মাইকেল ফ্যারাডে এর জীবনী | Biography of Michael Faraday

মাইকেল ফ্যারাডে এর জীবনী | Biography of Michael Faraday

May 14, 2025 - 10:32
May 16, 2025 - 01:09
 0  1
মাইকেল ফ্যারাডে এর জীবনী | Biography of Michael Faraday

মাইকেল ফ্যারাডে – যে বিজ্ঞানীর কাছে পুরো মানবজাতি কৃতজ্ঞ

মাইকেল ফ্যারাডে:

 (সেপ্টেম্বর ২২১৭৯১ – আগস্ট ২৫, ১৮৬৭) একজন ইংরেজ রসায়নবিদ এবং পদার্থবিজ্ঞানী ছিলেন। তড়িচ্চুম্বক তত্ত্ব এবং তড়িৎ রসায়নের ক্ষেত্রে তার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। তিনি প্রতিষ্ঠা করেন যে, চুম্বকত্ব আলোকে প্রভাবিত করে এবং এই দুই প্রত্যক্ষ ঘটনার মধ্যে একটি অন্তর্নিহিত সম্পর্ক রয়েছে। তার আবিষ্কারের প্রধান বিষয়বস্তুগুলোর মধ্যে রয়েছে তড়িচ্চুম্বক আবেশডায়াম্যাগনেটিজমতড়িৎ বিশ্লেষণ। তিনি বিদ্যুতের জনক হিসেবে পরিচিত।

জন্ম – ২২শে সেপ্টেম্বর, ১৭৯১, জন্মস্থান – লন্ডন, ইংল্যান্ড
শৈশব – কী অদ্ভুত কষ্টে আর সমস্যায় যে কেটেছে এই লোকটার শৈশব!
স্ত্রী – সারাহ বার্নার্ড
সন্তান – নেই
ঝোঁক – পদার্থ (বিশেষ করে তাড়িৎ-চৌম্বক), রসায়ন
আবিষ্কার – ওরে বাবা! এখানে লিখে শেষ করা যাবে না। পাবেন নিচের দিকে, গল্পে গল্পে আসবে। শুধু একটা জিনিস বলে রাখি, তার কাজের মাহাত্ম্য বোঝানোর জন্য – আধানের একক ফ্যারাডে (অবশ্য এখন কুলম্ব ব্যবহার করা হয়), আধান সংরক্ষণ ক্ষমতার একক ফ্যারাড (Farad, ফ্যারাডে নয়), এক মোল ইলেকট্রনে আধানের পরিমাণকে বলে ফ্যারাডে ধ্রুবক বা Faraday Constant.

পুরষ্কার – Royal Medal (দুইবার), Copley Medal (দুইবার), Rumford Medal, Albert Medal
মৃত্যু – ২৫শে আগস্ট, ১৮৬৭, মৃত্যুস্থল – ইংল্যান্ড

জন্ম ও শৈশব

১৭৯১ সালের ২২শে সেপ্টেম্বর ইংল্যান্ডে নিউইংটন বাটস অঞ্চলে ফ্যারাডের জন্ম। তার বাবা জেমস ছিলেন একজন কামার। বাড়ির কাছে একটি প্রাথমিক স্কুল এ কিছুদিন পড়াশোনা করছেন ফ্যারাডে। তারপর আর্থিক অনটনের কারণে মাঝপথেই স্কুল ছেড়ে দিতে হয়। তারপর আর কোনোদিন স্কুলে যাওয়ার সৌভাগ্য হয় নি তার।

বিজ্ঞানের জগতে পদার্পণ:

পরিবারের আর্থিক অবস্থার কথা চিন্তা করে তিনি একটি বইয়ের দোকানে কাজ নেন। সেখান থেকে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা মানুষের বাড়ি গিয়ে গিয়ে বিক্রি করাই ছিল তার কাজ। এক বছর কাজ করার পর তাকে বই বাঁধাইয়ের কাজ দেওয়া হয়, যাতে কষ্ট আরেকটু কম হয়। এই কাজের ফাঁকে পড়ার সুযোগ বেশি। বিজ্ঞানবিষয়ক বইগুলো তাকে বেশি আকর্ষণ করে। কিছুদিনের মধ্যে তিনি তার বাড়িতে বিজ্ঞানের গবেষণার জন্য ছোট একটা গবেষণাগার তৈরি করে ফেলেন। হাত খরচের পয়সা বাঁচিয়ে গবেষণার জন্য একটা দুইটা জিনিস কিনতেন। আবার অনেক জিনিস ফেলে দেওয়া আবর্জনা থেকে তুলে নিয়ে নিজে তৈরি করে নিতেন। একদিন হঠাৎ করে ২১ বছর বয়সে তিনি স্যার হামফ্রে ডেভির সাথে কাজ করার সুযোগ পেলেন। হামফ্রে তাকে ল্যাবরেটরির বোতল ধোয়ার কাজ দিলেন। কাজের ফাঁকেই তিনি হামফ্রের গবেষণা মনোযোগ সহকারে দেখতেন।

গবেষণার মূল্যায়ন

ফ্যারাডের গবেষণাকে মূলত তিনটি অংশে ভাগ করা যায়। তিনি প্রথমে রসায়ন নিয়ে গবেষণা করতেন। ধীরে ধীরে চুম্বক শক্তি সংক্রান্ত গবেষণার প্রতি মনোযোগী হয়ে ওঠেন। তিনি প্রধানত তড়িৎ ও চুম্বক শক্তির মধ্যেকার সম্পর্ক নির্ণয় এবং তড়িৎ শক্তির সাহায্যে কীভাবে যান্ত্রিক শক্তি লাভ করা সম্ভব, তা নিয়ে ব্যাপক অনুসন্ধান করেন এবং এই কাজে অনেকখানি সাফল্য লাভ করেন। এই সময় বিজ্ঞানী ওয়ালস্টন একই বিষয় নিয়ে গবেষণা করছিলেন। তিনি ফ্যারাডের বিরুদ্ধে তার গবেষণার বিষয়বস্তু চুরির অভিযোগ আনেন। যদিও অভিযোগ মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়, তবুও ফ্যারাডে নিজেকে বিদ্যুৎ সংক্রান্ত গবেষণা থেকে সরিয়ে আনেন। তারপর তিনি রসায়ন শাস্ত্রের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অনুসন্ধান করতেন।

দীর্ঘ সাত বছর পর ১৮৩১ সালে আবার ফিরে এলেন তিনি তার তড়িৎ চুম্বক গবেষণায়। অবশেষে কিছুদিনের মধ্যেই তিনি ডায়নামো প্রস্তুত করে ফেললেন। তিনি এই মেশিনের নাম দেন ম্যাসোনো ইলেক্ট্রিক মেশিন। তারপর ১৮৪১ সালে তিনি আবিষ্কার করে ফেললেন তার যুগান্তকারী তত্ত্ব আলোর ওপর চুম্বকের প্রভাব। এই আবিষ্কারের উপর ভিত্তি করেই জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল বার করলেন তার বিখ্যাত তড়িচ্চুম্বকীয় সমীকরণ। আমরা এখন যে বিদ্যুৎ সুবিধা ভোগ করছি, তা মূলত মাইকেল ফ্যারাডেরই আবিষ্কার । তিনি সবসময় বলতেন যে:

জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সবকিছুকে সমানভাবে গ্রহণ করা, আর অবিচলভাবে নিজের পক্ষে এগিয়ে চলা।

স্মরণশক্তি আর বিষণ্ণতা সংক্রান্ত সমস্যা

৪৯ বছর বয়সে ফ্যারাডে স্মৃতিশক্তিজনিত অসুস্থতার মুখোমুখি হলেন। তার স্মরণশক্তি দুর্বল হয়ে পড়লো। অনেক সময় অনেক কিছু তিনি মনে করতে পারতেন না। এজন্য তার মধ্যে প্রচণ্ড বিষণ্নতা তৈরি হলো। হবারই কথা! তিনি একজন বিজ্ঞানী, মস্তিষ্ক তার হাতিয়ার। আর সেই হাতিয়ারই কিনা তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছিলো। ফ্যারাডে কি এখানেই দমে যাবেন?

তিনি সম্পূর্ণ সেরে ওঠেননি কখনোই। কিন্তু তার সবচেয়ে মহান আবিষ্কারগুলো, যেগুলো আমরা এখনো পড়ি, সেগুলো কিন্তু আরো পরের কথা!

তিন শক্তির বন্ধন

ইতোপূর্বে আমরা জানলাম যে, ফ্যারাডে বিদ্যুৎ আর চৌম্বক বলের মধ্যে সম্পর্ক আবিষ্কার করেছিলেন। এই দুটো বল (force) মিলে হচ্ছে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক বা তাড়িত-চৌম্বক বল। কিন্তু এই দুই বল কি অন্য কোনোকিছুর সাথে সম্পর্কিত? তিনি তিন ধরনের শক্তির (energy) মধ্যে সম্পর্ক আছে কিনা পরীক্ষা করে দেখতে চাইলেন। তৃতীয় শক্তিটার নাম ছিলো আলো। তিনি দেখতে চাইলেন ইলেকট্রোম্যাগনেটিক বল প্রয়োগ করে পোলারাইজড আলোকরশ্মিকে বাঁকিয়ে দেয়া যায় কিনা। তিনি একের পর এক পরীক্ষা করলেন। তিনি দেখলেন, সাধারণ বায়ু বা শূন্য মাধ্যমে চলা আলোকে বাঁকানো যাচ্ছে না। তাই তিনি আর অনেক অনেক মাধ্যম ব্যবহার করলেন। আলোকে সেগুলোর মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত করে চৌম্বকক্ষেত্র দিয়ে বাঁকাতে চাইলেন, কিন্তু পারলেন না। বিভিন্ন গ্যাস নিয়ে চেষ্টা করলেন, তরল (এমনকি অ্যাসিড) নিয়ে চেষ্টা করলেন; পারলেন না। অনেকটা বেপরোয়া হয়ে, মাধ্যমের জায়গায় বসিয়ে দিলেন নিজের ব্যর্থতার স্মৃতিচিহ্নটিকে, সেই কাঁচের বিস্কিটটিকে। মনে আছে তো সেটার কথা? যাই হোক, সেটার মধ্যে দিয়ে গমন করে আলো তার গতিপথ পালটে নিলো! এই পরীক্ষার ফলাফল কেন মানবজাতির জন্য মহা গুরুত্বপূর্ণ?

এই কারণে যে, এর মাধ্যমেই আমরা প্রকৃতির উপাদানগুলো যে আসলে একে অপরের সাথে কতটা গভীরভাবে সংযুক্ত, সেটা বুঝতে পারলাম। ব্রহ্মাণ্ডের আদি শক্তিগুলোর মধ্যে যে কী লীলাখেলা চলে, তা তিনি দেখিয়ে দিলেন। এই আবিষ্কারটাই আইনস্টাইন, হাবল, লেমিত্রের আবিষ্কারগুলোর পথ সুগম করে দিয়েছিলো।

চৌম্বকক্ষেত্র এবং চৌম্বক বলরেখার আবিষ্কার

কেন চুম্বক জিনিসটা সবসময় উত্তর-দক্ষিণ হয়ে থাকে – এটা নিয়ে মানুষ ভেবেছে সবসময়ই। লোহার গুঁড়াকে চুম্বকের ওপর ছড়িয়ে দিলে যে এমন একটা আকৃতি ধারণ করে, এটাও জানা ছিলো।কিন্তু কেন এমন হয়, কেউ জানতো না। ফ্যারাডে জানতেন, ইলেকট্রিসিটি প্রবাহিত করলে তারও চুম্বকে পরিণত হয়। তিনি সেটাকে দিয়ে একই পরীক্ষা করলেন। ফলাফল আসলো এরকম।

এবার তিনি বুঝতে পারলেন, চুম্বক জিনিসটা সবসময়েই নিজের চারপাশে একটা ক্ষেত্র তৈরি করে। প্রথমে তিনি এটাকে চৌম্বক বলরেখা (magnetic lines of force), পরবর্তীতে শুধু বলরেখা (lines of force), এবং আরো পরে চৌম্বকক্ষেত্র (magnetic field) বলা শুরু করলেন।

তিনি এমন এক প্রশ্নের সমাধান দিলেন যা আইজ্যাক নিউটনকেও হতবাক করে দিয়েছিলো। নিউটন মহাকর্ষের সূত্র দিয়েছিলেন; কিন্তু তিনি জানতেন না, এতো দূর থেকেও স্পর্শ না করেই মহাকর্ষ কিভাবে কাজ করে? ফ্যারাডে বললেন, ওদের মহাকর্ষের ক্ষেত্র কিন্তু ঠিকই একে অপরকে স্পর্শ করে। এজন্যেই চুম্বক, পৃথিবী নামক দানবীয় চুম্বকের বলরেখা দ্বারা প্রভাবিত হয়, এজন্যেই সে উত্তর-দক্ষিণে মুখ করে থাকে।

জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল, পুরনো অতীতের ভূত

নিজের আবিষ্কারটাকে তিনি সবার কাছে প্রচার করলেন। কিন্তু সেটার পেছনে কোনো গাণিতিক ব্যাখ্যা দিতে পারলেন না। কারণ, সেই যে ছোটোবেলায় তিনি দারিদ্র্যে ভুগেছিলেন, ঐ যে তিনি স্কুল ছেড়ে দিয়েছিলেন। গণিতের জটিলতা তিনি কখনোই বুঝে উঠতে পারেননি। তাই প্রায় সবাই ফ্যারাডের কথাগুলোকে প্রমাণ হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানালো। কেউ কেউ খোঁচা মারতেও ছাড়লো না। এমন সময় তার সাহায্যে এগিয়ে এলেন মোটামুটি সুপরিচিত একজন তরুণ গণিতবিদ, জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল।

মৃত্যু

জীবিত থাকা অবস্থায় মাইকেল ফ্যারাডেকে প্রস্তাব দেয়া হয়েছিলো যে ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবি (Westminster Abbey)-তে তার কবর দেয়া হবে। সেখানে ব্রিটেনের রাজা-রাণীদের কবর দেয়া হয়। সেখানে আইজ্যাক নিউটনের মত বিজ্ঞানীর মৃতদেহ রাখা আছে। তিনি সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। ৭৫ বছর বয়সে, ১৮৬৭ সালের আগস্টের ২৫ তারিখে, মারা যাওয়ার পর তাকে লন্ডনের হাইগেইট সেমেটারিতে কবর দেয়া হয়। সেখানে স্ত্রী সারাহ এবং তার কবর পাশাপাশি।

What's Your Reaction?

Like Like 0
Dislike Dislike 0
Love Love 0
Funny Funny 0
Angry Angry 0
Sad Sad 0
Wow Wow 0