হযরত লূত (আঃ) এর জীবনী | Biography of Hazrat Loot (As)
হযরত লূত (আঃ) এর জীবনী | Biography of Hazrat Loot (As)

নবী
হজরত লূত়
لوط লোট আলাইহিস সালাম
|
|
---|---|
জন্ম |
কল্দীয় দেশের ঊর, ইরাক
|
মৃত্যু |
বনী নাঈম, পশ্চিম তীর
|
অন্যান্য নাম |
লোট (হিব্রু ভাষায়: לוֹט) লূত বিন হারান (আরবি: لوط بن هاران) |
দাম্পত্য সঙ্গী |
লূতের স্ত্রী |
সন্তান |
লূতের কন্যাগণ |
পিতা-মাতা |
হারান (পিতা) |
আত্মীয় |
ইব্রাহিম (চাচা) |
লূত আ.-এর জাতি যে পাপের কারণে ধ্বংস হয়েছিল
লুত ইবনে হারান
(لوط, Lūṭ), যিনি সচরাচর হযরত লুত নামে অভিহিত, বাইবেল এবং কুরআনে উল্লেখিত আল্লাহ প্রেরিত একজন পয়গম্বর যাকে সদোম ও গোমোরাহ নামক শহরদ্বয়ের অধিবাসীদের নবী হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছিল। তিনি ছিলেন নবী ইব্রাহীমের আপন ভাতিজা।[৩] ইব্রাহীমের সঙ্গে তিনি কেনানে চলে আসেন। সেখানেই তার উপর নবুয়াতের দায়িত্ব অবতীর্ণ হয়। [৪]পবিত্র কুরআনে বর্ণিত ২৫ জন নবীর মধ্যে ইসলামের একজন নবী যাকে সমকামিতায় লিপ্ত থাকা স্বীয় জাতির সতর্ককারী হিসেবে আল্লাহ তাআলা নিয়োজিত করেছিলেন। সমকামিতা ত্যাগ না করায় তারা আল্লাহর আযাবে সমূলে ধ্বংস হয়েছিলো।
কুরআনের বর্ণনানুসারে লূত (আঃ) এবং তার সম্প্রদায়ের কাহিনী
পবিত্র কুরআনে ১৫,২৬,২৯ এবং ৬৬ নম্বর সূরাসমূহের বিভিন্ন অংশে লূত (আঃ) এর কাহিনী বর্ণনা করেন।লূত (আঃ) এর জাতি পার্থিব উন্নতির চরম উৎকর্ষে পৌছে যাওয়ার কারণে বিলাসিতার অতিশয্যে সীমালঙ্ঘনের দিক দিয়ে তাদের পূর্বের গযবপ্রাপ্ত জাতিগুলোকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। লূত (আঃ) এর জাতি ব্যভিচার ও অজাচার তো করতোই, তার উপর সমকামিতার মত চরম সীমালঙ্ঘনও তারাই প্রথম শুরু করে, যা তাদের পূর্বে কেউ কখনো করে নি; উপরন্তু, তারা এর ফলে বিন্দুমাত্র অনুতপ্ত না হয়ে গর্ব ভরে তা সমাজে প্রকাশ করে বেড়াত এবং প্রকাশ্যে ও নির্লজ্জভাবে এসব নিষিদ্ধ কাজগুলো করত। এজন্য আল্লাহ তা'আলা লূত (আঃ) কে তার জাতির জন্যে সতর্ককারী নবী হিসেবে মনোনীত করলেন এবং আল্লাহ তা'আলা নির্দেশে তাদেরকে এসব কাজ থেকে বিরত থাকতে বললেন। তিনি দীর্ঘ সময় ধরে সতর্ক করার পরও যখন তাদের পরিবর্তন হল না তখন আল্লাহ তা'আলা চূড়ান্ত বিপর্যয়ের মাধ্যমে সমগ্র এলাকা উল্টিয়ে দেন, আকাশ থেকে একাধারে বৃষ্টি ও পাথর বর্ষণ করে সমগ্র জাতিকে সমুলে নিশ্চিহ্ন করে দেন। বর্ণিত আছে, বর্তমান মৃত সাগর বা ডেড সি হল লূত (আঃ) এর জাতির সেই বাসস্থান, যেখানে তাদের ধ্বংস করা হয়েছিলো।
নবী হযরত লুত (আঃ) এর পিতার নাম ছিল হারান। লূত (আঃ) ছিলেন ইব্রাহীম (আঃ) এর ভাইয়ের ছেলে। ভাতিজা লূত (আঃ) ছোটবেলা থেকেই ইব্রাহীম (আঃ) এর সাহচর্যে বড় হন। এবং ইব্রাহীম (আঃ) এর আহবানে সাড়া দিয়ে সঠিক ধর্ম গ্রহন করেন ও সেই সত্য ধর্ম প্রচার করার জন্য মাতৃভূমি ইরাক ত্যাগ করে হিজরত করে মিশরে চলে আসেন। তিনি ইব্রাহীম (আঃ) এর যুগেই নবুয়ত প্রাপ্ত হন।
মিসরে ইব্রাহীম (আঃ) এর সাথে লূত (আঃ) কিছুদিন কাজ করার পর ইব্রাহীম (আঃ) মিসর হতে সিরিয়ার ফিলিস্তিনে, আর লূত (আঃ) জর্দান রাজ্য বা ট্রান্সজর্দান এলাকায় চলে আসেন। এটি বর্তমানে মরু সাগরের নিকট সডম ও গমোরা নগর হিসাবে খ্যাত। এখানে সাদ্দুম নামে এক বস্তি ছিল। সে বস্তি এবং আশে পাশের আরো কিছু এলাকায় লূত (আঃ) সত্য ধর্মের তবলীগ করতে থাকতেন।
লূত (আঃ) যে জাতির প্রতি প্রেরিত হয়েছিলেন, তারা জঘন্য রকমের খারাপ স্বভাবের ছিলো। তারা কুফর, শেরক ইত্যাদির সাথে সাথে জুলুম, অত্যাচারে লিপ্ত ছিল। পথিক, বিদেশী আগুন্তক, বনীক ও ব্যাবসায়ীদের কাছ হতে লুন্ঠন করতো। এছাড়াও তারা এমন এক কদর্য ও নির্লজ্জ কাজে লিপ্ত ছিল, যা তাদের পূর্বে বিশ্ব জগতের আর কেউই করেনি। তারা মাঠে ঘাটে, রাস্তায়, মাহফিল, মজলিসে বিনা দ্বিধায় পুরুষদের সাথে কুকর্মে লিপ্ত হতো।
হযরত লূত (আঃ) এসব জঘন্য দুস্কর্মের জন্য দেশবাসীকে বিভিন্নভাবে বোঝালেন। তারা বুঝলো না। তারপর তিরস্কার করলেন, ‘তারা তাঁর কথায় কর্ণপাত করলো না। তিনি তাঁর দেশবাসিকে বললেন, নিশ্চই তোমরা এমন এক নির্লজ্জ ও কুৎসিৎ কাজে লিপ্ত যা তোমাদের পূর্বে বিশ্ব জগতের কেউই করেনি। ছেলে ও পুরুষদের সাথে কুকর্ম, ডাকাতি এবং প্রকাশ্য মজলিসে কুকর্ম, তোমরা কি এসবে ডুবে থাকবে? দেশবাসী উত্তর করলো, ‘তুমি যদি সত্যবাদী হয়ে থাকো, তবে আমাদের উপর গজব নিয়ে আসো।’ লূত (আঃ) আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করেন, ‘হে পরওয়ারদেগার, আমাকে এই দুষ্টদের মোকাবেলায় সাহায্য করুন।
আল্লাহর হুকুমে কয়েকজন ফেরেশতা মানুষের রূপ ধারণ করে প্রথমে হযরত ইবরাহীমের বাড়ীতে পদার্পণ করলেন। তিনি তাদেরকে মেহমানদারীর জন্য একটা আস্ত বাছুর গরু যবেহ করে ভুনা করে তাদের সামনে পরিবেশন করলেন। কিন্তু তারা তাতে হাত দিলেন না। এতে ইবরাহীম (আঃ) ভয় পেয়ে গেলেন (হূদ ১১/৬৯-৭০)। কেননা এটা ঐ সময়কার দস্যু-ডাকাতদেরই স্বভাব ছিল যে, তারা যে বাড়ীতে ডাকাতি করত বা যাকে খুন করতে চাইত, তার বাড়ীতে খেত না।
ফেরেশতাগণ নবীকে অভয় দিয়ে নিজেদের পরিচয় দিয়ে বললেন, ‘আমরা এসেছি অমুক শহরগুলি ধ্বংস করে দিতে। ইবরাহীম একথা শুনে তাদের সাথে ‘তর্ক জুড়ে দিলেন (হূদ ১১/৭৪) এবং বললেন, ‘সেখানে যে লূত আছে। তারা বললেন, সেখানে কারা আছে, আমরা তা ভালভাবেই জানি। আমরা অবশ্যই তাকে ও তার পরিবারকে রক্ষা করব, তবে তাঁর স্ত্রী ব্যতীত। সে ধ্বংসপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে (আনকাবূত ২৯/৩১-৩২)। অতঃপর তারা ইবরাহীম দম্পতিকে ইসহাক-এর জন্মের সুসংবাদ শুনালেন।
বিবি সারা ছিলেন নিঃসন্তান। অতি বৃদ্ধ বয়সে এই সময় তাঁকে হযরত ইসহাকের জন্মের সুসংবাদ দেওয়া হয়। শুধু তাই নয় ইসহাকের পরে তার ঔরসে যে ইয়াকূবের জন্ম হবে সেটাও জানিয়ে দেওয়া হল (হূদ ১১/৭১-৭২)। উল্লেখ্য যে, ইয়াকূবের অপর নাম ছিল ‘ইস্রাঈল এবং তাঁর বংশধরগণকে বনু ইস্রাঈল বলা হয়। যে বংশে হাযার হাযার নবীর আগমন ঘটে।
কেনআনে ইবরাহীম (আঃ)-এর নিকট থেকে বিদায় হয়ে ফেরেশতাগণ সাদূম নগরীতে ‘লূত (আঃ)-এর গৃহে উপস্থিত হলেন (হিজর ১৫/৬১)। এ সময় তাঁরা অনিন্দ্য সুন্দর নওজোয়ান রূপে আবির্ভূত হন। কেননা আল্লাহ তাআলা যখন কোন জাতিকে ধ্বংস করেন, তখন শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাদের পরীক্ষা নেন। সাদূম জাতি তাদের এই চূড়ান্ত পরীক্ষায় ব্যর্থকাম হল। তারা যখন জানতে পারল যে, লূত-এর বাড়ীতে অতীব সুদর্শন কয়েকজন নওজোয়ান এসেছে, ‘তখন তারা খুশীতে আত্মহারা হয়ে সেদিকে ছুটে এল (হূদ ১১/৭৮)।
এ দৃশ্য দেখে লূত (আঃ) তাদেরকে অনুরোধ করে বললেন, ‘তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। অতিথিদের ব্যাপারে তোমরা আমাকে লজ্জিত করো না। তোমাদের মধ্যে কি একজনও ভাল মানুষ নেই? (হূদ ১১/৭৮)। কিন্তু তারা কোন কথাই শুনলো না। তারা দরজা ভেঙ্গে ঘরে ঢোকার উপক্রম করল। লূত (আঃ) বললেন, হায়! ‘আজকে আমার জন্য বড়ই সংকটময় দিন (হূদ ১১/৭৭)। তিনি বললেন, ‘হায়! যদি তোমাদের বিরুদ্ধে আমার কোন শক্তি থাকত, অথবা আমি কোন সুদৃঢ় আশ্রয় পেতাম (হূদ ১১/৮০)। এবার ফেরেশতাগণ আত্মপরিচয় দিলেন এবং লূতকে অভয় দিয়ে বললেন, ‘হে লূত! আমরা আপনার প্রভুর প্রেরিত ফেরেশতা। ওরা কখনোই আপনার নিকটে পৌঁছতে পারবে না (হূদ ১১/৮১)।
লূত (আঃ) ফেরেশতাদের কথানুযায়ী তার অনুসারীদের সাথে নিয়ে রাতেই শহরের বাইরে চলে গেলেন, সিরিয়ার উদ্দেশ্যে। অবশ্য লূত (আঃ) এর স্ত্রী ওখানেই রয়ে গেলেন। ভোরে এই এলাকায় ভয়ংকর ভূকম্প, তর্জন-গর্জন আরম্ভ হলো। উপর হতে প্রস্তর বর্ষণ হতে লাগলো। সমগ্র দেশকে উপরে তুলে সজোরে নিক্ষেপ করা হলো। প্রভাতেই সমগ্র দেশ ধ্বংস হয়ে ভূপৃষ্ট হতে পাপিষ্টদের চিহ্ন চিরতরে মুছে গেল। শুধু রইল কুৎসিৎ কলংকের কালিমা রেখা। সবকিছু ধ্বংস হয়ে সম্পূর্ণ এলাকা সাগরে পরিণত হলো। যা আজও জর্দানের মানচিত্রে বিদ্যমান আছে। আল্লাহর গজবে পতিত অভিশপ্ত এই এলাকাটি বাংলায় মরু সাগর, ইংরেজীতে ও আরবীতে ‘বাহরে মাইয়েত’ নামে পরিচিত। এটি দৈঘ্যে ৭৭ কিলোমিটার (প্রায় ৫০ মাইল), প্রস্থে ১২ কিলোমিটারের কিছু উর্ধ্বে (প্রায় ৯ মাইল), গভীরতায় ৪০০ মিটার (প্রায় কোয়াটার মাইল)। পুরাতন ইতিহাসে এটি ‘লূত সাগর’ নামে আখ্যায়িত।
এজন্যেই আমাদের রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘আল্লাহ রহম করুন লূতের উপরে, তিনি সুদৃঢ় আশ্রয় প্রার্থনা করেছিলেন (অর্থাৎ আল্লাহর আশ্রয়)। অতঃপর জিবরীল তাদের দিকে পাখার ঝাপটা মারতেই বীর পুঙ্গরেরা সব অন্ধ হয়ে ভেগে গেল। আল্লাহ বলেন,
ওরা লূতের কাছে তার মেহমানদের দাবী করেছিল। তখন আমি তাদের দৃষ্টি বিলুপ্ত করে দিলাম। অতএব আস্বাদন কর আমার শাস্তি ও হুঁশিয়ারী (ক্বামার ৫৪/৩৭)। |
অতঃপর ফেরেশতাগণ হযরত লূত (আঃ)-কে স্বীয় পরিবারবর্গসহ (ক্বামার ৫৪/৩৪) ‘কিছু রাত থাকতেই এলাকা ত্যাগ করতে বললেন এবং বলে দিলেন যেন ‘কেউ পিছন ফিরে না দেখে। তবে আপনার বৃদ্ধা স্ত্রী ব্যতীত। নিশ্চয়ই তার উপর ঐ গযব আপতিত হবে, যা ওদের উপরে হবে। ভোর পর্যন্তই ওদের মেয়াদ। ভোর কি খুব নিকটে নয়? (হূদ ১১/৮১; শোআরা ২৬/১৭১)।
লূত (আঃ)-এর স্ত্রী ঈমান আনেননি এবং হয়তবা স্বামীর সঙ্গে রওয়ানাই হননি। তারা আরও বললেন, ‘আপনি তাদের পিছে অনুসরণ করুন। আর কেউ যেন পিছন ফিরে না তাকায়। আপনারা আপনাদের নির্দেশিত স্থানে চলে যান (হিজর ১৫/৬৫)। এখানে আল্লাহ লূতকে হিজরতকারী দলের পিছনে থাকতে বলা হয়েছে। বস্ত্ততঃ এটাই হল নেতার কর্তব্য।
অতঃপর আল্লাহর হুকুমে অতি প্রত্যুষে গযব কার্যকর হয়। লূত ও তাঁর সাথীগণ যখন নিরাপদ দূরত্বে পৌছেন, তখন জিবরীল (আঃ) আল্লাহর নির্দেশ পাওয়া মাত্র ছুবহে ছাদিক-এর সময় একটি প্রচন্ড নিনাদের মাধ্যমে তাদের শহরগুলিকে উপরে উঠিয়ে উপুড় করে ফেলে দিলেন এবং সাথে সাথে প্রবল বেগে ঘুর্ণিবায়ুর সাথে প্রস্তর বর্ষণ শুরু হয়। যেমন আল্লাহ বলেন,
অবশেষে যখন আমাদের হুকুম এসে পৌঁছল, তখন আমরা উক্ত জনপদের উপরকে নীচে করে দিলাম এবং তার উপরে ক্রমাগত ধারায় মেটেল প্রস্তর বর্ষণ করলাম। ‘যার প্রতিটি তোমার প্রভুর নিকটে চিহ্নিত ছিল। আর ঐ ধ্বংসস্থলটি (বর্তমান আরবীয়) যালেমদের থেকে বেশী দূরে নয়’ (হূদ ১১/৮২-৮৩)।
এটা ছিল তাদের কুকর্মের সাথে সামঞ্জস্যশীল শাস্তি। কেননা তারা যেমন আল্লাহর আইন ও প্রাকৃতিক বিধানকে উল্টিয়েছিল অর্থাৎ স্ত্রীসঙ্গ বাদ দিয়ে মানুষের স্বভাববিরুদ্ধ ভাবে পুংমৈথুনে ও সমকামিতায় লিপ্ত হয়েছিল, ঠিক তেমনি তাদেরকে মাটি উল্টিয়ে উপুড় করে শাস্তি দেওয়া হ’ল।
হযরত লূত (আঃ)-এর নাফরমান কওমের শোচনীয় পরিণতি বর্ণনা করার পর দুনিয়ার অপরাপর জাতিকে সতর্ক করার জন্য আল্লাহ পাক এরশাদ করেন, ‘(জনপদ উল্টানো ও প্রস্তর বর্ষণে নিশ্চিহ্ন ঐ ধ্বংসস্থলটি) বর্তমান কালের যালেমদের থেকে খুব বেশী দূরে নয় (হূদ ১১/৮৩)। মক্কার কাফেরদের জন্য উক্ত ঘটনাস্থল ও ঘটনার সময়কাল খুব বেশী দূরের ছিল না। মক্কা থেকে ব্যবসায়িক সফরে সিরিয়া যাতায়াতের পথে সর্বদা সেগুলো তাদের চোখে পড়ত। কিন্তু তা থেকে তারা শিক্ষা গ্রহণ করতো না। বরং শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে অবিশ্বাস করত ও তাঁকে অমানুষিক কষ্ট দিত। আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, যখন আমার উম্মত পাঁচটি বিষয়কে হালাল করে নেবে, তখন তাদের উপর ধ্বংস নেমে আসবে। যথা-
(১) যখন পরস্পরে অভিসম্পাৎ ব্যাপক হবে
(২) যখন তারা মদ্যপান করবে
(৩) রেশমের কাপড় পরিধান করবে
(৪) গায়িকা-নর্তকী গ্রহণ করবে
(৫) পুরুষ-পুরুষে ও নারী-নারীতে সমকামিতা করবে।
কওমে লূত-এর বর্ণিত ধ্বংসস্থলটি বর্তমানে ‘বাহরে মাইয়েত বা ‘বাহরে লূত অর্থাৎ ‘মৃত সাগর বা ‘লূত সাগর নামে খ্যাত। যা ফিলিস্তীন ও জর্ডান নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে বিশাল অঞ্চল জুড়ে নদীর রূপ ধারণ করে আছে। যেটি সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে বেশ নীচু। এর পানিতে তৈলজাতীয় পদার্থ বেশী। এতে কোন মাছ, ব্যাঙ এমনকি কোন জলজ প্রাণী বেঁচে থাকতে পারে না। এ কারণেই একে ‘মৃত সাগর বা ‘মরু সাগর বলা হয়েছে।
তখন উক্ত জনপদে লূত-এর পরিবারটি ব্যতীত মুসলমান ছিল না। আল্লাহ বলেন, ‘আমরা সেখানে একটি বাড়ী ব্যতীত কোন মুসলমান পাইনি (যারিয়াত ৫১/৩৬)। কুরআনী বর্ণনা অনুযায়ী উক্ত গযব হতে মাত্র লূত-এর পরিবারটি নাজাত পেয়েছিল। তাঁর স্ত্রী ব্যতীত (আরাফ ৭/৮৩)।
তাফসীরবিদগণ বলেন, লূত-এর পরিবারের মধ্যে কেবল তাঁর দুমেয়ে মুসলমান হয়েছিল। তবে লূত-এর কওমের নেতারা লূত-কে সমাজ থেকে বের করে দেবার যে হুমকি দেয়, সেখানে তারা বহুবচন ব্যবহার করে বলেছিল, ‘এদেরকে তোমাদের শহর থেকে বের করে দাও। কেননা এই লোকগুলি সর্বদা পবিত্র থাকতে চায় (আরাফ ৭/৮২; নমল ২৭/৫৬)। এতদ্ব্যতীত শহর থেকে বের হবার সময় আল্লাহ লূতকে ‘সবার পিছনে থাকতে বলেন (হিজর ১৫/৬৫)।
অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘অতঃপর আমরা তাকে ও তার পরিবার সবাইকে নাজাত দিলাম (শোআরা ২৬/১৭০)।এখানে أجمعين বা ‘সবাইকে শব্দের মধ্যে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, ঈমানদারগণের সংখ্যা বেশ কিছু ছিল। অতএব এখানে লূত-এর ‘আহ্ল (আরাফ ৮৩; হূদ ৮১; নমল ৫৭; ক্বামার ৩৪) বা পরিবার বলতে লূত-এর দাওয়াত কবুলকারী ঈমানদারগণকে সম্মিলিতভাবে ‘আহলে ঈমান বা ‘একটি ঈমানদার পরিবার গণ্য করা যেতে পারে।
তবে প্রকৃত ঘটনা যেটাই হৌক না কেন, কেবলমাত্র নবীর অবাধ্যতা করলেই আল্লাহর গযব আসাটা অবশ্যম্ভাবী। তার উপরে কেউ ঈমান আনুক বা না আনুক। হাদীছে এসেছে, ‘ক্বিয়ামতের দিন অনেক নবীর একজন উম্মতও থাকবে না। এখানে লক্ষণীয় যে, নবীপত্নী হয়েও লূতের স্ত্রী গযব থেকে রেহাই পাননি। আল্লাহ নূহ পত্নী ও লূত পত্নীকে ক্বিয়ামতের দিন বলবেন- ‘যাও জাহান্নামীদের সাথে জাহান্নামে চলে যাও (তাহরীম ৬৬/১০)।
বর্তমানে যে এলাকাটিকে ট্রান্স জর্ডান বলা হয় সেখানেই ছিল লূত আঃ এর অভিশপ্ত জাতি বসবাস। বাইবেলে সাদূম কে এ জাতির কেন্দ্রস্থল বলা হয়েছে। মৃত সাগরের (Dead sea) নিকটবর্তী কোথাও এর অবস্থান ছিল। তালমূদে বলা হয়েছে, সাদূম ছাড়া তাদের আরো চারটি বড় বড় শহর ছিল। এ শহরগুলোর মধ্যবর্তী এলাকাসমূহ এমনই শ্যামল সবুজে পরিপূর্ণ ছিল যে, মাইলের পর মাইল জুড়ে এ বিস্তৃত এলাকা যেন একটি বাগান মনে হতো। এ এলাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মানুষকে মুগ্ধ ও বিমোহিত করতো। কিন্তু আজ এ জাতির নাম- নিশানা দুনিয়ার বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এমনকি তাদের জনপদগুলো কোথায় কোথায় অবস্থিত ছিল তাও আজ সঠিকভাবে জানা যায় না।
সমকামিতার শাস্তি
কুরআনের আরো বিভিন্ন স্থানে কেবল এতটুকুন বলা হয়েছে, যে, লূত জাতি একটি অতি জঘন্য ও নোংরা পাপ কাজের অনুশীলন করে যাচ্ছিল । এবং এ ধরনের পাপ কাজের পরিণামে এ জাতির ওপর আল্লাহর গযব নেমে আসে। তারপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশনা থেকে আমরা একথা জানতে পেরেছি যে, এটি এমন একটি অপরাধ সমাজ অংগনকে যার কুলুষমুক্ত রাখার চেষ্টা করা ইসলামী রাষ্ট্রের দায়ীত্বের অন্তর্ভুক্ত এবং এ ধরনের অপরাধকারীদেরকে কঠোর শাস্তি দেয়া উচিত।এ প্রসংগে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে যে সমস্ত হাদীস বর্ণিত হয়েছে তার কোনটিতে বলা হয়েছেঃ ও যার সাথে সে অপরাধ করেছে তাদের উভয়কে হত্যা করো আবার কোনটিতে এর ওপর এতটুকু বৃদ্ধি করা হয়েছেঃ বিবাহিত হোক বা অবিবাহিত। আবার কোথাও এও বলা হয়েছেঃ ওপরের ও নীচের উভয়কে পাথর মেরে হত্যা করো।
কিন্তু যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে এ ধরনের কোন মামলা আসেনি তাই এর শাস্তি কিভাবে দেয়া হবে, তা অকাট্যভাবে চিহ্নিত হতে পারেনি।সাহাবীগণের মধ্যে হযরত আলীর(রা) মতে অপরাধীকে তরবারীর আঘাতে হত্যা করতে হবে এবং কবরস্থ করার পরিবর্তে তার লাশ পুড়িয়ে ফেলতে হবে। হযরত আবু বকর(রা) এ মত সমর্থন করেন।হযরত উমর(রা) ও হযরত উসমানের (রা) মতে কোন পতনোন্মুখ ইমারতের নীচে তাকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে ইমারতটিকে তার ওপর ধ্বসীয়ে দিতে হবে। এ ব্যাপারে ইবনে আব্বাসের (রা) ফতোয়া হচ্ছে, মহল্লার সবচেয়ে উঁচু বাড়ির ছাদ থেকে তাকে পা উপরের দিকে এবং মাথা নিচের দিকে করে নিক্ষেপ করতে এবং এই সংগে উপর থেকে তার ওপর পাথর নিক্ষেপ করতে হবে।
ফকীহদের মধ্যে ইমাম শাফেঈ(র) বলেন, অপরাধী ও যার সাথে অপরাধ করা হয়েছে তারা বিবাহিত হোক বা অবিবাহিত , তাদের উভয়কে হত্যা করা ওয়াজিব।শাবী যুহরী, মালিক ও আহমদ (রাহেমাহুল্লাহুর)মতে তাদের শাস্তি হচ্ছে রজম অর্থাৎ পাথর মেরে হত্যা করা। সাঈদ ইবনুল মুসাইয়েব,আতা, হাসান বসরী, ইবরাহীম নাখঈ, সুফিয়ান সওরী , ও আওযাঈর (রাহেমাহুমুল্লাহুর )মতে যিনার অপরাধে যে শাস্তি দেয়া হয় এ অপরাধের সেই একই শাক্তি দেয়া হবে। অর্থাঃ অবিবাহিতকে একশত বেত্রাঘাত করে দেশ থেকে বহিস্কার করা হবে, এবং বিবাহিতকে রজম করা হবে। ইমাম আবু হানিফার(র) মতে,তার ওপর কোন দণ্ডবিধি নির্ধারিত নেই বরং এ কাজটি এমন যে,ইসলামী শাসক তার বিরুদ্ধে অবস্থা ও প্রয়োজন অনুপাতে যে কোন শিক্ষনীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন।এর সমর্থনে ইমান শাফেঈর একটি বক্তব্যও পাওয়া যায়।
উল্লেখ্য যে, কোন ব্যক্তির তার নিজের স্ত্রীর সাথেও লূত জাতির কুকর্ম করা চূড়ান্তভাবে হারাম। সহীহ আবু দাউদ হাদিসের বরাত দিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ উক্তি উদ্বৃত হয়েছেঃ যে ব্যক্তি তার স্ত্রীর পশ্চাদ্দেশে(পায়ুপথে) যৌন কার্য করে সে অভিশপ্ত। ইবনে মাজাহ ও মুসনাদে আহমদে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ বানী উদ্বৃত হয়েছেঃ যে ব্যক্তি নিজের স্ত্রীর পশ্চাদ্দেশে যৌন সংগমে লিপ্ত হয় আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার প্রতি দৃষ্টিপাত করবেন না।
ইমাম তিরমিযী তাঁর আর একটি নির্দেশ উদ্ধৃত করেছেন। তাতে বলা হয়েছেঃ “আর তোমাদের মধ্য থেকে যারা (দুজন) এতে লিপ্ত হবে তাদেরকে শাস্তি দাও৷ তারপর যদি তারা তাওবা করে এবং নিজেদের সংশোধন করে নেয়, তাহলে তাদেরকে ছেড়ে দাও৷ কেননা আল্লাহ বড়ই তাওবা কবুলকারী ও অনুগ্রশীল৷ তবে একথা জেনে রাখো, আল্লাহর কাছে তাওবা কবুল হবার অধিকার এক মাত্র তারাই লাভ করে যারা অজ্ঞতার কারণে কোন খারাপ কাজ করে বসে এবং তারপর অতি দ্রুত তাওবা করে ৷ এ ধরনের লোকদের প্রতি আল্লাহ আবার তাঁর অনুগ্রহের দৃষ্টি নিবন্ধ করেন এবং আল্লাহ সমস্ত বিষয়ের খবর রাখেন, তিনি জ্ঞানী ও সর্বজ্ঞ৷ কিন্তু তাওবা তাদের জন্য নয়, যারা খারাপ কাজ করে যেতেই থাকে, এমন কি তাদের কারো মৃত্যুর সময় এসে গেলে সে বলে, এখন আমি তাওবা করলাম৷ অনুরূপভাবে তাওবা তাদের জন্যও নয় যারা মৃত্যুর সময় পর্যন্ত কাফের থাকে৷ এমন সব লোকদের জন্য তো আমি যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি তৈরী করে রেখেছে৷” (নিসাঃ ১৬-১৮)।
sourse: wikipedia .... dhakapost ...dailyinqilab
What's Your Reaction?






