হুদ (আঃ এর জীবনী | Biography of Hud (prophet)
হুদ (আঃ এর জীবনী | Biography of Hud (prophet) হুদ আঃ Hud prophet

নবী
হজরত হুদ
هود হেবার আলাইহিস সালাম
|
|
---|---|
هود
|
|
উপাধি |
নবী |
অন্য নাম |
সম্ভবত: হেবার (হিব্রু ভাষায়: עֵבֶר) |
ব্যক্তিগত তথ্য |
|
সমাধিস্থল |
কবর নবী হুদ হাদরামাউত (সম্ভাব্য) |
ধর্ম |
ইসলাম |
অন্য নাম |
সম্ভবত: হেবার (হিব্রু ভাষায়: עֵבֶר) |
মুসলিম নেতা |
|
পূর্বসূরী |
নূহ |
উত্তরসূরী |
সালেহ |
যে কারণে ধ্বংস হলো হুদ নবীর উম্মত
হুদ
(আরবি: هود) একজন নবীর নাম যার সম্পর্কে ইসলামের মূল ধর্মগ্রন্থ কোরআনে কিছু বর্ণনা রয়েছে। কুরআনের ১১তম সূরা হুদে তার নাম ঊল্লেখ করা হলেও এই সূরাটিতে তার সম্পর্কে সামান্য বর্ণনা রয়েছে। আল্লাহর গজবে ধ্বংসপ্রাপ্ত পৃথিবীর প্রধান ছয়টি জাতির মধ্যে হযরত নূহের জাতির পরেই হূদের জাতি আদ ছিল।
ধারণা করা হয় বাইবেলীয় চরিত্র এবর এবং নবী হূদ একই ব্যক্তি।
বংশ পরিচয়
হূদ ছিলেন নূহ -এরই বংশধর। আদ জাতি ও ছামূদ জাতি ছিল নূহ -এর পরবর্তী বংশধর এবং নূহের পঞ্চম অথবা অষ্টম অধস্তন পুরুষ। ইরামপুত্র ‘আদ-এর বংশধরগণ ‘আদ ঊলা’ বা প্রথম ‘আদ এবং অপর পুত্রের সন্তান ছামূদ-এর বংশধরগণ ‘আদ ছানী বা দ্বিতীয় ‘আদ বলে খ্যাত। ‘আদ ও ছামূদ উভয় গোত্রই ইরাম-এর দু’টি শাখা। সেকারণ ‘ইরাম’ কথাটি ‘আদ ও ছামূদ উভয় গোত্রের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। এজন্য কুরআনে কোথাও ‘আদ ঊলা’ (নাজম ৫০) এবং কোথাও ‘ইরাম যাতিল ‘ইমাদ’ (ফজর ৭) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে।আদ সম্প্রদায়ের ১৩টি পরিবার বা গোত্র ছিল। আম্মান থেকে শুরু করে হাযারামাউত ও ইয়েমেন পর্যন্ত তাদের বসতি ছিল। উল্লেখ্য যে, নূহের প্লাবনের পরে এরাই সর্বপ্রথম মূর্তিপূজা শুরু করে।
ঘটনা
হুদ এর জাতির নাম ছিল আ'দ। এটি আরবের প্রাথমিক যুগের একটি জাতি। বনি আদ গোত্রকে "আমালিকা" গোত্রও বলা হয়। খ্রিস্টপূর্ব আনুমানিক দুই হাজার বছর আগে ইয়েমেনের হাজরামাউত অঞ্চলে তাদের বসবাস ছিল বলে অনুমান করা হয়ে থাকে। দীর্ঘাকৃতি, দৈহিক শক্তি ও পাথর ছেদনশিল্পে তাদের বিশেষ খ্যাতি ছিল। কালক্রমে তারা কুসংস্কারাচ্ছন্নতা ও মূর্তি পূজার লিপ্ত হয়ে পড়ে। দৈহিক শক্তির কারণেও তারা বিভিন্ন অত্যাচার ও উচ্ছৃঙ্খলতায় লিপ্ত হয়। এই পরিস্থিতিতে আল্লাহ হুদ -কে তাদের উদ্দেশ্যে পাঠান, আল্লাহর শোকর গোজার ও সৎ কাজের আহবান দেওয়ার জন্য।
আপতিত গজব
আদ-এর অমার্জনীয় পাপের ফলে প্রাথমিক গজব হিসাবে তিন বছর বৃষ্টিপাত বন্ধ থাকে। তাদের শস্যক্ষেত সমূহ শুষ্ক বালুকাময় মরুভূমিতে পরিণত হয়। বাগ-বাগিচা জ্বলে-পুড়ে যায়। এতেও তারা শিরক ও মূর্তিপূজা ত্যাগ করেনি। কিন্তু অবশেষে তারা বাধ্য হয়ে আল্লাহর কাছে বৃষ্টি প্রার্থনা করে। তখন আসমানে সাদা, কালো ও লাল মেঘ দেখা দেয় এবং গায়েবী আওয়ায আসে যে, "তোমরা কোনটি পছন্দ করো?" লোকেরা বলল কালো মেঘ। তখন কালো মেঘ এলো। লোকেরা তাকে স্বাগত জানিয়ে বলল, "এটি আমাদের বৃষ্টি দেবে"। জবাবে বলা হয়,“ | বরং এটা সেই বস্তু, যা তোমরা তাড়াতাড়ি চেয়েছিলে। এটা বায়ু এতে রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি। তার পালনকর্তার আদেশে সে সব কিছুকে ধ্বংস করে দেবে। | ” |
ফলে অবশেষে পরদিন ভোরে আল্লাহর চূড়ান্ত গযব নেমে আসে। সাত রাত্রি ও আট দিন ব্যাপী অনবরত ঝড়-তুফান বইতে থাকে(সূরা আল হাক্বকাহ: ৬-৭)। মেঘের বিকট গর্জন ও বজ্রাঘাতে বাড়ী-ঘর সব ধ্বসে যায়, প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে গাছ-পালা সব উপড়ে যায়, মানুষ ও জীবজন্তু শূন্যে উত্থিত হয়ে সজোরে যমীনে পতিত হয়।
আদ জাতি খুবই শক্তিশালী ও উন্নত ছিল। তারা শক্তি দিয়ে সুবিশাল পাহাড় কেটে সুন্দর কারুকাজ করে বড় অট্টালিকা তৈরি করত। তাদের প্রতি মহান আল্লাহ তায়ালা রহমতের দুয়ার খুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু তারা আল্লাহকে ভুলে যায়। যখন তাদের মধ্যে অপকর্মের মাত্রা বেড়ে যায়, তখনই মহান আল্লাহ তাদের সৎপথে আহ্বানের জন্য একজন নবি পাঠান। সেই নবি হচ্ছেন হজরত হুদ (আ.)। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর আদ সম্প্রদায়ের কাছে পাঠিয়েছি তাদের ভাই হুদকে।’ (সুরা আ’রাফ :৬৫)
হজরত হুদ (আ.) তাদের অপকর্ম থেকে ফিরিয়ে আনার কাজ শুরু করেন। কিন্তু হজরত হুদ (আ.)-এর সত্যের আহ্বান অল্পসংখ্যক লোক মান্য করল। বাকিরা হজরত হুদ (আ.)কে অপমান করল। আল্লাহর বাণীসমূহ প্রত্যাখ্যান করল। উলটো ইসলাম ও হজরত হুদ (আ.)কে নিয়ে বিভিন্ন কটূক্তি করতে লাগল। এই পরিস্থিতিতে মহান আল্লাহ তায়ালা তাদের ওপর প্রাথমিক শাস্তি অর্পণ করেন। তাদের ওপর আল্লাহর দেওয়া নিয়ামত বৃষ্টি বন্ধ হয়ে যায়। বৃষ্টি বন্ধ হয়ে জমিন চৌচির হয়ে গেলে হজরত হুদ (আ.) তাদের শাস্তির কথা বলেন। কিন্তু তারা কোনো কর্ণপাত করল না।
বছর তিন সময় দেওয়ার পরেও যখন তারা পরিবর্তন হলো না, তখন মহান আল্লাহ তায়ালা তাদের ওপর ঝড় দিলেন। ভয়ানক ঝড়ে আদ জাতি ধ্বংস হয়ে গেল। আল্লাহ তার ক্ষমতা দিয়ে হজরত হুদ (আ.) ও তার অনুসারীদের রক্ষা করলেন। আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর আদ জাতি, তারা পৃথিবীতে অযথা অহংকার করেছে এবং বলেছে, আমাদের চেয়ে শক্তিধর কে আছে? তারা কি লক্ষ করেনি যে আল্লাহ তাদের সৃষ্টি করেছেন, তিনি তাদের অপেক্ষা অধিক শক্তিধর? বস্তুত তারা আমার নিদর্শনাবলি অস্বীকার করেছে (সুরা হামিম সিজদা-১৫)।
আদ জাতির বসতি ও পরিণতি
‘আদ সম্প্রদায়ের ১৩টি গোত্র ছিল। আম্মান হতে হাদারামাউত ও ইয়ামান পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল তাদের বসতি। তাদের ক্ষেত-খামারগুলো ছিল সজীব ও ফলফসলে পূর্ণ। তাদের ছিল সব ধরনের বাগ-বাগিচা। তারা ছিল সুঠাম ও দীর্ঘ দেহের অধিকারী। তৎকালীন আদ সম্প্রদায়ের শক্তি ও বাহাদুরির খুব খ্যাতি ছিল। নিজেদের অর্থ সম্পদ, ফল-ফসল ও প্রাচুর্যের আধিক্যে তারা ভুলে যায় নিজেদের রবকে। ভুলে যায় সঠিক পথে জীবনযাপন করার পথ ও পদ্ধতি। ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে অহংকারী। আর ডুবে যায় মূর্তিপূজার গভীরে। এরাই পৃথিবীতে দ্বিতীয়বার মূর্তিপূজা ও শিরকের প্রচলন করে। তাদের ঘটনাবহুল জীবন ধারায় সর্বকালের মানুষের জন্য শিক্ষা রয়েছে। তাদের অশুভ পরিণতিতে রয়েছে বোধসম্পন্ন মানুষের জন্য ভাবনার খোরাক। চলার পথের পাথেয়। রবের অনুগত বান্দা ও প্রকৃত মানুষ হওয়ার বিবিধ উপকরণ।
আল্লাহর বান্দারা অতীত ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনের ১৭টি সুরায় ৭৩টি আয়াতে হুদ (আ.) ও ‘আদ’ সম্প্রদায় সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। যাতে শিরক ও অহংকারের পরিণতি কী হয়, তা ভেবে যুগে যুগে বান্দারা সতর্ক হতে পারে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা আদ সম্প্রদায়ের অহংকার ও পরিণতির কথা উল্লেখ করে বলেন, তাদের ঘটনা এই ঘটল যে, তারা পৃথিবীতে অন্যায় দম্ভ প্রদর্শন করতে লাগল এবং বলল, ‘আমাদের চেয়ে অধিক শক্তিশালী কে আছে? তবে কি তারা অনুধাবন করল না, যে আল্লাহ তাদের সৃষ্টি করেছেন, তিনি তাদের চেয়ে অধিক শক্তিশালী? মূলত তারা আমার আয়াতগুলো অস্বীকার করত।’ (সুরা ফুছছিলাত : ১৫)।
ধ্বংসের কারণ
কোনো জাতির অন্যায় ও জুলুম যখন স্বাভাবিক আচরণে পরিণত হয়, তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের প্রতি আজাব ও গজব ধেয়ে আসে। অহংকারে মানুষ যখন নিজের অস্তিত্ব ও অবস্থানের কথা ভুলে যায়, তখনই আল্লাহ তাকে ধ্বংস করে দেয়। যেসব কারণে হুদ (আ.) এর উম্মত আদ জাতি ধ্বংস হয়েছিল, তা নিচে তুলে ধরা হলো-
১. আদ সম্প্রদায় তাদের প্রতি প্রেরিত আল্লাহর নবীকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিল। নবীর দাওয়াত গ্রহণ করেনি। নিজেদের মনগড়া পথেই অবিচল ছিল।
২. তাদের প্রতি আল্লাহতায়ালার অনুগ্রহগুলোকে তারা অবমূল্যায়ন করেছিল, যার ফলে তারা আল্লাহর আনুগত্য হতে বিমুখ হয়ে শয়তানের আনুগত্য বরণ করে স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেছিল।
৩. আল্লাহর নেয়ামতরাজিকে নিজেদের জন্য চিরস্থায়ী ভেবেছিল তথা দুনয়িার জীবনকেই একমাত্র জীবন ভেবে আখেরাতকে অস্বীকার করেছিল।
৪. আল্লাহর গজব থেকে বাঁচার জন্য বিভিন্ন কল্পিত উপাস্যের অসীলা ধরে পূজা-অর্চনা শুরু করেছিল। একত্ববাদকে গ্রহণ না করে বহুত্ববাদকে গ্রহণ করে শিরকে লিপ্ত ছিল।
৫. তারা আল্লাহকে বিশ্বাস করত; কিন্তু আল্লাহর গজব থেকে নির্ভীক ছিল।
৬. তারা অযথা উঁচু স্থানগুলোতে সুউচ্চ টাওয়ার ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করত, যা অপচয় ছাড়া কিছুই ছিল না। (সুরা শুআরা : ১২৮)।
৭. তারা বড় বড় প্রাসাদ নির্মাণ করত এবং ভাবত যেন তারা পৃথিবীতে চিরকাল বসবাস করবে। (সুরা শুআরা : ১২৯)।
৮. তারা দুর্বলদের ওপর নিষ্ঠুরভাবে আঘাত করত এবং মানুষের ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতন চালাত। (সুরা শুআরা : ১৩০)।
তুফান দিয়ে শাস্তি
আল্লাহতায়ালা আদ জাতির প্রতি অনুগ্রহের দুয়ার খুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু তাদের বক্রবুদ্ধির কারণে তাদের নেয়ামতই তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। ফলে তারা নিজেরা পথভ্রষ্ট হয়েছিল ও অন্যকে পথভ্রষ্ট করেছিল। এ জন্য আল্লাহতায়ালা তাদের শাস্তির সম্মুখীন করলেন আর পৃথিবীতে ঘোর অপরাধীদের শোচনীয় পরাজয় ও লাঞ্ছনার বিষয়টি শিক্ষণীয় হিসেবে পবিত্র কোরআনে স্থান দিলেন। মহান আল্লাহ তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে তাদের প্রতি শাস্তি স্বরূপ প্রচণ্ড ঝোড়ো হাওয়া পাঠালেন। পবিত্র কোরআনে এর বর্ণনা এসেছে।
আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি অশুভ কিছু দিনে তাদের প্রতি পাঠালাম প্রচণ্ড ঝোড়ো হাওয়া, তাদের দুনিয়ার জীবনে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তির স্বাদ গ্রহণ করানোর জন্য। আর আখেরাতের শাস্তি তো আরো বেশি লাঞ্ছনাকর এবং (সেখানে) তারা পাবে না কোনো সাহায্য।’ (সুরা ফুছছিলাত : ১৬)।
তাফসিরে মাআরিফুল কোরআনে মুফতি মুহাম্মদ শফি (রহ.) তাফসিরে কুরতুবি ও মাযহারির উদ্ধৃতি দিয়ে লেখেন, যাহহাক বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা আদ সম্প্রদায়ের ওপর তিন বছর পর্যন্ত বৃষ্টিপাত সম্পূর্ণ বন্ধ রাখেন। সে সময়ে শুধু প্রবল শুষ্ক বাতাস প্রবাহিত হতো। অবশেষে আট দিন ও সাত রাত পর্যন্ত উপর্যুপরি তুফান চলতে থাকে।’
অনাবৃষ্টি আল্লাহর গজব
বৃষ্টি আল্লাহর রহমত। খরা বা অনাবৃষ্টি আল্লাহর গজব। যখন অনাবৃষ্টি ও গরম বাতাস বইতে থাকবে, তখন বেশি বেশি ইস্তেগফার করা মোমিনের বৈশিষ্ট্য। জাবের ইবনে আবদুল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা কোনো সম্প্রদায়ের মঙ্গল চাইলে তাদের ওপর বৃষ্টি বর্ষণ করেন। পক্ষান্তরে আল্লাহতায়ালা কোনো জাতিকে বিপদগ্রস্ত করতে চাইলে তাদের ওপর বৃষ্টিপাত বন্ধ করে দেন এবং প্রবল বাতাস প্রবাহিত হতে থাকে।’ (তাফসিরে মাআরিফুল কোরআন : সুরা ফুছছিলাত : ১৬)। আদ সম্প্রদায়কে আল্লাহতায়ালা প্রথমে একটানা তিন বছর অনাবৃষ্টি অতঃপর দীর্ঘ আট দিন তুফানের মাধ্যমে আজাবে পতিত করে ধ্বংস করেছিলেন।
হযরত হূদ (আঃ) দুর্ধর্ষ ও শক্তিশালী ‘আদ জাতির প্রতি প্রেরিত হয়েছিলেন। আল্লাহর গযবে ধ্বংসপ্রাপ্ত বিশ্বের প্রধান ছয়টি জাতির মধ্যে কওমে নূহ-এর পরে কওমে ‘আদ ছিল দ্বিতীয় জাতি। হূদ (আঃ) ছিলেন এদেরই বংশধর। ‘আদ ও ছামূদ ছিল নূহ (আঃ)-এর পুত্র সামের বংশধর এবং নূহের পঞ্চম অথবা অষ্টম অধঃস্তন পুরুষ। ইরামপুত্র ‘আদ-এর বংশধরগণ ‘আদ ঊলা’ বা প্রথম ‘আদ এবং অপর পুত্রের সন্তান ছামূদ-এর বংশধরগণ ‘আদ ছানী বা দ্বিতীয় ‘আদ বলে খ্যাত।[1] ‘আদ ও ছামূদ উভয় গোত্রই ইরাম-এর দু’টি শাখা। সেকারণ ‘ইরাম’ কথাটি ‘আদ ও ছামূদ উভয় গোত্রের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। এজন্য কুরআনে কোথাও ‘আদ ঊলা’ (নাজম ৫০) এবং কোথাও ‘ইরাম যাতিল ‘ইমাদ’ (ফজর ৭) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে।
‘আদ সম্প্রদায়ের ১৩টি পরিবার বা গোত্র ছিল। আম্মান হ’তে শুরু করে হাযারামাউত ও ইয়ামন পর্যন্ত তাদের বসতি ছিল।[2] তাদের ক্ষেত-খামারগুলো ছিল অত্যন্ত সজীব ও শস্যশ্যামল। তাদের প্রায় সব ধরনের বাগ-বাগিচা ছিল। তারা ছিল সুঠামদেহী ও বিরাট বপু সম্পন্ন। আল্লাহ তা‘আলা তাদের প্রতি অনুগ্রহের দুয়ার খুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু বক্রবুদ্ধির কারণে এসব নে‘মতই তাদের কাল হয়ে দাঁড়ালো। তারা নিজেরা পথভ্রষ্ট হয়েছিল ও অন্যকে পথভ্রষ্ট করেছিল। তারা শক্তি মদমত্ত হয়ে ‘আমাদের চেয়ে শক্তিশালী আর কে আছে’ (ফুছসালাত/হামীম সাজদাহ ১৫) বলে ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করতে শুরু করেছিল।
তারা আল্লাহর ইবাদত পরিত্যাগ করে নূহ (আঃ)-এর আমলে ফেলে আসা মূর্তিপূজার শিরক-এর পুনরায় প্রচলন ঘটালো। মাত্র কয়েক পুরুষ আগে ঘটে যাওয়া নূহের সর্বগ্রাসী প্লাবনের কথা তারা বেমালুম ভুলে গেল। ফলে আল্লাহ পাক তাদের হেদায়াতের জন্য তাদেরই মধ্য হ’তে হূদ (আঃ)-কে নবী হিসাবে প্রেরণ করলেন। উল্লেখ্য যে, নূহের প্লাবনের পরে এরাই সর্বপ্রথম মূর্তিপূজা শুরু করে।
হযরত হূদ (আঃ) ও কওমে ‘আদ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের ১৭টি সূরায় ৭৩টি আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।
কওমে ছামূদ-এর প্রতি হযরত সালেহ (আঃ)-এর দাওয়াত :
পথভোলা জাতিকে হযরত ছালেহ (আঃ) সর্বপ্রথম তাওহীদের দাওয়াত দিলেন। তিনি তাদেরকে মূর্তিপূজাসহ যাবতীয় শিরক ও কুসংস্কার ত্যাগ করে এক আললাহর ইবাদত ও তাঁর প্রেরিত বিধান সমূহের প্রতি আনুগত্যের আহবান জানালেন। তিনি যৌবনকালে নবুঅতপ্রাপ্ত হন। তখন থেকে বার্ধক্যকাল অবধি তিনি স্বীয় কওমকে নিরন্তর দাওয়াত দিতে থাকেন। কওমের দুর্বল শ্রেণীর লোকেরা তাঁর উপরে ঈমান আনলেও শক্তিশালী ও নেতৃস্থানীয় লোকেরা তাঁকে অস্বীকার করে। ছালেহ (আঃ)-এর দাওয়াত সম্পর্কে সূরা আ‘রাফের ৭৩-৭৯ আয়াতে আল্লাহ বলেন,
ﻭَﺇِﻟَﻰ ﺛَﻤُﻮْﺩَ ﺃَﺧَﺎﻫُﻢْ ﺻَﺎﻟِﺤﺎً ﻗَﺎﻝَ ﻳَﺎ ﻗَﻮْﻡِ ﺍﻋْﺒُﺪُﻭﺍ ﺍﻟﻠﻪَ ﻣَﺎ ﻟَﻜُﻢ ﻣِّﻦْ ﺇِﻟَـﻪٍ ﻏَﻴْﺮُﻩُ ﻗَﺪْ ﺟَﺎﺀﺗْﻜُﻢْ ﺑَﻴِّﻨَﺔٌ ﻣِّﻦ ﺭَّﺑِّﻜُﻢْ ﻫَـﺬِﻩِ ﻧَﺎﻗَﺔُ ﺍﻟﻠﻪِ ﻟَﻜُﻢْ ﺁﻳَﺔً ﻓَﺬَﺭُﻭْﻫَﺎ ﺗَﺄْﻛُﻞْ ﻓِﻲْ ﺃَﺭْﺽِ ﺍﻟﻠﻪِ ﻭَﻻَ ﺗَﻤَﺴُّﻮْﻫَﺎ ﺑِﺴُﻮْﺀٍ ﻓَﻴَﺄْﺧُﺬَﻛُﻢْ ﻋَﺬَﺍﺏٌ ﺃَﻟِﻴْﻢٌ، ﻭَﺍﺫْﻛُﺮُﻭْﺍ ﺇِﺫْ ﺟَﻌَﻠَﻜُﻢْ ﺧُﻠَﻔَﺎﺀَ ﻣِﻦْ ﺑَﻌْﺪِ ﻋَﺎﺩٍ ﻭَﺑَﻮَّﺃَﻛُﻢْ ﻓِﻲ ﺍﻷَﺭْﺽِ ﺗَﺘَّﺨِﺬُﻭْﻥَ ﻣِﻦْ ﺳُﻬُﻮْﻟِﻬَﺎ ﻗُﺼُﻮْﺭﺍً ﻭَﺗَﻨْﺤِﺘُﻮْﻥَ ﺍﻟْﺠِﺒَﺎﻝَ ﺑُﻴُﻮْﺗﺎً ﻓَﺎﺫْﻛُﺮُﻭْﺍ ﺁﻵﺀَ ﺍﻟﻠﻪِ ﻭَﻻَ ﺗَﻌْﺜَﻮْﺍ ﻓِﻲ ﺍﻷَﺭْﺽِ ﻣُﻔْﺴِﺪِﻳْﻦَ، ﻗَﺎﻝَ ﺍﻟْﻤَﻸُ ﺍﻟَّﺬِﻳْﻦَ ﺍﺳْﺘَﻜْﺒَﺮُﻭْﺍ ﻣِﻦْ ﻗَﻮْﻣِﻪِ ﻟِﻠَّﺬِﻳْﻦَ ﺍﺳْﺘُﻀْﻌِﻔُﻮْﺍ ﻟِﻤَﻦْ ﺁﻣَﻦَ ﻣِﻨْﻬُﻢْ ﺃَﺗَﻌْﻠَﻤُﻮْﻥَ ﺃَﻥَّ ﺻَﺎﻟِﺤﺎً ﻣُّﺮْﺳَﻞٌ ﻣِّﻦ ﺭَّﺑِّﻪِ ﻗَﺎﻟُﻮْﺍ ﺇِﻧَّﺎ ﺑِﻤَﺎ ﺃُﺭْﺳِﻞَ ﺑِﻪِ ﻣُﺆْﻣِﻨُﻮْﻥَ، ﻗَﺎﻝَ ﺍﻟَّﺬِﻳْﻦَ ﺍﺳْﺘَﻜْﺒَﺮُﻭْﺍ ﺇِﻧَّﺎ ﺑِﺎﻟَّﺬِﻱْ ﺁﻣَﻨﺘُﻢْ ﺑِﻪِ ﻛَﺎﻓِﺮُﻭْﻥَ، ﻓَﻌَﻘَﺮُﻭﺍ ﺍﻟﻨَّﺎﻗَﺔَ ﻭَﻋَﺘَﻮْﺍ ﻋَﻦْ ﺃَﻣْﺮِ ﺭَﺑِّﻬِﻢْ ﻭَﻗَﺎﻟُﻮﺍ ﻳَﺎ ﺻَﺎﻟِﺢُ ﺍﺋْﺘِﻨَﺎ ﺑِﻤَﺎ ﺗَﻌِﺪُﻧَﺎ ﺇِﻥْ ﻛُﻨْﺖَ ﻣِﻦَ ﺍﻟْﻤُﺮْﺳَﻠِﻴْﻦَ، ﻓَﺄَﺧَﺬَﺗْﻬُﻢُ ﺍﻟﺮَّﺟْﻔَﺔُ ﻓَﺄَﺻْﺒَﺤُﻮْﺍ ﻓِﻲْ ﺩَﺍﺭِﻫِﻢْ ﺟَﺎﺛِﻤِﻴْﻦَ، ﻓَﺘَﻮَﻟَّﻰ ﻋَﻨْﻬُﻢْ ﻭَﻗَﺎﻝَ ﻳَﺎ ﻗَﻮْﻡِ ﻟَﻘَﺪْ ﺃَﺑْﻠَﻐْﺘُﻜُﻢْ ﺭِﺳَﺎﻟَﺔَ ﺭَﺑِّﻲْ ﻭَﻧَﺼَﺤْﺖُ ﻟَﻜُﻢْ ﻭَﻟَﻜِﻦ ﻻَّ ﺗُﺤِﺒُّﻮْﻥَ ﺍﻟﻨَّﺎﺻِﺤِﻴْﻦَ – ) ﺍﻷﻋﺮﺍﻑ ৭৩-৭৯ (
‘ছামূদ জাতির নিকটে (আমরা প্রেরণ করেছিলাম) তাদের ভাই ছালেহকে। সে বলল, হে আমার জাতি! তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর। তিনি ব্যতীত তোমাদের কোন উপাস্য নেই। তোমাদের কাছে তোমাদের পালনকর্তার পক্ষ হ’তে একটি প্রমাণ এসে গেছে। এটি আল্লাহর উষ্ট্রী, তোমাদের জন্য নিদর্শন স্বরূপ। অতএব তোমরা একে ছেড়ে দাও আল্লাহর যমীনে চরে বেড়াবে। তোমরা একে অন্যায়ভাবে স্পর্শ করবে না। তাতে মর্মান্তিক শাস্তি তোমাদের পাকড়াও করবে’ (আ‘রাফ ৭/৭৩)। ‘তোমরা স্মরণ কর, যখন আল্লাহ তোমাদেরকে ‘আদ জাতির পরে তাদের স্থলাভিষিক্ত করেন এবং তোমাদেরকে পৃথিবীতে ঠিকানা করে দেন।
সেমতে তোমরা সমতল ভূমিতে অট্টালিকা সমূহ নির্মাণ করেছ এবং পাহাড়ের গায়ে খোদাই করে প্রকোষ্ঠ সমূহ নির্মাণ করেছ। অতএব তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ সমূহ স্মরণ কর এবং পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করো না’ (৭৪)। কিন্তু তার সম্প্রদায়ের দাম্ভিক নেতারা ঈমানদার দুর্বল শ্রেণীর উদ্দেশ্যে বলল, ‘তোমরা কি জানো যে, ছালেহ তার প্রভুর পক্ষ হ’তে প্রেরিত নবী? তারা বলল, আমরা তো তার আনীত বিষয় সমূহের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনকারী’ (৭৫)। ‘(জবাবে) দাদ্ভিক নেতারা বলল, তোমরা যে বিষয়ে বিশ্বাস স্থাপন করেছ, আমরা সে বিষয়ে অস্বীকারকারী’ (৭৬)। ‘অতঃপর তারা উষ্ট্রীকে হত্যা করল এবং তাদের প্রভুর আদেশ অমান্য করল। তারা বলল, হে ছালেহ! তুমি নিয়ে এস যদ্বারা তুমি আমাদের ভয় দেখাতে, যদি তুমি আল্লাহর প্রেরিত নবীদের একজন হয়ে থাক’ (৭৭)। ‘অতঃপর ভূমিকম্প তাদের পাকড়াও করল এবং সকাল বেলা নিজ নিজ গৃহে সবাই উপুড় হয়ে পড়ে রইল’ (৭৮)। ‘ছালেহ তাদের কাছ থেকে প্রস্থান করল এবং বলল, হে আমার সম্প্রদায়! আমি তোমাদের কাছে আমার প্রতিপালকের পয়গাম পৌঁছে দিয়েছি এবং তোমাদের কল্যাণ কামনা করেছি। কিন্তু তোমরা কল্যাণকামীদের ভালবাস না’ (আ‘রাফ ৭/৭৩-৭৯)।
ছালেহ (আঃ)-এর উপরোক্ত দাওয়াত ও তাঁর কওমের আচরণ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের ২২টি সূরায় ৮৭টি আয়াতে বিভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে।
গযবের ধরন :
হযরত ছালেহ (আঃ)-এর ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী বৃহষ্পতিবার ভোরে অবিশ্বাসী কওমের সকলের মুখমন্ডল গভীর হলুদ বর্ণ ধারণ করল। কিন্তু তারা ঈমান আনল না বা তওবা করল না। বরং উল্টা হযরত ছালেহ (আঃ)-এর উপর চটে গেল ও তাঁকে হত্যা করার জন্য খুঁজতে লাগল। দ্বিতীয় দিন সবার মুখমন্ডল লাল বর্ণ ও তৃতীয় দিন ঘোর কৃষ্ণবর্ণ হয়ে গেল। তখন সবই নিরাশ হয়ে গযবের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। চতুর্থ দিন রবিবার সকালে সবাই মৃত্যুর জন্য প্রস্ত্ততি নিয়ে সুগন্ধি মেখে অপেক্ষা করতে থাকে।[6] এমতাবস্থায় ভীষণ ভূমিকম্প শুরু হ’ল এবং উপর থেকে বিকট ও ভয়াবহ এক গর্জন শোনা গেল। ফলে সবাই যার যার স্থানে একযোগে অধোমুখী হয়ে ভূতলশায়ী হ’ল (আ‘রাফ ৭/৭৮; হূদ ১১/৬৭-৬৮) এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত হ’ল এমনভাবে, যেন তারা কোনদিন সেখানে ছিল না’। অন্য আয়াতে এসেছে যে, ‘আমরা তাদের প্রতি একটিমাত্র নিনাদ পাঠিয়েছিলাম। তাতেই তারা শুষ্ক খড়কুটোর মত হয়ে গেল’ (ক্বামার ৫৪/৩১)।
কোন কোন হাদীছে এসেছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ছামূদ জাতির উপরে আপতিত গযব থেকে ‘আবু রেগাল’ নামক জনৈক অবিশ্বাসী নেতা ঐ সময় মক্কায় থাকার কারণে বেঁচে গিয়েছিল। কিন্তু হারাম শরীফ থেকে বেরোবার সাথে সাথে সেও গযবে পতিত হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছাহাবায়ে কেরামকে মক্কার বাইরে আবু রেগালের উক্ত কবরের চিহ্ন দেখান এবং বলেন যে, তার সাথে একটা স্বর্ণের ছড়িও দাফন হয়ে গিয়েছিল। তখন কবর খনন করে তারা ছড়িটি উদ্ধার করেন। উক্ত রেওয়ায়াতে একথাও বলা হয়েছে যে, ত্বায়েফের প্রসিদ্ধ ছাক্বীফ গোত্র উক্ত আবু রেগালের বংশধর। তবে হাদীছটি যঈফ।
অন্য হাদীছে এসেছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন যে, ‘ছাক্বীফ গোত্রে একজন মিথ্যাবাদী (ভন্ড নবী) ও একজন রক্ত পিপাসুর জন্ম হবে।[8] রাসূলের এ ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়িত হয় এবং এই বংশে মিথ্যা নবী মোখতার ছাক্বাফী এবং রক্তপিপাসু কসাই ইরাকের উমাইয়া গবর্ণর হাজ্জাজ বিন ইউসুফের জন্ম হয়। কওমে ছামূদ-এর অভিশপ্ত বংশের রক্তধারার কু-প্রভাব হওয়াটাও এতে বিচিত্র নয়।
অন্য এক হাদীছে বর্ণিত হয়েছে যে, ৯ম হিজরীতে তাবূক যুদ্ধের সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সিরিয়া ও হেজাযের মধ্যবর্তী ‘হিজ্র’ নামক সে স্থানটি অতিক্রম করেন, যেখানে ছামূদ জাতির উপরে গযব নাযিল হয়েছিল। তিনি ছাহাবায়ে কেরামকে নির্দেশ দেন, কেউ যেন ঐ গযব বিধ্বস্ত এলাকায় প্রবেশ না করে এবং ওখানকার কূয়ার পানি ব্যবহার না করে’।[9] এসব আযাব-বিধ্বস্ত এলাকাগুলিকে আল্লাহ তা‘আলা ভবিষ্যৎ মানবজাতির জন্য শিক্ষাস্থল হিসাবে সংরক্ষিত রেখেছেন, যাতে তারা উপদেশ হাছিল করতে পারে এবং নিজেদেরকে আল্লাহর অবাধ্যতা হ’তে বিরত রাখে।
আরবরা তাদের ব্যবসায়িক সফরে নিয়মিত সিরিয়া যাতায়াতের পথে এইসব ধ্বংসস্ত্তপ গুলি প্রত্যক্ষ করত। অথচ তাদের অধিকাংশ তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেনি এবং শেষনবীর উপরে বিশ্বাস স্থাপন করেনি। যদিও পরবর্তীতে সব এলাকাই ‘মুসলিম’ এলাকায় পরিণত হয়ে গেছে। আল্লাহ বলেন,
ﻭَﻛَﻢْ ﺃَﻫْﻠَﻜْﻨَﺎ ﻣِﻦْ ﻗَﺮْﻳَﺔٍ ﺑَﻄِﺮَﺕْ ﻣَﻌِﻴْﺸَﺘَﻬَﺎ ﻓَﺘِﻠْﻚَ ﻣَﺴَﺎﻛِﻨُﻬُﻢْ ﻟَﻢْ ﺗُﺴْﻜَﻦ ﻣِّﻦ ﺑَﻌْﺪِﻫِﻢْ ﺇِﻻَّ ﻗَﻠِﻴﻼً ﻭَﻛُﻨَّﺎ ﻧَﺤْﻦُ ﺍﻟْﻮَﺍﺭِﺛِﻴْﻦَ، ﻭَﻣَﺎ ﻛَﺎﻥَ ﺭَﺑُّﻚَ ﻣُﻬْﻠِﻚَ ﺍﻟْﻘُﺮَﻯ ﺣَﺘَّﻰ ﻳَﺒْﻌَﺚَ ﻓِﻲْ ﺃُﻣِّﻬَﺎ ﺭَﺳُﻮﻻً ﻳَﺘْﻠُﻮ ﻋَﻠَﻴْﻬِﻢْ ﺁﻳَﺎﺗِﻨَﺎ ﻭَﻣَﺎ ﻛُﻨَّﺎ ﻣُﻬْﻠِﻜِﻲ ﺍﻟْﻘُﺮَﻯ ﺇِﻻَّ ﻭَﺃَﻫْﻠُﻬَﺎ ﻇَﺎﻟِﻤُﻮْﻥَ – ) ﺍﻟﻘﺼﺺ ৫৮-৫৯ ( –
‘আমরা অনেক জনপদ ধ্বংস করেছি; যেসবের অধিবাসীরা তাদের বিলাসী জীবন যাপনে মত্ত ছিল। তাদের এসব আবাসস্থলে তাদের পরে মানুষ খুব সামান্যই বসবাস করেছে। অবশেষে আমরাই এসবের মালিক রয়েছি’। ‘আপনার পালনকর্তা জনপদ সমূহকে ধ্বংস করেন না, যে পর্যন্ত না তার কেন্দ্রস্থলে রাসূল প্রেরণ করেন। যিনি তাদের কাছে আমাদের আয়াত সমূহ পাঠ করেন। আর আমরা জনপদ সমূহকে তখনই ধ্বংস করি, যখন তার বাসিন্দারা (অর্থাৎ নেতারা) যুলুম করে’ (ক্বাছাছ ২৮/৫৮-৫৯)।
উল্লেখ্য যে, উপরে বর্ণিত কাহিনীর প্রধান বিষয়গুলি পবিত্র কুরআনের ২২টি সূরায় ৮৭টি আয়াতে এবং কিছু অংশ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে। কিছু অংশ এমনও রয়েছে যা তাফসীরবিদগণ বিভিন্ন ইস্রাঈলী বর্ণনা থেকে সংগ্রহ করেছেন, যা সত্য ও মিথ্যা দুই-ই হ’তে পারে। কিন্তু সেগুলি কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয় এবং সেগুলির উপরে ঘটনার প্রমাণ নির্ভরশীল নয়।
কওমে ছামূদ-এর ধ্বংস কাহিনীতে শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ :
১. সমাজের মুষ্টিমেয় নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ ও শক্তিশালী শ্রেণী সবার আগে শয়তানের পাতানো ফাঁদে পা দেয় ও সমাজকে জাহান্নামের পথে আহবান করে এবং তাদেরকে ধ্বংসের পথে পরিচালনা করে। যেমন কওমে ছামূদ-এর প্রধান নয় কুচক্রী নেতা করেছিল (নামল ২৭/৪৮)।
২. দুর্বল শ্রেণীর লোকেরা সাধারণতঃ অন্যদের আগে আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাসী হয় ও এজন্য যেকোন ত্যাগ স্বীকারে প্রস্ত্তত হয়ে যায়।
৩. অবিশ্বাসীরা মূলতঃ দুনিয়াবী স্বার্থে আল্লাহ প্রেরিত শরী‘আতে বিশ্বাস ও তদনুযায়ী আমল প্রত্যাখ্যান করে এবং নিজেদের কল্পিত শিরকী আক্বীদায় বিশ্বাস ও তদনুযায়ী আমলে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে এবং তারা সর্বদা তাদের বাপ-দাদা ও প্রচলিত প্রথার দোহাই দেয়।
৪. নবী ও সংস্কারকগণ সাধারণতঃ উপদেশদাতা হয়ে থাকেন- শাসক নন।
৫. নবী ও সংস্কারকদের বিরুদ্ধে শাসক ও সমাজ নেতাগণ যুলুম করলে সরাসরি আল্লাহর গযব নেমে আসা অবশ্যম্ভাবী।
৬. মানুষকে বিপথে নেওয়ার জন্য শয়তানের সবচাইতে বড় হাতিয়ার হ’ল নারী ও অর্থ-সম্পদ।
৭. হঠকারী ও পদগর্বী নেতারা সাধারণতঃ চাটুকার ও চক্রান্তকারী হয়ে থাকে ও ঈমানদারগণের বিরুদ্ধে সাময়িকভাবে জয়ী হয়। কিন্তু অবশেষে আল্লাহর কৌশল বিজয়ী হয় এবং কখনো কখনো তারা দুনিয়াতেই আল্লাহর গযবে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। আর আখেরাতের আযাব হয় তার চাইতে কঠিনতর (ক্বলম ৬৮/৩৩)।
৮. আল্লাহ পাক তাঁর বান্দাকে নে‘মতরাজি দান করেন তাকে পরীক্ষা করার জন্য। শুকরিয়া আদায় করলে সে আরও বেশী পায়। কিন্তু কুফরী করলে সে ধ্বংস হয় এবং উক্ত নে‘মত তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়।
৯. অহংকারীদের অন্তর শক্ত হয়। তারা এলাহী গযব প্রত্যক্ষ করার পরেও তাকে তাচ্ছিল্য করে। যেমন নয় নেতা ১ম দিন গযবে ধ্বংস হ’লেও অন্যেরা তওবা না করে তাচ্ছিল্য করেছিল। ফলে অবশেষে ৪র্থ দিন তারা সবাই ধ্বংস হয়ে যায়।
১০. আল্লাহ যালেম জনপদকে ধ্বংস করেন অন্যদের শিক্ষা গ্রহণের জন্য।
১১. আল্লাহ সংশোধনকামী জনপদকে কখনোই ধ্বংস করেন না।
১২. কখনো মাত্র একজন বা দু’জনের কারণে গোটা সমাজ ধ্বংস হয়ে যায়। ছালেহ (আঃ)-এর উষ্ট্রী হত্যাকারী ছিল মাত্র দু’জন। অতএব মুষ্টিমেয় কুচক্রীদের বিরুদ্ধে বৃহত্তর সমাজকে সদা সতর্ক থাকতে হয়।
১৩. কুচক্রীদের কৌশল আল্লাহ ব্যর্থ করে দেন। কিন্তু তারা বুঝতে পারে না। যেমন ছামূদ কওমের নেতারা বুঝতে না পেরে অযথা দম্ভ করেছিল (নামল ২৭/৫০-৫১)।
১৪. আল্লাহ মানুষকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার জন্যই দুনিয়াতে ছোট-খাট শাস্তির আস্বাদন করিয়ে থাকেন ও তাদেরকে ভয় দেখান (ইসরা ১৭/৫৯; সাজদাহ ৩২/২১)।
১৫. সত্য ও মিথ্যার দ্বন্দ্বে অবশেষে সত্য সেবীদেরই জয় হয়। যেমন হযরত ছালেহ (আঃ) ও তাঁর ঈমানদার দুর্বল শ্রেণীর লোকেরা এলাহী গযব থেকে নাজাত পেয়ে বিজয়ী হয়েছিলেন ও মিথ্যার পূজারী শক্তিশালীরা ধ্বংস হয়েছিল
সামুদ জাতি ধ্বংসের ইতিহাস
হযরত সালেহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন নামাজে বসে গেলেন এবং আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করলেন যেন সামনে পাহাড় থেকে একটি গর্ভবতী স্বাস্থ্যবান উট বেরিয়ে আসে। আল্লাহ তার দোয়া কবুল করলেন এবং পাহাড় থেকে একটি গর্ভবতী স্বাস্থবান বিশালাকার উট বেরিয়ে আসলো। তখন উপস্থিত অধিকাংশই হযরত সালেহ আঃ সালামের নবুয়াত মেনে নিলেন এবং এক আল্লাহর দাসত্ব শুরু করলেন। কিন্তু সমাজের প্রভাবশালী এবং শক্তিশালী ব্যক্তিবর্গ সালেহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর আরো বেশি ক্ষেপে গেলেন এবং তার ক্ষতি করা বা হত্যা করার চেষ্টাও করলেন। হযরত সালেহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে বললেন তোমরা কখনো উটটি মেরোনা তাহলে তোমরা ধ্বংসের মুখে পতিত হবে।উটটি খোলা মাঠে চরে বেড়াতো এবং মানুষ ও অন্যান্য পশু যে কুয়ো থেকে পানি পান করত উটটি সেই থেকে পানি পান করত সবার শেষে। তখন অনেকেই উটটি হত্যা করতে চাইল কিন্তু আল্লাহর গজবের ভয়ে কেউ সাহস হলো না অবশেষে দুই পথভ্রষ্ট যুবক ওই শহরের সবচেয়ে সুন্দরী, রূপবতী দুই নারীর প্রলোভনে উটটিকে হত্যা করতে সম্মত হলো। তারা উটটিকে পা কেটে হত্যা করল এর ফলে তাদের উপর আল্লাহর গজব শুরু হয়ে গেল।
উটটিকে হত্যা করার মাধ্যমে সকল অবিশ্বাসীগণ মহান আল্লাহতালার গজব শিকারে পরিণত হলেন, প্রথমদিন অবিশ্বাসীদের মুখমন্ডল হলুদ বর্ণ ধারণ করলো, এতে মহান আল্লাহকে ভয় না পেয়ে বরং হযরত সালেহ আঃ কে হত্যা করতে তাকে খুঁজতে থাকে। এরপর দ্বিতীয় দিন তাদের সবার মুখ মন্ডল লাল বর্ণ ধারণ করে এবং তারা ভয় পেতে শুরু করে, কিন্তু তারা ঈমান আনে না। এর পরেরদিন অবিশ্বাসীদের মুখমন্ডল কালো বর্ণ ধারণ করে এবং তারা আল্লাহর গজবের জন্য ভয় পেতে শুরু করে এবং আল্লাহর গজবের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে এরপর চতুর্থ দিন সবাই শরীরে সুগন্ধি মেখে আল্লাহর গজবের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। রবিবার ভোরবেলা প্রকণ্ড ভূমিকম্পের মাধ্যমে সামুদ জাতি ধ্বংস হয়ে যায়, এমনভাবে ধ্বংস হয়ে যায় যেন মনে হয় সেখানে তারা কোনদিন ছিলই না।
sourse: wikipedia ... alokitobangladesh .... ittefaq
What's Your Reaction?






