আল-ইদরিসি এর জীবনী | Biography of Muhammad al-Idrisi
আল-ইদরিসি এর জীবনী | Biography of Muhammad al-Idrisi

জন্ম |
আনু. ১১১০ সেউতা, আলমোরাভিদ রাজবংশ
(বর্তমানে স্পেন) |
---|---|
মৃত্যু |
১১৬৫ (বয়স ৬৪–৬৫) সেউতা, আলমোহাদ খিলাফত
(বর্তমানে স্পেন) |
পরিচিতির কারণ |
তাবুলা রজারিয়ানা |
বৈজ্ঞানিক কর্মজীবন |
|
কর্মক্ষেত্র |
ভূগোলবিদ, লেখক, বিজ্ঞানী, মানচিত্রাঙ্কনবিদ্যা |
মুহাম্মদ আল-ইদ্রিসি এর সম্পর্কিত ধারনা
আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মাদ আল-ইদ্রিসি আল-কুরতুবী আল-হাসানী আস-সাবিত,
বা সাধারণভাবে আল-ইদ্রিসি (/ælɪˈdriːsiː/; আরবি: أبو عبد الله محمد الإدريسي القرطبي الحسني السبتي; লাতিন: Dreses; ১১০০ - ১১৬৫), ছিলেন একজন আরব মুসলিম ভূগোলবিদ, মানচিত্রাঙ্কনকার এবং মিশরতত্ত্ববিদ যিনি কিছু সময়ের জন্য রাজা ২য় রজারের শাসনামলে সিসিলির পালের্মোতে বসবাস করেছিলেন। মুহম্মাদ আল-ইদ্রিসি সেউতাতে জন্মগ্রহণ করেন তখন তা আলমোরাভিডদের অন্তর্গত ছিলেন। তিনি তাবুলা রোজেরিয়ানা তৈরি করেছেন, মধ্যযুগীয় বিশ্বের অন্যতম উন্নত মানচিত্র। তিনি ১১৫৪ সালে সর্বপ্রথম বিশ্বের মানচিত্র তৈরি করেছিলেন।
বিশ্ববিখ্যাত আবিষ্কারক Christopher colombas এবং Vasco da-gama যে মানচিত্র নিয়ে বিশ্ব আবিষ্কারে বেরিয়েছিলেন সেই মানচিত্রটিও আল-ইদ্রিসি এর আঁকা।
তাঁর আরেকটি অন্যতম বৈশিষ্ট ছিলো যে তিনি যত মানচিত্র আঁকতেন সবগুলো মানচিত্র ছিলো উল্টো অর্থ্যাৎ উপরের দিক দক্ষিণ আর নীচের দিক ছিল উত্তর।
প্রারম্ভিক জীবন
আল-ইদ্রিসি উত্তর আফ্রিকা এবং আল-আন্দালুস এর হাম্মুদিদ রাজবংশ থেকে এসেছেন তিনি ইদ্রিসিদ রাজবংশ এর মাধ্যমে মুহাম্মদএর বংশধর। আল-ইদ্রিসি ১১০০ সালে সেউতা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তখন আলমোরাভিদ রাজবংশ এর অধীনে ছিল। তার প্রপিতামহ হাম্মুদিদ রাজবংশ এর মালাগা শহরের পতনের পর গ্রানাডা-এর জিরিদদের জন্য সেখানেই বসবাস করতে বাধ্য হন। তার প্রপিতামহ হাম্মুদিদ রাজবংশ এর মালাগা শহরের পতনের পর গ্রানাডা-এর জিরিদদের জন্য সেখানেই বসবাস করতে বাধ্য হন। ভ্রমণে ব্যয় করেন এবং মনে হচ্ছে তিনি এই দুটি অঞ্চলের ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করেছেন। তিনি ১৬ বছর বয়সে আনাতোলিয়া সফর করেন। তিনি কর্ডোভা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন।
আল-ইদ্রিসির প্রারম্ভিক জীবন (Early Life)
আল-ইদ্রিসি ছিলেন উত্তর আফ্রিকা ও আল-আন্দালুসের হাম্মুদিদ বংশের একজন সদস্য, যাদের বংশধারা ইসলামের নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর বংশজ ইদ্রিসিদ রাজবংশ থেকে উদ্ভূত। তাঁর জন্ম হয়েছিল ১১০০ খ্রিস্টাব্দে সেউতা শহরে (বর্তমান স্পেনে মরক্কোর উপকূলে অবস্থিত), যেটি তখন আলমোরাভিদ শাসনের অধীনে ছিল। তাঁর প্রপিতামহ হাম্মুদিদ মালাগার পতনের (যা জিরিদদের হাতে হয়েছিল) পরে এই শহরে বসতি স্থাপন করতে বাধ্য হন।
শিক্ষাজীবন ও ভ্রমণ
আল-ইদ্রিসি তাঁর জীবনের অনেকটা সময় উত্তর আফ্রিকা এবং আল-আন্দালুস (সেসময়ের মুসলিম শাসিত স্পেন ও পর্তুগাল) ভ্রমণ করে কাটিয়েছিলেন। এই অঞ্চলগুলো সম্পর্কে তাঁর সংগ্রহিত তথ্য ছিল অত্যন্ত বিশদ ও নির্ভরযোগ্য। মাত্র ১৬ বছর বয়সে তিনি আনাতোলিয়া ভ্রমণ করেন। এরপর তিনি কর্দোবার বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষালাভ করেন, যেটি তখন ইসলামী বিশ্বের অন্যতম বিদ্যাকেন্দ্র ছিল।[^2]
তাঁর ভ্রমণ কেবল মুসলিম ভূখণ্ডেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চল যেমন—
-
পর্তুগাল
-
পাইরেনীজ পর্বতমালা
-
ফ্রান্সের আটলান্টিক উপকূল
-
হাঙ্গেরি
-
ইংল্যান্ডের ইয়র্ক (তৎকালীন জোরভিক)
এমনকি এইসব স্থানেও ভ্রমণ করেছেন বলে ধারণা করা হয় (যদিও কিছু ক্ষেত্রে এর ঐতিহাসিক প্রমাণ দুর্বল বা বিতর্কিত)।
তাবুলা রোজেরিয়ানা
আল-ইদ্রিসির সবচেয়ে বিখ্যাত কর্ম হল "তাবুলা রোজেরিয়ানা" — একটি বিস্ময়কর ভূগোল ও মানচিত্র রচনার গ্রন্থ, যা তিনি সিসিলির রাজা রজার দ্বিতীয়ের অনুরোধে রচনা করেন ১১৫৪ খ্রিস্টাব্দে। এই মানচিত্র ও বর্ণনামূলক গ্রন্থটি মধ্যযুগে ভূগোলবিদ্যা ও বিশ্বজ্ঞান চর্চায় এক অনন্য অবদান হয়ে ওঠে।
আল-ইদ্রিসি ও তাবুলা রোজেরিয়ানা (Tabula Rogeriana): বিস্ময়কর মানচিত্র ও বিশ্ববর্ণনা
আল-আন্দালুস থেকে সিসিলি
আল-আন্দালুসে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সংঘাতের কারণে, আল-ইদ্রিসি তাঁর সমসাময়িকদের (যেমন আবু আল-সালত) মতো সিসিলিতে চলে আসেন। সে সময় নরম্যানরা (Normans) সেখানে ফাতিমিদদের প্রতি অনুগত আরবদের শাসন উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করেছিল। এই পরিবেশে আল-ইদ্রিসির জ্ঞানের চর্চার জন্য রাজদরবারের পৃষ্ঠপোষকতা ছিল উপযোগী।
বিশ্ব মানচিত্রের সর্বশ্রেষ্ঠ চিত্রণ
সিসিলির নরম্যান রাজা রজার দ্বিতীয়ের জন্য ১১৫৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি প্রস্তুত করেন পৃথিবীর অন্যতম সর্বাধিক নির্ভুল ও বিস্তারিত মানচিত্র — তাবুলা রোজেরিয়ানা (Tabula Rogeriana)। এটি তাঁর গ্রন্থ “কিতাব নুযহাত আল-মুশতাক”-এর (লাতিনে: Opus Geographicum) দৃষ্টিগ্রাহ্য রূপ।
গ্রন্থের নামের অর্থ:
“দূর-দিগন্তের ভ্রমণের আকাঙ্ক্ষায় উদগ্রীব মানুষের জন্য এক আনন্দদায়ক ভ্রমণবৃত্তান্ত”
এই মানচিত্র ও গ্রন্থে আল-ইদ্রিসি একত্র করেন—
-
ইসলামি ব্যবসায়ী ও অভিযাত্রীদের জ্ঞান
-
প্রাচীন ইসলামি মানচিত্র ও বর্ণনা
-
নরম্যান অভিযাত্রীদের অভিজ্ঞতা
-
আফ্রিকা, ভারত মহাসাগর ও দূরপ্রাচ্যের তথ্য
মানচিত্রের বিশিষ্টতা
-
এই মানচিত্রটি একটি দুই মিটার ব্যাসের রূপার চাকায় (silver disc) খোদাই করে তৈরি করা হয়।
-
চাকাটি প্রায় ৪৫০ পাউন্ড ওজনের ছিল এবং দুই পাশে খোদাই ছিল:
-
এক পাশে জ্যোতির্বিদ্যা: রাশিচক্র ও নক্ষত্রমণ্ডল
-
অন্য পাশে: ভূপৃষ্ঠ ও জলভাগ, দেশ ও অঞ্চলসমূহের সুনির্দিষ্ট অবস্থান
-
মানচিত্রটি ইউরেশিয়া মহাদেশ পুরোপুরি দেখালেও, আফ্রিকার দক্ষিণ অংশ, হর্ন অব আফ্রিকা এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ছিল অল্প বা অনুপস্থিত।
ইতিহাসে তাৎপর্য
ঐতিহাসিক এস.পি. স্কট ১৯০৪ সালে লেখেন:
“আল-ইদ্রিসির সংকলন বিজ্ঞানের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। শুধু এর ঐতিহাসিক তথ্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়, অনেক অঞ্চলের বিবরণ আজও নির্ভরযোগ্য। তিন শতাব্দী ধরে ভূগোলবিদরা এই মানচিত্র অনুকরণ করেছেন পরিবর্তন ছাড়াই।”
তিনি আরও লেখেন যে নাইল নদীর উৎসস্থল ও হ্রদগুলোর অবস্থান আল-ইদ্রিসির মানচিত্রে যেমন ছিল, তা ৭০০ বছর পর বেকার ও স্ট্যানলি যেভাবে চিহ্নিত করেন, তার সঙ্গে বিস্ময়কর মিল ছিল।
প্রভাব ও সীমাবদ্ধতা
-
তাঁর কাজ প্রভাব ফেলেছিল অনেক মুসলিম পণ্ডিতের উপর, যেমন:
-
ইবন সাঈদ আল-মাগরিবি
-
হাফিজ-ই আবরু
-
ইবন খালদুন
-
-
তবে ইউরোপীয় রেনেসাঁ যুগে তাঁর মানচিত্র বা রচনার তেমন প্রভাব পড়েনি। পশ্চিমা ইউরোপে তাঁর কাজ ছিল অনেকাংশে অজানা।
উত্তরের দ্বীপসমূহের বিবরণ
আল-ইদ্রিসি তাঁর তাবুলা রোজেরিয়ানায় উল্লেখ করেন "ইরলানদাহ-আল-কাবিরাহ" (Great Ireland) নামক এক দ্বীপের কথা। তাঁর মতে, "আইসল্যান্ড থেকে গ্রেট আয়ারল্যান্ড পর্যন্ত যাত্রা ছিল এক দিনের।"
ইতিহাসবিদদের ধারণা, যদিও নরস্ ও ইসলামি উৎসগুলো ভৌগোলিক দূরত্ব প্রায়শই কমিয়ে বলে, তবে এই "গ্রেট আয়ারল্যান্ড" সম্ভবত গ্রিনল্যান্ড বোঝাত।
চীনা বাণিজ্যের বিবরণ
চীনা বাণিজ্য নিয়ে আল-ইদ্রিসির বিবরণ
আল-ইদ্রিসি তাঁর ভ্রমণ ও মানচিত্র সংকলনে চীনা বাণিজ্য সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করেন, যা মধ্যযুগীয় আরব বণিক ও ভৌগোলিকদের জন্য ছিল অনন্য উৎস। তিনি চীনের বাণিজ্যজাহাজ ও পণ্যের বিশদ বিবরণ দিয়েছেন।
চীনা জাঙ্ক (Junks) ও বহনকৃত পণ্য
আল-ইদ্রিসি লিখেছেন যে চীনা জাঙ্ক জাহাজ (বড় বড় বাণিজ্যিক নৌযান) বহন করত—
-
চামড়াজাত পণ্য (leather)
-
তলোয়ার (swords)
-
লোহার সামগ্রী (iron)
-
রেশম (silk)
এই পণ্যগুলো ছিল উচ্চমানের এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অত্যন্ত চাহিদাসম্পন্ন।
চীনের শহরগুলির প্রসিদ্ধতা
-
তিনি হাংঝৌ (Hangzhou) শহরের কাচের সামগ্রী (glassware)-এর প্রশংসা করেন। মধ্যযুগীয় চীনের এই শহর ছিল শিল্প ও সংস্কৃতিতে অগ্রগামী।
-
চুয়ানঝৌ (Quanzhou) শহরের রেশমকে তিনি “সর্বোত্তম” বলে বর্ণনা করেছেন।
সিলা রাজবংশের (Silla Dynasty) উল্লেখ
আল-ইদ্রিসি চীনের বাণিজ্যের প্রসঙ্গে সিলা রাজবংশের কথাও বলেন।
-
সিলা ছিল কোরিয়ার একটি প্রাচীন ও গুরুত্বপূর্ণ রাজবংশ, যা ঐ সময় চীনের অন্যতম প্রধান বাণিজ্য সহযোগী ছিল।
-
আল-ইদ্রিসি ছিলেন প্রথমদিককার আরব লেখক, যিনি সিলা সম্পর্কে লিখেছেন।তাঁর এই উল্লেখের ফলে:
-
অন্যান্য আরব বণিকরা সিলার সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে
-
সিলার প্রতি বিশেষ আগ্রহ ও শ্রদ্ধা গড়ে ওঠে
-
অনেক আরব ব্যবসায়ী সিলাকে পূর্ব এশিয়ার আদর্শ রাষ্ট্র হিসেবে কল্পনা করতে শুরু করে
মৃত্যু:
১১৬৫ (বয়স ৬৪–৬৫) সেউতা, আলমোহাদ খিলাফত (বর্তমানে স্পেন) তিনি মৃত্যু বরণ করেন।
What's Your Reaction?






