হেগেল এর জীবনী | Biography of Hegel
হেগেল এর জীবনী | Biography of Hegel

হেগেল : জীবন ও দর্শন
জর্জ উইলহেলম ফ্রিডরিখ হেগেল
(জন্ম: ২৭ আগস্ট, ১৭৭০, স্টুটগার্ট , ওয়ার্টেমবার্গ [জার্মানি]—মৃত্যু: ১৪ নভেম্বর, ১৮৩১, বার্লিন) ছিলেন একজন জার্মান দার্শনিক যিনি একটি দ্বান্দ্বিক পরিকল্পনা তৈরি করেছিলেন যা ইতিহাস এবং ধারণার অগ্রগতির উপর জোর দিয়েছিল থিসিস থেকে অ্যান্টিথিসিস এবং তারপর সংশ্লেষণে। হেগেল ছিলেন আধুনিক সময়ের মহান দার্শনিক ব্যবস্থার নির্মাতাদের মধ্যে শেষ। তাঁর কাজ, ইমানুয়েল কান্ট , জোহান গটলিব ফিচটে এবংফ্রেডরিখ শেলিং , এইভাবে ধ্রুপদী জার্মান দর্শনের শীর্ষস্থান চিহ্নিত করেন ।
খ্রিস্টীয় অন্তর্দৃষ্টি দ্বারা অনুপ্রাণিত এবং সুনির্দিষ্ট জ্ঞানের এক অসাধারণ ভাণ্ডারের উপর তার দক্ষতার উপর ভিত্তি করে, পরম আদর্শবাদী হেগেল সবকিছুর জন্য একটি স্থান খুঁজে পেয়েছিলেন - যৌক্তিক, প্রাকৃতিক, মানবিক এবং ঐশ্বরিক - একটি দ্বান্দ্বিক পরিকল্পনায় যা বারবার থিসিস থেকে অ্যান্টিথিসিসে এবং আবার একটি উচ্চতর এবং সমৃদ্ধ সংশ্লেষণের দিকে ফিরে আসে।
তার প্রভাব তার প্রতিক্রিয়াগুলিতে যতটা উর্বর ছিল - ডেনিশ অস্তিত্ববাদী সোরেন কিয়েরকেগার্ডে ; মার্কসবাদীদের মধ্যে , যারা সামাজিক কর্মের দিকে ঝুঁকেছিলেন; যৌক্তিক ইতিবাচকবাদীদের মধ্যে ; এবং ব্রিটিশ বিশ্লেষণাত্মক দর্শনের অগ্রণী ব্যক্তিত্ব জিই মুর এবং বার্ট্রান্ড রাসেলের মধ্যে - তার ইতিবাচক প্রভাবের ক্ষেত্রেও ততটাই উর্বর ছিল।
দার্শনিক ফ্রেডরিখ হেগেলের জন্ম
গেয়র্গ ভিলহেল্ম ফ্রেডরিখ হেগেল (১৭৭০-১৮৩১) প্রখ্যাত জার্মান দার্শনিক এবং জার্মান ভাববাদের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তার ঐতিহাসিক ও ভাববাদী অবস্থান ইউরোপীয় দর্শনকে বিপ্লবী করে তোলে। এ ছাড়া মহাদেশীয় দর্শন ও মার্কসবাদের গুরুত্বপূর্ণ অগ্রদূত হিসেবে বিবেচিত হয়। বিশ্বখ্যাত এই দার্শনিক জার্মানির স্টুটগার্টে ১৭৭০ সালের ২৭ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। জগৎ বা সত্যের ক্ষেত্রে জ্ঞেয় ও অজ্ঞেয়র দ্বৈত রূপ হেগেল অস্বীকার করলেও হেগেলের নিকট মূল হচ্ছে ভাব; বস্তু নয়। যা কিছু জ্ঞেয় বা দৃশ্যমান, সবই হচ্ছে ভাবের প্রকাশ ও বিকাশ।
এ ছাড়া ভাবের চরম বিকাশ জার্মান রাষ্ট্রযন্ত্রে ঘটেছে বলে হেগেলের রাজনৈতিক ব্যাখ্যা পরবর্তীকালে স্বৈরতান্ত্রিক ও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রযন্ত্রের আদর্শগত হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হতে পেরেছে। বস্তুত হেগেল দর্শন থেকে উত্তরকালে দুটি পরস্পরবিরোধী ধারার বিকাশ ঘটেছে; এর একটি হচ্ছে মার্কসবাদ বা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ, আর অন্যটি হচ্ছে নবভাববাদ ও স্বৈরতান্ত্রিক রাজনৈতিক মতবাদ। ১৮৩১ সালের ১৪ নভেম্বর প্রয়াত হন এই দার্শনিক।
১৭৭০ সালের ২৭ আগস্ট দক্ষিণ পশ্চিম জার্মানির স্টুটগার্টে হেগেলের জন্ম হয়। তাঁর পুরো নাম জর্জ ভিলহেলম ফ্রেডরিক হেগেল। তাঁর বাবা জর্জ লুডউইগ উর্তেমবার্গের ডিউক কার্ল ইউগেনের রাজস্ব দপ্তরের সম্পাদক ছিলেন এবং তাঁর মায়ের নাম ছিল মেরিয়া ম্যাগডেলেনা লুসিয়া। উর্তেমবার্গ আদালতের এক উকিলের কন্যা ছিলেন তাঁর মা। হেগেলের মাত্র তেরো বছর বয়সেই জণ্ডিসে আক্রান্ত হয়ে তাঁর মা মারা যান। পরে হেগেল এবং তাঁর বাবাও এই রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন, কিন্তু ভাগ্যক্রমে তাঁরা বেঁচে যান। হেগেলের এক বোন ও এক ভাই ছিল যাদের নাম যথাক্রমে ক্রিস্টেন লুইস ও জর্জ লুডউইগ। শৈশব থেকেই অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন হেগেল।
মাত্র তিন বছর বয়সে জার্মান স্কুলে ভর্তি হন হেগেল। দুই বছর পরে তিনি যখন লাতিন স্কুলে ভর্তি হন, ততদিনে মায়ের কাছে প্রথম বর্ণমালাগুলি শিখে নিয়েছিলেন তিনি। ১৭৭৬ সালে স্টুটগার্টের জিমন্যাসিয়াম ইলাস্ট্রে-তে ভর্তি হন। এখানে প্রচুর পড়াশোনা করতে থাকেন তিনি। এই সময়কার দীর্ঘ পঠন-পাঠনের অ
ভিজ্ঞতা তিনি তাঁর দিনলিপিতে লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন। সেই সময়কার জার্মান নবজাগরণের কবি ফ্রেদরিক ক্লপস্টক, সাহিত্যিক ক্রিস্টিয়ান গার্ভ ও গ্রথহোল্ড লেসিং-এর লেখাপত্র পড়তে থাকেন হেগেল। এই জিমন্যাসিয়ামে স্নাতক উত্তীর্ণ হন হেগেল এবং বিশেষ বৃত্তি নিয়ে তুরস্কে পড়তে যান তিনি। ১৮ বছর বয়সে তুবিনজেন বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন তুবিনজের স্টিফট নামে একটি প্রোটেস্ট্যান্ট সেমিনারিতে ভর্তি হন তিনি। এখানেই পরবর্তীকালের দার্শনিক ফ্রেডরিক হোল্ডারলিন এবং ফ্রেডরিক শেলিং-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে তাঁর। সেমিনারির প্রবল নিয়মতান্ত্রিক পরিবেশের মধ্যে এই তিনজনের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে এবং ক্রমেই হেগেল জাঁ জাঁক রুশোর চিন্তা-চেতনার দ্বারা প্রভাবিত হতে থাকে। তাঁর বন্ধু হোল্ডারলিন ও শেলিং উভয়েই কান্টের দর্শনতত্ত্ব বিষয়ে বিতর্ক করলেও হেগেল এই বিষয়ে নীরব ছিলেন।
তাঁর প্রধান লক্ষ্যই ছিল দার্শনিক চিন্তা-চেতনার বিমূর্ত ধারণাগুলি সাধারণের উদ্দেশ্যে সহজ ও সরল করে তোলা। কিন্তু সেই সময় ১৭৯৩ সালের সন্ত্রাসের রাজত্বের সহিংস রূপ হেগেলকে প্রভাবিত করে এবং এই সময়েই তিনি গিরেণ্ডিন গোষ্ঠীর সঙ্গে পরিচিত হন। তুবিনজেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনশাস্ত্রে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করার পর ১৭৯৩ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করে শিক্ষা সমাপ্ত হয় তাঁর। এই প্রোটেস্ট্যান্ট সেমিনারি থেকে হেগেল একটি ধর্মতত্ত্বের সার্টিফিকেট পেয়েছিলেন। এরপরে তিনি বার্ন শহরের একটি অভিজাত পরিবারে গৃহশিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন। এই সময় যিশুর জীবন বিষয়ে একটি নাতিদীর্ঘ রচনা প্রকাশ করেন হেগেল এবং ‘খ্রিস্টধর্মের ইতিবাচকতা’ শিরোনামে একটি পাণ্ডুলিপিও তৈরি করেন তিনি।
ফ্রাঙ্কফোর্টে থাকার সময় হেগেল অনেকগুলি প্রবন্ধ লেখেন যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ‘ধর্ম ও প্রেম সংক্রান্ত অংশ’, ‘খ্রিস্টান ধর্মের আত্মা ও তার ভাগ্য’ ইত্যাদি। ১৭৯৭ সালে তিনি লেখেন ‘জার্মান আদর্শবাদের প্রাচীনতম পদ্ধতিগত প্রক্রিয়া’, কিন্তু এই বইটি তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশ পায়নি। ১৭৯৯ সালে তাঁর বাবার মৃত্যুর পরে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে জার্মানির জেনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন হেগেল এবং এখান থেকেই তাঁর পাণ্ডিত্যের সংবাদ ক্রমেই ছড়িয়ে পড়তে থাকে। সেই সময় জেনা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমালোচনামূলক দর্শনের অধ্যাপক হিসেবে কে. এল. রেইনহোল্ডের খুব নামডাক ছিল। হেগেলও তাঁর ক্লাস করেছেন এবং তাঁর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তিনি লেখেন ‘দ্য ডিফারেন্স বিটুইন ফিস্তে অ্যাণ্ড শেলিংস সিস্টেম অফ ফিলোজফি’। ১৮০১ সালে হেগেলের এই বই প্রকাশ পায় এবং এর পরের দুই বছর ১৮০২-০৩ সাল নাগাদ শেলিং-এর সঙ্গে যৌথভাবে হেগেল সম্পাদনা করেন তাঁর বিখ্যাত বই ‘ক্রিটিক্যাল জার্নাল অফ ফিলোজফি।
চার বছর জেনা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিষয়ের প্রভাষক রূপে নিযুক্ত ছিলেন হেগেল এবং এরপরে ১৮০৫ সালে তিনি দর্শনের অধ্যাপক পদে উন্নীত হন। এই সময়পর্বেই নেপোলিয়নের নেতৃত্বে ফরাসিরা জার্মানি আক্রমণ করে বসে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায় অনির্দিষ্টকালের জন্য। কর্মহীন হয়ে পড়েন হেগেল। এই সময়পর্বেই ১৮০৬ সালের শেষ দিকে হেগেল তাঁর বিখ্যাত কাজ ‘দ্য ফেনোমেনোলজি অফ স্পিরিট’ প্রকাশ করেন। শেলিং ১৮০৩ সালে জেনা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু হেগেলের এই বই প্রকাশের পর বইয়ের ভূমিকা পড়ে তাঁর মনে হয় যে হেগেল তাঁর সম্পর্কে নিন্দনীয় মন্তব্য করেছেন, ফলে অচিরেই তাঁদের বন্ধুত্ব শেষ হয়।
জেনা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ না থাকার সময় বামবুর্গের একটি পত্রিকার সম্পাদকের পদে বেশ কিছুদিন কাজ করেন হেগেল এবং পরে ন্যুরেমবার্গের একটি জিমন্যাসিয়ামে প্রধান শিক্ষকের পদে আসীন হন। ১৮০৮ থেকে ১৮১৫ সাল পর্যন্ত তিনি এই জিমন্যাসিয়ামেই কর্মরত ছিলেন। ১৮১৬ সালে তাঁর লেখা আরেকটি বিখ্যাত বই প্রকাশ পায় ‘দ্য সায়েন্স অফ লজিক’ নামে। তাঁর এই শেষ দুটি বইয়ের জনপ্রিয়তার কারণে হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করার আমন্ত্রণ পান হেগেল। ১৮১৬ সালের শেষ দিকে তিনি হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন এবং ঠিক এর পরের বছর তিনি লেখেন ‘এনসাইক্লোপিডিয়া অফ ফিলোজফিকাল সায়েন্স ইন আউটলাইন’ বইটি। ১৮১৮ সালের মাঝামাঝি নাগাদ হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্বগ্রহণ করেন হেগেল।
১৮২১ সালে বার্লিনে থাকার সময় হাইডেলবার্গে দেওয়া বক্তৃতার ভিত্তিতে হেগেল দুটি বই লেখার পরিকল্পনা করেন যার বিষয় ছিল রাজনৈতিক দর্শন এবং অধিকারের দর্শনের সমস্ত উপাদান। ১৮২১ সালে হেগেল লেখেন ‘ফিলোজফি অফ হিস্ট্রি’ বইটি। কিন্তু এই বইগুলি তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশ পায়নি, বরং তাঁর মৃত্যুর ছয় বছর পরে ১৮৩৭ সালে প্রকাশ পেয়েছিল। ১৮৩১ সালে তাঁর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত বার্লিনে একজন জনপ্রিয় অধ্যাপক হিসেবে।
মৃত্যু:
১৮৩১ সালের ১৪ নভেম্বর জার্মানির বার্লিনে ৬১ বছর বয়সে হেগেলের মৃত্যু হয়
What's Your Reaction?






