রবার্ট বয়েল এর জীবনী | biography of Robert Boyle

রবার্ট বয়েল এর জীবনী | biography of Robert Boyle

May 15, 2025 - 19:47
May 20, 2025 - 23:58
 0  1
রবার্ট বয়েল এর জীবনী | biography of Robert Boyle

আলকেমির কুসংস্কার থেকে রসায়নকে মুক্ত করেছিলেন যে বিজ্ঞানী

রবার্ট বয়েল:

 এফআরএস (২৫ জানুয়ারি ১৬২৭ – ৩১ ডিসেম্বর ১৬৯১) ছিলেন একজন অ্যাংলো-আইরিশ প্রাকৃতিক দার্শনিক, রসায়নবিদ, পদার্থবিজ্ঞানী, আলকেমিবিদ এবং উদ্ভাবক। বয়েলকে প্রথম আধুনিক রসায়নবিদ হিসেবে গণ্য করা হয়। তিনি হলেন আধুনিক রসায়নের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং আধুনিক পরীক্ষামূলক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির অন্যতম প্রবর্তক। বয়েলের সূত্রের জন্য তিনি সবচেয়ে বেশি পরিচিত। বয়েলের প্রদত্ত সূত্রটি হলো, স্থির তাপমাত্রায় নির্দিষ্ট ভরের কোনো গ্যাসের আয়তন ঐ গ্যাসের উপর প্রযুক্ত চাপের ব্যস্তানুপাতিক। তার রচনাগুলির মধ্যে দ্য স্কেপটিকাল কাইমিস্ট গ্রন্থটিকে রসায়নের ক্ষেত্রে একটি আদি গ্রন্থ হিসাবে দেখা হয়। তিনি একজন ধর্মপ্রাণ অ্যাংলিকানবাদি ছিলেন। ধর্মতত্ত্বেও তিনি তার কাজের জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন।

জীবনী

প্রারম্ভিক জীবন

রবার্ট বয়েল আয়ারল্যান্ডের কাউন্টি ওয়াটারফোর্ডের লিসমোর ক্যাসেলে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি প্রথম আর্ল অফ কর্ক ('দ্য গ্রেট আর্ল অফ কর্ক') এবং ক্যাথরিন ফেন্টনের সপ্তম পুত্র এবং চতুর্দশ সন্তান। আর্ল অফ কর্ক হলো আয়ারল্যান্ডের একটি শিরোনাম।রবার্টের বাবা লর্ড কর্ক তখন কেবল রিচার্ড বয়েল নামে পরিচিত ছিলেন। রিচার্ড বয়েল ১৫৮৮ সালে ইংল্যান্ড থেকে ডাবলিনে চলে আসেন। সেখানে ডেপুটি এস্কেটর হিসাবে একটি চাকরি পান। রবার্টের জন্মের সময় তিনি প্রচুর ধন সম্পদ এবং জমিজমার মালিক হন। ১৬২০ সালের অক্টোবরে রিচার্ড আর্ল অফ কর্ক হন। রিচার্ডের স্ত্রী ক্যাথরিন ফেন্টন ছিলেন আয়ারল্যান্ডের প্রাক্তন সেক্রেটারি অফ স্টেট এবং লেখক স্যার জিওফ্রে ফেন্টন (১৫৩৯ - ১৬০৮)-এর কন্যা। 

অন্য বড় ভাইদের মতো শৈশবে একজন ধাত্রী মায়ের কাছে বয়েলের বেড়ে ওঠা। বয়েলের বয়স যখন আট বছর সেইসময় তিনি গৃহশিক্ষকের কাছে ল্যাটিন, গ্রীক এবং ফরাসি ভাষা শিক্ষার সুযোগ পান। তার মায়ের মৃত্যুর পর তাকে এবং তার ভাই ফ্রান্সিসকে ইংল্যান্ডের ইটন কলেজে পাঠানো হয়। সেখানে তার বাবার বন্ধু স্যার হেনরি ওয়াটন তখন কলেজের প্রভোস্ট ছিলেন।

এই সময়ে ইটনে তার বাবা ছেলেদের ব্যক্তিগত গৃহশিক্ষক হিসাবে রবার্ট কেয়ারু নামে একজন গৃহশিক্ষককে নিয়োগ করেন। এই গৃহশিক্ষকের আইরিশ ভাষা সম্পর্কে জ্ঞান ছিল। যদিও শুধু মাত্র রবার্ট বয়েলই আইরিশ ভাষা শিখতে চান। অন্যরা ফরাসি এবং ল্যাটিন শিখতে চেয়েছিলেন। ইটনে তিন বছরেরও বেশি সময় কাটানোর পর, রবার্ট বয়েল একজন ফরাসি গৃহশিক্ষকের সাথে বিদেশ ভ্রমণ করেন। ১৬৪১ সালে তারা ইতালিও ভ্রমণ করেন এবং সেই বছরের শীতকালে ফ্লোরেন্সে যান।

কর্মজীবন

৬৪৪ সালের মাঝামাঝি রবার্ট বয়েল বৈজ্ঞানিক গবেষণায় গভীর আগ্রহ নিয়ে মহাদেশীয় ইউরোপ থেকে ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন। তার বাবা লর্ড কর্ক আগের বছর অর্থাৎ ১৬৪৩ সালে মারা যান। মারা যাবার আগে লর্ড কর্ক রবার্টকে ডরসেটের স্টালব্রিজের জমির পাশাপাশি আয়ারল্যান্ডের কাউন্টি লিমেরিকে উল্লেখযোগ্য সম্পত্তি দিয়ে গিয়েছিলেন। রবার্ট সেগুলি অধিগ্রহণ করেন। ১৬৪৪ থেকে ১৬৫২ সালের মধ্যে স্টলব্রিজ হাউসে রবার্ট তার বাসস্থান তৈরি করেন এবং সেখানে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য একটি পরীক্ষাগারও স্থাপন করা হয়। সেই সময় থেকে রবার্ট তার জীবনকে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় উৎসর্গ করেন। এই স্থানটি শীঘ্রই অনুসন্ধানকারীদের কাছে "অদৃশ্য কলেজ" নামে বিশিষ্ট স্থান হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। যারা "নতুন দর্শন" এর শিক্ষায় আত্মনিয়োগ করেন, তারা প্রায়শই লন্ডনে মিলিত হতেন। প্রায়শই গ্রেশাম কলেজে এবং কিছু সদস্য অক্সফোর্ডেও মিটিং করতেন। ১৬৪৭ সালের শুরুতে আইরিশ এস্টেটে বেশ কয়েক বার পরিদর্শন করার পর ১৬৫২ সালে রবার্ট আয়ারল্যান্ডে চলে আসেন। যদিও রাসায়ন গবেষণার কাজে তেমন অগ্রগতি করতে না পারায় তিনি হতাশ হয়ে পড়েন। একটি চিঠিতে তিনি আয়ারল্যান্ডকে বর্ণনা করেন একটি বর্বর দেশ হিসাবে যেখানে রাসায়নিক আত্মাগুলিকে ভুল বোঝানো হয়েছে এবং রাসায়নিক যন্ত্রগুলিও ঠিক ছিল না বলে

১৬৫৪ সালে বয়েল তার কাজ আরও সফলভাবে চালিয়ে যাওয়ার জন্য আয়ারল্যান্ড থেকে অক্সফোর্ডে চলে আসেন। ১৬৫৭ সালে অটো ভন গুয়েরিকের এয়ার পাম্প পড়ে তিনি রবার্ট হুকের সহায়তায় এই যন্ত্রটির উন্নতির জন্য নিজেকে নিয়োজিত করেন। গুয়েরিকের এয়ার পাম্পটি বড় ছিল। তাই এই পাম্পটি চালাতে দুইজন শক্তিশালী লোকের অবিরাম শ্রমের প্রয়োজন হতো। বয়েল এই পাম্পের একটি সহজ সংস্করণ তৈরি করেছিলেন। যেটি সুবিধাজনকভাবে চালানো যেতো। ১৬৫৯ সালের শেষে বাতাসের বৈশিষ্ট্যগুলির উপর তিনি অনেকগুলি পরীক্ষা করেন। এই সময় তিনি ফ্যাটিশিয়াস এয়ার শব্দটি চালু করেন। যার মানে কৃত্রিম বায়ু বা মানুষের তৈরি বায়ু।

রবার্ট বয়েলের বায়ু পাম্প সংক্রান্ত কাজের একটি বিবরণ ১৬৬০ সালে নিউ এক্সপেরিমেন্টস ফিজিকো-মেকানিক্যাল, টাচিং দ্য স্প্রিং অফ দ্য এয়ার অ্যাণ্ড ইটস্ ইফেক্টস এই শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছিল।

এই বই সম্পর্কে যারা মতামত বা সমালোচনা করেছিলেন তাদের মধ্যে ফ্রান্সিস লাইন (১৫৯৫-১৬৭৫) নামে একজন জেসুইট ছিলেন। তার সমালোচনার উত্তর দেওয়ার সময় বয়েল গ্যাসের আয়তনের সঙ্গে চাপের সম্পর্কটি উল্লেখ করে বলেছিলেন যে, গ্যাসের আয়তন ঐ গ্যাসের উপর প্রযুক্ত চাপের ব্যস্তানুপাতিকভাবে পরিবর্তিত হয়। ইংরেজিভাষী লোকেদের মধ্যে রবার্ট বয়েলের নাম অনুসারে এটি বয়েলের সূত্র হিসাবে পরিচিতি লাভ করে।[১১] যদিও ১৬৬১ সালে যে ব্যক্তি প্রাথমিকভাবে গ্যাসের আয়তন ও গ্যাসের উপর প্রযুক্ত চাপের এই বৈজ্ঞানিক অনুকল্পটি তুলে ধরেছিলেন তার নাম ছিলো হেনরি পাওয়ার। ১৬৬২ সালে বয়েল তার একটি গবেষণা পত্রে হেনরি পাওয়ারের লেখা তথ্যসূত্র হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করেন কিন্তু ভুলবশত এতে রিচার্ড টাউনলির নাম এসে পড়ে। মহাদেশীয় ইউরোপে এই অনুকল্পটির সঙ্গে কখনও কখনও এডমে মারিওটের নামও উল্লেখ করা হয় যদিও তিনি এটি ১৬৭৬ সাল পর্যন্ত প্রকাশ করেননি। সম্ভবত সেই সময়ে বয়েলের গবেষণা সম্পর্কে তিনি অবগত ছিলেন।

১৬৬৩ সালে রবার্ট বয়েলের সৃষ্ট অদৃশ্য কলেজটি দ্য রয়েল সোসাইটি অব লন্ডন ফর ইম্প্রুভিং ন্যাচারাল নলেজ হয়ে ওঠে। আগে রয়েল সোসাইটির নাম এটাই ছিল। ওই সময় ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় চার্লসের অনুমোদনের পর রবার্ট বয়েলকে এই সোসাইটির কাউন্সিলের সদস্য হিসাবে মনোনীত করা হয়। ১৬৮০ সালে তিনি সোসাইটির সভাপতি নির্বাচিত হন। কিন্তু শপথ সম্পর্কে একটি বিভ্রান্তির কারণে সেই সম্মান প্রত্যাখ্যান করেন।

রবার্ট বয়েল ২৪টি সম্ভাব্য উদ্ভাবনের একটি "ইচ্ছা তালিকা" তৈরি করেছিলেন যার মধ্যে রয়েছে জীবনের দীর্ঘায়ণ, উড্ডয়নের শিল্প, স্থায়ী আলো, হালকা ও অত্যন্ত কঠিন বর্ম তৈরি, সব রকম বাতাসের গতিবেগ মোকাবিলা করর মতো একটি জাহাজ যেটি সহজে ডুবে যাবে না, দ্রাঘিমাংশ খোঁজার ব্যবহারযোগ্য এবং নির্দিষ্ট উপায়, কল্পনা-জাগ্রত বা স্মৃতিশক্তি পরিবর্তন বা উন্নীত করার এবং ব্যথা প্রশমিত করার শক্তিশালী ওষুধ প্রভৃতি। এই ২৪টি সম্ভাব্য উদ্ভাবনের মধ্যে মাত্র কয়েকটিই পরবর্তীকালে সত্য হয়েছে।

১৬৬৮ সালে তিনি অক্সফোর্ড থেকে লন্ডনে চলে আসেন। সেখানে পল মলে তিনি তার বড় বোন ক্যাথরিন জোন্স (লেডি রানেলাঘ)-এর বাড়িতে থাকতেন। ওই বাড়িতে ক্যাথরিন জোন্সের একটি পরীক্ষাগার ছিল। রবার্ট সেই পরীক্ষাগারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন এবং বিজ্ঞানে আগ্রহী বুদ্ধিজীবীরা যারা ওই বাড়িতে আসতেন তাদের সঙ্গে আলোচনায় যোগ দিতেন। ভাইবোনরা "একটি আজীবন বৌদ্ধিক অংশীদারিত্ব বজায় রেখেছিল"। তারা একে অপরের বৈজ্ঞানিক ধারণাগুলিকে প্রচার করতেন এবং একে অপরের পাণ্ডুলিপি সম্পাদনার কাজও করতেন। রবার্ট বয়েলের সমসাময়িক বিজ্ঞানীরা বয়েলেরে কাজের উপর ক্যাথরিনের প্রভাবকে ব্যাপকভাবে স্বীকার করেছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় পরবর্তীকালে ইতিহাসবিদরা ক্যাথরিনের প্রভাব এবং তার ভাইয়ের সাথে সম্পর্কের আলোচনা প্রসঙ্গ তাদের ইতিহাস থেকে বাদ দেন।

বৈজ্ঞানিক অন্বেষী

বৈজ্ঞানিক অন্বেষী হিসেবে বয়েলের সবচেয়ে বড় পরিচয় হলো যে , তিনি সেইসব নীতিগুলি পালন করেন যেগুলি ফ্রান্সিস বেকন তার নোভাম অর্গানাম বইয়ে সমর্থন করেছিলেন। তবুও বয়েল বেকনের অনুসারী বা অন্য কোন শিক্ষকের অনুসারী বলে নিজেকে স্বীকার করেন নি।

বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে, তিনি উল্লেখ করেছেন যে দর্শনের যে কোনো আধুনিক তত্ত্বের বিচার করতে পরীক্ষার ব্যবস্থা করা উচিত। তিনি পারমাণু, কার্টেসিয়ান সিস্টেম বা নোভাম অর্গানাম সম্পর্কে অধ্যয়ন থেকে বিরত ছিলেন। যদিও তিনি কিছু বিবরণ সম্পর্কে ক্ষণস্থায়ীভাবে পরামর্শ করার কথা স্বীকার করেছেন। জ্ঞান অর্জনই ছিল তার মূল লক্ষ্য তাই তিনি বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের লক্ষ্যে একটি বিস্তৃত দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করেছিলেন। তবে এর মানে এই নয় যে তিনি বিজ্ঞানের ব্যবহারিক প্রয়োগের প্রতি কোন মনোযোগ দেননি

রবার্ট বয়েল একজন আলকেমিস্ট ছিলেন। তিনি মনে করতেন ধাতুকে রূপান্তর করা সম্ভব। এটি একটি সম্ভাবনাময় বিষয় বলে তিনি বিশ্বাস করতেন এবং তা অর্জনের আশায় তিনি অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন। তিনি পদার্থবিজ্ঞানে যে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পন্ন করেছিলেন তার মধ্যে রয়েছে বয়েলের সূত্র, বায়ুতে শব্দের বিস্তার, বরফ গলা জলের প্রসারণ শক্তি, মাধ্যাকর্ষণ বিষয় এবং প্রতিসরণ শক্তি নিয়ে। স্ফটিক, বিদ্যুুৎ, রঙ, উদস্থিতিবিজ্ঞান ইত্যাদি অধ্যয়ন ও গবেষণার বিষয়ও তিনি যথেষ্ট উৎসাহী ছিলেন। এই সব অদ্ভূত বিষয় নিয়ে তার প্রথম বইটি ছিল দ্য স্কেপটিকাল কাইমিস্ট । বইটি ১৬৬১ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন, রসায়ন হলো পদার্থের গঠনের বিজ্ঞান, কেবল আলকেমিস্ট বা চিকিৎসকের শিল্পের সংযোজন নয়।

রাসায়নিক মৌল সম্পর্কে তিনি মনে করতেন সেগুলি বস্তুগত দেহের অপরিবর্তনীয় উপাদান। তিনি মিশ্র পদার্থ এবং যৌগের মধ্যে পার্থক্যের কথা তুলে ধরেন। উপাদান সনাক্তকরণের কৌশল নির্ণয়ে তার অবদান রয়েছে। উপাদান সনাক্তকরণের কৌশলে তিনি অ্যানালেসিসি বা "বিশ্লেষণ" শব্দটি প্রথম মনোনীত করেন। তিনি আরও অনুমান করেন যে রাসায়নিক মৌল বিভিন্ন ধরণের এবং আকারের কণার সমন্বয়ে গঠিত। তিনি দহন এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের রসায়ন অধ্যয়ন করেন এবং শারীরবিদ্যায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন।

ভ্যাকুয়াম বা শূন্যস্থানের ধর্ম আবিষ্কারের জন্য বয়েল একটি ২৮ লিটার আয়তনের কাঁচের জার নিয়ে তার মধ্যে একটি বেল স্থাপন করলেন। জারের বাইরে থেকে একটি চুম্বক দ্বারা ভেতরের বেলটি বাজানো হলো। জারের ভেতরের বাতাস একটি পাম্প দ্বারা ধীরে ধীরে বের করা হলো। দেখা গেল যে, জারের বাতাস বের হওয়া শুরু হতেই বেলের শব্দ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসছে। জারটি বাতাস মুক্ত হবার সাথে সাথে আর কোনো শব্দই শোনা গেল না। এই পরীক্ষা দ্বারা রবার্ট বয়েল আবিষ্কার করেন, শব্দ শূন্যস্থানে চলাচল করতে পারে না। অর্থাৎ শব্দ চলাচলের জন্য মাধ্যম প্রয়োজন। একইসাথে এটাও প্রমাণ হয়ে যায় যে, চৌম্বক বল শূন্যস্থানের মধ্যে দিয়ে গমন করতে পারে। অন্যথায় জারের ভেতরের বেলটি বাজতো না। বয়েলের এই আবিষ্কার ছিল এক যুগান্তকারী আবিষ্কার। কেননা শূন্যস্থানের ভেতর দিয়ে বাহ্যিক বল চলাচল করতে পারে, এ ব্যাপারটিই মহাকাশে তড়িৎচুম্বক তরঙ্গ চলাচল করতে পারার ব্যাপারটি নিশ্চিত করে।

বয়েলের ভ্যাকুয়াম পাম্প; source: college.columbia.edu

পরীক্ষাটি দ্বারা বয়েল আরো একটি বিষয় প্রমাণ করে ফেলেছিলেন, যা তাৎক্ষণিকভাবে তিনি নিজেও জানতেন না। আর তা হচ্ছে, আলোরও চলাচলের জন্যও কোনো মাধ্যমের প্রয়োজন হয় না। যদি হতো, তাহলে বায়ুমক্ত জারের ভেতরে বেলটি আর দেখা যেত না। তিনি আরো দেখান যে, বায়ুশূন্য জারের মধ্যে কোনো দহনও সম্ভব নয়। দহনের জন্যও বাতাসের প্রয়োজন। উল্লেখ্য, তখনো অক্সিজেন আবিষ্কারই হয়নি।

তখনকার সময়ে সব সম্ভ্রান্ত পরিবারের শিশুদের শিক্ষাজীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল দীর্ঘ এক শিক্ষাভ্রমণ। রবার্ট বয়েলের জীবনে সেই ভ্রমণ এসেছিল ১২ বছর বয়সে। বড় ভাই ফ্রান্সিস এবং গৃহশিক্ষকের সাথে বয়েল ইউরোপ ভ্রমণে বের হন। যদিও অধিকাংশ শিক্ষামূলক ভ্রমণই গ্রীস আর ইটালি কেন্দ্রিক ছিল, বয়েল তার ভ্রমণের অধিকাংশ সময় ব্যয় করেন সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরে। ১৪ বছর বয়সে তিনি ইতালি ভ্রমণে গিয়ে পিসার সেই ভুবনখ্যাত হেলানো মিনার দর্শন করেন। এই মিনার দেখে তিনি গ্যালিলিওর যুগান্তকারী পড়ন্ত বস্তুর গতির সূত্র সম্বলিত পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রতি আকৃষ্ট হন। তখন ইতালিতে গ্যালিলিওর সকল গবেষণা পুস্তক নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু যে করেই হোক, বয়েলের সেগুলো চাই। তিনি সেগুলো সুইজারল্যান্ড থেকে চোরাই পথে নিয়ে এলেন!

রবার্ট বয়েল যখন ফ্লোরেন্স শহরে ভ্রমণে যান, তখন গ্যালিলিও তার জীবনের শেষ অধ্যায়ে ছিলেন। গৃহবন্দী গ্যালিলিওর সাথে দেখা করতে চেয়েছিলেন বয়েল, কিন্তু সম্ভব হয়নি। বয়েল ফ্লোরেন্সে থাকাকালীনই গ্যালিলিওর মৃত্যু হয়। গ্যালিলিওর মৃত্যুতে শোক করার সময়ই পাননি বয়েল, কারণ কিছুদিনের মধ্যেই তার বাবার মৃত্যু সংবাদ এসে পৌঁছে। তবে শিক্ষাভ্রমণের ইতি টানেননি তিনি। ১৪ বছর বয়সে দেশ ত্যাগ করা বয়েল ১৬৪৪ সালে ১৭ বছর বয়সে ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন। বাবার রেখে যাওয়া অঢেল সম্পত্তির কল্যাণে তিনি তখন রীতিমত ধনী। তিনি লন্ডনে বড় বোন ক্যাথেরিনের সাথে কয়েক মাস বসবাস করেন। তখন ইংল্যান্ডে চলছিল গৃহযুদ্ধ। বয়েল তাই লন্ডন ছেড়ে স্টলব্রিজে চলে যান। কারণ যুদ্ধে জড়াবার কোনো ইচ্ছাই তার ছিল না।

শেষজীবন

রবার্ট বয়েল স্বাস্থ্যবান ছিলেন না। ১৬৬৯ সালে তার স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ে। তিনি ধীরে ধীরে জনসমাগম থেকে সরে আসেন। রয়্যাল সোসাইটির সাথে তার যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। "অসাধারণ ঘটনা না হলে" তিনি আতিথেয়তা গ্রহণ করতেন না। এইভাবে অর্জিত অবসর সময়ে তিনি কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিক গবেষণা প্রস্তুত করতে চেয়েছিলেন যা তিনি পরবর্তীকালের জন্য রেখে যাওয়ার প্রস্তাব করেছিলেন। ১৬৯১ সালে তার স্বাস্থ্য আরও খারাপ হতে থাকে। সেই বছরের ৩১ ডিসেম্বর তার জীবনাবসান হয়। তার বড় বোন ক্যাথরিনের মৃত্যু হয় এর মাত্র এক সপ্তাহ আগে ২৩ ডিসেম্বর। ক্যাথরিনের বাড়িতেই প্রায় কুড়ি বছরেরও বেশি তিনি ছিলেন। যার সাথে তিনি অনেক বৈজ্ঞানিক আলোচনা ভাগ করে নিয়েছিলেন। বয়েল পক্ষাঘাত রোগে মারা যান। তাকে সেন্ট মার্টিন-ইন-দ্য-ফিল্ডস-এর চার্চইয়ার্ডে সমাহিত করা হয়। বয়েলের অন্ত্যেষ্টির ধর্মোপদেশ তার বন্ধু বিশপ গিলবার্ট বার্নেট প্রচার করেন। বয়েল তার উইলে বেশ কিছু কথা লেখেন যা পরে বয়েল লেকচার নামে পরিচিতি পায়।

What's Your Reaction?

Like Like 0
Dislike Dislike 0
Love Love 0
Funny Funny 0
Angry Angry 0
Sad Sad 0
Wow Wow 0