জান্নাতের সার্টিফিকেট প্রাপ্ত সাহাবী হযরত তালহা (রা:) জীবনী | (Biography of Hazrat Talha Radiallahu anhu)
জান্নাতের সার্টিফিকেট প্রাপ্ত সাহাবী হযরত তালহা (রা:) জীবনী | (Biography of Hazrat Talha Radiallahu anhu)

তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ রাযিআল্লাহু আনহু (মৃ. ৩৬ হিজরী : ৬৫৬ খৃস্টাব্দ)
রাসূলে আকরাম ﷺ-এর জীবনকে যিনি নিজের জীবন দিয়ে খরিদ করেছিলেন। জীবদ্দশায় যিনি শাহাদাতের মর্যাদা নিয়ে ঘুরাফেরা করেছিলেন। তিনি জীবন্ত শহীদ। সমুদয় সম্পদ যিনি দান করেছিলেন খোদার রাহে। ইতিহাস যাঁর জন্মসালটি সংরক্ষণ করেছে। যাঁর ইসলাম গ্রহণের গুঞ্জন বজ্রের ন্যায় কুফর ও শিরককে প্রকম্পিত করেছে। তিনি তালহা। কল্যাণের আধার। অগ্রগামী ও প্রবীণ সাহাবা কেরামের একজন। যাঁরা ঈমান ও বিশ্বাসের ঝিরঝিরে বাতাসের সৌরভ গ্রহণ করেছিলেন। আগ্রহের ডানায় ভর দিয়ে যিনি নূর ও জ্যোতির উৎসস্থলে উড়েছিলেন। তিনি সেই দলের একজন, যাঁদেরকে ইসলাম গড়ে তুলেছিল এবং যাঁরা ইসলামের মনোনীত ব্যক্তিবর্গ।
জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশজন সাহাবা কেরামের তিনি অন্যতম। ছয় সদস্যের শূরা কমিটির তিনি একজন। রাসূলে আকরাম ﷺ ইন্তেকালের সময় যেসব সাহাবা কেরামের প্রতি বিশেষভাবে সন্তুষ্ট ছিলেন তিনি ছিলেন তাঁদের একজন। আরব প্রাজ্ঞ নেতাদের একজন। ঢোলের গুঞ্জনের চেয়ে তাঁর অন্তরে ঈমানের আওয়াজ ছিল অনেক বজ্রময়ী ও বজ্রগম্ভীর। তাঁর বজ্রকণ্ঠে ছিল বিশ্বাস ও তাওহীদের কথা। ধনৈশ্বর্যের প্রাচুর্য আর নিজ গোত্রের সুসংহত অবস্থান থাকা সত্তেও তিনি তাঁর ভূমিকা নিয়েছিলেন নির্যাতিত লোকদের সারিতে থেকে।
ইসলামের সকল সমর অভিযানে অংশগ্রহণ করেছিলেন। সমূহ ঝুঁকি নিয়ে উহুদ প্রান্তরে রাসূলের সাথে অবিচল ছিলেন। জীবনবাজির শপথ নিয়েছিলেন। নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে মহানবী ﷺ-কে রক্ষা করেছিলেন। নিজের হাত দিয়ে নবীজীর দিকে নিক্ষিপ্ত তীরাঘাত প্রতিরোধ করতে করতে অবশেষে তা অবশ হয়ে যায়। শেষতক নবীজীকে নিজের পিঠে তুলে সুরক্ষার কৃতিত্ব দেখান। তিনি ছিলেন আস্তানায় সিংহের ভূমিকার ন্যায়। নবীজী ﷺ-কে রক্ষায় তিনি প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। এক হাতে তরবারি চালিয়েছেন। আরেক হাতে মহানবী ﷺ রক্ষায় হস্তদুর্গ গড়ে তুলেছিলেন। মৃত্যুর ভয়াল ছায়ামূর্তি দেখেও যিনি ছিলেন নির্ভীক।
قالجابربنعبداللهسمعترسولاللهصلىاللهعليهوسلميقولمنسَرَّهأنينظرإلىشهيديمشيعلىوجهالأرضفلينظرإلىطلحةبنعبيدالله؛ وعنالزبيرقالكانعلىرسولاللهصلىاللهعليهوسلميومأحددرعانفنهضإلىصخرةفلميستطيعفأقعدتحتهطلحةفصعدالنبيصلىاللهعليهوسلمحتىاستوىعلىالصخرةفقالسمعتالنبيصلىاللهعليهوسلميقولأوجبطلحة. (رواه الترمذي؛ رقم الحديث : ৩৭৩৮؛ ৩৭৩৯)
মহানবী ﷺ বলেছেন [অর্থ]: ভূপৃষ্ঠে চলন্ত শহীদ যে দেখতে আগ্রহী সে যেন তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহকে দেখে। অন্য রেওয়ায়েতে আছে, উহুদ অভিযানের সময় নবীজীর গায়ে দু’টি লৌহবর্ম ছিল। তিনি একটি পাথরের উপর উঠতে চাইলেন। কিন্তু পারলেন না। সেজন্য উবাইদুল্লাহকে নিচে বসিয়ে তার উপর ভর দিয়ে তিনি পাথরের উপর উঠলেন। তখন তিনি বলেছিলেন, উবাইদুল্লাহ্ আবশ্যক করে নিয়েছে। অর্থাৎ তার জন্য জান্নাত অবধারিত হয়ে গেছে।
তাঁর হাতের তালু ছিল সদাসিক্ত। সম্পদ সঞ্চয়ে তাঁর অন্তরে দুঃখ হতো। তাই বিলিয়েছেন সম্পদ আর আনন্দ দিয়েছেন দীনদরিদ্র লোকদের আত্মাকে। হযরত জাবের রা. বলেছেন, না চাইতে এমন অঢেল দিতে তালহার চাইতে আর কাউকে দেখিনি। একবার ‘হাযরামাউত’ এলাকা থেকে সাত লক্ষ মুদ্রামানের সম্পদরাজি তাঁর কাছে আসে। তিনি সে রাত পাখির অস্থিরতায় যাপন করেছেন। তাঁর সহধর্মিণী সিদ্দীক তনয়া উম্মে কুলসুম বললেন, এমন করছেন কেন, কী হয়েছে? তিনি ভীতসন্তস্ত্র হয়ে বললেন, সারারাত ধরে আমি এসকল সম্পদ নিয়ে ভেবে হয়েছি ব্যাকুল। মনে মনে বলেছি, ঐ ব্যক্তির ঈমানের কী অবস্থা, যে ব্যক্তি এতো বিপুল সম্পদ নিয়ে রাত যাপন করে? তাঁর সহধর্মিণী বললেন, সকাল বেলায় এগুলো বিভিন্ন পাত্রে নিয়ে ভাগ করে দিলেই তো হয়। তখন তালহা রা. এর চেহারা হাস্যোজ্জ্বল হয়ে উঠে। তিনি খুশিতে বলে উঠলেন, আল্লাহ তোমাকে রহম করুন। সত্যিই তুমি সৌভাগ্যবানের সৌভাগ্যবতী মেয়ে।
সকাল বেলায় হযরত তালহা রা. কতগুলো ডিশ ও পাত্র আনালেন। তিনি মুহাজির ও আনসারদের মাঝে সেই সম্পদ বন্টন করে দিলেন। তাঁর সহধর্মিণী উম্মে কুলসুম বললেন, হে আবু মুহাম্মাদ (তালহা)! এই সম্পদরাজিতে আমাদের কি হিস্যা নেই? তিনি বললেন, দিনভর কোথায় ছিলে? এখন অবশিষ্ট যা আছে তাই নিয়ে নাও। তিনি একটি থলে নিয়ে দেখলেন, তাতে মাত্র একহাজার দিরহাম রয়েছে।
একবার এক বেদুঈন আবু তালহা রা. এর কাছে কিছু চেয়ে আসল। সে তাঁর কাছে আত্মীয়তা আর রিশতাদারি দিয়ে নৈকট্য লাভের চেষ্টা করতে লাগল। তালহা রা. বললেন, রিশতাদারির দোহাই দিয়ে তোমার আগে আর কেউ আমার কাছে চায়নি। আমার এক টুকরা জমি আছে। হযরত উসমান রা. আমার সেই জমিটা তিন হাজার দিরহাম (স্বর্ণমুদ্রা) দিয়ে কিনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমি তা বিক্রি করিনি। তুমি সেই জমিটা নাও। চাইলে হযরত উসমান রা.-এর নিকট বিক্রি করে মূল্য নিয়ে পারো। ইচ্ছা করলে সেই জমিটা নিজের কাছে রেখে দিতে পারো। হযরত তালহা রা. সেই জমিটা হযরত উসমান রা.-এর নিকট বিক্রি করে মূল্যটা লোকটিকে দিয়ে দিলেন।
হযরত তালহা রা.-এর স্ত্রী সু’দা বিনতে আওফ বলেন, একদিন হযরত তালহা চিন্তিত অবস্থায় আমার কাছে আসলেন। আমি বললেন, কী হয়েছে? মনে হয় আপনি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত? তিনি বললেন, না, কসম! তুমি তো খুব ভালো সহধর্মিণী! তবে আমার কাছে সামান্য অর্থকড়ি রয়েছে যা নিয়ে আমি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। স্ত্রী বললো, দুশ্চিন্তার কী আছে? এগুলো আপনার লোকদের মাঝে বিলিয়ে দিন। একথা শোনে হযরত তালহা রা. তারস্বরে বলে উঠলেন, খোকা! আমার গোত্রের লোকদেরকে ডাকো। তাদেরকে এসব সম্পদ বন্টন করে দাও। স্ত্রী সু’দা বিনতে আওফ বলেন, অর্থদাতাকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, দানের পরিমাণ কেমন ছিল? সে বলল, চার লক্ষ।
হযরত তালহা রা. ব্যবসায়ী ছিলেন। বনী তামীমের এমন কোন দীনদরিদ্র ছিল না যার ভরণপোষণ তিনি করতেন না। যথেষ্ট পরিমাণ দান করতেন, তাদের ঋণ আদায় করতেন। তিনি প্রতি বছর সাইয়্যেদাহ আয়িশা রা.-এর নিকট দশ হাজার দিরহাম পাঠাতেন। একদিন তিনি একলক্ষ দিরহাম দান করেছেন।
জঙ্গে জামাল বা উষ্ট্রীর যুদ্ধের সময় হযরত তালহা রা. গ্রহণ করেছিলেন হযরত আয়িশা রা. এর পক্ষ। সেই যুদ্ধে তিনি শহীদ হয়েছিলেন। হিজরী ৩৬ সালে তিনি বসরা নগরীতে সমাহিত হন। বাষট্টি বছর বয়সে তিনি পরলোকগমন করেন। বসরা শহরের ‘জাহিরা’ অঞ্চলে তাঁর সমাধি রয়েছে।
What's Your Reaction?






