নিকোলো ম্যাকিয়াভেলির জীবনী-biography of niccolo machiavelli

নিকোলো ম্যাকিয়াভেলির জীবনী-biography of niccolo machiavelli

May 12, 2025 - 11:01
May 13, 2025 - 01:13
 0  2
নিকোলো ম্যাকিয়াভেলির জীবনী-biography of niccolo machiavelli

নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি

ইতালীয় রাজনীতিবিদ এবং লেখক
নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি
ইউরোপীয় পুনর্জাগরণের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব নিকোলো মেকিয়াভেলি। ইংরেজিতে তাকে নিকোলাস মেকিয়াভেল নামেও ডাকা হয়ে থাকে। ইতালির ফ্লোরেন্স নগরীতে ১৪৬৯ খ্রিষ্টাব্দের ৩ মে জন্মগ্রহণ করেন নিকোলো। আইনজীবী পিতা বার্নার্ডো ডি নিকোলো মেকিয়াভেলি এবং মা বার্তোলোমিয়া ডি স্টেফানো নেলির তৃতীয় ও প্রথম পুত্রসন্তান মেকিয়াভেলি পারিবারিক ঐতিহ্যের কারণেই গ্রন্থপ্রেমী ও জ্ঞানতৃষ্ণার্ত হয়ে ওঠেন। তার মধ্যে জ্ঞানতৃষ্ণার এ আবহটি সঞ্চারিত হয় পিতার মধ্যে থাকা জ্ঞান আহরণের প্রবল আকাঙ্ক্ষার ক্ষেত্রভূমি থেকে। যুবক নিকোলো তাই পুস্তক পাঠে আগ্রহী হয়ে জ্ঞানরাজ্যে অবগাহনের অবকাশ পান। আজীবন তার এ জ্ঞানচর্চা অব্যাহত ছিল।

প্রাথমিক জীবন এবং রাজনৈতিক কর্মজীবন

ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে, ম্যাকিয়াভেলির পরিবার ধনী এবং বিশিষ্ট ছিল, মাঝে মাঝে ফ্লোরেন্সের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিল। তার পিতা,আইনের একজন ডাক্তার বার্নার্ডো পরিবারের সবচেয়ে দরিদ্র সদস্যদের মধ্যে একজন ছিলেন। দেউলিয়া ঋণগ্রহীতা হিসেবে ফ্লোরেন্সে সরকারি পদ থেকে বঞ্চিত থাকার পর, বার্নার্ডো মিতব্যয়ী জীবনযাপন করতেন, শহরের কাছে তার ছোট জমিদারি পরিচালনা করতেন এবং সেখান থেকে তার সামান্য আয়ের পরিপূরক হিসেবে তার পেশার সীমিত এবং প্রায় গোপন অনুশীলন থেকে আয় করতেন।

১৪৯৮ সালে এক বন্ধুকে লেখা এক চিঠিতে, ম্যাকিয়াভেলি তাঁর ধর্মোপদেশ শোনার কথা লিখেছেনগিরোলামো সাভোনারোলা (১৪৫২-৯৮), একজন ডোমিনিকান ধর্মযাজক যিনি ১৪৮২ সালে এবং ১৪৯০-এর দশকে ফ্লোরেন্সে চলে আসেন, সরকার, ধর্মযাজক এবং পোপের বিরুদ্ধে তার পাতলা গোপন অভিযোগের মাধ্যমে জনপ্রিয় সমর্থকদের একটি দলকে আকৃষ্ট করেছিলেন। যদিও সাভোনারোলা, যিনি ১৪৯৪ সালের পর বেশ কয়েক বছর ধরে ফ্লোরেন্স শাসন করেছিলেন, তাকে " দ্য প্রিন্স" (১৫১৩) তে একজন "নিরস্ত্র নবী" হিসেবে দেখানো হয়েছিল, যিনি অবশ্যই ব্যর্থ হবেন, ম্যাকিয়াভেলি তার শিক্ষা এবং বাগ্মী দক্ষতায় মুগ্ধ হয়েছিলেন। ২৪শে মে, ১৪৯৮ তারিখে, সাভোনারোলাকে একজন ধর্মদ্রোহী হিসেবে ফাঁসি দেওয়া হয় এবং তার দেহ জনসাধারণের চত্বরে পুড়িয়ে ফেলা হয়। কয়েক দিন পরে, ২৯ বছর বয়সে অস্পষ্টতা থেকে বেরিয়ে এসে, ম্যাকিয়াভেলি দ্বিতীয় চ্যান্সেরির ( ক্যান্সেলেরিয়া ) প্রধান হন, এই পদটি তাকে প্রজাতন্ত্রের পররাষ্ট্র বিষয়ক বিষয়গুলির দায়িত্বে নিযুক্ত করে।

এত কম বয়সী একজন মানুষকে এত উচ্চপদে নিয়োগ করা সম্ভব হলো, তা এখনও রহস্যময়, বিশেষ করে কারণ ম্যাকিয়াভেলি কখনোই চ্যান্সেরিতে শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করেননি। তিনি ১৫১২ সাল পর্যন্ত এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন, এবং আস্থা অর্জন করেছিলেন।পিয়েরো সোডেরিনি (১৪৫২-১৫২২), ১৫০২ সাল থেকে ফ্লোরেন্সে আজীবনের জন্য গনফালোনিয়ার (প্রধান ম্যাজিস্ট্রেট)।দ্বিতীয় চ্যান্সেরিতে থাকাকালীন , ম্যাকিয়াভেলি সোডেরিনিকে একটি মিলিশিয়া প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভাড়াটে বাহিনীর উপর শহরের নির্ভরতা কমাতে রাজি করান (১৫০৫), যা পরবর্তীতে ম্যাকিয়াভেলি সংগঠিত করেন। তিনি ফ্রান্সের দরবারে কূটনৈতিক ও সামরিক মিশনও পরিচালনা করেন;পোপ আলেকজান্ডার ষষ্ঠের পুত্র সিজার বোর্জিয়া (১৪৭৫/৭৬-১৫০৭) (রাজত্বকাল ১৪৯২-১৫০৩); আলেকজান্ডারের উত্তরসূরী পোপ জুলিয়াস দ্বিতীয় (রাজত্বকাল ১৫০৩-১৩); পবিত্র রোমান সম্রাট ম্যাক্সিমিলিয়ান প্রথমের (রাজত্বকাল ১৪৯৩-১৫১৯); এবং পিসার (১৫০৯ এবং ১৫১১) দরবারে।

নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি: একজন রাজনীতির বিজ্ঞানী

রাজনীতিবিদরা রাজনীতি করবেন দেশ ও দশের জন্য। তাদের প্রতিটি কাজ হবে নীতি-নৈতিকতার দৃষ্টান্ত। এমনটাই তো হওয়া উচিৎ। কিন্তু নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি তা মানতে নারাজ। তিনি বলেছেন, “রাজনীতিতে নৈতিকতার কোনো স্থান নেই!” হ্যাঁ, ইতালির রেনেসাঁর সময়ের এই কূটনীতিবিদ, রাজনীতিবিদ, মানবতাবাদী, লেখক এবং দার্শনিক বিশ্বাস করতেন, রাজনীতিতে নৈতিকতা বলতে কিছু নেই। কিন্তু তাই বলে তিনি কি অনৈতিক ও দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতির পক্ষপাতী ছিলেন? অবশ্যই না!

তবে নৈতিকতার স্থান না রেখেই কীভাবে তিনি রাজনীতিকে জনকল্যাণমুখী করার দর্শন লিখে গেছেন তার অমর গ্রন্থ ‘দ্য প্রিন্স’-এ, সে ব্যাপারে জানতে যেতে হবে একটু গভীরে। জানতে হবে তার জীবন, মতাদর্শ ও দর্শনের খুঁটিনাটি।নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি ১৪৫৯ সালের ৩ মে ইতালির ফ্লোরেন্সে এক অ্যাটর্নির ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। সে সময়টা ইতালিতে এক টালমাটাল অবস্থা চলছিল। ঘনঘন সরকার পরিবর্তন, পোপদের সাথে সাধারণ জনগণের ক্ষোভ আর রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নে ইতালির অবস্থা তখন বেশ নাজুক। এমন পরিস্থিতিতে জন্ম নেয়া ম্যাকিয়াভেলি স্বাভাবিকভাবেই রাজনৈতিক সচেতনতা নিয়ে বেড়ে ওঠেন। তিনি ল্যাটিন ব্যাকরণ এবং ক্লাসিক ও অলংকারশাস্ত্র (রেটরিক) পড়ালেখা করেন। ফ্লোরেন্স তখনকার সময়ের গ্রীক দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু হলেও তিনি গ্রীক পড়েছিলেন কিনা, তা নিয়ে ইতিহাসবিদগণের মাঝে রয়েছে বিতর্ক।

১৪৯৪ সালে ইতালিতে ষাট বছরের ‘হাউজ অব মেডিসি’র শাসনের অবসান ঘটে এবং প্রজাতন্ত্র পুনরায় চালু হয়। এর চার বছর পরই ২৯ বছর বয়সী ম্যাকিয়াভেলি ফ্লোরেন্সের সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন। তিনি প্রাথমিকভাবে ‘লিবার্টি অ্যান্ড পিস’ এর সেক্রেটারি হিসেবে কাজ শুরু করলেও কিছুকাল পর সামরিক ও পররাষ্ট্র বিভাগের একজন কার্যনির্বাহী হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৫০২ সালে তিনি ম্যারিয়েট্টা করসিনি নাম্নী এক রমণীকে বিয়ে করেন।সিভিল সার্ভিসই মূলত ম্যাকিয়াভেলিকে একজন দার্শনিকে পরিণত করে। তিনি তার ১৪ বছরের সরকারি কর্মজীবনে ফ্রান্স, জার্মানি ও সুইজারল্যান্ডে বহু কূটনৈতিক মিশনে গিয়েছেন এবং দীর্ঘকাল কাটিয়েছেন।

এসব কূটনৈতিক মিশনের বাস্তব অভিজ্ঞতাই পরবর্তীকালে তার দর্শনে প্রতিফলিত হয়েছে। তবে সামরিক বাহিনীর কার্যনির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালীন তিনি সামরিক বাহিনীর সাথে অতিমাত্রায় জড়িয়ে পড়েন। ১৫০৬ সালের কুখ্যাত ‘সামরিক অধ্যাদেশ’ এর জন্য ম্যাকিয়াভেলিকেই দায়ী করা হয়। তাছাড়া, দায়িত্ব পালনকালে ম্যাকিয়াভেলি নয়টি অতিরিক্ত সৈন্যবাহিনী একরকম নিজ প্রচেষ্টায় গঠন করেন। ১৫১২ সালে যখন নানামুখী চাপে ফ্লোরেন্টাইন সরকারের অবস্থা টালমাটাল এবং চারদিকে যখন মেডিসি বংশের ক্ষমতা পুনর্দখলের রব উঠেছে, তখন ম্যাকিয়াভেলি আক্রমণ প্রতিহত করতে ১২ হাজার সৈন্য প্রস্তুত করেন। কিন্তু তার সদ্য গঠন করা আনকোরা সেনাবাহিনী তাদের চেয়ে অপেক্ষাকৃত অভিজ্ঞ ও দক্ষ মেডিসি সমর্থক বাহিনীর সাথে পারবে কেন?

ভালো পিতা ও স্বামী হবার পাশাপাশি ম্যাকিয়াভেলি ছিলেন একজন কঠোর সত্যনিষ্ঠ ও কর্তব্যপরায়ণ মানুষ। তিনি মনেপ্রাণে রিপাবলিকান হলেও ফ্লোরেন্সের উন্নতিই তার মূলনীতি ছিল। অন্যদিকে তিনি একজন চমৎকার সাহিত্যিক ছিলেন এবং তার গদ্য লেখার হাত ছিল জাদুকরি। ‘ম্যানড্রাগোলা’ তার বিখ্যাত ব্যাঙ্গাত্মক নাটক। অন্যদিকে, প্রায়োগিক অর্থে তিনি একজন দার্শনিকও নন। তার কোনো ট্রিটিই মানুষ ও সরকারের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে ব্যাখ্যায় উদ্ভাসিত নয়। তবে তার লেখায় বিদ্যমান পদ্ধতিগত বিশ্লেষণের সমন্বয় যেকোনো পাঠকের মনে আলোড়ন সৃষ্টি করতে বাধ্য। তিনি মূলত একটি সুশৃঙ্খল রাজনৈতিক পদ্ধতির অবতারণা করতে চেয়েছিলেন। তিনি রাজনীতিকে একেবারে ভিন্নরূপে দেখেছেন এবং কীভাবে ক্ষমতায় আরোহণ ও ক্ষমতায় থেকে সমাজের উপকার করা যায় সে বিষয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন।

ম্যাকিয়াভেলির দর্শন কাদের দ্বারা অনুপ্রাণিত, সে বিষয়ে ইতিহাসবিদরা অনুমান করেন যে তিনি মূল ধারার দার্শনিকদের চেয়ে বরং ক্লাসিক্যাল লেখকদের লেখায় বেশি প্রভাবিত হয়েছেন। এক্ষেত্রে লিভি, প্লুটার্ক, ট্যাকিটাস, জেনোফোন, পলিবিয়াসের নাম চলে আসে সবার আগে। তাছাড়াও তিনি প্রভাবিত হয়েছেন অ্যারিস্টটল, প্লেটো, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, সিসেরো প্রভৃতি দার্শনিকের দর্শন দ্বারা। অন্যদিকে তার রাজনৈতিক কর্মজীবন তার কাজকে প্রভাবিত করেছে এটা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি রাজনৈতিক সাফল্যকে পন্থার চেয়ে অধিক গুরুত্ব দিতেন। দ্য প্রিন্স ও ডিসকোর্সেসে তিনি রাজনৈতিক নেতৃত্বকে সমাজের ভালোর জন্য সাফল্য খুঁজে পেতে যেকোনো পন্থা অবলম্বনে উৎসাহিত করেছেন। আর তার এই দর্শনের পেছনে রয়েছে মানুষের প্রকৃতি সম্বন্ধে তার তীক্ষ্ণ ও সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পর্যবেক্ষণ। তিনি মানুষকে দেখেছেন চিরন্তন অপরিবর্তনীয় চরিত্র হিসেবে। মানুষের  মধ্যে লোভ, স্বার্থপরতা, প্রতারণা- এসব বৈশিষ্ট্যকে ম্যাকিয়াভেলি দেখেছেন সহজাত বৈশিষ্ট্য হিসেবে। বরং তার মতে, মানুষের এই নেতিবাচক স্বভাবগুলো সর্বদা তাদের ভালো কাজের উদ্যমকে দমিয়ে রাখে না। 

লেখা

অফিসে থাকাকালীন ম্যাকিয়াভেলি ফ্লোরেনটাইনের ইতিহাসের উপর বেশ কয়েকটি ছোট রাজনৈতিক বক্তৃতা এবং কবিতা ( ডেসেনালি ) লিখেছিলেন। তবে, যখন তিনি অফিসের বাইরে এবং নির্বাসনে ছিলেন, তখন "ফ্লোরেনটাইন সেক্রেটারি", যাকে ম্যাকিয়াভেলি বলা হত, রাজনৈতিক দর্শনের কিছু রচনা লিখেছিলেন যার জন্য তাকে স্মরণ করা হয়। তার সবচেয়ে বিখ্যাত চিঠিতে (১০ ডিসেম্বর, ১৫১৩), তিনি তার একটি দিনের বর্ণনা দিয়েছেন - সকালে বনে হাঁটা, বিকেলে সরাইখানায় বন্ধুদের সাথে মদ্যপান এবং জুয়া খেলা, এবং সন্ধ্যায় তার পড়াশোনায় পড়া এবং প্রতিফলন করা, যেখানে তিনি বলেছেন, "আমি সেই খাবার খাই যা আমার এবং যার জন্য আমি জন্মগ্রহণ করেছি। ১৫১৩ সালে ম্যাকিয়াভেলি এই বইটি লিখেছিলেন ফ্লোরেন্সের তৎকালিন রাজা পিয়ারো ডি মেডিচির পুত্র প্রিন্স লরেঞ্জোর প্রতি উপদেশমূলক গ্রন্থ হিসেবে। লরেঞ্জো যদিও সেই সময় এই উপদেশ গ্রহণ করেন নি; কিন্তু পরবর্তিতে দুনিয়াতে যত স্বৈরশাসক ও ডিকটেটর এসেছেন তারা সকলই দ্য প্রিন্সকে মূল উপজীব্য হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন।রাজনৈতিক দার্শনিকগণ সর্বদাই রাজনীতিবিদদের নৈতিক বোধ উন্নত করার প্রতি জোর দিয়ে থাকেন।

কিন্তু ম্যাকিয়াভেলি বলেছেন, রাজনীতিবিদদের নৈতিকতা বলতে কিছু থাকার প্রয়োজন নেই। বরং তাদের প্রধান কাজ হবে তাদের সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা ঠিক রাখা এবং জনকল্যাণমূলক কাজ করা। এই কল্যাণ সাধনে একজন রাজনীতিবিদের যদি কোনো অনৈতিক পন্থাও অবলম্বন করতে হয়, তা-ও তিনি করবেন তার জনগণের ভালোর জন্য। কেননা, ম্যাকিয়াভেলির নিকট পন্থার চেয়ে ফলাফল অধিক গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের ব্যক্তিগত নৈতিকতা তার দেশের ‘অনৈতিক’ উপায়ে নিশ্চিত করা নিরাপত্তার উপরই নির্ভর করে। তাই বলে এই নয় যে ম্যাকিয়াভেলি মানুষের নৈতিকতার কোনো মূল্য দিচ্ছেন না। তিনি বরং নৈতিকতাকে প্রথাগতভাবে না দেখে সামাজিক কাঠামোর ছাঁচে ফেলে দেখার চেষ্টা করেছেন। একজন ব্যক্তি, যার বাড়ি-গাড়ি আছে, তার দৃষ্টিতে মসজিদে জুতা চুরি একটি জঘন্য অপরাধ। কারণ একজোড়া জুতা তার নিকট প্রায় মূল্যহীন। কিন্তু তিনি নিজ ক্ষেত্রে হয়তো আরো অনেক বড় দুর্নীতি করছেন, যা নিয়ে নৈতিক-অনৈতিক সাতপাঁচ ভাবার সময় তিনি পান না। অন্যদিকে সেই চোরের কাছেও একইভাবে এই জুতা চুরি খুবই সামান্য ব্যাপার। কারণ সে জানে, সমাজের উপর মহলে অনেক বড় বড় চুরি সংঘটিত হচ্ছে। ম্যাকিয়াভেলি নিজেও একজন কঠোর নীতিবান মানুষ ছিলেন। 

রাজনৈতিক জীবন:

নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি সামরিক সক্ষমতায় বিশ্বাসী ছিলেন এবং তিনি বিশ্বাস করতেন যে একটি সফল সরকারের অবশ্যই একটি শক্তিশালী সামরিক বাহিনী প্রয়োজন। দেশের প্রতিটি নাগরিককে অপর নাগরিকের হাত থেকে সুরক্ষা দেয়ার দায়িত্ব সামরিক বাহিনীর। তার মতে, সে রাষ্ট্রই সফল যার নাগরিকগণ মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে যে তাদের প্রতি কোনো অন্যায় হতে পারে না কিংবা হলেও তারা তার সঠিক বিচার পাবে। ম্যাকিয়াভেলি তার ‘আর্ট অব ওয়ার’ বইয়ে কীরকম সামরিক ব্যবস্থাকে আদর্শ মনে করেন তার একটি পরিষ্কার ধারণা দিয়েছেন। তিনি অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে একরকম যুদ্ধশাস্ত্রের সাথেই তুলনা করেছেন। তিনি নিজে রাজনীতিতে জড়িত থাকাকালীন একজন সামরিক কর্মকর্তার মতোই বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করেছেন এবং ভেবেছেন।

তার এই রাজনৈতিক মতাদর্শ খুব স্বাভাবিকভাবেই সামরিক ভাবাদর্শে প্রভাবিত। সামরিক বাহিনীর মধ্যে যে শৃঙ্খলা বিদ্যমান, তা-ই তিনি রাজনীতিতে আনয়ন করতে চাইতেন। তিনি মনে করতেন, রাজনীতির অধিকাংশ দিকই হচ্ছে ষড়যন্ত্রমূলক, যা সামরিক কায়দায় সর্বোচ্চ গোপনীয়তা এবং প্রস্তুতির সাথে সমাধান করতে হবে। এসব বিষয় ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ম্যাকিয়াভেলি ‘জেনারেল থিওরি অব কন্সপিরেসি’ রচনা করেছেন, এক্ষেত্রে কোনো সামরিক তাত্ত্বিকের বাইরে প্রথম ব্যক্তি তিনিই।ম্যাকিয়াভেলি শুধু রাজনৈতিক সমস্যাকে সামরিক উপায়ে সমাধান করেই দমে যাননি, তিনি রাজনৈতিক আর সামরিক নেতার মধ্যেও সাদৃশ্য দেখিয়েছেন। একজন সামরিক নেতা যেভাবে তার সৈন্যদেরকে প্রশিক্ষণ দেন, শৃঙ্খলিত করেন, যুদ্ধক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক পরিস্থিতি সাপেক্ষে পরিচালিত করার মতো সৃজনশীল কাজ করেন, একজন রাজনৈতিক নেতাও একইরূপে দেশ পরিচালনা করেন। অন্যদিকে, তার মতে, একটি দেশের বৈদেশিক নীতি পরিচালিত হয় দুটি উপায়ে- হয় কূটনীতি, নয় যুদ্ধ।কিয়াভেলির প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, তার খ্যাতির চেয়ে কুখ্যাতি, আর আলোচনার চেয়ে সমালোচনা হয়েছে বেশি।

 তার পরিচিতির প্রায় পুরোটাই তার অমর কীর্তি ‘দ্য প্রিন্স’ এর জন্য। আবার তার সমালোচনার অধিকাংশই তার রাজনৈতিক ফায়দা বিষয়ক তত্ত্বের জন্য। যে তত্ত্বে তিনি বলেছেন, সামষ্টিক ভালোর জন্য কোনো কাজ করতে গেলে নৈতিক-অনৈতিক বিবেচনার প্রয়োজন নেই। তথাপি পশ্চিমা রাজনৈতিক দার্শনিকদের মধ্যে তার অবস্থান একেবারে উপরের দিকে রাখতে সকলেই বাধ্য। তবে সাম্প্রতিককালে তাকে যেন নতুন করে আবিষ্কার করা হয়েছে। তাকে বলা হচ্ছে একজন ‘রাজনীতির বিজ্ঞানী’! আবার অনেকেই তাকে প্রথম উদারনৈতিক কিংবা প্রগতিশীল রাজনৈতিক দার্শনিকও বলছেন। তার আরেকটি বড় সাফল্য হচ্ছে তার সামরিক দর্শন। তবে সাম্প্রতিককালে, কী রাজনৈতিক দর্শন, কী সামরিক ভাবনা, উভয় ক্ষেত্রেই ম্যাকিয়াভেলিকে বলা হচ্ছে অতুলনীয়।

মৃত্যু

২১ জুন ১৫২৭ (বয়স ৫৮)  ফ্লোরেন্স, Republic of Florence.

What's Your Reaction?

Like Like 0
Dislike Dislike 0
Love Love 0
Funny Funny 0
Angry Angry 0
Sad Sad 0
Wow Wow 0