বিজ্ঞানী ড. মাকসুদুল আলমের জীবনী - Biography of Dr Maksudul Alam

বিজ্ঞানী ড. মাকসুদুল আলমের জীবনী - Biography of Dr Maksudul Alam

May 12, 2025 - 13:46
May 13, 2025 - 19:34
 0  1
বিজ্ঞানী ড. মাকসুদুল আলমের জীবনী - Biography of Dr Maksudul Alam

জীবনজয়ী জিনোম বিজ্ঞানী ড. মাকসুদুল আলম

মাকসুদুল আলম (১৪ ডিসেম্বর ১৯৫৪ - ২০ ডিসেম্বর ২০১৪) ছিলেন একজন বাংলাদেশি জিনতত্ত্ববিদ। তাঁর নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ডাটাসফটের একদল গবেষকের যৌথ প্রচেষ্টায় ২০১০ সালের মাঝামাঝি সময়ে সফলভাবে উন্মোচিত হয় পাটের জিন নকশা । ২০১০ সালের ১৬ জুন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে পাটের জিনোম অনুক্রম আবিষ্কারের ঘোষণা দেন।

শৈশব

মাকসুদুল আলম ফরিদপুরে ১৯৫৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা দলিলউদ্দিন আহমেদ ছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের (ইপিআর) একজন কর্মকর্তা এবং তাঁর মা লিরিয়ান আহমেদ একজন সমাজকর্মী ও শিক্ষিকা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পিতা শহিদ হলে পরিবারের দায়িত্ব এসে পড়ে মা লিরিয়ান আহমেদের উপর। শিক্ষকতা করে তিনি তাঁর চার ছেলে ও চার মেয়েকে গড়ে তোলেন।

মাকসুদুল আলম তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা মাহবুবুল আলম ও বন্ধু জোনায়েদ শফিককে নিয়ে গড়ে তোলেন ‘অনুসন্ধানী বিজ্ঞান ক্লাব’। ক্লাবের কাজ ছিল মূলত গাছ পর্যবেক্ষণ, গাছের চারা লাগানো এবং পাতা সংগ্রহ। গাছের পাতা। অ্যালবামে সাজিয়ে বই দেখে দেখে বের করতেন গাছগুলোর বৈজ্ঞানিক নাম।

শিক্ষাজীবন:

গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে স্বাধীনতার পর মাকসুদুল আলম চলে যান রাশিয়ায়। সেখানে মস্কোফস্কি গোসুদারস্তেভনেই উনিভারসিতিয়েৎ ইমিন্যে (মস্কো রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে অণুপ্রাণবিজ্ঞানে স্নাতক, স্নাতকোত্তর (১৯৭৯) ও পিএইচডি (১৯৮২) সম্পন্ন করেন[]। পরে জার্মানিতে বিখ্যাত মাক্স-প্লাংক ইনস্টিটুট ফুর বিয়োখেমি (মাক্স প্লাংক জৈবরসায়ন ইনস্টিটিউট) থেকে ১৯৮৭ সালে প্রাণরসায়নে আরেকটি পিএইচডি উপাধি অর্জন করেন। মস্কোতে মাকসুদ ভ্লাদিমির পেত্রোভিচ মুলাচেভের সংস্পর্শে আসেন। পেত্রোভিচের প্রাণরসায়নের নানা শাখায় অবদান রয়েছে।

কর্মজীবন:

জার্মানিতে তিনি কাজ করার সুযোগ পান প্রাণরসায়নের ডিটার উস্টাহেল্ট (Dieter Oesterhelt) ও গেরাল্ড হেইজেলবাওয়াদের (Gerald Hazelbauer) সঙ্গে। জার্মানির পর তিনি যুক্তরাষ্ট্র হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে সামুদ্রিক জীবপণ্য প্রকৌশল কেন্দ্রে (Marine Bioproduct Engineering Center) সহকারী পরিচালক হিসেবে যোগ দেন। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান গবেষণার জন্য মাকসুদ ও তাঁর সহকর্মীদের ১০ লাখ ডলার অনুদান দেয়।

১৯৯২ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসাবে যোগ দেন। ওই কেন্দ্রে কাজ করার সময় লবণ-আকর্ষী আর্কিয়ার ভৌত-তড়িৎ রূপান্তর (transduction) সংকেতকে বিশ্লেষণ করেন। ২০০০ সালে তিনি ও তাঁর সহকর্মী র‌্যান্ডি লারসেন সহ আটজন বিজ্ঞানী আর্কিয়াতে মায়োগ্লোবিনের মতো এক নতুন ধরনের আমিষ আবিষ্কার করেন। এ দুটিকে নাম দেন গ্লোবিন-যুগল সংবেদক (globin-coupled sensors) এবং প্রোটোগ্লোবিন (protoglobins)। এই প্রাচীন আমিষগুলো থেকে প্রাণের উদ্ভবকালে অক্সিজেন কেমন করে ব্যবহৃত হতো তার হদিশ পাওয়া যায়।

ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন ও হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের সামুদ্রিক জীবপণ্য প্রকৌশল কেন্দ্রের উদ্যোগে পরিচালিত অণুজীব বৈচিত্র‌্য অনুসন্ধান পর্বে হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ, লোঈহি (Lō‘ihi) নামক সমুদ্রগর্ভ আগ্নেয়গিরি এবং নিউজিল্যান্ডের জলতাপীয় এলাকা পরিবীক্ষণ করে বেশ কিছু প্রজাতির অণুজীব আবিষ্কার করেন যা ছিল তদপরিপার্শ্বিক জনবসতির বসবাসের কায়দা সম্পর্কে জানতে সহায়ক।[]

এ আবিষ্কারের সুবাদে মাকসুদের খ্যাতি ও দক্ষতা সবার নজরে আসে। ২০০১ সাল থেকে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসাবে কাজ করে যান।

২০০৩ সালে তিনি হাওয়াই বিশ্বদ্যিালয়ে বংশাণুসমগ্র বিজ্ঞান, প্রোটিনসমগ্র বিজ্ঞান ও জৈব তথ্যবিজ্ঞানে অগ্রসর গবেষণা কেন্দ্র (Advanced Studies in Genomics, Proteomics and Bioinformatics (ASGPB)) প্রতিষ্ঠা করেন। যার ফলশ্রতিতে হাওয়াইয়ান পেঁপের ‍জিনোম অনুক্রম বের করা হয়। এ কাজ সম্পন্ন করার পর বিজ্ঞান সাময়িকী নেচারের প্রচ্ছদে স্থান পান তিনি। বংশাণুগতভাবে পরিবর্তিত এই পেঁপের জিন নকশা উন্মোচনের পর তিনি পাটের জিন নকশা উন্মোচনের কথা ভেবেছিলেন। সে সময় কয়েকবার বাংলাদেশেও এসেছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁর ডাক পড়ে মালয়েশিয়ায় রাবার গাছের জিন নকশা উন্মোচনের জন্য, ওই কাজেও তিনি সফল হন।

২০১২ সালে পাটের জন্য ক্ষতিকর ছত্রাকমাক্রোফোমিনা ফেইজেওলিনার জিনোম অনুক্রম উদ্ঘাটনে বাংলাদেশের একটি গবেষণা দলের নেতৃত্ব দেন।

একজন মাকসুদুল আলম ও একটি গর্ব!

ই জিনোম রহস্য উন্মোচন বা জিনোম সিকুয়েন্সিং সম্বন্ধে অনেকেরই হয়তো ধারণা আছে। একটু সহজ করে বলার চেষ্টা করি। যে কোন জীবের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সকল কার্যক্রমই নিয়ন্ত্রিত হয় তার জিনোম বা কিছু ক্রোমোজোম বা অনেক অনেক অনেক জিনের দ্বারা। জিনগুলি তৈরি DNA দ্বারা, আর DNA তৈরি নিউক্লিওটাইড দ্বারা। এই নিউক্লিওটাইডের বেস আবার চার ধরনের। এডেনিন (A), গুয়ানিন (G), সাইটোসিন (C) ও থাইমিন (T)। আসলে জীবের ক্রোমোজোমে এই চারটি বেসই ঘুরে ফিরে নানা কম্বিনেশনে আছে, এবং এদের কম্বিনেশন ও বিন্যাসের উপরেই নির্ভর করছে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ।

তাই কোনো জীবের এই জিনোম ডিকোড বা ATGC এর পারস্পরিক বিন্যাসটা আবিষ্কার করা মানেই সেই জীবের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণকারী জিনগুলির অবস্থান ও ফাংশন সম্বন্ধে বিস্তারিত ধারণা পাওয়া। যেমন মানুষের জিনোম ডিকোডিং করে ইতিমধ্যে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণকারী বিভিন্ন জিনের অবস্থান জানা গেছে, এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানেও তার ব্যবহার শুরু হয়ে গেছে। সুতরাং পাটের জিনোম ডিকোডিং বা জিন সিকুয়েন্সিং হওয়া মানে আমরা এখন পাট সম্বন্ধে অনেক কিছু জানি বা এর বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণকারী জিনগুলোর সম্বন্ধেও জানি। এটা অবশ্যই একটা বড়সড় অর্জন।

 অর্থাৎ, সিকুয়েন্সিং করা হয়েছে মানে পাটের জিনগুলির বিন্যাস ও অবস্থানের ব্যাপারে জানা গেছে। এদের কার্যকলাপ বা দায়িত্ব-কর্তব্য জানা গেছে। যারা এই বিষয়ে পড়াশোনা করছেন, তারা বেশ ভালভাবে বুঝবেন এই কাজের গুরুত্ব কতটুকু। আধুনিক বিজ্ঞান আমাদের জৈবিক কার্যক্রমের অন্তর্নিহিত নিয়ন্ত্রকগুলি বের করার সুযোগ দিয়েছে, কিন্তু সেই নিয়ন্ত্রকগুলি বের করা এখনো শেষ হয়নি, সেটাও করতে আরো অনেক সময় লাগবে। ডঃ মাকসুদুল আলম তিনটা উদ্ভিদের জিন সিকুয়েন্সিং করেছেন।

ছোটবেলা থেকেই মাকসুদুল আলম ছিলেন বিজ্ঞানপ্রেমী

ড. মাকসুদুল আলম ১৯৫৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। পাট চাষের জন্য অনুকূল এই জায়গায় জন্মালেও তিনি বেড়ে ওঠেন পিলখানায়। তার বাবা দলিল উদ্দীন আহমেদ তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের একজন সরকারী কর্মকর্তা ছিলেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তিনি শহীদ হন। মাকসুদুল আলমের মা লিরিয়ান আহমেদ ছিলেন একজন শিক্ষিকা ও সমাজসেবিকা।

ছোটবেলা থেকেই মাকসুদুল আলম ছিলেন অনেক বিজ্ঞান মনস্ক। তিনি ছোট ভাই মাহবুবুল আলম ও বন্ধু জোনায়েদ শফিককে নিয়ে গড়ে তোলেন ‘অনুসন্ধানী বিজ্ঞান ক্লাব’। ক্লাবের প্রধান কার্যালয় ছিল নিজের বাসার ছাদ। এখানে তাদের প্রধান কাজ ছিল গাছ সংগ্রহ, এগুলো যাচাই-বাছাই ও পাতা সংগ্রহ করা। তিনি গাছের পাতাগুলো অ্যালবাম আকারে সংগ্রহ করতেন এবং বই পড়ে এগুলোর বৈজ্ঞানিক নাম  বের করতেন। আর এভাবেই যাত্রা শুরু হয় বাংলাদেশের সফল একজন জীববিজ্ঞানীর।

ড. মাকসুদুল আলম ঢাকায় গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুলে মাধ্যমিক এবং ঢাকা কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা লাভ করেন। ছোটবেলা থেকেই উদ্ভিদ নিয়ে গবেষণার প্রবল ইচ্ছা তাকে তাড়া করে বেড়াত। এই গবেষণার তৃষ্ণা মেটানোর জন্য তিনি পাড়ি জমান সুদুর রাশিয়ায়। রাশিয়ার মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে তিনি অণুজীববিজ্ঞানে মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন। এরপর ১৯৮২ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি পিএইচডি শেষ করেন। এছাড়াও ১৯৮৭ সালে তিনি জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাংক ইন্সটিটিউট থেকে নিজের দ্বিতীয় পিএইচডি অর্জন করেন প্রাণরসায়ন বিষয়ে।

মৃত্যু:

যকৃতের জটিলতায় ভুগতে থাকা মহৎ এই বিজ্ঞানী ২০১৪ সালের ২০ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াইয়ে কুইন্স মেডিকেল সেন্টারে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

What's Your Reaction?

Like Like 0
Dislike Dislike 0
Love Love 0
Funny Funny 0
Angry Angry 0
Sad Sad 0
Wow Wow 0