মাইকেলেঞ্জেলো এর জীবনী-biography of michelangelo

মাইকেলেঞ্জেলো এর জীবনী-biography of michelangelo

May 13, 2025 - 10:39
May 13, 2025 - 22:22
 0  1
মাইকেলেঞ্জেলো এর জীবনী-biography of michelangelo

মাইকেলেঞ্জেলো: যে শিল্পী রেনেসাঁস বিপ্লবে দিয়েছেন এক নতুন মাত্রা

প্রথম জীবন

মিকেলাঞ্জেলোর জন্ম হয় ১৪৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ৬ মার্চ, জন্মস্থান ক্যাপ্রিসি, যা তাসকানি-র আরেজ্জো-র কাছাকাছি অবস্থিত। ক্যাপ্রিসির বর্তমান নাম ক্যাপ্রিসি মিকেলাঞ্জেলো। কয়েক প্রজন্ম ধরে তার পূর্বপুরুষরা ফ্লোরেন্সে ক্ষুদ্র পরিসরে ব্যাংকিং করতেন। ব্যাংক সর্বস্বান্ত হবার কারণে তার পিতা, লুদভিকো দি লিওনার্দো বুওনারোত্তি সিমোনি, কিছু সময়ের জন্য ছোট শহর ক্যাপ্রিসিতে সরকারি প্রশাসক হিসাবে দায়িত্ব পালনে আসেন, এবং এখানেই মিকেলাঞ্জেলোর জন্ম হয়। তার মায়ের নাম ফ্রাঞ্চেসকা দি নেরি দেল মিনিয়াতো দি সিয়েনা। মিকেলাঞ্জেলোর জন্মের কয়েক মাস পরে তার পরিবার ফ্লোরেন্সে ফিরে আসে, তার পরে সেখানেই তিনি বড় হয়ে ওঠেন। পরবর্তীতে তার মায়ের ক্রমাগত অসুস্থতার সময়ে এবং মৃত্যুপরবর্তীকালে (১৪৮১, তখন মিকেলাঞ্জেলোর বয়স ৬ বছর) তিনি সেত্তিগনানো শহরে এক পাথর খোদাইকারীর পরিবারের সাথে বসবাস করেন। এই শহরে মিকেলাঞ্জেলোর পিতার মালিকানাধীন একটি মার্বেল খনি ও একটি ছোট খামার ছিল।

উল্লেখযোগ্য কীর্তি

সিঁড়িতে ম্যাডোনা (ম্যাডোনা অফ দ্য স্টেপস) মিকেলেঞ্জেলোর প্রথম উল্লেখযোগ্য কীর্তি। ১৪৯১ সালে, যখন তার বয়স মাত্র ১৭ বছর, পাতলা মার্বেলের উপর খোদাই করে এই ভাস্কর্যটি তিনি তৈরি করেন। ম্যাডোনার কোলে বসা বাচ্চাটির শরীরে একটু বেঁকে বসার যে ভঙ্গীটি আমরা এই ভাস্কর্যে দেখতে পাই, সেটিই পরবর্তীকালে মিকেলেঞ্জেলোর কাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিকশিত হয়। ভ্যাটিকান শহরের সন্ত পিতরের ব্যাসিলিকা গির্জায় রক্ষিত পিয়েতা ভাস্কর্যটি ইতালিয় নবজাগরণের যুগের ভাস্কর্যশিল্পর এক অনবদ্য নিদর্শন। ১৪৯৮-৯৯ সালের মধ্যে তিনি এই ভাস্কর্যটি তৈরি করেন। মার্বেলে তৈরি এই মূর্তিটিতে দেখা যায় ক্রুশ থেকে নামানো যিশুর মৃতদেহ কোলে শোকস্তব্ধ মা মেরি। একজন ৩৩ বছর বয়সী ছেলের মা হিসেবে মেরির যথেষ্ট কম বয়স, অথচ ভঙ্গীমার মধ্য দিয়ে শোকস্তব্ধ মাতৃত্বর এক আশ্চর্য জীবন্ত প্রতিচ্ছবি এই ভাস্কর্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ১৫০২ সালে তার সৃষ্ট আরেকটি খোদাই শিল্প তাদেও তোন্ডো, সেখানে খোদিত শিশু যিশু খ্রিষ্টের আশ্চর্য জীবন্ত প্রতিকৃতির জন্য সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। ক্রুশের প্রতীক দেখে ভীষণ বিচলিত শিশু যিশুর এই ভঙ্গী পরবর্তীকালে আরও বহু শিল্পীর প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে।

যেমন রাফায়েলের সৃষ্ট ব্রিজওয়াটার ম্যাডোনার মধ্যেও আমরা এর ছাপ দেখতে পাই। বেলজিয়ামের ব্র্যুজ শহরে রক্ষিত ম্যাডোনা ও শিশু (১৫০৪) ভাস্কর্যটিও তার আর এক অনবদ্য কীর্তি। এখানেও শিশু যিশু আশ্চর্য জীবন্ত। দেখে মনে হয় তিনি যেন এখনই মার কোল ছেড়ে পৃথিবীর পথে ঝাঁপ দিতে প্রস্তুত। মা ম্যাডোনা শুধু বাঁহাতে আলতো করে তাকে তখনও ধরে আছেন। এই ভাস্কর্যটি আরও উল্লেখযোগ্য, তার কারণ মিকেলেঞ্জেলোর জীবনকালেই ইতালির বাইরে যাওয়া তার একমাত্র শিল্পকর্ম এটিই। ৪ হাজার ফ্লোরিনের বিনিময়ে এটি বিক্রি হয় ও জিওভানি এটি বেলজিয়ামের ব্র্যুজ শহরে নিয়ে আসেন। যতদূর সম্ভব এই মূর্তিটি গির্জার বেদিতে (অল্টারে) বসানোর জন্য তৈরি করা হয়েছিল। ম্যাডোনার সামান্য ডানদিকে ঘোরানো মুখ ও নিচের দিকে নীমিলিত দৃষ্টি তেমনই ইঙ্গিত করে। ইতোমধ্যেই উল্লিখিত পিয়েতা ভাস্কর্যটির সাথে এই ভাস্কর্যটির বিষয়গত মিল বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ১৫০৪-০৬'এর মধ্যে অঙ্কিত দোনি তোন্ডো তার আরেক উল্লেখযোগ্য শিল্পকর্ম। এর বিষয়বস্তু হল 'পবিত্র পরিবার', অর্থাৎ কুমারী মা মেরি, শিশু যিশু ও যোসেফ। ছবিটির বৃত্তাকার গঠন ও চরিত্রগুলির জীবন্ত রূপের মধ্যে পূর্বে উল্লিখিত 'তাদেও তোন্ডো'র ছাপ সহজেই চখে ধরা পড়ে। উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার এ' ছবির আরেক উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। পরবর্তীকালে সিস্টিন চ্যাপেলের ছাদে অঙ্কিত তার ছবির অনেক বৈশিষ্ট্যই এই ছবতে চিহ্নিত করা সম্ভব।

শিল্পী বিপ্লব

সভ্যতার একদম শুরু থেকেই মানুষ প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে নানা কারণে ছবি আঁকছে, ভাস্কর্য তৈরি করছে। সময় যত অগ্রসর হচ্ছে, শিল্পকলার ততই প্রসার হচ্ছে। সময়ের হাত ধরে শিল্পীরা পৃথিবীকে উপহার দিয়ে যাচ্ছেন অসাধারণ সব শিল্পকর্ম। এরকমই এক অন্যতম শিল্পী মাইকেলেঞ্জেলো, ইউরোপীয় রেঁনেসাসের সময় যার জন্ম।

‘রেনেসাঁস’ শব্দের উৎপত্তি ইউরোপের সাংস্কৃতিক ইতিহাস থেকে, যার অর্থ পুনর্জাগরণ। ইউরোপীয় রেনেসাঁসে অর্থনীতি-রাজনীতির অনেক বিকাশ ঘটলেও এর শিল্পের বিকাশ সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। আর এই বিকাশের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র মাইকেলেঞ্জেলো। মাইকেলেঞ্জেলোর জন্ম ১৪৭৫ সালের ৬ মার্চ, ক্যাপ্রিসিতে। তার পূর্বপুরুষ ফ্লোরেন্সে বসবাস করতেন এবং সেখানেই ব্যাংকিংয়ের সাথে জড়িত ছিলেন। কিন্তু একসময় ব্যাংকিংয়ের কাজে বড় ধরনের ক্ষতি হওয়ায় মাইকেলেঞ্জেলোর বাবা ক্যাপ্রিসিতে আসলে এখানেই মাইকেলেঞ্জেলোর জন্ম হয়।

তার বাবা লুদভিকো দি লিওনার্দো বুওনারোত্তি সিমোনি এবং মা ফ্রাঞ্চেসকা দি নেরি দেল মিনিয়াতো দি সিয়েনা।ন্মের কয়েক মাস পর তারা আবার সপরিবারে ফ্লোরেন্সে ফিরে যান এবং সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর ছয় বছর বয়সে, তার মা মারা গেলে তিনি সেত্তিগনানো নামক শহরের এক পাথর খোদাইকারী পরিবারে সাথে থাকতে শুরু করেন। এখানেই তার ভাস্কর্য তৈরির হাতেখড়ি হয়।

মাইকেলেঞ্জেলো ছিলেন একাধারে চিত্রশিল্পী, ভাস্কর ও স্থপতি। কিন্তু ছোট থেকেই মার্বেল পাথর খোদাইয়ের সাথে জড়িত থাকায় এদিকে ঝোঁকও ছিল তুলনামূলক বেশি। তার ধারণা ছিল- মানবদেহের আসল সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলা যায় ভাস্কর্যে। কথাটি যে খুব একটা ভুল নয়, সেটা তার ভাস্কর্যগুলো দেখলেই বুঝতে পারা যায়।

মাইকেলেঞ্জেলোর সৃষ্ট ভাস্কর্যগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘পিয়েতা’। মার্বেল পাথরের এই মর্মস্পর্শী ভাস্কর্য তিনি তৈরি করেন ভ্যাটিকানের সেন্ট পিটার ব্যাসিলিকার জন্য। ভাস্কর্যে উপস্থিত মাতা মেরির কোলে ক্রুশবিদ্ধ যীশুর প্রাণহীন দেহ দেখানো হয়েছে। মাতা মেরি জাগতিক সবকিছু ভুলে গভীর শোকে আচ্ছন্ন হয়ে নির্মীলিত নেত্রে তাকিয়ে আছেন তার মৃত পুত্রের মুখের দিকে। এমন স্তব্ধ, সংযত, শোকাবহ, শান্ত কিন্তু পবিত্র ভাব কীভাবে শক্ত পাথরের গায়ে প্রতিফলিত হলো তা এক রহস্যই বটে! 

পিয়েতা’র পর মাইকেলেঞ্জেলো ফ্লোরেন্সে গিয়ে নির্মাণ করেন ‘ডেভিড’। পূর্বে দোনাতোল্লা এবং ভেরোচ্চিও ডেভিড নির্মাণ করলেও অ্যাঞ্জেলোর ডেভিডের তুলনায় সেগুলো ছিল আকারে ছোট, অল্পবয়স্ক বালক, আর এই ডেভিড আকারে বেশ বড় এবং বয়সে যুবক। পূর্বের ডেভিডদের শরীর জামাকাপড় ও অস্ত্রে সজ্জিত, কিন্তু অ্যাঞ্জেলোর ডেভিড সম্পূর্ণ নগ্ন এবং সুঠাম দেহের অধিকারী, ফলে পুরুষোচিত সৌন্দর্যের আধার হয়ে ওঠে তার ডেভিড। দেহের প্রতিটি ভাঁজ আদর্শায়িত, যার সাথে গ্রীক বা রোমান ক্ল্যাসিক্যাল স্টাইলের মিল পাওয়া যায়। শরীর এবং মুখভঙ্গির মধ্যে দেখা যায় দৃঢ় আত্মবিশ্বাস এবং কিছুটা বেপরোয়া কিন্তু শান্ত ভাব। সব মিলিয়ে বেশ অস্থির অথচ প্রস্তুত একটি ভঙ্গি পরিলক্ষিত হয়।

মাইকেলেঞ্জেলোর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো পোপ দ্বিতীয় জুলিয়াসের সমাধিসৌধের ভাস্কর্য। মার্বেলে নির্মিত ‘ডাইং স্লেইভ’ বা ‘মৃত্যুপথযাত্রী দাস’ নামক দণ্ডায়মান এই ভাষ্কর্যে তিনি মূর্ত করেছেন মৃত্যুর ঠিক আগমূহুর্তকে। মৃত্যুর আগে শুধু মৃত্যুযন্ত্রণা নয়, জাগতিক দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্তির এক অদ্ভুত প্রশান্তির ব্যাকুলতাও ব্যক্ত হয়েছে এখানে। এত ছন্দময়তা এবং সচল ভঙ্গি যে ফিগারটি দেখে বাস্তব বলে ভ্রম হয়।

মাইকেলেঞ্জেলোর সবচেয়ে বিখ্যাত এবং জনপ্রিয় শিল্পকর্মটি হল ডেভিড (David) এর ভাস্কর্য

এই ভাস্কর্যটি প্রায় ৫.১৭ মিটার (১৭.0 ফুট) লম্বা। এটি আসলে একটি মার্বেলের তৈরি পুরুষ নগ্ন মূর্তি। আর মূর্তিটি প্রতিনিধিত্ব করছে বাইবেলের নায়ক ডেভিডকে। তার তৈরি ডেভিডের এই মূর্তিটি অন্য সবার মত ছিল না। যেখানে বেশিরভাগ শিল্পী এবং ভাস্কর গোলিয়াথ এর সাথে যুদ্ধের পর ডেভিডের জয়ী রূপ তুলে ধরেছেন সেখানে মাইকেলেঞ্জেলো তুলে ধরেছেন যুদ্ধে যাওয়ার আগে ডেভিডের চিন্তিত এবং সতর্ক অবস্থান। মাইকেলেঞ্জেলো ডেভিড এর কাজ শুরু করেন তার বয়স যখন মাত্র ২৬! এবং এই কাজ শেষ হতে সময় লাগে প্রায় ৩ বছর। তার এই কাজ দেখলে বিশ্বাসই হয় না যে তিনি এটি পাথর কেটে তৈরি করেছেন।

ম্ত্যু:

১৫৬৪ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

What's Your Reaction?

Like Like 0
Dislike Dislike 0
Love Love 0
Funny Funny 0
Angry Angry 0
Sad Sad 0
Wow Wow 0