedin

May 15, 2025 - 23:48
May 23, 2025 - 23:45
 0  3
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন এর জীবনী | Biography of Shilpacharya Zainul Abedin

জন্ম ২৯ ডিসেম্বর ১৯১৪
কিশোরগঞ্জ জেলা, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারত

মৃত্যু

২৮ মে ১৯৭৬ (বয়স ৬১)

জাতীয়তা

বাংলাদেশি
নাগরিকত্ব ব্রিটিশ ভারতীয় (১৯১৪-১৯৪৭)
পাকিস্তানি (১৯৪৭-১৯৭১)
বাংলাদেশি (১৯৭১-১৯৭৬)

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন

১৯১৪ সালে ২৯ ডিসেম্বর ময়মনসিংহ জেলায়  জন্মগ্রহণ করেন। জয়নুল আবেদীন এর বাল্যকাল কেটেছে ব্রহ্মপুত্রের লালিত্যে গড়ে ওঠা সবুজ শ্যামলিমায়।

জয়নুল তাঁর প্রথম জীবনেই নদী ও মুক্ত প্রকৃতির মাঝে রোমান্টিকতার অনুপ্রেরণা পান। তিনি ১৯৩৩ সালে কলকাতা সরকারি আর্ট স্কুলে যোগদান করেন পড়াশুনার  জন্য এবং পাঁচ বছর সেখানে ব্রিটিশ ও ইউরোপীয় স্টাইলের ওপর পড়াশুনা করেন। ১৯৩৮ সালে তিনি আর্ট স্কুল ব্যবস্থাপক পদে  যোগদান করেন  এবং তিনি তাঁর চিত্রাঙ্কন চালিয়ে যেতে থাকেন। ১৯৩৮ সালে সর্ব ভারতীয় চিত্রকলা প্রদর্শনীতে তাঁর অঙ্কিত জলরঙের ছবির জন্য তিনি স্বর্ণপদক অর্জন করেন । তাঁর অঙ্কনের মূল বিষয়বস্তু ছিল ব্রহ্মপুত্র নদ, যা ছিল তাঁর শিশুকাল অনুপ্রেরণার বিষয়। তার বিখ্যাত চিত্রকর্মের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো  দুর্ভিক্ষ-চিত্রমালা, সংগ্রাম, মই দেয়া, সাঁওতাল রমণী, ঝড়, কাক, বিদ্রোহী ইত্যাদি।

পারিবারিক জীবন
১৯৪৬ সালে জয়নুল আবেদিন ঢাকা মৃত তৈয়ব উদ্দিন আহমদের কন্যা জাহানারা বেগমের সাথে বিবাহ সম্পন্ন করেন। তিনি ৩ পুত্র সন্তানের জনক তার কোন মেয়ে সন্তান নাই। তার প্রথম পুত্র সাইফুল আবেদিন বাংলাদেশ এর একজন স্থপতি ছিলেন। বর্তমানে তিনি আমেরিকা প্রবাসী। দ্বিতীয় পুত্র খায়রুল আবেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূগোল বিষয় নিয়ে এমএ এবং কনিষ্ঠ পুত্র মঈনুল আবেদিন(মিতু) প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পানি-সম্পদ বিভাগ হতে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন।

শিক্ষাজীবন
যখন জয়নুলের বয়স মাত্র ষোল বছর, তিনি বন্ধুদের সাথে বাড়ি থেকে পালিয়ে কলকাতায় চলে যান শুধুমাত্র গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টস দেখার জন্য। সেখান থেকে ঘুরে আসার পর থেকে সাধারণ পড়াশোনায় জয়নুল আবেদিনের আর মন বসছিল না, সেই কারণে ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে মাধ্যমিক পরীক্ষার পূর্বেই স্কুলের পড়ালেখা ত্যাগ করে তিনি কলকাতায় চলে যান। মায়ের সমর্থনে সেখানকার গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টস-এ ভর্তি হন। জয়নুলের মা আঁকা শেখার প্রতি তাঁর গভীর আগ্রহ দেখে নিজের গলার হার বিক্রি করে তাঁকে কলকাতার আর্ট স্কুলে ভর্তি হতে সাহায্য করেন। জয়নুল ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কলকাতার সরকারি আর্ট স্কুলে অধ্যয়ন করেন। তিনি সেখানে পাঁচ বছর ইউরোপীয় একাডেমিক স্টাইল শিখেছিলেন । ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টসের ড্রইং অ্যান্ড পেইন্টিং বিভাগ থেকে স্নাতক স্তরে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকারী করেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৫১ সালে জয়নুল দুই বছরের জন্য স্লেড স্কুল অফ আর্ট-এ পড়াশুনা করার উদ্দেশ্যে লন্ডনে যান।

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন সংগ্রহশালা

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন বাংলাদেশের আধুনিক ও সমসাময়িক শিল্প আন্দোলনের পরিচালক ছিলেন। ময়মনসিংহ শহরের উত্তর পাশে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে একটি দোতলা ঘর বাড়া করে ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে এই সংগ্রহশালাটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ এপ্রিল বাংলা ১৩৮২ সালের ১লা বৈশাখ তারিখে সংগ্রহশালার উদ্বোধন করেন তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম । সে সময় দেশব্যাপী জয়নুল আবেদিনের বিভিন্ন শিল্পকর্ম রক্ষনাবেক্ষণের নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো। এজন্য শিল্পীর নিজের এলাকা অর্থ্যাৎ ময়মনসিংহে এই সংগহশালাটি প্রতিষ্ঠিত হয়। উদ্বোধনের পর সংগ্রহশালার আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৭৫ সালের ৭ জুলাই।

এই সংগ্রহশালায় প্রথমে স্থান পেয়েছিল ৭০ টি চিত্রকর্ম  যার বেশিরভাগই ছিল জলরঙের।

উল্লেখযোগ্য কিছু ছবি
উল্লেখযোগ্য কিছু ছবি ছিল সেখানে  যেগুলো হলো  – বিভিন্ন দেশ ভ্রমনকালে শিল্পাচার্যের অঙ্কিত ছবি, গুণটানা, নদী পারাপারের অপেক্ষায় পিতা-পুত্র এবং দুর্ভিক্ষ। সংগ্রহশালাটি ১৯৮২ সালে চুরি হয়ে ১৭ টি অতি আকর্ষণীয় ছবির খুঁজ পাওয়া যাচ্ছিল নাহ ,তবে ১০ টি ছবি ১৯৯৪ সালে আবার উদ্ধার করা হয়। বর্তমানে তাই সংগ্রহশালায় মোট ৬৩ টি চিত্রকর্ম রয়েছে এবং রয়েছে শিল্পাচার্যের ব্যবহৃত জিনিস এবং তার কিছু স্থিরচিত্র। স্থিরচিত্রগুলো ভবনের দোতলার বারান্দায় শোভা পায়।

কর্মজীবন

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ শাসনের সময় ভারতবর্ষ দুটি দেশের বিভক্ত হয় যথা ভারত ও পাকিস্তান। পূর্ববঙ্গ নতুন নাম লাভ করে পূর্ব পাকিস্তান যা পরবর্তীতে ১৯৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধে জয়লাভ করার পর বাংলাদেশ নামে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে। পূর্ববঙ্গের প্রথম প্রজন্মের শিল্পীদের প্রধান ব্যক্তিত্ব জয়নুল আবেদিন। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতবিভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে একটি চিত্রকলা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন অনুভুত করেন জয়নুল আবেদীন । নিজ উদ্যোগে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে পুরান ঢাকার জনসন রোডের ন্যাশনাল মেডিকেল স্কুলের একটি পুরাতন কক্ষে গভর্নমেন্ট আর্ট ইন্সটিটিউট স্থাপিত করেন। প্রথমে ১৮ জন ছাত্র নিয়ে যাত্রা শুরু করেন। জয়নুল আবেদিন ছিলেন এ প্রতিষ্ঠানের প্রথম শিক্ষক। ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে এই আর্ট ইন্সটিটিউট সেগুনবাগিচার একটি বাড়িতে স্থানান্তরিত হয়। ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে আর্ট ইন্সটিটিউটটি শাহবাগে স্থানান্তরিত হয়।

রচনা ও চিত্রকর্ম

কাঠকয়লা জ্বালিয়ে জয়নুল নিজেই নিজের কালি তৈরি করেন এবং সস্তা, সাধারণ প্যাকিং কাগজ ব্যবহার করেন। দুর্ভিক্ষের রেখাচিত্রের মধ্য দিয়ে জয়নুল রাস্তার পাশে মারা যাওয়া হতদরিদ্র মানুষের অসহায়ত্ব ও বঞ্চনা এবং অনাহারী লোকদের চিত্রিত করেছিলেন।  উক্ত স্কেচগুলি তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ। তিনি দুর্ভিক্ষের ভয়ঙ্কর চেহারা প্রকাশ করেছিলেন অনাহারে মারা যাওয়া মানুষের কঙ্কালের চিত্রের মাধ্যমে। জয়নুল আবেদিন ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে সৃষ্ট এই দুর্ভিক্ষ চিত্রমালার মাধ্যমে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন। এ ছাড়াও তাঁর বিখ্যাত শিল্পকর্মগুলো হল: ১৯৫৭ সালের নৌকা, ১৯৫৯ সালের সংগ্রাম, ১৯৭১ সালের বীর মুক্তিযোদ্ধা, ম্যাডোনা প্রভৃ‌তি উল্লেখযোগ্য। তাঁর দীর্ঘ দুটি স্ক্রল ১৯৬৯ সালে অঙ্কিত ‘নবান্ন’ এবং ১৯৭৪ সালে অঙ্কিত ‘মনপুরা-৭০’ জননন্দিত দুই শিল্পকর্ম। চিত্রাঙ্কনের চেয়ে চিত্রশিক্ষা প্রসারের ওপর বেশি সময় ব্যয় করেছেন তিনি। তাঁর চিত্রকর্মের সংখ্যা আনুমানিক তিন হাজারের বেশি।

স্বীকৃতি লাভ

১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে এটি একটি প্রথম শ্রেণির সরকারি কলেজ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে এবং এর নাম হয় পূর্ব পাকিস্তান চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়। ১৯৭১-এ বাংলাদেশের অভ্যূদয়ের পর একই প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘বাংলাদেশ চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়’।চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, জয়নুল আবেদীন ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দ।

সম্মাননা

পূর্ববঙ্গে তথা বাংলাদেশে চিত্রশিল্প বিষয়ক শিক্ষার প্রসারের আমৃত্যু প্রচেষ্টার চালিয়ে যান ,যার ফলশ্রুতিতে জনসাধারণ্যে তিনি শিল্পাচার্য উপাধি লাভ করেন। বাংলাদেশের চিত্রকরদের মধ্যে তিনি শিল্পগুরু হিসেবে পরিচিত। তার নামে বাংলাদেশ চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয় এ চারুকলা অনুষদে একটি গ্যালারি রয়েছে। ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের ৩৫ সংখ্যক গ্যালারীটিতে শিল্পচার্য জয়নুল আবেদিন চিত্রশালা হিসাবে সজ্জিত করে।


১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের ছবি চিত্রমালার জন্য তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। তার চিত্রকর্মের মধ্যে অন্যতম ১৯৫৭-এ নৌকা, ১৯৫৯-এ সংগ্রাম, ১৯৭১-এ বীর মুক্তিযোদ্ধা, ম্যাডোনা। তার দীর্ঘ দুটি স্ক্রল ১৯৬৯-এ অংকিত ‘নবান্ন’ এবং ১৯৭৪-এ অংকিত ‘মনপুরা-৭০’ জননন্দিত দুটি শিল্পকর্ম। অনুমান করা হয় তার চিত্রকর্ম তিন হাজারেরও বেশি।

ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন কর্তৃক ৯ জুলাই, ২০০৯ বুধ গ্রহের একটি জ্বালামুখ তার মানবসভ্যতায় মানবিক মূল্যবোধ ও উপলদ্ধিকে গভীরতর করার প্রেক্ষিতে আবেদিন জ্বালামুখ নামে নামকরণ করা হয়। তার জন্মদিন উপলক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে উৎসব হয় ও শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালায় (আর্ট গ্যালারি) শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়।


মৃত্যু

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে পুনরুজীবিত করার আন্দোলনে নিজেকে সংক্রিয়ভাবে জড়িত করেন। তিনি পূর্বে ধারণা করেছিলেন যে, ইউরোপীয় বা আমেরিকা কিছু  কৌশল ও রীতির প্রভাব, যা এখানকার কিছু চিত্রশিল্পীকে অনুপ্রাণিত করেছিল, যা দেশিয় রীতিকে ধ্বংস করবে। কিন্তু ফুসফুসে ক্যান্সারের কারণে তিনি তাঁর কাজ সম্পন্ন করতে পারেন নি। তাঁর স্বাস্থ্য দ্রুত ভেঙ্গে পড়তে শুরু করে। ১৯৭৬ সালের ২৮ মে ঢাকায় তাঁর মৃত্যু হয়।

What's Your Reaction?

Like Like 0
Dislike Dislike 0
Love Love 0
Funny Funny 0
Angry Angry 0
Sad Sad 0
Wow Wow 0