বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলামের জীবনী - Biography of Jamal Nazrul

বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলামের জীবনী - Biography of Jamal Nazrul

May 12, 2025 - 12:44
May 13, 2025 - 19:32
 0  1
বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলামের জীবনী - Biography of Jamal Nazrul

বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলাম

জন্ম ও শিক্ষাজীবন :

বাংলাদেশের কৃতি সন্তান অধ্যাপক ড. জামাল নজরুল ইসলাম ১৯৩৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ঝিনাইদহ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তারা বাবা ছিলেন এই মুনসেফ (বর্তমান সহকারি জজের সমতুল্য)। বাবার বদলির চাকরির সূত্রে তার শিক্ষাজীবন শুরু হয় কলকাতায়। কলকাতায় পড়ালেখা করেন চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত এবং পরবর্তীতে চলে আসেন চট্টগ্রাম শহরে। চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি পরীক্ষায় বিশেষ কৃতিত্বের জন্যে তাকে ডাবল প্রমোশন দিয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি করিয়ে নেয়া হয়। এখানেই গণিতের প্রতি সৃষ্টি হয় তার প্রবল ভালো লাগা এবং তিনি নিজের আগ্রহেই শুরু করেন জ্যামিতির অতিরিক্ত সমাধান।

নবম শ্রেণী পর্যন্ত এখানে পড়ালেখা করে চলে যেতে হয় পশ্চিম পাকিস্তানে এবং ভর্তি হন লরেন্স কলেজে। এখান থেকেই সিনিয়র কেমব্রিজ ও হায়ার সিনিয়র কেমব্রিজ পাশ করেন। সে সময় সিনিয়র কেমব্রিজ বলতে বর্তমানের ‘ও লেভেল’ এবং হায়ার সিনিয়র কেমব্রিজ বরতে বর্তমানের ‘এ লেভেল’ বোঝাতো। লরেন্স কলেজের পাঠ শেষে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়তে যান এবং বিএসসি অনার্স সম্পন্ন করেন। এরপর ১৯৫৭ সালে কেমব্রিজে পড়তে যান এবং প্রায়োগিক গণিত ও তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে আবারো স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন ১৯৫৯ সালে। এখান থেকেই ১৯৬০ সালে মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করেন এবং প্রায়োগিক গণিত ও তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন ১৯৬৪ সালে। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮২ সালে এসডিসি (ডক্টর অব সায়েন্স) ডিগ্রি লাভ করেন।

কর্মজীবন :

১৯৬৩ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত ড. ইসলাম পোস্ট ডক্টরাল ফেলো হিসেবে কর্মরত ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ডে। তিনি কেমব্রিজের ইনস্টিটিউট অব থিওরিটিক্যাল অ্যাস্ট্রোনমি-তে (বর্তমানে ইনস্টিটিউট অব অ্যাস্ট্রোনমি) কাজ করেন ১৯৬৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত। ১৯৭১ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত তিনি কাজ করেন ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি-তে। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটিতে সিনিয়র গবেষণা সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন লন্ডন কিংস কলেজে ফলিত গণিতের প্রভাষক।

১৯৭৫ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত ইউনিভার্সিটি কলেজ, কার্ডিফ (বর্তমানে কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়) সায়েন্স রিসার্চ কাউন্সিলে ফেলো ছিলেন। ১৯৭৮ সালে তিনি লন্ডনের সিটি ইউনিভার্সিটিতে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন এবং পরবর্তীতে রিডার পদে উন্নীত হন এবং কর্মরত থাকেন ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত। যুক্তরাষ্ট্রে প্রিন্সটনে অবস্থিত ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্সড স্টাডিতে ১৯৬৮, ১৯৭৩ ও ১৯৮৪ সালে ভিজিটিং সদস্য হিসেবে কাজ করেন। ১৯৮৪ সালে ড. ইসলাম বাংলাদেশে ফিরে এসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন।

ব্যক্তি ড. জামাল নজরুল ইসলাম :

শুধু জ্ঞানচর্চা আর গবেষণাতেই নয় তিনি ব্যক্তি হিসেবেও ছিলেন অসাধারণ। তার সান্নিধ্য সমৃদ্ধ করেছে, অনুপ্রাণিত করেছে শত শত মানুষকে। আজ ড. ইসলামের মৃত্যুতে তারা অনুভব করছেন অভিভাবক হারানোর শূন্যতা।বই পড়তে খুব ভালোবাসতেন। গান শোনা আর ছবি আঁকার প্রতিও তার ছিল দারুন ঝোঁক। ছোটবেলা থেকেই ক্যালকুলেটর ব্যবহারের প্রতি তার ছিল বেশ অনীহা। গণিতের জটিল সব সমস্যার সমাধান করতে ভালবাসতেন মাথা খাটিয়ে।তার চিন্তা আর ভালবাসার অনেকটা জুড়ে ছিল তার দেশ এবং দেশের মানুষ।

তাই তো বিশ্বসেরা সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে জ্ঞান অর্জন করে ফিরেছেন নিজের দেশে। বিশ্বমানের সব গবেষণাগারে কাজ করার হাতছানি পেছনে ফেলে ছুটে এসেছেন বাংলাদেশে, গড়ে তুলেছেন বিজ্ঞানচর্চার জন্যে আধুনিক গবেষণাগার। তার হাতে গড়া গণিত ও ভৌত গবেষণা কেন্দ্র বর্তমানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ইনস্টিটিউট হিসেবে গবেষণার সুযোগ করে দিচ্ছে শত শত শিক্ষার্থীকে। বাংলাদেশে আধুনিক মানের গবেষণার এই পরিবেশ ধরে রাখার পেছনে মূল অবদান তার।

বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রেও তিনি রেখেছেন অনন্য সাধারণ ভূমিকা। শিক্ষক হিসেবেও তিনি ছিলেন চমৎকার। গণিত এবং বিজ্ঞানের জটিলতর বিষয়গুলো ছাত্রদের বোঝাতেন খুব সহজে।বাংলা ভাষার ওপরও তার ছিল ভালো দখল। তার সুন্দর শব্দচয়ন বিজ্ঞানের সেমিনারগুলোতে শ্রোতাদের মাঝে সঞ্চার করত অন্যরকম মুগ্ধতা।সবসময়ই ড. ইসলাম নিজের আয় থেকে কিছুটা বাঁচিয়ে পড়ালেখার ব্যবস্থা করে গেছেন দরিদ্র ছাত্রদের। তার ছাত্রদের এবং সান্নিধ্যে আসা মানুষদের দেশের জন্যে কিছু করতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন সবসময়।

১৯৭১ সালে পড়ালেখা এবং কাজের জন্যে বিদেশ বিভুঁইয়ে থাকলেও কাজ করে গেছেন দেশের জন্যে। বিশ্বের নানাপ্রান্তে অসংখ্য দেশে চিঠি লিখেছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত সৃষ্টি করতে।

প্রকাশনা :

তার লেখা গ্রন্থগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ‘দি আলটিমেট ফেইট অব দি ইউনিভার্স’ যা ১৯৮৩ সালে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়। এই বইটি বিজ্ঞানী মহলে ব্যাপক সাড়া ফেলতে সক্ষম হয় এবং অনুদিত হয় ফরাসি, জাপানি, পুর্তগিজ ও যুগোস্লাভ ভাষায়। ১৯৮৪ সালে ডব্লিউ বি বনো-র সাথে যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ‘ক্ল্যাসিক্যাল জেনারেল রিলেটিভিটি’। এছাড়াও ১৯৮৫ সালে কেমব্রিজ থেকে প্রকাশিত হয় ‘রোটেটিং ফিল্ডস ইন জেনারেল রিলেটিভিটি’, ১৯৯২ সালে প্রকাশিত হয় ‘ইনট্রোডাকশন টু ম্যাথেমেটিক্যাল কসমোলজি’।

তার অন্যান্য বইগুলো হলো, ‘কৃষ্ণবিবর, মাতৃভাষা ও বিজ্ঞান চর্চা এবং অন্যান্য প্রবন্ধ, শিল্প সাহিত্য ও সমাজ’। কেমব্রিজ থেকে প্রকাশিত হয় তার আরো লেখা-‘স্কাই এন্ড টেলিস্কোপ’ বইটি যা অনুদিত হয়েছে স্প্যানিশ ভাষায়, ‘দ্য ফার ফিউচার অব ইউনিভাস’র্ যা অনুদিত হয়েছে জার্মান, ডাচ এবং ইতালিয়ান ভাষায় এবং ‘ইনেট্রাডাকশন টু ম্যাথেম্যাটিক্যাল ইকোনোমিক্স এন্ড সোশাল চয়েজ’।

পুরষ্কার ও সম্মাননা :

বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমী ১৯৮৫ সালে তাকে স্বর্ণপদকে ভূষিত করে। ১৯৯৪ সালে তিনি ন্যাশনাল সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি মেডেল পান। ১৯৯৮ সালে ইতালির আবদুস সালাম সেন্টার ফর সায়েন্স এন্ড থিওরিটিক্যাল ফিজিক্সে থার্ড ওয়ার্ল্ড একাডেমি অব সায়েন্স অনুষ্ঠানে তাকে মেডাল লেকচার পদক দেয়া হয়। ২০০১ সালে তিনি একুশে পদক লাভ করেন। পদার্থবিজ্ঞানে বিশেষ অবদান রাখার জন্যে ২০১১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজ্জাক-শামসুন আজীবন সম্মাননা পদকে ভূষিত করা হয়।

কোয়ান্টাম মুক্ত আলোচনায় ড. জামাল নজরুল ইসলাম :

২০০৯ সালের ৬ মে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন চট্টগ্রাম সেন্টারে কোয়ান্টাম মুক্ত আলোচনায় অতিথি হয়ে আসেন অধ্যাপক ড. জামাল নজরুল ইসলাম। এ অনুষ্ঠানে তার দেয়া অভিজ্ঞতা প্রসূত বক্তব্য এবং মেডিটেশন সম্পর্কিত তার অভিমত আজও কোয়ান্টাম পরিবারের জন্যে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে আছে। তিনি বলেন, প্রত্যেক মানুষেরই নীরব কিছু মুহূর্ত কাটানো প্রয়োজন, তার ধর্ম বর্ণ গোত্র যা-ই হোক।

কারণ ধ্যানেই শক্তি, ধ্যানেই মুক্তি, ধ্যানেই মানুষের সকল অর্জন। তাই আমাদের মুনি-ঋষিদের ধ্যানের ঐতিহ্য ও শান্তির বাণী সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিতে হবে। বর্তমানে পৃথিবী জুড়ে এত যে অবক্ষয়, সন্ত্রাস আর দুর্নীতি-এ জন্যে শুধু যে খারাপ লোকেরা দায়ী তা নয়। এর অন্যতম কারণ আমরা ভালো মানুষেরা সঙ্ঘবদ্ধ নই। পরষ্পরকে দোষারোপ করে নয়, সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে ভালো কিছু কাজ করার মাধ্যমেই আমরা পৃথিবীকে সুন্দর করে তুলতে পারব। আর এই পারষ্পারিক সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও সেবার ক্ষেত্রে কোয়ান্টাম চমৎকার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যাচ্ছে নিরলস।

তিনি পোস্ট-ডক্টরাল ফেলো হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে (১৯৬৩-১৯৬৫) এবং ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে (১৯৬৫-১৯৬৬) গবেষণা করেছেন। তিনি কেমব্রিজ ইনস্টিটিউট অফ থিওরিটিক্যাল অ্যাস্ট্রোনমি (১৯৬৭-১৯৭১), ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (১৯৭১-১৯৭২), এবং ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিদ্যা বিভাগে (১৯৭২-১৯৭৩) সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট হিসেবে গবেষণা করেছেন। পরে তিনি লন্ডনের কিংস কলেজে ফলিত গণিতের প্রভাষক হিসেবে (১৯৭৩-১৯৭৪) যোগ দেন। এছাড়াও, তিনি ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত বিজ্ঞান গবেষণা কাউন্সিল, ইউনিভার্সিটি কলেজ, কার্ডিফে ফেলো হিসেবে কাজ করেন।

১৯৭৮ সালে ফ্যাকাল্টি হিসেবে তিনি লন্ডনের সিটি ইউনিভার্সিটিতে যোগ দেন এবং ১৯৮৪ সালে স্থায়ীভাবে চট্টগ্রামে ফিরে না আসা পর্যন্ত সেখানে কাজ করেন। এছাড়াও তিনি যুক্তরাষ্ট্রে প্রিন্সটনের ইনস্টিটিউট অফ অ্যাডভান্সড স্টাডিজে ভিজিটিং সায়েন্টিস্ট হিসেবে গবেষণা করেছেন। দেশে ফিরে আসার পর তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে যোগদান করেন এবং সেখানকার অধ্যাপক হিসেবে ১৯৮৪ সাল থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। ১৮৮৯ সালে তিনি গাণিতিক ও ভৌত বিজ্ঞানের গবেষণা কেন্দ্র (RCMPS) প্রতিষ্ঠা করেন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৬ সালে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক হন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।

পেশাগতভাবে ড. ইসলাম ছিলেন একজন তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী, এবং তাঁর গবেষণার ক্ষেত্র ছিল আপেক্ষিকতা, বিশ্বতত্ত্ব এবং কোয়ান্টাম তত্ত্ব। তিনি ৫০টিরও বেশি বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ এবং বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় বই প্রকাশ করেছেন। ১৯৮৩ সালে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত তাঁর বই ’দি আল্টিমেট ফেইট অফ দি ইউনিভাস’ বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়। এটি জাপানি, ফরাসি, পর্তুগিজ এবং যুগোস্লাভ ভাষায় অনূদিত হয়েছে। আরও বেশ কিছু বই স্প্যানিশ, জার্মান, ডাচ এবং ইতালীয় ভাষায় অনূদিত হয়েছে। অক্সফোর্ড এবং কেমব্রিজের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর বই পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত বাংলা ভাষায় তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত ’বই কৃষ্ণগহ্বর’ (ব্ল্যাক হোল)। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য বইগুলো হলো ‘মাতৃভাষা, বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং অন্যান্য প্রবন্ধ’, ও ‘শিল্প, সাহিত্য এবং সমাজ’।

স্বাধীনতা পদক পাওয়া কে এই জামাল নজরুল ইসলাম

জামাল নজরুল ইসলাম—শুধু বাংলাদেশে নয়, গোটা বিশ্বে প্রথম সারির পদার্থবিজ্ঞানীদের কথা উঠলেই উচ্চারিত হয় এই নাম। মৌলিক পদার্থবিজ্ঞানে মতো অবদান রাখা বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের মধ্যে তিনি অনন্য। তিনি বাংলাদেশের অন্যতম বিশিষ্ট বিজ্ঞানী, গণিতজ্ঞ ও শিক্ষাবিদ। সৃষ্টিতত্ত্ব, মহাবিশ্বের উৎপত্তি, কৃষ্ণবিবর (ব্ল্যাকহোল), আপেক্ষিকতা তত্ত্ব, মহাকর্ষীয় তরঙ্গ, স্ট্রিং থিওরিসহ আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের বহু গুরুত্বপূর্ণ দিক নিয়ে তিনি গবেষণা করেছেন। বৈশ্বিক বিজ্ঞানসমাজে তাঁর গবেষণার ফল গভীর প্রভাব রয়েছে। বিজ্ঞান গবেষণায় অসামান্য অবদানের জন্য ২০২৫ সালে তাঁকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার স্বাধীনতা পদক (মরণোত্তর) দেওয়া হয়েছে।

জামাল নজরুল ইসলামের শিক্ষক, বন্ধু আর সহপাঠীদের নাম শুনলে চক্ষু ছানাবড়া হয়ে যেতে পারে কারও কারও। কেমব্রিজে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন বিশ্বখ্যাত পদার্থ ও মহাকাশবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং। ফ্রিম্যান ডাইসন, পদার্থবিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান, সুব্রামানিয়াম চন্দ্রশেখর, আবদুস সালাম, অমর্ত্য সেন ও অমিয় বাগচী, জয়ন্ত নারলিকার ও জিম মার্লিস—এঁরা সবাই ছিলেন জামাল নজরুলের ঘনিষ্ঠজন ও শুভাকাঙ্ক্ষী। কেউ শিক্ষক, কেউ সহপাঠী, কেউ সহগবেষক, কেউবা বন্ধু।

বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলাম: এক প্রতিভার গল্প

ব্ল্যাকহোল ও কোয়ান্টাম মহাকর্ষের জন্য বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং আজ পরিচিত একটি নাম। তিনি আমাদের দেশের যে বিজ্ঞানীর বন্ধু ছিলেন, ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় একই রুমে থাকতেন, তিনি বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. জামাল নজরুল ইসলাম। হকিং বলেছেন, “আমরা ছিলাম পরস্পর পরস্পরের শিক্ষক।”

১৯৬০ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত হকিং যে-সব বিজ্ঞানী নিয়ে গবেষণা করেছেন, এর মধ্যে জামাল নজরুল ইসলাম ছিলেন অন্যতম। তার ‘কৃষ্ণবিবর’ বইটি স্টিফেন হকিংয়ের ‘ব্ল্যাকহোল থিওরি’র অনেক আগেই লেখা এবং তখন থেকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হচ্ছে।

 তিনি ১৯৮৩ সালে ‘দ্য আল্টিমেট ফেইট অফ দি ইউনিভার্স’ লিখেছেন। স্টিফেন হকিং ‘অ্যা ব্রিফ হিস্টরি অব টাইম’ লিখেছেন ১৯৮৮ সালে। গুরুত্বের বিবেচনায় গবেষকরা জামাল নজরুল ইসলামের বইটিকে এগিয়ে রেখেছেন। যদিও হকিং-এর বইটি বেশি প্রচার পায়।জামাল নজরুল ইসলাম পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক ড. আবদুস সালামেরও বন্ধু ছিলেন। অধ্যাপক সালাম একবার ঢাকা এসেছিলেন। তিনি বিমান থেকে নেমেই প্রথম খোঁজ করেছিলেন জামাল নজরুল ইসলামকে। আবদুস সালাম বলেছেন, “এশিয়ায় আমার পরে পদার্থবিজ্ঞানে আর কেউ যদি নোবেল পুরস্কার পায়, তবে তা পাবেন অধ্যাপক ড. জামাল নজরুল ইসলাম”।

ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকেই জামাল নজরুল ইসলাম একে একে প্রায়োগিক গণিত ও তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর এবং প্রায়োগিক গণিত ও তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে পিএইচডি ও এসসিডি (ডক্টর অফ সায়েন্স) ডিগ্রি পান। পশ্চিম পাকিস্তানে মুরি লরেন্স কলেজ পড়ার সময় জামাল নজরুল ইসলাম গণিতের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এ সময় তিনি নিজে নিজে অনেক অঙ্কের সমাধান করতেন। বিভিন্ন বই থেকে জটিল অঙ্ক সংগ্রহ করতেন, যা পরে তার অনেক কাজে আসে। তার সময়ে তিনি একাই গণিত বিষয়ে পড়েছিলেন। বিষয় হিসেবে গণিত অন্য অনেকের কাছে ‘তুলনামূলক জটিল’ হওয়াতে কেউ নিতে চাইত না।

 জামাল নজরুল ইসলাম গণিতের কঠিনসব সমস্যা সমাধানের সময়ে ক্যালকুলেটর ব্যবহার করতেন না। এ অভ্যাস তার আমৃত্যু ছিল। এমন কি তিনি কম্পিউটার, ইন্টারনেটও ব্যবহার করতে চাইতেন না। তার মতে- ক্যালকুলেটর, কম্পিউটার ও ইন্টারনেট ইত্যাদি মানুষের চিন্তার জগতকে সংকুচিত করে দেয়। কারণ এসব যে কোনো সমস্যার সহজ সমাধান করে দেয়।

অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলামের পদার্থবিজ্ঞান, গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও বিশ্বতত্ত্ব বিষয়ে পাণ্ডিত্য ছিল। তিনি আইনস্টাইনের তত্ত্ব নিয়ে কাজ করেছেন। ১৯৬৭ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব বিষয়ে শিক্ষকতা করে ৩০ বছরের পাশ্চাত্য জীবন ছেড়ে স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে চট্টগ্রাম ফিরে আসেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র দুই হাজার আটশ টাকা বেতনে গণিত বিভাগে অধ্যাপনার কাজে যোগ দেন।

মৃত্যু

২০১৩ সালের ১৬ই মার্চ শুক্রবার রাতে চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ৭৪ বছর বয়সে অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলামের মৃত্যু হয়। মারা যাওয়ার সময় তিনি স্ত্রী ও দুই মেয়ে রেখে যান। তাকে রোববার চট্টগ্রামের জমিয়াতুল ফালাহ মসজিদে জানাজার পর গরিবুল্লাহ শাহ মাজার কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।

What's Your Reaction?

Like Like 0
Dislike Dislike 0
Love Love 0
Funny Funny 0
Angry Angry 0
Sad Sad 0
Wow Wow 0