মীর মোশাররফ হোসেন এর জীবনী || Biography of Mir Mosharraf Hossain

মীর মোশাররফ হোসেন এর জীবনী || Biography of Mir Mosharraf Hossain

May 14, 2025 - 11:51
May 21, 2025 - 00:29
 0  1
মীর মোশাররফ হোসেন এর জীবনী || Biography of Mir Mosharraf Hossain
জন্ম
সৈয়দ মীর মশাররফ হোসেন। ছদ্ম নাম: গাজীমিয়াঁ

১৮৪৭
কুষ্টিয়া (বর্তমান বাংলাদেশ)
মৃত্যু ১৯ ডিসেম্বর ১৯১২ (বয়স ৬৪–৬৫)[
পদমদী, নবাবপুর, বালিয়াকান্দি, রাজবাড়ী।

জাতীয়তা

ব্রিটিশ ভারতীয় (অধুনা বাংলাদেশি)

পেশা

লেখক
মীর মশাররফ হোসেন
 (নভেম্বর ১৩, ১৮৪৭ - ডিসেম্বর ১৯, ১৯১২) ছিলেন একজন বাঙালি ঔপন্যাসিক, নাট্যকার ও প্রাবন্ধিক। তার পুরো নাম সৈয়দ মীর মশাররফ হোসেন। তিনি বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান গদ্যশিল্পী ও বাঙালি মুসলিম সাহিত্যিকদের পথিকৃৎ।[২] কারবালার যুদ্ধকে উপজীব্য করে রচিত বিষাদ সিন্ধু তার সবচেয়ে জনপ্রিয় সাহিত্যকর্ম।
তিনি তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতে (বর্তমান বাংলাদেশ) কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার চাঁপড়া ইউনিয়নের লাহিনীপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈত্রিক নিবাস রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকন্দি উপজেলার পদমদি গ্রামে। তার লেখাপড়ার জীবন কাটে প্রথমে কুষ্টিয়ায়, পরে বর্তমান রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার পদমদী গ্রামে ও শেষে কৃষ্ণনগরের বিভিন্ন বিদ্যালয়ে। তার জীবনের অধিকাংশ সময় ব্যয় হয় ফরিদপুরের নবাব এস্টেটে চাকরি করে। তিনি কিছুকাল কলকাতায় বসবাস করেন।
মীর মশাররফ হোসেন তার বহুমুখী প্রতিভার মাধ্যমে উপন্যাস, নাটক, প্রহসন, কাব্য ও প্রবন্ধ রচনা করে আধুনিক যুগে মুসলিম রচিত বাংলা সাহিত্যে সমৃদ্ধ ধারার প্রবর্তন করেন।
তার স্মৃতি রক্ষার্থে তার নামে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭৮ সালে একটি আবাসিক হল নির্মাণ করা হয়, যা দক্ষিন এশিয়ার মধ্যে ছাত্রদের জন্য তৈরীকৃত ২য় বৃহৎ আবাসিক হল।
প্রাথমিক জীবন
সৈয়দ মীর মশাররফ হোসেন খুলনা বিভাগের কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালীর একটি ছোট গ্রাম লাহিনিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন।কিন্তু তার জীবনের অধিকাংশ সময় তিনি রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দির পদমদীতে অতিবাহিত করেন। তবে তার জন্ম তারিখ ১৮৪৭ সালের ১৩ নভেম্বর বলে ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়।[৪] কিন্তু কিছু গবেষক তার জন্ম তারিখ ১৮৪৭ সালের ২৬ অক্টোবর বলে দাবি করেন। তিনি নবাব সৈয়দ মীর মোয়াজ্জেম হোসেন[৬] (মুসলিম সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি, তৎকালীন কুষ্টিয়ার কুমারখালীর লাহিনী পাড়ার জমিদার) এবং দৌলতুন্নেছার ঘরে জন্মগ্রহণ করেন।
শিক্ষাজীবন
সৈয়দ মীর মশাররফ হোসেনের স্কুল জীবন কেটেছে প্রথমে কুষ্টিয়ায়, পরে পদমদী এবং শেষে কৃষ্ণনগর শহরে। জগমোহন নন্দীর পাঠশালা, কুমারখালীর ইংলিশ স্কুল, পদমদী নবাব স্কুল ও কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুল এ পড়ার কথা লেখকের আত্নজীবনীতে লেখা আছে।
‘বঙ্গবাসী মুসলমানদের দেশভাষা বা মাতৃভাষা “বাঙ্গালা”। মাতৃভাষায় যাহার আস্থা নাই, সে মানুষ নহে। বিশেষ সাংসারিক কাজকর্ম্মে মাতৃভাষারই সম্পূর্ণ অধিকার। মাতৃভাষায় অবহেলা করিয়া অন্য দুই ভাষায় বিখ্যাত পণ্ডিত হইলেও তাহার প্রতিপত্তি নাই। পরিবার, আত্মীয়স্বজন, এমনকি প্রাণের প্রাণ যে স্ত্রী, তাহার নিকটেও আদর নাই। অসুবিধাও বিস্তর। ইস্তক ঘরকন্নার কার্য্য নাগাদে রাজসংশ্রবী যাবতীয় কার্য্যে বঙ্গবাসী মুসলমানদের বাঙ্গালা ভাষার প্রয়োজন।
বিতর্ক
১৮৮৯ সালের মার্চ মাসে প্রকাশিত হয় তার লেখা প্রবন্ধ গো-জীবন। গো-জীবনের লেখক মূলত উপমহাদেশে গোরু কোরবানি নিয়ে হিন্দু মুসলমানের যে দ্বান্দ্বিক অবস্থান, তার ব্যাপারে মন্তব্য রাখেন নিজের। তার মত ছিল, গোরু কুরবানির বদলে অন্য কিছু ( যেমনঃ ছাগল) কুরবানি দেওয়ার।
"খাদ্য সম্বন্ধে বিধি আছে যে খাওয়া যাইতে পারে-খাইতেই হইবে, গো-মাংস না খাইলে মোসলমান থাকিবে না, মহাপাপী হইয়া নরকযন্ত্রণা ভোগ করিতে হইছে….একথা কোথাও লিখা নাই।"
"এই বঙ্গরাজ্যে হিন্দু-মোসলমান উভয় জাতিই প্রধান। পরস্পর এমন ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ যে, ধর্ম ভিন্ন, কিন্তু মর্মে ও কর্মে এক-সংসার কার্যে, ভাই না বলিয়া আর থাকিতে পারি না। আপদে, বিপদে, সুখে দুঃখে, সম্পদে পরস্পরের সাহায্য ভিন্ন উদ্ধার নাই। সুখ নাই, শেষ নাই, রক্ষার উপায় নাই।..এমন ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ যাহাদের সঙ্গে, এমন চিরসঙ্গী যাহারা, তাহাদের মনে ব্যথা দিয়া লাভ কী?"
"আরবে কেহই গরু কোরবানি করে না। ধর্মের গতি বড় চমৎকার। পাহাড় পর্বত, মরুভূমি সমুদ্র, নদ-নদী ছাড়াইয়া মোসলমান ধর্ম ভারতে আসিয়াছে, সঙ্গে সঙ্গে কোরবানি আসিয়াছে। এদেশে দোম্বা নাই-দোম্বার পরিবর্তে ছাগ, উঠের পরিবর্তে গো, এই হইল শাস্ত্রকারদিগের ব্যবস্থা।"
"গরু কোরবানি না হইয়া ছাগলও কোরবানি হইতে পারে। তাহাতেও ধর্ম রক্ষা হয়।"
এই প্রবন্ধ লেখার পর সৈয়দ মীর মোশারাফ হোসেন প্রবল নিন্দার সম্মুখীন হন। তার নামে ফতোয়া জারি হয়। ধর্মসভা ডেকে তাঁকে কাফের এবং তার স্ত্রীকে হারাম জারি করা হয়। তাঁকে বলা হয় 'তওবা' করতে।
ক্ষুব্ধ লেখক প্রথমে একটি মামলা দায়ের করলেও পরে ব্যাপারটি আপসে মিটিয়ে নেন। কিন্তু গো-জীবন এর পরবর্তীকালে আর ছাপা হয়নি।

উপন্যাস

বাংলা কথাসাহিত্যের ইতিহাসে মীর মশাররফ হোসেন (১৮৪৭-১৯১২)-এর অবদান অশেষ। তিনি বাংলা সাহিত্যের সমন্বয়ধর্মী লেখকদের গোত্রভূক্ত। বাংলা সাহিত্য যখন মুসলিম সমাজের প্রতিনিধিত্বহীন ঠিক এমনই একটি সময়ে বাংলা সাহিত্যে তাঁর আবির্ভাব ও প্রতিষ্ঠালাভ, যা ছিলো একটি বিষ্ময়কর। এ সময়ে মুসলমান লেখকগণ পাশ্চাত্য শিক্ষা-সংস্কৃতিকে বর্জন করার কারণে ছিলেন সাহিত্যে তাঁদের উপস্থিতি তেমন পরিদৃষ্ট হয় না। বস্তুত, তাঁরা মধ্যযুগের একঘেঁয়ে সাহিত্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে দো-ভাষী পুঁথি রচনাতেই ছিলেন তৃপ্ত। আর এর মধ্যে নবজাগরণের বিশ্বপ্রতীম মানবিক বোধবুদ্ধি ও জিজ্ঞাসা ছিল অনুপস্থিত। এ কারণে মানুষের সার্বজনীন আত্মজিজ্ঞাসা ও বিকাশের দ্বন্দ্বমুখর অগ্রযাত্রায় তাঁদের ভূমিকা ছিলো প্রশ্নবিদ্ধ।
অন্যদিকে একই সময়ে হিন্দু লেখকগণ পাশ্চাত্য শিক্ষা সংস্কৃতিকে পুরোপুরি আত্মস্থ করে আধুনিকতার মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে উঠে ওঠেন। এ সময়ে ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-৯১), বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮-৯৪), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) প্রমুখ সাহিত্য-শিল্পী দোর্দণ্ড প্রতাপে বাংলা সাহিত্যে বিচরণশীল ছিলেন। তাঁদের সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যের সীমা ছাড়িয়ে বিশ্ব দরবারে সমাদৃত ও গ্রহণীয় হয়ে ওঠে। এই সর্বপ্লাবী সাহিত্যশিল্পের জয়যাত্রার জোয়ারের মুখে মীর মশাররফ হোসেন বাংলা সাহিত্যে পদার্পণ করেন ও প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। তিনি অবনমিত মুসলিম সমাজকে আত্মপ্রত্যয়ী ও সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগী করে তুলতে সক্ষম হন।

মীর মশাররফ হোসেনের অসাধারণ কৃতিত্ব এই যে, তিনি দো-ভাষী পুঁথির মিশ্র ভাষারীতি থেকে বেরিয়ে এসে এক ধরনের বিশেষ শালীন সাধুগদ্য রচনা করেন। মাইকেল যেমন রামায়ণের কাহিনি নিয়ে এক অপরূপ ট্র্যাজেডি ‘মেঘনাদ বধ’ মহাকাব্য রচনার মধ্য দিয়ে পুরাণের পুনর্জন্ম ঘটিয়েছিলেন, তেমনি মীর মশাররফ গদ্যে কারবালার ঐতিহাসিক বিয়োগান্ত ঘটনা নিয়ে ‘বিষাদ সিন্ধু’ ট্র্যাজেডি রচনার মাধ্যমে ইতিহাসের নবজন্ম দান করলেন। ইসলামী ভাবধারার উজ্জীবন অপেক্ষা সমাজের দোষ-ক্রটি উদ্ঘাটন এবং জীবন চিত্রাঙ্কনের প্রতি তাঁর দৃষ্টি বেশি নিবন্ধ ছিল। এ কারণে তাঁর সাহিত্য মুসলমান-হিন্দু সকলের কাছে ছিল জনপ্রিয়।

মীর মশাররফ হোসেন উপন্যাস, নাটক, জীবনী, আত্মজীবনী, ইতিহাস, ধর্মতত্ব, কাব্য, সঙ্গীত ইত্যাদি বিষয়ক ৩৫টি গ্রন্থ রচনা করেন। কাঙাল হরিণাথ তাঁর সাহিত্য গুরু। ছাত্রজীবনেই তার লেখা ‘সংবাদ প্রভাকর’ ও ‘গ্রাম বার্তায়’ প্রকাশিত হয়। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে ‘রত্মাবতী’ (১৮৬৯), ‘বিষাদসিন্ধু’ (১৮৮৫-৯১) ‘উদাসীন পথিকের মনের কথা’ (১৮৯০), ‘গাজী মিয়ার বস্তানী’ (১৮৯৯) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

‘রত্নাবতী’ (১৮৬৯) মীর মশাররফ হোসেনের প্রথম গ্রন্থ। ‘কৌতুকাবহ উপন্যাস’ নামে চিহ্নিত এটি লেখকের মৌলিক সৃষ্টি, কোন গ্রন্থ বিশেষের অনুবাদ নয়। এ সম্পর্কে গ্রন্থের ভূমিকায় লেখক বলেছেন, ‘ইহা কোন গ্রন্থ বিশেষের অনুবাদ নহে। আজকাল অনেক সুবিজ্ঞ গ্রন্থকার অনুবাদের পক্ষপাতি।.....আমি সে পথের পথিক না হইয়া যথাসাধ্য এই গল্পটি কল্পনা করিয়াছি।’ (মীর মশাররফ হোসেন, ভূমিকা, রত্নাবতী)। ‘রত্নাবতী’র সাফল্য তার ভাষার উপরেই প্রতিষ্ঠিত। বক্তব্য কিংবা বিষয় গৌরবে নয়, মূলত ভাষার সৌন্দর্য ও বিশুদ্ধতার প্রশ্নেই স্বীকৃতি ও প্রশংসা মিলেছে।

‘বিষাদসিন্ধু’ (১৮৮৫-৯১) বাংলা সাহিত্যের একটি ধ্রুপদী গ্রন্থ। ইসলামের ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা বিষাদান্তক মর্মন্তুদ কারবালার কাহিনি অবলম্বনে গ্রন্থটি তিনটি খণ্ডে রচিত। মহরম পর্ব (১৮৮৫), উদ্ধার পর্ব (১৮৮৭), এজিদবধ পর্ব (১৮৯১)। গ্রন্থের মুখবন্ধে লেখক দাবি করেছেন, ‘পারস্য ও আরব্য গন্থ হইতে মূল ঘটনার সারাংশ লইয়া ‘বিষাদ সিন্ধু’ বিরচিত হইল।’ এটি একটি মহাকাব্যপোম বৃহদাকার ইতিহাসাশ্রয়ী রোমান্সধর্মী উপন্যাস। ‘বিষাদ সিন্ধু’র ‘মহরম পর্বে’ বর্ণিত হয়েছে দামেষ্ক অধিপতি মাবিয়াপুত্র এজিদের প্রণয়াসক্তি, ব্যর্থতা এবং তার পরিণাম। হাসান পত্নী জয়নবকে সে করায়ত্ত করতে সক্ষম হয়নি। এ ব্যর্থতার সূত্রে হাসানের প্রতি সে বৈরিতা পোষণ করে এবং তার ষড়যন্ত্রে কৌশলে হাসানকে জীবন দিতে হয় এবং অবশেষে কারবালা প্রান্তরের এক অসম যুদ্ধে হোসেন নৃশংসভাবে নিহত হন। ‘উদ্ধার পর্বে’র কাহিনী অংশে আছে বিপন্ন হোসেন পরিবারের অস্তিত্ব রক্ষাকারী এবং ক্রোধান্ধ দুর্জয় মহাবীর মোহাম্মদ হানিফার প্রতিশোধ গ্রহণের বিবরণ। শেষ খণ্ড ‘এজিদবধ’ পর্বে বর্ণিত হয়েছে হানিফার এজিদ হত্যার প্রচেষ্টা, এজিদের ভূগর্ভস্থ গুপ্ত কক্ষে পলায়ন ও জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে নারকীয় কষ্টভোগ, দৈব নির্দেশে বহু প্রাণ ক্ষয়কারী আবু হানিফার প্রাকৃতিক বন্দিত্ব এবং হোসেনের বংশধর জয়নাল আবেদীনের রাজ্যলাভের অবশ্যম্ভাবিতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।

‘বিষাদ সিন্ধু’ মীর মশাররফকে ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তার উচ্চ শিখরে পৌঁছে দিয়েছে। একদিকে ধর্মচেতনা ও স্বজাতির কাছে দায়বদ্ধতা তাকে অনিবার্যভাবে হাসান-হোসেনের পক্ষাবলম্বী করে তুলেছে, অন্যদিকে, শিল্পী মশাররফের সহানুভূতি ও মমত্ববোধ যে এজিদের প্রতি ধাবিত হয়েছে, তাও বলার অপেক্ষা রাখে না। বাহ্যত হাসান-হোসেনের প্রতি মমত্ববোধ হলেও শিল্প মননের গভীরে ‘দুরাত্মা’ এজিদই আন্তরিক অনুরাগ ও মমতায় প্রতিষ্ঠিত। তথাপিও শিল্পী মশাররফের অভিপ্রায়ের বিজয় সাধিত হয়েছে এই ধর্মাশ্রয়ী কাহিনির শিল্প রূপায়ণে। উপন্যাসের এজিদ চরিত্র শুধু বাংলা সাহিত্য নয়, বিশ্ব সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ চরিত্রের সমান্তরাল। রূপজমোহ বঙ্কিমের ‘চন্দ্রশেখরে’র ন্যায় হলেও এজিদের রূপজমোহ এজিদকে যে পরিণতিতে টেনে নিয়েছে তা মহাকাব্যিক রূপ পেয়েছে। তার চরিত্র সৃষ্টির কারণেই মায়মুনা, সীমার ইত্যাদি চরিত্র কেবল উপন্যাসের চরিত্রের মধ্যেই বন্দি থাকেনি। এরা রীতিমতো বিশ্লেষণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। উপন্যাসে জয়নবের প্রতি এজিদের যে প্রণয় সে প্রণয়ের তীব্র-তীক্ষè যন্ত্রণায় এজিদ নামদারের মতো একজন শাসক এবং ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন পুরুষ যন্ত্রণায় বিপর্যস্ত, সে প্রণয়ই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় ঘটনাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। এতে ধর্ম, রাজনীতি, ইতিহাস অনেক ক্ষেত্রেই গৌণ হয়ে গেছে।

‘উদাসীন পথিকের মনের কথা’ মীর মশাররফ হোসেনের আত্মকথা যা নিরেট উপন্যাস না বলে একে উপন্যাসের আদলে মশাররফের শ্রুতি স্মৃতিনির্ভর বাস্তব ঘটনার আলেখ্য হিসাবে চিহ্নিত করা যায়। মুনীর চৌধুরী এটিকে ‘মশাররফের আত্মজীবনীমূলক রচনা’ বলে অভিহিত করেছেন। প্রকৃত প্রস্তাবে মীর মশাররফ হোসেনের ‘উদাসীন পথিকের মনের কথা’ দু’টি স্বতন্ত্র ধারা এ গ্রন্থের অন্যতম উদ্দেশ্য হলেও এর প্রধান আকর্ষণ মীর সাহেবের পিতা-মাতার দাম্পত্য জীবন ও তাঁর নিজের শৈশব জীবনের কাহিনী। ‘উদাসীন পথিকের মনের কথা’ না গাঢ়বন্ধ উপন্যাস, না যথার্থ আত্মজীবনী। উভয়ের সংমিশ্রণে এটি একটি শংকর সৃষ্টি। তবে মানুষের জীবনে ছোট-বড় নানা ঘটনা একটি সংবেদনশীল মনের ছোঁয়ায় কাহিনি আকারে প্রবাহিত হয়ে গেছে বলে ‘উদাসীন পথিকের মনের কথা’কে শ্লথ বিন্যস্ত উপন্যাস বলা যায়। এ উপন্যাসের কাহিনির একদিকে রয়েছে নীলকর টিআই কেনীর সঙ্গে সুন্দরপুরের মহিলা জমিদার প্যারী সুন্দরীর দ্বন্দ্ব, রায়ত প্রজার উপর কেনীর অত্যাচার-নিপীড়ন, নীলবিদ্রোহ ও কেনীর পরিণতি। কাহিনির দ্বিতীয় ধারাটি গড়ে উঠেছে মশাররফ হোসেনের পিতা মীর মোয়াজ্জম হোসেনের সঙ্গে তার ভ্রাতুষ্পুত্রী পতি সা গোলামের তিক্ত সম্পর্ককে কেন্দ্র করে এবং এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মোয়াজ্জম হোসেনের দাম্পত্য জীবনের ঘটনা। আর এ দু’ধারার যোগসূত্র স্থাপন করেছেন মোয়াজ্জম হোসেন। উপন্যাসে মশাররফের সমাজ সচেতন শিল্পি মানসের গভীর পরিচয় প্রতিফলিত হয়েছে।

‘গাজী মিয়ার বস্তানী’তে মুখ্যত দু’টি সমান্তরাল কাহিনি বিবৃত : কুঞ্জ নিকেতনের কুট-কৌশলী ভূমি অধিকারিণী পয়জারননেসা ওরফে বেগম ঠাকরুণের বেপরোয়া অনৈতিক জীবন-যাপন এবং অপর পক্ষে জমদ্বারের জমিদারীর দুটি প্রতিপক্ষ শরিক সোনাবিবি ও মনিবিবির দ্বন্দ্বকলহ, পাপাচার ও পরিণামের আখ্যান। এই দুটি কাহিনির সূত্রে গ্রথিত হয়েছে একাধিক শাখা কাহিনি। মানব চরিত্রের মন্দ ও অন্ধকার দিকগুলোই এই উপখ্যানে বিধৃত। মহৎ জীবনাদর্শ, সুরুচি-শালীনতার শিক্ষা, নৈতিক মূল্যবোধ, প্রেম-প্রীতি-কৃতজ্ঞতার মানসিক গুণাবলী ‘বস্তানী’র মানব-মানবীর জীবনে অনুশীলিত হয়নি। তাই রমণীর সতীত্ব দানে সানন্দ সম্মতি লোকনিন্দা উপেক্ষা করে উপপতির মনোরঞ্জন, পুত্রের হাতে গর্ভধারিণীর লাঞ্ছনা, নির্বিচার ল্যাম্পট্য ক্রীড়ায় নিত্য তৃপ্তি, ন্যায়ালয়ের প্রতিনিধির অনাচার, অর্থের কাছে বিবেক-বিশ্বাস-মনুষ্যত্ব বিসর্জন, সংকোচনহীন কৃতঘ্নতা-এসব ঘটনা স্বাভাবিক জীবনযাপন ও জীবনাচরণের অঙ্গ হিসেবেই প্রকাশিত। প্রকৃতপক্ষে ‘এক ক্লেদাক্ত পরিবেশের বিবেকশূন্য, নীতি-বিবর্জিত, অসৎ ও চরিত্রহীন মানুষের কাহিনি এই ‘বস্তানী’। তবে নানা ত্রুটি, অসঙ্গতি ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ‘গাজী মিয়ার বস্তানী’ কালের দর্পণ এবং মশাররফের প্রচলিত শিল্পভূবনের বাইরে স্বতন্ত্র শিল্পরীতির নিদর্শন হিসেবে স্বীকৃত।


পরিশেষে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, একটি বিশেষ যুগসন্ধিক্ষণে মীর মশাররফ হোসেন উপন্যাস রচনায় শিল্পী-চৈতন্যে যে নতুন মাত্রা যোগ করেছিলেন তার প্রেক্ষিতেই পুঁথি সাহিত্যের গণ্ডি পেরিয়ে আধুনিক জীবন-সাহিত্যে পদার্পণের দরজা উম্মুক্ত করেছিলেন।

মৃত্যু
 ১৯ ডিসেম্বর, ১৯১১ সালে দেলদুয়ার জমিদার এস্টেটে নায়েব বা ম্যানেজার থাকাকালেই সৈয়দ মীর মশাররফ হোসেন পরলোকগমন করেন। তাকে পদমদীতে দাফন করা হয়।এখানেই 'মীর মশাররফ হোসেন স্মৃতি কমপ্লেক্স' অবস্থিত।

What's Your Reaction?

Like Like 0
Dislike Dislike 0
Love Love 0
Funny Funny 0
Angry Angry 0
Sad Sad 0
Wow Wow 0