রিচার্ড ফাইনম্যান এর জীবনী | Biography of Richard Feynman
রিচার্ড ফাইনম্যান Biography of Richard Feynman

রিচার্ড ফাইনম্যান: যিনি ছিলেন পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষক
জন্ম |
১১ মে ১৯১৮ ফার রকঅ্যাওয়ে, কুইন্স, নিউ ইয়র্ক
|
---|---|
মৃত্যু |
১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৮ (বয়স ৬৯) লস অ্যাঞ্জেলেস, ক্যালিফোর্নিয়া
|
জাতীয়তা |
![]() |
মাতৃশিক্ষায়তন |
এমআইটি প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় |
পরিচিতির কারণ |
|
সন্তান |
কার্ল ফাইনম্যান মিচেল ফাইনম্যান |
পুরস্কার |
পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার(১৯৬৫) ওয়েরস্টেড মেডেল (১৯৭২) |
বৈজ্ঞানিক কর্মজীবন |
|
কর্মক্ষেত্র |
পদার্থবিজ্ঞান |
প্রতিষ্ঠানসমূহ |
ম্যানহাটন প্রকল্প কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যালটেক |
ডক্টরাল উপদেষ্টা |
জন আর্কিবাল্ড হুইলার |
ডক্টরেট শিক্ষার্থী |
আলবার্ট হিব্স জর্জ জিৎজ |
যাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন |
পল ডিরাক |
যাদেরকে প্রভাবিত করেছেন |
হেগেন ক্লেনার্ট রড ক্রিউথার হোসে লেইতে লোপেজ |
স্বাক্ষর |
|
|
রিচার্ড ফিলিপ্স ফাইনম্যান
(১১ই মে, ১৯১৮ - ১৫ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৮) একজন নোবেল বিজয়ী মার্কিন পদার্থবিজ্ঞানী, যিনি তার কোয়ান্টাম বলবিদ্যার পাথ ইন্টিগ্রাল ফর্মুলেশন, কোয়ান্টাম তড়িৎ-গতিবিজ্ঞান তত্ত্ব এবং অতিশীতলকৃত তরল হিলিয়ামের চরমপ্রবাহমানতা ক্রিয়াকৌশল ব্যাখ্যা করেছেন ও কণা পদার্থবিজ্ঞানে তার কাজের জন্য (তিনি পার্টন মডেল প্রস্তাব করেন।) খ্যাত। কোয়ান্টাম তড়িৎ-গতিবিজ্ঞানে তার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৬৫ সালে ফাইনম্যান মার্কিন বিজ্ঞানী জুলিয়ান শুইঙার এবং জাপানি বিজ্ঞানী সিন-ইতিরো তোমোনাগার সাথে যৌথভাবে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন। ফাইনম্যান অতিপারমাণবিক কণাসমূহের আচরণ নিয়ন্ত্রণকারী গাণিতিক প্রকাশের বহুল ব্যবহৃত একটি চিত্ররূপ প্রদান করেন, যা ফাইনম্যান চিত্র নামে পরিচিত। জীবদ্দশায় এবং মৃত্যুর পরেও ফাইনম্যান পৃথিবীর অন্যতম জনপ্রিয় ও বিখ্যাত বিজ্ঞানী হিসেবে বিবেচিত।
ফাইনম্যান ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি এবং প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। ১৯৪২ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের পর অন্যান্য অনেক তরুণ পদার্থবিদের সাথে নিউ মেক্সিকোর লস আলামোসে পারমাণবিক বোমা তৈরিতে সাহায্য করেন। যুদ্ধশেষে প্রথমে তিনি কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং পরবর্তীকালে ক্যালটেকে শিক্ষকতা করেন। তাকে কোয়ান্টাম গণনা এবং ন্যানোপ্রযুক্তির (আণবিক স্তরে যন্ত্রপাতি তৈরি) ধারণার জনক বলা হয়।.
ফাইনম্যান তার বিভিন্ন বই ও লেকচারের মাধ্যমে পদার্থবিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার কাজ করেছেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ১৯৫৯ সালে ন্যানোপ্রযুক্তির ওপর প্রদত্ত ভাষণ দেয়ার্স প্লেনটি অফ রুম অ্যাট দা বটম, এবং দ্য ফাইনম্যান লেকচার্স অন ফিজিক্স। ফাইনম্যান তার আধা-আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ শিওরলি ইউ আর জোকিং, মি. ফাইনম্যান! এবং হোয়াট ডু ইউ কেয়ার হোয়াট আদার পিপল থিংক? ইত্যাদির জন্যেও খ্যাত। তিনি ছিলেন একজন প্রাঙ্কস্টার, জাগলার, সেফক্রাকার, শখের চিত্রশিল্পী ও বঙ্গোবাদক। তিনি ছিলেন মুক্ত চিন্তার অধিকারী একজন সুরসিক ব্যক্তি। পদার্থবিজ্ঞান ছাড়াও তার জীববিজ্ঞান, চিত্রকলা, মায়ান স্ক্রিপ্ট এবং সেফক্রাকিং-এ আগ্রহ ছিল।
ফাইনম্যানের জীববিজ্ঞানে গভীর আগ্রহ ছিল; তার জিনবিজ্ঞানী ও অণুজীববিজ্ঞানী এস্থার লিডারবার্গের বন্ধুত্ব ছিল, যিনি রেপ্লিকা প্লেটিং ও ব্যাকটেরিওফায ল্যামডা আবিষ্কার করেছিলেন। তাদের বেশ কিছু বিজ্ঞানী সাথে সখ্যতা ছিল, যাঁরা নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞানে ক্যারিয়ার শুরু করলেও নৈতিক কারণে জিনতত্ত্বে আগ্রহী হন—তাদের মধ্যে লিও জিলার্ড, গুইদো পনটেকরভো, এরন রোভিক এবং কার্ল সাগান উল্লেখযোগ্য।
জীবনবৃত্তান্ত
রিচার্ড ফিলিপ ফাইনম্যান ১১ মে, ১৯১৮ সালে নিউ ইয়র্কের ফার রকওয়ে, কুইনসে জন্মগ্রহণ করেন। তার পূর্বপুরুষরা রাশিয়া ও পোল্যান্ডের আদি অধিবাসী ছিলেন এবং তার পিতামাতা উভয়েই ছিলেন ইহুদি, তবে তারা গোঁড়া ছিলেন না। ফাইনম্যান (দুই বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন ও এডওয়ার্ড টেলারের মতো) দেরিতে কথা বলা শুরু করেছিলেন; তিন বছর পূর্ণ হবার আগ পর্যন্ত তিনি একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। শৈশবে ফাইনম্যান তার বাবা মেলভিল ভীষণভাবে প্রভাবিত করেন, তিনিই তাকে প্রচলিত চিন্তা-ভাবনাকে চ্যালেঞ্জ করতে শিখিয়েছিলেন। আর মা লুসিলের কাছ থেকে ফাইনম্যান পেয়েছিলেন রসবোধ। ছোটোবেলা থেকেই তার বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ ছিল; তিনি রেডিও মেরামত করে আনন্দ পেতেন এবং প্রকৌশলেও তার প্রতিভার কমতি ছিল না। তার বোন জোয়ানও একজন পেশাদার পদার্থবিজ্ঞানী ছিলেন।
শিক্ষা
ফাইনম্যান ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী, তার আইকিউ ছিল ১২৫। কলেজে প্রবেশের আগেই তিনি ডিফারেন্সিয়াল ক্যালকুলাস ও ইন্টিগ্রাল ক্যালকুলাস জানতেন। গণিতে তার অপার আগ্রহ ছিল, তিনি জুনিয়র স্কুলের ছাত্র থাকাকালীন সময়ে স্কুলের গণিত দলের নিয়মিত সদস্য ছিলেন এবং নিত্য নতুন সমস্যা সমাধান করার কৌশল আবিষ্কার করা তার নেশার মত ছিল। এছাড়া গণিতে ব্যবহৃত বিভিন্ন প্রতীকের নিজস্ব রূপ উদ্ভাবন করাটাও তার শখ ছিল, তার আত্মজীবনীতে তিনি বলেছেন ত্রিকোণমিতির সাইন, কোসাইন এবং অন্যান্য অনেক প্রচলিত প্রতীকের নিজস্ব রূপ তিনি ব্যবহার করতেন। অবশ্য পরবর্তীকালে তিনি এ শখটি পরিত্যাগ করেন, কারণ অন্য মানুষজন তার প্রতীকের সাথে পরিচিত ছিল না।
ফাইনম্যান ফার রকওয়ে হাই স্কুলের ছাত্র ছিলেন, যাতে নোবেল বিজয়ী বার্টন রিখটার ও বারুচ স্যামুয়েল ব্লুমবার্গ পড়েছিলেন।[১০] ফাইনম্যান তার হাই স্কুলে পড়াশোনার শেষ বছরে নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি ম্যাথ চ্যাম্পিয়নশিপ জয় করেন; তার প্রাপ্ত নম্বরের সাথে নিকটতম প্রতিযোগীর নম্বরের ব্যবধান বিচারকদের বিস্মিত করেছিল। তিনি ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি থেকে ১৯৩৯ সালে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক অর্জন করেন এবং এরপর তিনি প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করতে যান। প্রিন্সটনে নির্বাচনী পরীক্ষায় তিনি গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানে পারফেক্ট স্কোর করেন, যা ছিল একটি রেকর্ড - তবে ইতিহাস ও ইংরেজি ভাষা অংশে তিনি অতটা ভালো করতে পারেননি। তিনি ১৯৪২ সালে জন আর্কিবাল্ড হুইলারের অধীনে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তার গবেষণার বিষয় ছিল প্রিন্সিপাল অফ স্টেশনারি একশান। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার এই কাজই তার পাথ ইন্টিগ্রালের ভিত্তি ছিল, যার মাধ্যমে দ্য প্রিন্সিপাল অফ লিস্ট একশান ইন কোয়ান্টাম মেকানিকস গড়ে ওঠে।
ম্যানহাটন প্রকল্প
প্রিন্সটনে থাকাকালীন সময়ে পদার্থবিজ্ঞানী রবার্ট আর. উইলসন ফাইনম্যানকে ম্যানহাটন প্রকল্পে যোগদানের আমন্ত্রণ জানান— যা ছিল লস আলামসে যুদ্ধকালীন সময়ে মার্কিন সামরিক বাহিনীর পারমাণবিক বোমা তৈরির প্রকল্প। জার্মানিতে অ্যাটম বোমা তৈরির পূর্বেই কাজটি সম্পন্ন করার গুরূত্ব অনুধাবন করে ফাইনম্যান এর সাথে যুক্ত হন। তাকে হানস বেথের অধীনে তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানী হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়, এবং বেথেকে চমৎকৃত করে তিনি একটি দলের নেতা নিযুক্ত হন। রবার্ট সার্বারের কাজের ওপর ভিত্তি করে ফাইনম্যান ও বেথে ফিশন বোমার বিধ্বংসী ফলাফল নির্ণয়ের জন্যে যৌথভাবে বেথে-ফাইনম্যান ফর্মুলা তৈরি করেন। ফাইনম্যান এই প্রকল্পে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কাজ করেছেন এবং ট্রিনিটি পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণের সময়ও তিনি উপস্থিত ছিলেন। তার দাবী অনুযায়ী বিস্ফোরণ একমাত্র তিনিই খালি চোখে (সহায়ক কালো গ্লাস না লাগিয়ে) পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। তিনি একটি ট্রাকের উইন্ডশিল্ডের মধ্য দিয়ে বিস্ফোরণ অবলোকন করেছিলেন, যার কাচ ক্ষতিকর অতিবেগুনী তেজষ্ক্রিয়তা শুঁষে নেবে বলে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন।
তখনকার সময়ে কম্পিউটার ছিল না বলে ম্যানহাটন প্রজেক্টে মানব কম্পিউটার ব্যবহার করা হত, আর ফাইনম্যান গণনার তত্ত্বাবধান করতেন। এছাড়াও তার কাজের মধ্যে ছিল নিউক্লিয়ার রিঅ্যাকটর ডিজাইন করা।
কাজটির নিশ্ছিদ্র গোপনীয়তার কারণে লস আলামস ছিল জনবিরল। ফাইনম্যানের ভাষায়, ওখানে করবার মতো কিছুই ছিল না, বসে থেকে থেকে বিরক্ত হয়ে ফাইনম্যান নানানরকম মজার পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন। ম্যানহাটন প্রকল্পে কর্মরত বিজ্ঞানীদের সব চিঠিপত্রই কর্তৃপক্ষের অনুমোদন লাভ করার পর (মানে প্রয়োজনীয় সম্পাদনার পর) প্রেরিত হত। ফাইনম্যান প্রায়ই তার সহকর্মীদের সাথে বাজি ধরতেন কোন কথাটা কাচির তলা পড়বে আর কোনটা পড়বে না তা নিয়ে। তিনি এ বিষয়ে একটা নিয়মও আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন। আবার একবার তিনি ল্যাবরেটরি আবেষ্টন করা কাঁটাতারের বেড়ায় একটি ফাঁক আবিষ্কার করলেন, যা কর্মচারীরা শর্টকাট হিসাবে ব্যবহার করতো। তিনি তা নিরাপত্তা কর্মীদের নজরে আনবার জন্যে বারবার গেট দিয়ে বের হয়ে বেড়ার ফাঁক দিয়ে ঢুকে আবার গেট দিয়ে বের হতে লাগলেন। এভাবে নিত্য নতুন ফন্দি আঁটা ফাইনম্যান কম্বিনেশন লক খোলার বিদ্যা শিখতে উঠে পড়ে লাগলেন। তিনি খেয়াল করেছিলেন বিজ্ঞানীরা ও কর্মকর্তারা পারমাণবিক বোমা সংক্রান্ত অতি গোপনীয় কাগজপত্র যেসব স্থানে তালাবন্ধ অবস্থায় রাখেন তা আদৌ নিরাপদ নয়। তিনি প্রায়ই এসব ক্যাবিনেট ও সেফের তালা খুলে সহকর্মীদের সাথে প্র্যাকটিকাল জোক করতেন। একসময় ব্যাপারটা তার নেশায় পরিণত হয় এবং তিনি সেফক্রাকিং এর ওপর রীতিমতো পড়াশোনা করে তালা খোলার বিদ্যা পারদর্শীতা অর্জন করেন। লস আলামসে কম্বিনেশন লকের নিরাপত্তা যাচাই করার জন্যে তার কাছে মতামত চাওয়া হতে শুরু করে। ফাইনম্যান কম্বিনেশন লকের কম্বিনেশন বের করার মজার এক বুদ্ধি বের করেছিলেন এবং এর মাধ্যমে তালা খুলে নানান হাস্যরসাত্মক ঘটনার জন্ম দিতেন।
কর্মজীবনের সূচনাভাগ
১৯৪২ সালে ডক্টরেট করার পর ফাইনম্যান ইউনিভার্সিটি অফ উইসকনসিন-ম্যাডিসনে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন। ম্যানহাটন প্রজেক্টে যোগদানের কারণে তার নিয়োগের পরপরই তিনি ছুটিতে চলে যান। ১৯৪৫ সালে তিনি ডিন মার্ক ইনগ্রাহামের কাছ থেকে একটি চিঠি পান, যাতে তাকে পরবর্তী শিক্ষাবর্ষে পাঠদানের জন্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিতে অনুরোধ করা হয়। কিন্তু ফাইনম্যান এ বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু না বলায় তার নিয়োগ আর বর্ধিত করা হয়নি। পরবর্তীকালে ফাইনম্যান ইউডব্লুতে কয়েকটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন, যেখানে তিনি মন্তব্য করেন, "এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসতে পেরে খুবই ভালো লাগছে কারণ আমাকে চাকরিচ্যুত করার সুবুদ্ধি বিশ্ববিদ্যালয়ের আছে।
যুদ্ধের পর ফাইনম্যান প্রিন্সটনের ইন্সটিটিউট অফ অ্যাডভান্স স্টাডির আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন, কিন্তু সেখানে আলবার্ট আইনস্টাইন, কুর্ট গোডেল, জন ভন নিউম্যান প্রমুখ বাঘা বিজ্ঞানীদের উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও তিনি সে আমন্ত্রণ প্রত্যাখান করে কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান পড়ানোর চাকরি গ্রহণ করেন। ফাইনম্যান ১৯৪৫ থেকে ১৯৫০ পরযন্ত কর্নেলে পদার্থবিজ্ঞানে গাণিতিক পদ্ধতি প্রয়োগের পাঠদান করেন। হিরোশিমায় পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের পর তার গবেষণায় একটু ভাঁটার টান চলে, তবে তার পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে আনন্দময় গবেষণা করার অভ্যাসটি তিনি শীঘ্রই ফিরে পান। একবার ক্যাফেটেরিয়ায় বসে এক কর্নেলের লোগো আঁকা প্লেট নিয়ে এক দড়াবাজিকরের খেলা দেখতে দেখতে তিনি প্লেট ও লোগোর ঘূর্ণনের সম্পর্কের একটি জটিল হিসাব নিকাশ সম্পন্ন করেন, যা পরবর্তীকালে তার নোবেল পুরস্কার পাওয়া কাজের ভিত্তি।
ফাইনম্যান অসাধারণ ব্যাখ্যাদাতা হিসাবে সুপরিচিত ছিলেন। ছাত্রদের কোন কিছু সহজভাবে বোঝানোর ব্যাপারটি তিনি খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন এবং পাঠ্য বিষয় ছাত্রদের হৃদয়ঙ্গম করাকে নিজের নৈতিক দায়িত্ব মনে করতেন। তিনি মনে করতেন একজন প্রথম বর্ষের ছাত্রকে যেকোন বিষয় বোঝানো সম্ভব, তা না করতে পারার মানে হল শিক্ষক নিজে বিষটি সম্পূর্ণরূপে অনুধাবন করতে পারেন নি। তার বিভিন্ন লেকচার এবং বক্তৃতায় এ নীতির ছাপ স্পষ্ট লক্ষ করা যায়।
না বুঝে পদার্থবিজ্ঞান বা বিজ্ঞানের যে কোন বিষয় পড়াকে ফাইনম্যানের অর্থহীন মনে হত। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকার সময়েই লক্ষ্য করেছিলেন তার সহপাঠীরা যা শেখে তা অনেকটাই গ্রন্থগত; পরবর্তীকালে তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন ব্যক্তির মধ্যেও এমন সীমাবদ্ধতা লক্ষ্য করেন। কর্নেলে অধ্যাপনারত অবস্থায় ফাইনম্যান কিছুদিনের জন্যে পরিদর্শক অধ্যাপক হিসেবে ব্রাজিলে যান। সেখনে গিয়ে তিনি খেয়াল করেন সেখানকার বিজ্ঞান শিক্ষার দৈন্যদশা এবং পাঠ্যপুস্তকের দুর্বলতা। তিনি সে দেশের শিক্ষা সংক্রান্ত জাতীয় কনফারেন্সে অকুন্ঠচিত্তে এ বিষয়ে সমালোচনা করেন। তিনি যা ভালো মনে করতেন তা করতে তিনি কখনো দ্বিধাবোধ করতেন না। তিনি নির্বুদ্ধিতা বা ভান করা পছন্দ করতেন না এবং যারা তাকে বোকা বানাতে চাইত তাদের তিনি সহজে ছেড়ে দিতেন না।
ফাইনম্যান ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি এবং প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। ১৯৪২ সালে পিএইচ. ডি. ডিগ্রী অর্জনের পর অন্যান্য অনেক তরুণ পদার্থবিদের সাথে নিউ মেক্সিকোর লস আলামোসে পারমাণবিক বোমা তৈরীতে সাহায্য করেন। যুদ্ধশেষে প্রথমে তিনি কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং পরবর্তীকালে ক্যালটেকে শিক্ষকতা করেন। তাকে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং[২] এবং ন্যানোপ্রযুক্তির (আণবিক স্তরে যন্ত্রপাতি তৈরি) ধারণার জনক বলা হয়।
ফাইনম্যান তার বিভিন্ন বই ও লেকচারের মাধ্যমে পদার্থবিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার কাজ করেছেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ১৯৫৯ সালে ন্যানোপ্রযুক্তির ওপর প্রদত্ত ভাষণ দেয়ার্স প্লেনটি অফ রুম অ্যাট দা বটম, এবং দ্য ফাইনম্যান লেকচার্স অন ফিজিক্স। ফাইনম্যান তার আধা-আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ সিওরলি ইউ আর জোকিং, মি. ফাইনম্যান! এবং হোয়াট ডু ইউ কেয়ার হোয়াট আদার পিপল থিংক? ইত্যাদির জন্যেও খ্যাত। তিনি ছিলেন একজন প্রাঙ্কস্টার, জাগলার, সেফক্রাকার, শখের চিত্রশিল্পী ও বঙ্গোবাদক। তিনি ছিলেন মুক্ত চিন্তার অধিকারী একজন সুরসিক ব্যক্তি। পদার্থবিজ্ঞান ছাড়াও তার জীববিজ্ঞান, চিত্রকলা, মায়ান স্ক্রিপ্ট এবং সেফক্রাকিং-এ আগ্রহ ছিল।
ফাইনম্যানের জীববিজ্ঞানে গভীর আগ্রহ ছিল; তার জিনবিজ্ঞানী ও অণুজীববিজ্ঞানী এস্থার লিডারবার্গের বন্ধুত্ব ছিল, যিনি রেপ্লিকা প্লেটিং ও ব্যাকটেরিওফায ল্যামডা আবিস্কার করেছিলেন।[৪] তাদের বেশ কিছু বিজ্ঞানী সাথে সখ্যতা ছিল, যারা নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞানে ক্যারিয়ার শুরু করলেও নৈতিক কারণে জিনতত্ত্বে আগ্রহী হন—তাদের মধ্যে লিও জিলার্ড, গুইদো পনটেকরভো, এরন রোভিক এবং কার্ল সাগান উল্লেখযোগ্য।
পদার্থবিজ্ঞানের অমর নক্ষত্র
বিজ্ঞানী হয়েও জীবদ্দশায় পেয়েছেন রকস্টারের খ্যাতি। পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে তিনি কিংবদন্তীতুল্য। তাঁর রসিকতাবোধ মানুষকে মুগ্ধ করেছে বারেবারে। কাজ করেছেন ম্যানহাটান প্রজেক্টে সে কালের অন্যতম সেরা বিজ্ঞানীদের সঙ্গে। কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডাইনামিকসে গবেষণার জন্য পেয়েছেন নোবেল পুরস্কার। তিনি রিচার্ড ফাইনম্যান। আজ ১১ মে তাঁর জন্মদিন। এই দিনে জেনে নিন রিচার্ড ফাইনম্যানের শৈশব, কৈশোর, গবেষণা…
শুরুর আগে
একবার হাওয়াইতে আমাকে এক বৌদ্ধমন্দির দেখতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই মন্দিরের একজন আমাকে বলেছিলেন, ‘আপনাকে আমি একটা কথা বলতে চাই। এটা আপনি কোনোদিন ভুলতে পারবেন না, আমি জানি।’ তারপর বললেন, ‘প্রত্যেক মানুষকেই স্বর্গের দরজার চাবি দেওয়া হয়। কিন্তু এই চাবি দিয়ে নরকের দরজাও খোলে।’
বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও কথাটা একই। এটা স্বর্গের দরজার চাবি হলেও, একই চাবি দিয়ে নরকের দরজাও খোলে। তবে কোনটা যে কীসের দরজা—সে ব্যাপারে আমাদের কাছে কোনো নির্দেশনা নেই। তাহলে আমরা কি এই চাবি ছুঁড়ে ফেলে দেব? এবং স্বর্গে প্রবেশের সম্ভাবনা বন্ধ করে দেব চিরতরে? নাকি কীভাবে সবচেয়ে ভালোভাবে এই চাবি ব্যবহার করা যায়—এ প্রশ্নের সমাধান করার চেষ্টা করে যাব? এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রশ্ন। তবে আমার মনে হয়, স্বর্গের দরজার চাবির মূল্য আমরা অস্বীকার করতে পারি না।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন সরকার পারমাণবিক বোমা বানাতে একটি বিপুল ব্যয়বহুল প্রকল্প হাতে নেয়। এ প্রকল্পের নাম দেওয়া হয় ম্যানহাটান প্রজেক্ট। প্রকল্পটির প্রধান পরিচালক ছিলেন রবার্ট ওপেনহাইমার। বড় বড় বিজ্ঞানীদের সঙ্গে কাজ করার জন্য ডাক পেয়েছেন এক তরুণ বিজ্ঞানীও। তাঁর বয়স কেবল বিশ পেরিয়েছে। উচ্ছলতার বয়স। সেই বয়সে তরুণ এই বিজ্ঞানীর ঘাড়ে চেপেছে জটিল সব গাণিতিক হিসাবনিকাশের দায়িত্ব। গুরুদায়িত্ব, বলা বাহুল্য। একটু এদিক-ওদিক হলেই হয়েছে! সামান্য ভুলের জন্যও গুনতে হতে পারে চড়া মাশুল।
তরুণ যেন জাদু জানেন। দারুণ দক্ষতার সঙ্গে সামাল দিলেন সবকিছু। সেই সঙ্গে ইউরেনিয়াম-২৩৫ আর ইউরেনিয়াম-২৩৮-কে কীভাবে আলাদা করা যায়, এ নিয়েও কাজ করলেন সফলভাবে।
শুধু তাই নয়। পরবর্তীতে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার একটি শাখা—কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডাইনামিকসে অবদানের জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। নিজের উদ্ভাবিত স্বনামের ডায়াগ্রামটির জন্যই শুধু অমর খ্যাতি পেতে পারতেন। তবে থেমে যাননি শেখানেই। জীবদ্দশায় বিজ্ঞানী হয়েও পেয়েছিলেন রকস্টারের খ্যাতি। পদার্থবিজ্ঞানের অন্যতম মেধাবী শিক্ষক হিসেবে নিজেকে নিয়ে গেছেন কিংবদন্তী পর্যায়ে। একবার পদার্থবিজ্ঞানের একাডেমিক কোর্স করিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের—সেই লেকচারগুলো বই হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে, আজও সেই বই বহু তরুণকে পদার্থবিজ্ঞানে পড়াশোনার অনুপ্রেরণা জুগিয়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞান এগিয়ে গেছে অনেক দূর, বদলে গেছে অনেক কিছু, কিন্তু তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজনীয়তা ম্লান হয়নি একটুও।
তরুণ সেই বিজ্ঞানীর নাম রিচার্ড ফাইনম্যান। তাঁর গল্প শোনার জন্য চলুন ফিরে যাই ১৯১৮ সালে, যুক্তরাষ্ট্রের ব্রুকলিনে।
এভাবে ফাইনম্যান যোগ দিলেন ম্যানহাটান প্রজেক্টে। তাঁর মূল গবেষণার বিষয় ছিল, কীভাবে ইউরেনিয়াম-২৩৫ থেকে ইউরেনিয়াম-২৩৮-কে আলাদা করা যায়। ওদিকে হুইলার তখন শিকাগো চলে গেছেন। ফার্মির সঙ্গে মিলে পারমাণবিক রিঅ্যাক্টর বানানোর কাজ শুরু করেছেন। হুইলারের অনুপস্থিতিতে ফাইনম্যানের থিসিসের কাজে সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন ইউজিন উইগনার। তিনি ফাইনম্যানকে বললেন থিসিস পেপারটা লিখে ফেলতে। পেপার লেখা শেষ হলে উইগনার নিজেই পেপারটা দেখে দিলেন। এর মাধ্যমে ১৯৪২ সালে রিচার্ড ফাইনম্যানের পিএইচডি ডিগ্রি সম্পন্ন হলো।

প্রেমিকা আরলিন গ্রিনবমের টিউবার্কিউলোসিস ধরা পড়ল এ সময়। যখন পরিবারের সমর্থন সবচেয়ে বেশি দরকার, তখন পরিবারের কাছ থেকে মানসিক সমর্থন পাননি একটুও। সবার অমতে, পিএইচডি ডিগ্রি পাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই আরলিনকে বিয়ে করেন ফাইনম্যান। এ সময়ে সেখানে তাঁর পরিবারের কেউ উপস্থিত ছিল না। ব্যক্তি ফাইনম্যান দৃঢ়তা বেশ ভালোভাবেই বোঝা যায় এ থেকে।
১৯৪৫ সালে পারমাণবিক বোমা প্রথমবারের মতো পরীক্ষা করে দেখার আগেই আরলিন মারা যান। ফাইনম্যান আবারো নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কাজ বলতে, এ সময় তিনি কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন। গবেষণা বাদ দিয়ে সেটা নিয়েই দিন কাটাতে থাকেন তিনি।
প্রায় বছর পাঁচেক শিক্ষকতা ছাড়া তেমন কোনো কাজ করেননি। তারপরেই আগের সেই তাড়নাটা ফিরে এল। গবেষণা করতে হবে। এ সময়, ১৯৫০ সালে, ক্যালিফোর্নিয়া ইরস্টিটিউট অব টেকনোলজি বা ক্যালটেকে পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ পেলেন। সেখানেই তিনি বাকি কর্মজীবন কাটিয়েছেন। এখানে থাকতেই একবার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী, অর্থাৎ ফ্রেশম্যান ও সফোমরদের পদার্থবিজ্ঞান শেখানোর দায়িত্ব নেন তিনি। ঠিক করলেন, প্রচলিত ধারার লেকচার দেবেন না। অগ্রসর শিক্ষার্থীদের ধরে রাখার মতো করে সাজানো হলো লেকচারগুলো। অথচ শুরু থেকে যাঁরা শিখছেন, তাঁরাও অনায়াসে ঢুকে যেতে পারবেন বিষয়ের গভীরে। সেই লেকচারেরই লিখিত সংস্করণ হিসেবে পরে প্রকাশিত হয় দ্য ফাইনম্যান লেকচারস অব ফিজিকস। পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীমাত্রই জানেন এ বইয়ের গুরুত্ব।
এ সময় তিনি আবার কোয়ান্টাম বলবিদ্যা নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। তাঁর মূল অবদানও এই কোয়ান্টাম বলবিদ্যাতেই। আরও ঠিক করে বললে, কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডায়নামিকসে। নতুন একধরনের ডায়াগ্রামের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন তিনি আমাদের। তাঁর নামে এই ডায়াগ্রামের নাম দেওয়া হয়েছে ফাইনম্যান ডায়াগ্রাম। সিস্টেম বা ব্যবস্থার সঙ্গে মিথস্ক্রিয়াশীল কণাদের আচরণ গাণিতিকভাবে ব্যাখ্যা করতে এই ডায়াগ্রাম ব্যবহার করা হয়।
মৃত্যু
১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৮ (বয়স ৬৯) লস অ্যাঞ্জেলেস, ক্যালিফোর্নিয়া ।
soruse : wikipedia ...somewhereinblog ...bigganchinta
What's Your Reaction?






