আভেরোস এর জীবনী | Biography of Averroes
আভেরোস এর জীবনী | Biography of Averroes

জন্ম |
১৪ এপ্রিল ১১২৬ কর্দোবা, আন্দালুস, আলমুরাবিতুন খিলাফত (বর্তমানে স্পেন)[১][২][৩]
|
---|---|
মৃত্যু |
ডিসেম্বর ১০, ১১৯৮ (বয়স ৭২) মারাক্কেশ, আলমোহাদ খিলাফত, বর্তমানে মরক্কো
|
যুগ |
মধ্যযুগীয় দর্শন (ইসলামী স্বর্ণযুগ) |
অঞ্চল |
উত্তর আফ্রিকা/স্পেন |
ধারা |
ইবনে রুশদবাদ |
প্রধান আগ্রহ
|
ইসলামী ধর্মতত্ত্ব, দর্শন, গণিত, চিকিৎসাবিজ্ঞান, পদার্থবিদ্যা, জ্যোতির্বিজ্ঞান |
উল্লেখযোগ্য অবদান
|
ইসলামের সাথে দর্শনের সামঞ্জস্যবিধান |
স্পেনের হারিয়ে যাওয়া মুসলিম সাম্রাজ্য
আবুল ওয়ালিদ মুহাম্মাদ ইবন আহমাদ ইবন রুশদ
(আরবি: أبو الوليد محمد ابن احمد ابن رشد, ১৪ এপ্রিল ১১২৬- ১১ ডিসেম্বর, ১১৯৮) বা সংক্ষেপে ইবনে রুশদ হলেন একজন মুসলিম আন্দালুসীয় বহুবিদ্যাবিশারদ এবং আইনবিদ যিনি দর্শন ধর্মতত্ত্ব চিকিৎসাবিজ্ঞান জ্যোতির্বিজ্ঞান পদার্থবিজ্ঞান মনোবিজ্ঞান গণিত ইসলামি আইনশাস্ত্র এবং ভাষাবিজ্ঞানসহ বহু বিষয়ে লিখেছেন।তিনি শতাধিক বই এবং গবেষণাপত্রের রচয়িতা। তার দর্শন সংক্রান্ত কাজের মধ্যে আছে অ্যারিস্টটলের উপর বেশ কিছু ব্যাখ্যাগ্রন্থ, যে কারণে তিনি পাশ্চাত্যে ব্যাখ্যাদাতা(The Commentator) এবং যুক্তিবাদের জনক হিসেবে পরিচিত। ইবন রুশদ আলমোহাদ খেলাফতের রাজসভার চিকিৎসক এবং প্রধান বিচারপতির দায়িত্বে বহুদিন কাজ করেছেন।
তিনি কর্ডোবায় এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে ১১২৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার পরিবারের প্রধান পেশা ছিলো বিচারকার্য—তার পিতামহ ছিলেন শহরের প্রধান বিচারপতি.১১৬৯ সালে তাকে খলিফা আবু ইয়াকুব ইউসুফের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়, যিনি ইবন রুশদের প্রতিভায় বিমোহিত হন। তিনি তার পৃষ্ঠপোষক হিসেবে নিয়োজিত হন এবং ইবন রুশদের বিভিন্ন গবেষণা কর্মে সাহায্য করেন। ইবন রুশদ পরবর্তীকালে সেভিল এবং কর্ডোবায় বেশ কয়েকবার প্রধান বিচারপতির পদে দায়িত্ব পালন করেন।
১১৮২ সালে তিনি রাজ চিকিৎসক এবং কর্ডোবার প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিযুক্ত হন।.১১৮৪ সালে আবু ইউসুফের মৃত্যুর পরেও তার রাজসভার সুদৃষ্টি বজায় থাকে, তবে ১১৯৫ সালে তিনি রাজসভার রোষে পতিত হন। তার প্রতি বেশ কিছু অভিযোগ ছিলো—খুব সম্ভবত এর নেপথ্যে রাজনৈতিক স্বার্থ জড়িত ছিলো—এবং এ কারণে তাঁকে নির্বাসনে পাঠানো হয়।.১১৯৮ সালে, তার মৃত্যুর কিছু দিন পূর্বেই তাঁকে আবার সসম্মানে রাজসভায় ফিরিয়ে আনা হয়।
ইবন রুশদ অ্যারিস্টললের মতাদর্শের এক উৎসাহী সমর্থক ছিলেন; তিনি অ্যারিস্টটলের মূল শিক্ষা পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রয়াস করেছিলেন। এবং পূর্ববর্তী মুসলিম চিন্তানায়কদের যেমন আল-ফারাবি, ইবন সিনা প্রমুখদের নিওপ্লাটোনিস্ট প্রবণতার বিরোধী ছিলেন । তিনি আল গাযালির মতো আশ'আরি ধর্মতত্ত্ববিদগণের সমালোচনার বিরুদ্ধে গিয়ে দর্শনের চর্চার সমর্থন করেন। ইবন রুশদ বলেন যে, দর্শনের চর্চা ইসলামের মধ্যে পরিপূর্ণভাবে অনুমোদিত এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক। তিনি আরো বলেন যে ধর্মীয় অনুষঙ্গের কোনো দিক যখন যুক্তি এবং দর্শনের স্পষ্ট বিরোধী হিসেবে প্রতিভাত হবে তখন তা আক্ষরিকভাবে গ্রহণ না করে রূপকার্থে নিতে হবে।
তিনি ইসলামি আইনশাস্ত্র সম্পর্কে বিদআত আল-মুজতাহিদ লিখেছেন, যা বিভিন্ন মাযহাবের আইনের মধ্যে ভিন্নতা এবং এর নীতি সম্পর্কে আলোচনা করে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে তিনি স্ট্রোকের নতুন তত্ত্ব প্রদান করেন এবং প্রথমবারের মতো পারকিনসন রোগের বর্ণনা দেন। সম্ভবত তিনিই প্রথম ছিলেন যিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে রেটিনা হচ্ছে আলোক্সংবেদনশীলতার প্রকৃত স্থান। তার চিকিতসাবিজ্ঞানের বই আল-কুল্লিয়াত ফি আল-তিব্ব, যা ল্যাটনে কলিজেট (The Colliget) শিরোনামে অনূদিত হয়েছিলো এবং কয়েক শতক ধরে ইউরোপে শিক্ষামূলক কাজে ব্যবহৃত হয়েছিলো।
তার প্রভাব সুদূরপ্রসারী হয়েছে তার অবস্থানগত, বুদ্ধিবৃত্তিক এবং ভৌগোলিক কারণে। পাশ্চাত্যে ইবন রুশদের পরিচিতির কারণ তার অ্যারিস্টটলের উপর কাজ, যার সিঙ্ঘভাগ পরবর্তীকালে ল্যাটিন এবং হিবরু ভাষায় অনুদিত হয়েছিল। তার অনুবাদকৃত এসব কর্ম পাশ্চাত্যে গ্রিক দর্শন এর উৎসাহ পুনঃজাগরণে ভূমিকা রেখেছিলো, যা রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর ইউরোপে জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চার যে বন্ধ্যাকাল ছিলো তা দূরীভূত করে। তার এসব লেখা ল্যাটিন খ্রিষ্টান সমাজে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা ও বিতর্কের জন্ম দেয়, আভিরোসবাদ(Averroism) নামে এক দার্শনিক আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটায়। তার জ্ঞানের একতা তত্ত্ব, যা প্রতিটি মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক অভিন্নতা দাবি করে থাকে,ইউরোপে অন্যতম বিতর্কিত এক তত্ত্বে পরিণত হয় । ক্যাথলিক চার্চ তার মতবাদ সমূহের বিপক্ষে তীব্র ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। থমাস অ্যাকুইনাসের পরবর্তী সমালোচনায় এ মতবাদ ইউরোপে তার প্রভাব হারাতে থাকে।
জীবনী
শৈশব ও শিক্ষাজীবন
মুহম্মদ ইবন আহমাদ ইবন রুশদ ১৪ এপ্রিল, ১১২৬ সালে(৫২০ হিজরী) স্পেনের কর্ডোবায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পরিবার শহরের লোকপ্রসাশন সংক্রান্ত কাজ, বিশেষত বিচার ও ধর্মীয় বিষয়ে জড়িত থাকার কারণে সুপরিচিত ছিলো। তার পিতামহ আবুল ওয়ালিদ মুহম্মদ (মৃত্যুঃ১১২৬)আল মোরাভি কর্ডোবার প্রধান বিচারপতি(কাজি) একর্ডোবার কেন্দ্রীয় মসজিদের ইমাম ছিলেন।তার পিতা আবুল কাসিমও পরবর্তীকালে কর্ডোবার প্রধান বিচারপতি ছিলেন,১১৪৬ সালে আল-মোহাদ রাজবংশ আল-মোরাভিদের স্থলাভিষিক্ত হলে তাকে পদচ্যুত করা হয়।
তার জীবনীকারদের মতে ইবন রুশদের শিক্ষাজীবন ছিলো অনন্যসাধারণ। হাদিসশাস্ত্র(নবী মুহম্মদ সা. এর আদর্শ) হতে শুরু করে, ফিকহ(ইসলামী বিচারব্যবস্থা), চিকিৎসাবিজ্ঞান এবং ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা নিয়েছিলেন।তিনি মালিকি ফিকহ শিখেছিলেন আল-হাফিজ আবু মুহম্মদ ইবন রিযক এর কাছে, হাদিসশাস্ত্রের পাঠ নিয়েছেন তার পিতামহের এক শিষ্যের কাছে। তার পিতামহও তাকে ফিকহ এর জ্ঞান দিয়েছিলেন, বিশেষ করে ইমাম মালিকের সর্বশ্রেষ্ঠ কর্ম মুয়াত্তার পাঠ দিয়েছিলেন। তিনি আবু-জা'ফর জারিম আল-তাজাইল এর নিকট চিকিৎসার জ্ঞান লাভ করেন, যিনি সম্ভবত তাঁকে দর্শন এর দীক্ষাও দিয়েছেন। তিনি দার্শনিক ইবন বাজা এর লেখনীর সম্পর্কেও অবগত ছিলেন, খুব সম্ভবত তার সাথে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত ছিলেন অথবা তার ছাত্রত্বেও থেকে থাকতে পারেন। তিনি নিয়মিতই সেভিল এ অনুষ্ঠিত দার্শনিক, চিকিৎসাবিদ ও কবিদের সভায় উপস্থিত থাকতেন, এ সভা সেসময়কার বিখ্যাত দার্শনিক ইবন তুফায়েল ও চিকিৎসাবিদ ইবন যুহর অংশগ্রহণ করতেন। তিনি আশ'আরী মতের কালাম ধর্মতত্ত্ব পড়েছিলেন, যার সমালোচক হিসেবে পরবর্তী জীবনে তিনি অবতীর্ণ হন।
কর্মজীবন
আল-মোহাদ খেলাফতের বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক কাজে ইবন রুশদ অংশগ্রহণ করেছিলেন। খেলাফতের বিভিন্ন সময়কার সীমানার চিত্র এখানে প্রদর্শিত।
১১৫৩ সাল নাগাদ ইবন রুশদ আল-মোহাদ খেলাফতের রাজধানী মারাক্কেশ এ অবস্থান করছিলেন। কারণ নব্য প্রতিষ্ঠিত খেলাফতের নতুন কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ও মসজিদ নির্মাণ কাজে কিছু জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত হিসাব নিকাশে তার কাজ করতে হচ্ছিলো। তিনি জ্যোতির্বিদ্যার সমসাময়িক গাণিতিক নিয়ম গুলো নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না , তাই নতুন কিছু ভৌত সূত্র এর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। তবে তার এ প্রচেষ্টা তখন ব্যর্থ হয়। সম্ভবত মারাক্কেশে অবস্থানকালীন সময়ে তিনি বিখ্যাত দার্শনিক ও হায়্যি ইবন ইয়াকযান এর রচয়িতা ইবন তুফায়েল এর সাথে দেখা হয়েছিলো। ইবন তুফায়েলও তখন মারাক্কেশে রাজসভার চিকিৎসক ছিলেন। তাঁদের দুজনার মতভিন্নতা থাকলেও তারা একে অপরকে বন্ধুত্বে বরণ করেছিলেন।
১১৬৯ সালে ইবন তুফায়েল ইবন রুশদকে আল-মোহাদ খলিফা আবু ইয়াকুব ইউসুফের সাথে পরিচয় করান। ঐতিহাসিক আবদুল ওয়াহিদ আল-মারাকুশির এক জনপ্রিয় বর্ণনায় বর্ণিত আছে যে খলিফা ইবন রুশদকে জিজ্ঞাসা করেন যে মহাবিশ্ব কি চিরকাল ধরে বিরাজমান নাকি এর কোনো শুরু ছিলো। এ মতবিরোধপূর্ণ প্রশ্নে ইবন রুশদ উত্তর দিতে দ্বিধাগ্রস্ত হন। খলিফা তখন প্লেটো, অ্যারিস্টটল এবং মুসলিম দার্শনিকদের এ বিষয়ে মতামতের বর্ণনা করলেন এবং ইবন তুফায়েলের সাথে আলোচনায় মগ্ন হলেন। খলিফার জ্ঞানের এ প্রদর্শনীতে ইবন রুশদ আশ্বস্ত হলেন, ইবন রুশদ এ বিষয়ে তার মতামত ব্যক্ত করলেন; এতে খলিফা ইবন রুশদের উপর যারপরনাই সন্তুষ্ট হলেন। ইবন রুশদ ও ঠিক একইভাবে খলিফার পাণ্ডিত্যে অবাক হয়েছিলেন, বলেছিলেন "খলিফার জ্ঞানের আধিক্য এমন যে তা আশাতীত ছিলো তার নিজের কাছে"।
ইবন রুশদ এবং খলিফার পরিচিত হবার পরে ,১১৮৪ সালে খলিফার মৃত্যু পর্যন্ত তার একান্ত প্রিয় ছিলেন। খলিফা যখন ইবন তুফায়েলের নিকট ক্ষোভ প্রকাশ করলেন যে তিনি অ্যারিস্টটলের কিছু কাজ বুঝতে পারছেন না, তখন ইবন তুফায়েল খলিফাকে ইবন রুশদের অ্যারিস্টটলের ব্যাখ্যা সম্বন্ধে অবহিত করেন।সেই থেকে ইবন রুশদের বিখ্যাত কাজ, অ্যারিস্টটলের উপর সুবিস্তার ব্যাখাকর্মের সূচনা। এ বিষয়ে তার প্রথম লেখা লিখিত হয়েছে ১১৬৯ সালে।
সেই বছরই ইবন রুশদ কাজি হিসেবে সেভিলে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। ১১৭১ সালে তিনি তার জন্মস্থান কর্ডোবায় কাজি হিসেবে নিয়োজিত হন। কাজি হিসেবে তিনি ইসলামি শরিয়াহ (আইনশাস্ত্র) মোতাবেক মামলা মোকদ্দমার বিচারকার্য পরিচালনা ও ফতোয়া(আইনানুগ সমাধান) দিতেন। এসময় নানা দায়িত্ব ও প্রসাশনিক কাজে ব্যপৃত থাকলেও এটা ছিল তার জ্ঞান চর্চার শীর্ষ সময়, অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ তিনি এসময় সম্পন্ন করেন। আল-মোহাদ খেলাফতের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণের সুবাদে তিনি নানা জ্যোতির্বিদীয় প্রকল্পেও অংশগ্রহণের সুযোগ লাভ করেন.১১৮২ সালে তিনি রাজ চিকিৎসক হিসেবে তার বন্ধুবর দার্শনিক ইবন তুফায়েলের স্থলাভিষিক্ত হন, একই বছর তিনি কর্ডোবার প্রধান কাজি হিসেবে নিয়োজিত হন; সেই একই মর্যাদাপূর্ণ পদে যাতে এককালে তার পিতামহ দায়িত্ব পালন করে গেছেন।
১১৮৪ সালে খলিফা আবু ইয়াকুব ইউসুফ মৃত্যুবরণ করেন, খলিফার পদে অভিষেক ঘটে আবু ইউসুফ ইয়াকুব আল-মানসুর এর। এর পরেও ইবন রুশদ রাজসভার সুনজরেই ছিলেন, তবে ১১৯৫ সালে পাশা উলটে যায়। তার বিরুদ্ধে প্রথাবিরোধী কাজের অভিযোগসহ নানা আপত্তি তোলা হয়, কর্ডোবায় এক ট্রাইবুন্যালের মাধ্যমে তার বিচার হয়। তার কাজের প্রতি তীব্র নিন্দা করে বিচারসভা; তার কিছু লেখা জ্বালিয়ে দেবার নির্দেশ দেয়া হয় এবং তাঁকে লুসেনায় নির্বাসিত করা হয়, এনসাইক্লোপিডিয়া অব ইসলাম এ বলা হয়েছে যে খলিফা গোঁড়াপন্থী আলেম-উলামার সমর্থন লাভ করতে ইবন রুশদকে নিজের থেকে দূরে সরাবার ব্যবস্থা করেন। কেননা ইবন রুশদের প্রথাবিরোধী কিছু মতের সাথে এসব উলেমার মতবিরোধ ছিলো, আর তাদের সমর্থন খলিফার দরকার ছিলো- খ্রিষ্টান রাজ্যগুলো আক্রমণের জন্য।
কর্মসমূহ
ইবন রুশদ একজন অত্যন্ত উতপাদনশীল লেখক ছিলেন, তার জীবনীকারক মজিদ ফখরি্র মতে তার প্রাচ্যের পূর্বসূরীদের যে কারো তুলনায় তার কাজ বিস্তৃত ক্ষেত্রে বিচিত্ররকম বিষয় নিয়ে আলোচনা করে- এর মধ্যে আছে দর্শন, ঔষধ-পথ্য, আইনবিদ্যা অথবা আইনতত্ত্ব এবং ভাষাবিজ্ঞান। প্রাচ্যবিদ আর্নেস্ট রেনান এর মতে ইবন রুশদের অন্তত ৬৭ টি স্বতন্ত্র রচনা বিদ্যমান; তন্মধ্যে ২৮ টি দর্শন, ২০ টি চিকিৎসাবিদ্যা, ৮ টি আইনবিদ্যা, ৫ টি ধর্মতত্ত্ব ও ৪ টি ব্যাকরণ নিয়ে, এর সাথে আছে অ্যারিস্টটলের সিংহভাগ কাজের উপর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এবং প্লেটোর রিপাবলিক এর উপর বক্তৃতা। ইবন রুশদের অনেক কাজের মূল আরবি পান্ডুলিপি পাওয়া যায় নি, বেশিরভাগই শুধুমাত্র হিব্রু এবং ল্যাটিন অনুবাদের পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ অ্যারিস্টটলের উপর তার দীর্ঘ ব্যাখ্যাগুলোর খুব কম অংশের মূল আরবি পান্ডুলিপি উদ্ধার সম্ভব হয়েছে।
স্বতন্ত্র দার্শনিক কাজ
ইবন রুশদ স্বতন্ত্র দার্শনিক গবেষণাপত্র লিখেছেন; যার মধ্যে আছে বুদ্ধিবৃত্তির উপর, সময়ের উপর, মহাকাশীয় গোলকের উপর এবং গোলকের গতির সম্বন্ধীয়। তিনি কিছু সমালোচনামূলক গ্রন্থও লিখেছেনঃ আল-ফারাবির যুক্তিবিদ্যা পাঠের পদ্ধতির সাথে অ্যারিস্টটলের পদ্ধতির তুলনা, ইবন সিনার কিতাব-আশ শিফা অনুসারে অধিবিদ্যা, এবং ইবন সিনার অস্তিত্বশীল সত্তার শ্রেণিকরণের বিরোধিতা।
ধর্মতাত্ত্বিক কাজ
চিকিৎসাশাস্ত্র
ইবন রুশদ আল-মোহাদ খিলাফতের সভায় রাজচিকিৎসক পদে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন, এবং এর সুবাদে বেশ কিছু চিকিৎসা সংক্রান্ত গবেষণাপত্র লিখেছেন। এর মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয় হচ্ছে তার আল-কুল্লিয়াত ফিত-তিব("চিকিৎসার সাধারণ নীতিমালা", পাশ্চাত্যে ল্যাটিনকৃত নাম কলিজেট[The Colliget] নামে পরিচিত)। এ বই ১১৬২ সাল নাগাদ লেখা হয়েছিলো, তার রাজচিকিৎসক পদে অধিষ্ঠিত হবার কিছুকাল আগে। তার বইয়ের শিরোনাম সমসাময়িক আন্দালুসীয় চিকিৎসক ইবন যুহরের আল-জুযি'ইয়্যাত ফিত-তিব ( "চিকিৎসার বিশেষায়িত নীতিমালা") এর বিপরীত; মূলত তার এ কাজ ইবন যুহরের বইয়ের সাথে পরস্পরের পরিপূরক হিসেবে রচিত হয়েছিলো। ল্যাটিনে অনুদিত হয়ে তার এ বই ইউরোপে কয়েক শতাব্দীকাল ব্যাপী চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষার প্রমিত গ্রন্থরূপে ব্যবহৃত হয়েছিলো।ইবন রুশদ গ্রিক চিকিৎসাবিদ গ্যালেনের কর্মের সারবত্তা নিয়ে লিখেছেন এবং ইবন সিনার উরজুযাহ ফিত-তিব এর বিশ্লেষণ রচনা করেছেন।
আইনশাস্ত্র এবং বিচার
ইবন রুশদ তার কর্মজীবনের একটি উল্লেখযোগ্য সময় বিচারপতি হিসেবে ব্যয় করেছেন, এবং ইসলামি আইনশাস্ত্র এবং আইনতত্ত্বে বেশ কিছু কাজ করেছেন। তবে শুধু একটি কাজই কালের পরিক্রমায় আমাদের হাতে এসেছে- বিদআত আল-মুজতাহিদ ওয়া নিহায়াত আল-মুকতাসিদ। এই কর্মে তিনি সুন্নি মাযহাবগুলোর(ইসলামি আইনশাস্ত্রের বিভিন্ন মতাদর্শী দল) মধ্যকার বিরোধ গুলো নিয়ে আলোচনা করেন।
দার্শনিক চিন্তাধারা
অ্যারিস্টটলবাদ এবং ইসলামি দার্শনিক চিন্তা
দার্শনিক কর্মসমূহে ইবন রুশদের মধ্যে মূল অ্যারিস্টটলবাদের প্রতি গুরুত্বারোপ করতে দেখা যায়; তার মতে অ্যারিস্টটলের মূল বক্তব্য আল-ফারাবি, ইবন সিনার মতো মুসলিম দার্শনিকদের নিওপ্লাটোনিস্ট ভাবধারার কবলে পড়ে বিকৃতি লাভ করেছিলো। ইবন রুশদ আল-ফারাবির প্লেটো এবং অ্যারিস্টটলের মতবাদের সমন্বয় সাধনের প্রচেষ্টাকে প্রত্যাখ্যান করেন, তিনি দেখান যে প্লেটোর মতামত এবং অ্যারিস্টটলের মত সম্পূর্ণ ভিন্ন। তিনি আল ফারাবির যুক্তিবিদ্যার কাজেরও সমালোচনা করেন মূল অ্যারিস্টটলীয় উৎসের অপব্যাখ্যা করার জন্য। ইবন সিনা, যিনি ছিলেন মধ্যযুগে ইসলামি নিওপ্লাটোনিজমের প্রধান প্রবক্তা, তার সমালোচক হিসেবেও ইবন রুশদ অবতীর্ণ হন।
আন্দালুসের পতন
ভূমধ্যসাগরের একদিকে চলছে পবিত্র ভূমি দখলের লড়াই, অন্যদিকে চলছে আল-আন্দালুস থেকে মুসলিম শাসন উচ্ছেদ করার চেষ্টা। ১০৭৬ সালের দিকে স্পেনের টোলেডো শহর দখল করে নেয় ষষ্ঠ আলফোন্সো, একসময়ের ভিজিগথ রাজধানী ছিল এই শহর। পরবর্তী ১৫০ বছর আইবেরীয় উপদ্বীপের মানচিত্র একইরকম থাকে। অবশেষে ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে তৃতীয় ফার্নান্দো কর্ডোবা আর সেভিলের মতো গুরুত্বপূর্ণ শহর দখল করে নেন, অন্যদিকে আরাগনের প্রথম জায়ুম দখল করে নেন ভ্যালেন্সিয়া শহর। ৬০০ বছর ধরে রাজত্ব করা বিশাল খিলাফতের হাতে অবশিষ্ট থাকে শুধু গ্রানাডা, তা-ও সেখানেও নিয়মিতভাবে হানা দিতে থাকে ক্রুসেডার বাহিনী।
আন্দালুসে মুসলিমদের রাজনৈতিক পতনের সাথে সাথে এর শিক্ষা-সংস্কৃতির পতনও শুরু হয়ে যায়। মুসলিম অভিজাতদের বেশিরভাগই চলে যায় উত্তর আফ্রিকা কিংবা আরব অঞ্চলে, যদিও সাধারণ জনগণদের বেশিরভাগ গ্রানাডাতেই থেকে যায়। গ্রানাডাতেও ইহুদিরা একইভাবে সুরক্ষা পেতে থাকে, যেরকমটা তারা কয়েকশ বছর ধরে পেয়ে আসছে।
খ্রিস্টান শাসকরা আন্দালুসীয় চিত্রকলা, স্থাপত্যকলা আর বিজ্ঞানের বেশ বড় মাপের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। টোলেডো খ্রিস্টানরা দখল করে নিলেও এরপরেও কয়েকশ বছর আরবি শেখার অন্যতম পীঠস্থান ছিল এই শহর। দশম আলফোন্সো সেভিলে আরবি শেখার জন্য আলাদা স্কুল তৈরি করে দেন, আন্দালুসীয়দের বিজ্ঞান আর দর্শনশাস্ত্রেও আগ্রহী ছিলেন তিনি। তার সময়ে মুসলিম আর ইহুদিরা নিজেদের ধর্ম পালন করার সমান সুযোগ-সুবিধা পেত। ভ্যালেন্সিয়াতেও প্রায় পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত আরবি সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা ছিল।
যদিও খ্রিস্টান শাসকদের এই উদারমনা অবস্থা বেশিদিন চলেনি, যখন প্রথম ইসাবেলা ‘দ্য ক্যাথলিক’ এবং আরাগনের দ্বিতীয় ফার্দিন্যান্দ যৌথভাবে স্পেন শাসন করা শুরু করেন। যদিও ফার্দিন্যান্দ ভ্যালেন্সিয়া আর আরাগনে থাকা মুসলিমদের প্রতি বেশ উদার ছিলেন, কিন্তু ইসাবেলা ছিলেন সম্পূর্ণ বিপরীত। অবশেষে ১৪৯২ সালে বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে ছোট্ট গ্রানাডার উপর আক্রমণ চালান তারা দুজন, দখল করে নেয় আল-হাম্বারা থেকে শুরু করে সাধারণ বাড়িঘর। ঐ বছরেই ইহুদিদের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়, স্পেনে থাকতে হলে খ্রিস্টান হতে হবে অথবা চলে যেতে হবে। আর এভাবেই স্পেনের মাটি থেকে হারিয়ে যায় একসময়ে পৃথিবীর ওপর রাজত্ব করা আল-আন্দালুস।
What's Your Reaction?






