ইমাম বুখারী (রঃ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী নাম, জন্ম ও বংশ পরিচয় | Biography of Imam Bukhari
ইমাম বুখারী (রঃ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী নাম, জন্ম ও বংশ পরিচয় | Biography of Imam Bukhari

ইমাম বুখারী (রঃ)
নামঃ মুহাম্মাদ ইবনে ইসমাইল। কুনিয়াতঃ আবূ আবদুল্লাহ। লকবঃ শায়খুল ইসলাম ও আমীরুল মু’ মিনীন ফীল হাদিস।
বংশ পরিচয়ঃ
ইমাম বুখারীর প্রপিতামহও মুগীরা এবং পিতামহ ইবরাহীম সম্বন্ধে ইতিহাসে বিশেষ কোন তথ্য পাওয়া যায় না। অবশ্য জানা যায় যে, তার পিতা ইসমা’ঈল (রঃ) একজন মুহাদ্দিস ও বুজুর্গ ব্যাক্তি ছিলেন। ইমামা মালিক, হাম্মাদ ইবন যায়েদ ও আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারাক (রঃ) প্রমূখ প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিসের কাছে তিনি হাদিস শিক্ষা লাভ করেন। তিনি জীবনে কখনো হারাম বা সন্দেহজনক অর্থ উপার্জন করেননি। তার জীবিকা নির্বাহের উপায় ছিল ব্যবসাবাণিজ্য। তার আর্থিক অবস্থা ছিল সচ্ছল।
ইমাম বুখারী (রঃ)-এর শিশু কাল :
ইমাম বুখারী (রঃ)-এর শিশু কালেই পিতা ইসমাইল (রঃ)ইনতিকাল করেন। তার মাতা ছিলেন পরহেজগার ও বুদ্ধিমতী। স্বামীর রেখে যাওয়া বিরাট ধনসম্পত্তির দ্বারা তিনি তার দুই পুত্র আহামদ ও মুহাম্মাদকে লালন-পালন করতে থাকেন। শৈশবে রোগে আক্রান্ত হলে মুহাম্মাদের চোখ নষ্ট হয়ে যায়, অনেক চিকিৎসা করে ও যখন তার দৃষ্টিশক্তি কিছুতেই ফিরে এল না, তখন তার মা আল্লাহ্র দরবারে খুব কান্নাকতি র দু’আ করতে থাকেন। সপ্নেই তিনি জানতে পারলেন সেই বুযুর্গ হজরত ইব্রাহীম (আঃ)। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখতে পেলেন যে, সত্যিই তার পুত্রের চোখের দৃষ্টিশক্তি ফিরে এসেছে। বিস্ময় আর আনন্দে তিনি আল্লাহ্র দরবারে দু’রাকাত শোকরানা সালাত আদায় করেন।
জন্ম |
19 জুলাই 810 13 শাওয়াল 194 হিজরী |
ধর্ম | ইসলাম |
মৃত্যু |
1 সেপ্টেম্বর 870 1 শাওয়াল 256 হিজরী |
ইমাম বুখারীর স্মরণ শক্তির প্রখরতা:
ষোল বছর বয়সে ইমাম বুখারী (রঃ) বুখারা ও তার আশপাশের শহরের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিসগণ থেকে বর্ণিত প্রায় সকল হাদীস মুখস্থ করে নেন। সেই সাথে মুসলিম বিশ্বের খ্যাতিমান মুহাদ্দিস আবদুল্লাহ ইবনুল-মুবারক ও ওয়াকী ইবনুল-জাররাহ (রঃ)-এর সংকলিত হাদীস গ্রন্থসমূহ মুখস্থ করে ফেলেন। এরপর তিনি মা ও বড় ভাই আহম্মদের সাথে হজ্জে গমন করেন। এই সময় তিনি ‘কাযায়াস-সাহাবা ওয়াত-তাবিঈন’ শীর্ষক তাঁর প্রথম গ্রন্থ রচনা করেন। এরপর মদীনায় অবস্থানকালে চাঁদের আলোতে ‘তারীখে কবীর’ লিখে।
ইমাম বুখারী (রঃ) বলেনঃ আমার অন্তরে এক লক্ষ সহীহ হাদীছ ও দুই লক্ষ যঈফ হাদীছ মুখস্ত রয়েছে। মুহাদ্দিছ ইবনে খুযায়মা (রঃ) বলেনঃ পৃথিবীতে ইমাম বুখারী অপেক্ষা অধিক অভিজ্ঞ এবং হাদীছের হাফেয আর কেউ জন্ম গ্রহণ করে নি। কেউ কেউ বলেনঃ খোরাসানের যমীনে ইমাম বুখারীর মত আর কেউ জন্ম গ্রহণ করেন নি।
। তখন তিনি দশ বছর বয়সের কিশোর। এ সময় তদানিন্তন শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিছ ইমাম দাখিলীর ক্লাশে হাদীছের পাঠ গ্রহণ করছিলেন। মুহাদ্দিছ দাখিলী এই সনদে একটি হাদীছ উপস্থাপন করলেনঃ
“সুফিয়ান বর্ণনা করেন আবুয্ যুবাইর হতে আর আবুয যুবাইর বর্ণনা করেন ইবরাহীম হতে”। বালক বুখারী প্রতিবাদ করে বললেনঃ আবুয যুবাইর ইবরাহীম হতে হাদীছটি বর্ণনা করেন নি। মুহাদ্দিছ দাখিলী তাঁকে ধমক দিয়ে বললেও তিনি দৃঢ় চিত্তে এবং সবিনয়ে আরজ করলেনঃ আপনি দয়া করে একবার আপনার মূল কিতাবের সাথে মিলিয়ে দেখুন। তিনি মূল কিতাব দেখে ইমাম বুখারীকে লক্ষ্য করে বললেনঃ তোমার কথাই ঠিক। তখন মুহাদ্দিছ দাখিলী তার জন্য প্রাণ খুলে দুআ করলেন
ইমাম বুখারীর উস্তাদ ও ছাত্রগণ:
ইমাম বুখারী (রঃ) থেকে অসংখ্য মুহাদ্দিছ সহীহ বুখারী বর্ণনা করেছেন। খতীব বাগদাদী (রঃ) বুখারীর অন্যতম রাবী ফিরাবরির বরাত দিয়ে বলেন যে, তার সাথে প্রায় সত্তর হাজার লোক ইমাম বুখারী থেকে সরাসরি সহীহ বুখারী পড়েছেন। তাদের মধ্যে আমি ছাড়া আর কেউ বর্তমানে জীবিত নেই। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে রয়েছেন ইমাম মুসলিম, ইমাম তিরমিজী, ইমাম নাসাঈ। প্রতিবারই তিনি ইমাম আহমাদ বিন হাম্বালের সাথে দেখা করেছেন। প্রত্যেক সাক্ষাতের সময়ই ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল (রঃ) তাঁকে খোরাসান ছেড়ে দিয়ে বাগদাদে স্থায়ীভাবে বসবাস করার প্রতি উৎসাহ দিয়েছেন।
সহীহ বুখারী রচনায় ইমাম বুখারীর শর্ত ও সতর্কতা:
ইমাম বুখারী তাঁর কিতাবে কেবল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত সহীহ হাদীছগুলোই বর্ণনা করেছেন। কোন হাদীছকে সহীহ হিসেবে সাব্যস্ত করার জন্য এবং তা সহীহ বুখারীতে লিপিবদ্ধ করার জন্য তিনি সুস্পষ্ট করে কোন শর্তের কথা উল্লেখ না করলেও আলেমগণ তাঁর কাজের মূল্যায়ন করে নিম্নলিখিত শর্তগুলো বের করেছেন:
1) রাবী ছিকাহ তথা নির্ভরযোগ্য হতে হবে।
2) বর্ণনাকারীকে ন্যায়পরায়ন অর্থাৎ মানুষের সাথে কথা-বার্তায় ও লেনদেনে সত্যবাদী হতে হবে।
3) রাবী (বর্ণনাকারী) পূর্ণ ম্মরণশক্তি সম্পন্ন হওয়া।
4) হাদীছের সনদ মুত্তাসিল হওয়া। অর্থাৎ মাঝখান থেকে কোন রাবী বাদ না পড়া।
কোন হাদীছে উপরোক্ত শর্তগুলো পাওয়া গেলেই ইমাম বুখারী স্বীয় কিতাবে তা লিখে ফেলেন নি। তাঁর অন্তরে যদি হাদীছটি সম্পর্কে কোন প্রকার সন্দেহ জাগতো তাহলে সে হাদীছটি শর্ত মোতাবেক সহীহ হওয়া সত্ত্বেও তিনি সহীহ বুখারীতে লিখতেন না। এইভাবে মসজিদে নববীতে বসে তিনি তা লিখা শুরু করেন এবং একটানা ১৬ বছর এই কাজে দিন-রাত পরিশ্রম করেন। তাদের পরে এই উম্মাত আল্লাহ্ তাআলার কিতাবের পরই এটিকে সর্বাধিক সহীহ বলে গণ্য করেছেন।
ইমাম বুখারীর দানশীলতা ও উদারতা:
ইমাম বুখারী প্রচুর ধন-সম্পদের মালিক ছিলেন। মুহাম্মাদ বিন আবু হাতিম বলেনঃ ইমাম বুখারীর এক খণ্ড যমীন ছিল। এ থেকে তিনি প্রতি বছর সাত লক্ষ দিরহাম ভাড়া পেতেন। এই বিশাল অর্থ থেকে তিনি খুব সামান্যই নিজের ব্যক্তিগত কাজে খরচ করতেন। সামান্য খরচের পর যে বিশাল অর্থ অবশিষ্ট থাকতো তার পুরোটাই ইলম অর্জনের পথে খরচ করতেন এবং অভাবীদের অভাব পূরণে ব্যয় করতেন। তিনি সব সময় দীনার ও দিরহামের একটি থলে সাথে রাখতেন। মুহাদ্দিছদের মধ্যে যারা অভাবী ছিলেন তাদেরকেও তিনি প্রচুর পরিমাণ দান করতেন।
আলেমদের মূল্যায়নে সহীহ বুখারী:
সংক্ষিপ্তভাবে কিতাবটি সহীহ বুখারী হিসাবে প্রসিদ্ধি অর্জন করলেও এর পূর্ণ নাম হচ্ছে : আল জামেউস সহীহহুল মুসনাদু মিন উমরি রাসূলিল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওয়া সুনানিহি ওয়া আইয়্যামিহি”। উপরে বলা হয়েছে যে, প্রায় সত্তর হাজার লোক ইমাম বুখারীর নিকট হতে এই কিতাবটি শ্রবণ করেছেন। এ যাবৎ সহীহ বুখারীর যতগুলো ব্যাখ্যা গ্রন্থ বের হয়েছে, হাদীছের অন্য কোন কিতাবের এত বেশী সংখ্যক ব্যাখ্যা গ্রন্থ বের হয়নি। এই ব্যাখ্যা গ্রন্থগুলোর মধ্যে আল্লামা হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী কর্তৃক রচিত ‘ফতহুল বারী’ সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান দখল করে আছে। কেউ কেউ সহীহ বুখারীর উপর লিখিত ব্যাখ্যা গ্রন্থ শতাধিক বলে মন্তব্য করেছেন।
তাঁর এবাদত-বন্দেগী ও তাকওয়ার কিছু বিবরণ:
হাদীছ চর্চায় সদা ব্যস্ত থাকলেও এবাদত বন্দেগীতে তিনি মোটেও পিছিয়ে ছিলেন না। মুহাম্মাদ বিন আবু হাতিম আল ওয়াররাক বলেনঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নাত মোতাবেক তিনি শেষ রাতে তের রাকআত তাহাজ্জুদ নামায পড়তেন। আমি বলতামঃ আপনি আমাকে ঘুম থেকে কখনই জগ্রত না করার কারণ কী? উত্তরে ইমাম বুখারী বলতেনঃ তুমি যুবক। আমি তোমার ঘুমকে নষ্ট করতে চাইনা।
সহীহ বুখারী ছাড়াও ইমাম বুখারীর আরও কয়েকটি কিতাব:
সহীহ বুখারী ছাড়াও তিনি আরও কয়েকটি মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন। তার মধ্যে রয়েছে-
১) আল আদাবুল মুফরাদ। (বাংলায় অনুবাদ হয়েছে)
২) তারীখুল কাবীর। এতে তিনি হাদীছের রাবীদের (বর্ণনাকারীদের) জীবনী সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।
৩) তারীখুস সাগীর। এতে তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর সাহাবীসহ বেশ কিছু রাবীর জীবনী উল্লেখ করেছেন।
৪) খালকু আফআলিল ইবাদ। এতে তিনি মুতাজেলাদের একটি ভ্রান্ত মতবাদের প্রতিবাদ করেছেন।
মৃত্যু
জীবনকালের শেষদিকে একবার বুখারার তৎকালীন শাসনকর্তা "খালিদ বিন আহমাদ যুহলী" হাদীসশাস্ত্রে ইমাম বুখারীর পান্ডিত্য দেখে তাকে দরবারে এসে শাসনকর্তার সন্তানদেরকে হাদীস শেখাতে বলেন। তখন তিনি মাতৃভূমি বুখারা ত্যাগ করে সমরকন্দের খরতঙ্গে চলে যান এবং সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ২৫৬ হিজরীর, ১লা শাওয়াল মোতাবেক ৩১শে আগস্ট, ৮৭০ খ্রিষ্টাব্দের শুক্রবার দিবাগত রাতে মৃত্যুবরণ করেন। পরদিন শনিবার যোহরের নামাজের পর খরতঙ্গেই তাকে সমাধিস্থ করা হয়।
What's Your Reaction?






