মুহাম্মাদ কুদরাত-এর জীবনী-biography of Dr. Muhammad Qudrat-i-Khuda
মুহাম্মাদ কুদরাত-এর জীবনী-biography of Dr. Muhammad Qudrat-i-Khuda

ড. মুহাম্মদ কুদরাত-এ-খুদা: এক কৃতী বিজ্ঞানীর কর্মময় জীবন
মুহম্মদ কুদরাত-এ-খুদা বা ড. কুদরাত-এ-খুদা (১ ডিসেম্বর ১৯০০ - ৩ নভেম্বর ১৯৭৭) ছিলেন একজন বাংলাদেশী রসায়নবিদ, গ্রন্থকার এবং শিক্ষাবিদ। শিক্ষায় অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে ১৯৭৬ সালে একুশে পদক এবং ১৯৮৪ সালে মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করে।
জন্ম |
১৮৯৫ সালের ১২ ডিসেম্বর, |
জাতীয়তা |
বাংলাদেশী |
শিক্ষাক্ষেত্র |
প্রেসিডেন্সি কলেজ, লন্ডন বিশ্ববিদ্যলয়। |
মৃত্যু |
৩ নভেম্বর 1977 ( 76 বছর) , ঢাকা, বাংলাদেশ |
জন্ম ও শৈশব
মুহাম্মদ কুদরাত-ই-খুদার জন্ম হয়েছিল ১৮৯৫ সালের ১২ ডিসেম্বর, তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের অধীনে পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার মারগ্রাম গ্রামে। তাঁর পরিবার ছিল মধ্যবিত্ত ও ধর্মপরায়ণ, কিন্তু সেই সঙ্গে ছিল শিক্ষানুরাগী। পরিবার থেকেই তিনি ছোটবেলায় বিজ্ঞান চর্চা, জ্ঞানার্জন, ও পাঠাভ্যাসের প্রতি অনুরাগ লাভ করেন। প্রাথমিক শিক্ষা শেষে তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে রসায়নশাস্ত্রে অনন্য ফলাফল নিয়ে স্নাতক পাস করেন। পরবর্তীতে উচ্চশিক্ষার জন্য ইংল্যান্ডের লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট (D.Sc) ডিগ্রি অর্জন করেন। লন্ডন থেকে ফিরে এসে তিনি উপমহাদেশের বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতির বিকাশে নিজেকে নিবেদিত করেন।
পেশা জীবনঃ
দেশেফিরেতিনিপ্রেসিডেন্সিকলেজেরসায়নবিভাগেযোগদানকরেন, প্রভাষকহিসেবে১৯৩১সালে।১৯৩৬সালেহনবিভাগীয়প্রধান।পরেপ্রেসিডেন্সিকলেজেরপ্রিন্সিপালপদেথাকেনবেশকয়েকবছর।
দেশভাগেরপরতৎকালীনপূর্বপাকিস্তানেচলেআসেনড. কুদরাত-এ-খুদা।কিন্তুঢাকাবিশ্ববিদ্যালয়েযোগনাদিয়েতিনিডিপিআইবিভাগেযোগদানকরলেন।হতেপারেবিশ্ববিদ্যালয়েরকর্তাব্যক্তিদেরসঙ্গেতাঁরমতদ্বৈততাছিল।
‘জনশিক্ষাদপ্তরেরপরিচালকেরপদেথাকারসময়সরকারেরসঙ্গেতাঁরসম্পর্কভালোছিলনা, কেননাস্কুলেউর্দুশিক্ষাবাধ্যতামূলককরারবিরুদ্ধেতিনিমতপ্রকাশকরেন।১৯৫০সালেতাঁকেপাকিস্তানকেন্দ্রীয়সরকারেরবিজ্ঞানউপদেষ্টাকরাহয়, কিন্তুকরাচিতেওতাঁরজীবনআনন্দময়ছিলনা।একসময়তাঁরগৃহেরাতেইটপাটকেলপড়াশুরুহলো, করাচিতেবাসকরাতাঁরপক্ষেঅসম্ভবহয়েউঠল।
১৯৫৩সালেপাকিস্তানবিজ্ঞানওশিল্পগবেষণাপরিষদগঠিতহওয়ারপরসিদ্ধান্তহলোদেশীয়সম্পদেরবিকাশেপশ্চিমওপূর্বেকয়েকটিগবেষণাগারগড়েতোলাহবে।১৯৫৫সালেপূর্বাঞ্চলীয়গবেষণাগারগড়েতোলারদায়িত্বপানড. খুদা।এইপ্রতিষ্ঠানটিরইউত্তরসূরিআজকেরবিজ্ঞানওশিল্পগবেষণাপরিষদ (বিসিএসআইআর)।ড. খুদাএকদমশূন্যথেকেতিলতিলকরেএটিগড়েতোলেন।বিদেশেঅর্জিতঅভিজ্ঞতারঅনেকখানিইতিনিসদ্ব্যবহারকরতেপেরেছিলেনএইপ্রতিষ্ঠানে।১৯৬৬সালেঅবসরেরআগপর্যন্ততিনিএখানেইকর্মরতছিলেন।এইপ্রতিষ্ঠানেপ্রথমথেকেইবৈজ্ঞানিকগবেষণায়স্বাধীনতাছিল
পেশাগত জীবন ও গবেষণা
ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জনের পর মুহাম্মদ কুদরাত-ই-খুদা কলকাতায় শিক্ষকতা শুরু করেন। ভারত ভাগের পর তিনি পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) চলে আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা ও গবেষণার সাথে যুক্ত হন। তিনি মূলত রসায়ন শাস্ত্রে বিশেষজ্ঞ ছিলেন, বিশেষ করে জৈব রসায়ন এবং খাদ্য রসায়ন ক্ষেত্রে তাঁর অবদান উল্লেখযোগ্য। তাঁর গবেষণার মধ্যে ছিল দেশীয় সম্পদ—যেমন পাট (জুট) থেকে গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিক পদার্থ ও সেলুলোজ ভিত্তিক পণ্য উন্মোচন করার চেষ্ট। তিনি দেখিয়েছিলেন যে পাট থেকে সেলুলোজ নিষ্কাশন ও এর বহুমুখী ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশ তার অর্থনৈতিক উন্নয়নে নতুন মাত্রা পেতে পারে।
জ্ঞানচর্চায় বাংলা ভাষার প্রসার
মুহাম্মদ কুদরাত-ই-খুদা ছিলেন এক অসাধারণ চিন্তাবিদ, যিনি বিশ্বাস করতেন বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং উচ্চতর জ্ঞান শুধু ইংরেজি বা অন্য কোনও বিদেশি ভাষায় সীমাবদ্ধ রাখা উচিত নয়। তিনি মনে করতেন বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা ও পাঠদান করতে হবে, যাতে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম সহজেই বিজ্ঞানকে বুঝতে এবং কাজে লাগাতে পারে।
এই উদ্দেশ্যে তিনি বাংলা ভাষায় অসংখ্য বিজ্ঞানবিষয়ক গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর লেখা “বিজ্ঞান সাধনা,” “বিজ্ঞান কথা,” “ব্যাকরণ ও বিজ্ঞান,” ইত্যাদি বইগুলো বিদ্যার্থীদের বিজ্ঞান শিক্ষার ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করে। তিনি বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানের পরিভাষা তৈরিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন, ফলে জটিল বৈজ্ঞানিক বিষয় সহজবোধ্যভাবে পাঠকের কাছে তুলে ধরা সম্ভব হয়।
শিক্ষা সংস্কারে অবদান
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি ও নতুন কাঠামো গড়ে তোলার লক্ষ্যে সরকার ১৯৭২ সালে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করে, যা “কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন” নামে পরিচিত। এই কমিশন শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর একটি ঐতিহাসিক প্রয়াস ছিল। কমিশনের মূল উদ্দেশ্য ছিল একটি বিজ্ঞানমনস্ক, মানবিক, এবং গণমুখী শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা, যা জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ এবং উন্নয়নমুখী জ্ঞানসমৃদ্ধ নাগরিক তৈরি করবে।
কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন অনুসারে:
- প্রাথমিক স্তর থেকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর পাঠ্যক্রম চালু করা।
- মাতৃভাষায় পাঠদান নিশ্চিত করা।
- কারিগরি শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের ওপর জোর দেওয়া।
- ছাত্রদের সৃজনশীলতা ও গবেষণামূলক চিন্তার বিকাশে উৎসাহ প্রদান।
এই শিক্ষানীতি পরবর্তীতে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্যাপক প্রভাব ফেলে। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান শিক্ষার ওপর যত জোর তিনি দিয়েছেন, তা আজও প্রাসঙ্গিক। উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় দেশীয় সম্পদের ব্যবহার, স্থানীয় সমস্যা সমাধানে বিজ্ঞান প্রয়োগ ইত্যাদি বিষয় তাঁর দর্শনে অন্তর্ভুক্ত ছিল।
বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠান গঠনে ভূমিকা
মুহাম্মদ কুদরাত-ই-খুদা ছিলেন বাংলাদেশ কাউন্সিল অব সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ (BCSIR)-এর প্রথম চেয়ারম্যান। এই প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞান গবেষণা ও শিল্পায়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। কুদরাত-ই-খুদা এর নেতৃত্বে BCSIR দেশে প্রয়োগমুখী গবেষণার ধারা চালু করে। দেশীয় কাঁচামালকে বিভিন্ন শিল্পজাত পণ্যে রূপান্তরের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা এবং স্থানীয় সমস্যা সমাধানে বিজ্ঞানকে কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন পথিকৃৎ।
এছাড়াও তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারে বিভিন্ন উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন, যাতে দেশীয় বিজ্ঞান গবেষণা ও প্রযুক্তি বিকাশে অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়। সরকারী নীতিমালা প্রণয়নে তাঁর উপদেশ ও মতামত ছিল দূরদর্শী এবং বাস্তবমুখী।
রচনাবলী ও প্রকাশনাঃ
১৯৩৬সালেতিনিলিখেছিলেনবাংলারমাধ্যমেবিজ্ঞান।এরপরতাঁরসবচেয়েবিখ্যাতবই বিজ্ঞানেরবিচিত্রকাহিনী। এছাড়াও আরো যে সব বই লিখেন তিনি।
|
|
গবেষণা:
পাটকাঠি থেকে মণ্ড তৈরী করে সেই মণ্ড থেকে অতি উন্নতমানের দৃঢ় তক্তা করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন। পারটেক্স কাঠ কুদরাত-এ-খুদার বিশেষ অবদান। সমুদ্রের পানি থেকে লবণ চাষিরা যে পদ্ধতিতে লবণ সংগ্রহ করেন তা থেকে শুধুমাত্র খাবার লবণ (NaCl) সংগ্রহ করা সম্ভব। কিন্তু সমুদ্রের পানিতে NaCl ছাড়াও প্রচুর পরিমাণে ম্যাগনেশিয়াম সালফেট ও ম্যাগনেশিয়াম ক্লোরাইড ও স্বল্পমাত্রায় ব্রোমিন থাকে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে এসব রাসায়নিক প্রচুর পরিমাণে ব্যবহৃত হয় এবং প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে এসব বাংলাদেশে আমদানী করা হত। কুদরাত-এ-খুদাই প্রথম হিসাব করে দেখান, বড় কোনো কারখানায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে লবণ আহরণ করা হলে, সে কারখানা যদি ১ লাখ টন লবণ উৎপাদন করে, তবে সেখানে তার পাশাপাশি বাই-প্রোডাক্ট হিসেবে ১০ হাজার টন ম্যাগনেশিয়াম ক্লোরাইড, ১০ হাজার টন ম্যাগনেশিয়াম সালফেট ও সেই অনুপাতে পটাশিয়াম ক্লোরাইড উৎপন্ন হবে।
শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট
প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের উপযোগী সমাজগঠনমূলক একটি সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থার রুপরেখা প্রণয়নের উদ্দেশ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গৃহীত প্রস্তাব অনুযায়ী ১৯৭২ সালের ২৬ জুলাই গঠিত 'জাতীয় শিক্ষা কমিশন' প্রণীত সুপারিশমালা। এই কমিশনের সভাপতি ছিলেন কুদরাত-এ-খুদা। তার নাম অনুসারে পরবর্তীকালে রিপোর্টটির নাম রাখা হয় 'ড. কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষাকমিশন রিপোর্ট'। এটি প্রকাশিত হয় ১৯৭৪ সালের মে মাসে 'বাংলাদেশ শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট' নামে। এতে পরিশিষ্ট বাদে ৩৬টি অধ্যায় ছিল এবং পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিল মোট ৪৩০।
মৃত্যু ও উত্তরাধিকার
মুহাম্মদ কুদরাত-ই-খুদা ১৯৭৭ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুতে বাংলাদেশ হারায় এক মহান চিন্তাবিদ, বিজ্ঞানী এবং শিক্ষা সংস্কারককে। কিন্তু তিনি রেখে গেছেন অমর আদর্শ এবং প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো। আজও BCSIR ও অন্যান্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান তাঁর দেখানো পথে চলছে। শিক্ষা ব্যবস্থায় তাঁর দেওয়া পরিকল্পনা ও দর্শন বীজরূপে রয়ে গেছে, যা পরবর্তীতে নানা শিক্ষানীতিতে প্রতিফলিত হয়েছে।
বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার ধারা, মাতৃভাষাভিত্তিক পাঠ্যক্রম, এবং প্রযুক্তি উদ্ভাবনে স্থানীয় সম্পদ ব্যবহারের যে ধারণা তিনি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, তা এখনো প্রাসঙ্গিক। তরুণ বিজ্ঞানী, গবেষক, শিক্ষক, ও শিক্ষানীতিনির্ধারকরা তাঁর জীবন ও কর্ম থেকে অনুপ্রেরণা গ্রহণ করে চলেছেন। প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার যুগে দাঁড়িয়েও কুদরাত-ই-খুদার মতামত ও দিকনির্দেশনা স্মরণ করিয়ে দেয়—মাতৃভাষাভিত্তিক বিজ্ঞান শিক্ষা ও গবেষণা একটি জাতির জ্ঞানভিত্তিক বিকাশের মূল ভিত্তি হতে পারে।
What's Your Reaction?






