বিজ্ঞানী জে জে থমসন: ইলেকট্রন আবিষ্কার করলেন যিনি
স্যার জোসেফ জন থমসন,
ওএম, এফআর, সচরাচর জে. জে. থমসন নামে পরিচিত, একজন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী। ইলেকট্রন, আইসোটোপ এবং ভর বর্ণালীবীক্ষণ যন্ত্রের আবিষ্কারের জন্য তিনি বিখ্যাত। তিনি ১৯০৬ সালে তার এই আবিষ্কারগুলোর জন্য পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
থমসনের পরমাণু মডেল (Thomson’s atom model)
ইংরেজ পদার্থবিজ্ঞানী জোসেফ জে. থমসন (J. J. Thomson) 1897 খ্রিস্টাব্দে ইলেকট্রন আবিষ্কারের পর পরমাণুর গঠন সম্বন্ধে একটি চিত্র বা মডেল উপস্থাপন করেন। এটি থমসন মডেল নামে পরিচিত। 1911 খ্রিস্টাব্দে নিউজিল্যাণ্ডবাসী পদার্থবিজ্ঞানী আর্নেস্ট রাদারফোর্ডের আলফা কণার দ্বারা বিক্ষেপণ পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পূর্ব পর্যন্ত থমসনের পরমাণু মডেল বিজ্ঞানী মহলে সমাদৃত ছিল।
থমসন মডেলের মূল বক্তব্য হলো যে পরমাণু একটি ধনাত্মক তড়িতাহিত গোলক এবং ইলেকট্রনগুলো এর মধ্যে সর্বত্র ছড়ানো ছিটানো রয়েছে (চিত্র) অনেকটা ময়দার লেই বা কেক যার মধ্যে কিসমিস্ যেমন সর্বত্র ছড়ানো ছিটানো থাকে সেরকম। এখানে লেই বা কেক হলো ধনাত্মক তড়িতাহিত গোলক এবং কিসমিস গুলো হলো ইলেকট্রন। কেকের মধ্যে কিসমিসের ভর যেমন সামান্য তেমনি পরমাণুর মধ্যে ইলেকট্রনের ভর খুবই সামান্য এবং তার মতে গোলকটির ভরই পরমাণুর সম্পূর্ণ ভর; কিন্তু লর্ড রাদারফোর্ড এবং তার সহকারীদের দ্বারা সম্পন্ন বিক্ষেপণ পরীক্ষার ফলাফল কোনোভাবেই থমসনের মডেল ব্যাখ্যা করতে সমর্থ না হওয়ায় এর গ্রহণযোগ্যতা আর রইল না।
ইলেকট্রন আবিষ্কার
বিকাল বেলার চায়ের আড্ডা বেশ প্রিয় ছিল একজন বিজ্ঞানীর। তিনি ইলেকট্রন আবিষ্কারের জন্য বিখ্যাত। নাম তাঁর জোসেফ জন থমসন বা জে.জে. থমসন। তাঁর এ চা প্রীতির সাথে জড়িত একটি ঘটনা রয়েছে।থমসন তখন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাভেন্ডিস ল্যাবরেটরিতে গবেষণারত শিক্ষার্থীদের নেতা হয়েছেন। দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতিদিন একটি টি-ব্রেক বা চা পানের ছুটির ব্যবস্থা করেছিলেন। চা-কে কেন্দ্রে করে এই সাময়িক ছুটি গবেষণারত শিক্ষার্থীদের মাঝে বিজ্ঞান ও রাজনীতি নিয়ে পরস্পরের সাথে আলোচনার সুযোগ করে দিয়েছিল। শিক্ষার্থীদের গবেষণা কাজ আর সার্বিক কল্যাণের উদ্দেশ্যে জে.জে. থমসনের প্রয়াসের প্রতি পরবর্তীকালে অনেক শিক্ষার্থীই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিলেন।
থমসন ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টারের এক শহরতলীতে ১৮৫৬ সালের ১৮ই ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কেমব্রিজ ও রয়্যাল ইনস্টিটিউশনে পরীক্ষামূলক পদার্থবিজ্ঞানের একজন অধ্যাপক ছিলেন। ১৮৮৪ সালে তিনি রয়্যাল সোসাইটির একজন ফেলো নির্বাচিত হন এবং ১৯১৬-১৯২০ সাল পর্যন্ত এর সভাপতি ছিলেন।
পরমাণুর গঠন নিয়ে থমসন বৈপ্লবিক গবেষণা করেন। তিনিই পরমাণুর মাঝে থাকা ইলেকট্রন আবিষ্কারের জন্য সুপরিচিত। ক্যাথোড রশ্মি নিয়ে করা গবেষণা তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ কাজ বলে বিবেচিত হয়। এ কাজই তাঁকে পরবর্তীকালে ইলেকট্রন আবিষ্কারের পথে ধাবিত করে। ক্যাথোড রশ্মি নিয়ে গবেষণার জন্য তিনি ১৯০৬ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন।
পদার্থবিজ্ঞানী জে. জে. টমসন এবং প্রথম মৌলিক কণিকা― ইলেকট্রন /পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা
●পদার্থবিজ্ঞানী জে. জে. টমসন এবং প্রথম মৌলিক কণিকা― ইলেকট্রন
পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা
স্যার যোশেফ জন টমসন (সংক্ষেপে, জে. জে. টমসন) ১৮৫৬ সালের ১৮-ই ডিসেম্বর, ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টারের অন্তর্গত চেথাম হিল-এ জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর জন্মদাত্রী মাতা এমা সুইনডেলস তাঁতবস্ত্র বুননশিল্প পরিবারের মেয়ে। পিতা যোসেফ জেমস টমসন ম্যানচেস্টারে একটি পৈত্রিক প্রত্নতাত্ত্বিক সামগ্রী বেচা-কেনার দোকান চালাতেন।
স্থানীয় ছোট প্রাইভেট স্কুলে ছোট্ট টমসনের লেখাপড়ায় হাতেখড়ি। সেখানে তাঁর তীক্ষ্ম মেধার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ছোটবেলা থেকে বিজ্ঞানের প্রতি তার তীব্র আসক্তি। মাত্র ১৪ বছর বয়সের মধ্যে স্কুলের সব পাঠে সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়ে কিশোর টমসন রওনা দিলেন ম্যানচেস্টারের ওয়েনস কলেজে পড়তে। বর্তমানে যা 'ইউনিভার্সিটি অব ম্যানচেস্টার' নামে অধিক পরিচিত। ১৮৭০ সালে এই কলেজে ভর্তি হলেও তাঁর পিতার খুব ইচ্ছা ছিল শার্প স্টেওয়ার্ট অ্যান্ড কোং-এ একজন শিক্ষানবিশ ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে তার নাম নথিভুক্ত করতে। সেই মতো সব প্রস্তুতি চলছিল। বাধা হল নিয়তি।
১৮৭৩ সালে পিতার অকাল প্রয়াণ ঘটল। অপূর্ণ থেকে গেল স্বপ্ন। অর্থের অভাবে লেখাপড়ায় ছেদ পড়ার উপক্রম। ভেঙ্গে গেল হৃদয়। সেই ভগ্ন হৃদয়ে তার গণিতের অধ্যাপকদের কথায় বৃত্তির আবেদন করলেন কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে। সেটা ১৮৭৬ সাল। সেখান থেকে চার বছর পর গণিতে দ্বিতীয় স্থান পেয়ে 'Bachelor of Arts' ডিগ্রি লাভ করেন। জিতে নিলেন স্কলারশিপ। তারপর ফেলোশিপ নিয়ে ১৮৮৩-তে 'Master of Arts' ডিগ্রি।
লেখাপড়ার এমন কঠিন অথচ সফল পরিসমাপ্তির পর ১৮৮৪-এর ১২-ই জুন তিনি লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটির সভ্য নির্বাচিত হলেন। ঐ বছরই পদার্থবিজ্ঞানে ক্যাভেনডিস প্রফেসরের পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন নোবেলজয়ী খ্যাতনামা অধ্যাপক লর্ড র্যালে (Lord Rayleigh)। গ্রেট ব্রিটেনে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির ক্যাভেনডিস ল্যাবরেটরিতে ফলিত গবেষণার জন্য ফিজিক্স প্রফেসরের পদটি অত্যন্ত সম্মানীয় গণ্য করা হয়। স্বাভাবিক ভাবেই ঐ সম্মানীত পদ পূরণ করার জন্য উপযুক্ত অধ্যাপকের সন্ধান করে কর্তৃপক্ষ।
তার জন্য গঠন করা হয় একটি নির্বাচন কমিটি। কমিটিতে বিদায়ী অধ্যাপক লর্ড র্যালেও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তিনিই পরবর্তী ক্যাভেনডিস প্রফেসর পদের জন্য ২৮ বছরের যুবক টমসনের নাম সুপারিশ করেন এবং কমিটির সব সদস্য তাতেই সিলমোহর দিয়ে দেন। ২২-শে ডিসেম্বর, ১৮৮৪ সালে ক্যাভেনডিসে এলেন টমসন। কিন্তু তাঁর এই নির্বাচন যতটা না আকষ্মিক, তার থেকে বেশি বিস্ময়কর। অভূতপূর্বও বটে। কারণ তিনি একজন গণিতবিদ। অথচ ক্যাভেনডিসে ব্যবহারিক পদার্থবিজ্ঞানী হিসাবে তিনি নির্বাচিত। সে-সময় ওসবর্ন রেনল্ডস বা রিচার্ড গ্লেজব্রুক-এর মতো খ্যাতিমান পদার্থবিজ্ঞানী কিন্তু সিলেকশন কমিটির সুনজরে থাকা সত্ত্বেও।
কথায় আছে, রতনে রতন চেনে। তাই বিজ্ঞানী র্যালে-র জহুরী চোখ ঠিক মানুষের সন্ধান করেছে। এই ক্যাভেনডিসে থাকাকালীন গণিত এবং ফলিত পদার্থবিজ্ঞানে টমসনের একের পর এক যুগান্তকারী আবিষ্কার তথাকথিত বিশুদ্ধ পদার্থবিদদের বিস্মিত ও আকৃষ্ট করে। তিনি অসংখ্য জমকালো এক্সপেরিমেন্টের নকশা তৈরি করেন।
১৮৯০ সালের ২২-শে জানুয়ারি ক্যাভেনডিসে নিজের গবেষক ছাত্রী কুমারী রোজ প্যাগেট-এর সঙ্গে শুভ পরিণয় বন্ধনে আবদ্ধ হন টমসন। তাঁদের এক ছেলে এবং এক মেয়ে। জর্জ প্যাগেট টমসন ও জন প্যাগেট টমসন। তাঁর আদুরে কন্যা জন প্যাগেট প্রায়শই বাবার সঙ্গে ঘুরতে যেত।
তাঁর আবিষ্কারের জন্য দীর্ঘ সময় ধরে (১৮০৮ থেকে ১৮৯৭) মৌলিক পদার্থের পরমাণুর 'অভঙ্গুর' থাকার মিথ ভেঙে যায়। দুর্দান্তভাবে পরিকল্পিত তাঁর নিজের তৈরি ক্যাথোড রশ্মি নলের সাহায্যে ইলেকট্রনের অস্তিত্ব প্রমাণ করলেন তিনি। তার ফলে পরমাণু ভেঙে তার অভ্যন্তরে ঢুকে পরমাণুর নাড়ির কথা প্রথম জানতে পারল বিশ্বের মানুষ। শুরু হল পদার্থবিজ্ঞানের নতুন শাখা: সাব-অ্যাটমিক ফিজিক্স তথা কণাবাদী বলবিদ্যা। সেই কণা-বিজ্ঞানের প্রথম আবিষ্কৃত কণিকার স্বীকৃতি পেল ইলেকট্রন। আর এ হেন আবিষ্কারের জন্য প্রফেসর জে. জে. টমসন পেলেন পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার, ১৯০৬ সালে। তিনি ১৯১৩ সালে অতেজস্ক্রিয় স্থায়ী মৌলের আইসোটোপ বা সমস্থানিকের সত্যতা সর্বপ্রথম প্রমাণ করেন। ভর পার্থক্যের জন্য নিয়ন-২০ এবং নিয়ন-২২ আইসোটোপ দুটির পৃথকীকরণ হল Mass Spectrometry-এর প্রথম উদাহরণ। পরে Mass Spectrometer যন্ত্র উদ্ভাবনে বিশেষ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন।
মৃত্যু:
১৯৪০ সালের ৩০ আগস্ট তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবে-তে আইজাক নিউটন ও প্রিয় ছাত্র আর্নেস্ট রাদারফোর্ড-এর পাশে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়।