জাঁ জ্যাক রুশো এর জীবনী | Biography of jJean-Jacques Rousseau
জাঁ জ্যাক রুশো এর জীবনী | Biography of jJean-Jacques Rousseau

সহজ কথায় রুশো ও তার সমাজতত্ত্ব
জঁ-জাক রুসো বা রুশো:
(ফরাসি: Jean-Jacques Rousseau, উচ্চারণ: [ʒɑ̃ ʒak ʁuso]; ২৮ জুন ১৭১২ – ২ জুলাই ১৭৭৮) ছিলেন একজন জেনেভান দার্শনিক, লেখক ও সুরকার। তাঁর রাজনৈতিক দর্শন সমগ্র ইউরোপ জুড়ে আলোকায়নের অগ্রগতির পাশাপাশি ফরাসি বিপ্লবের নানা দিক এবং আধুনিক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও শিক্ষাগত চিন্তাধারার বিকাশকে প্রভাবিত করেছিল। জন্মসূত্রে সুইজারল্যান্ডের অধিবাসী হলেও রুশো ছিলেন ফরাসি জ্ঞানালোক আন্দোলনের অন্যতম প্রতিনিধি এবং ইউরোপের প্রগতিবাদী ও গণতান্ত্রিক সমাজচেতনার প্রধান পৃষ্ঠপোষক। তিনি আত্মজৈবনিক রচনাশৈলীতে আধুনিক ধারার সূত্রপাত করেন এবং তার লেখনীতে মন্ময়ী (subjective) চেতনার বিকাশের প্রভাব হেগেল ও ফ্রয়েডসহ অনুবর্তী অনেক চিন্তাবিদের মাঝেই সুস্পষ্ট। তার রচিত উপন্যাসগুলি ছিল একদিকে অষ্টাদশ শতকের জনপ্রিয় বেস্টসেলার এবং একই সাথে সাহিত্যে রোমান্টিকতাবাদের অন্যতম উৎস। তাত্ত্বিক ও সুরকার হিসাবে পাশ্চাত্য সঙ্গীতেও তার অসামান্য অবদান রয়েছে।
জীবন
১৭১২ সালে জেনেভাপ্রবাসী প্রোটেস্ট্যান্ট মতানুসারী এক ফরাসি পরিবারে রুসোর জন্ম হয়। জন্মকালেই মাতৃহারা এবং দশ বছর বয়সে পিতা-পরিত্যক্ত রুসো আত্মীয়স্বজনের কাছে প্রতিপালিত হন। আত্মীয়রা পারিবারিক ঘড়ির ব্যাবসায় তাকে কাজে লাগাতে চাইলে ১৬ বছর বয়সে রুসো বাড়ি থেকে পালিয়ে যান এবং ভবঘুরের মতো বিভিন্ন স্থানে বিচিত্র পেশায় জীবিকা উপার্জন করেন। ১৭২৮ সালের দিকে মাদাম দ্য ওয়ারেনের সংস্পর্শে আসেন, পরবর্তীকালে যাঁর সাথে রুসোর প্রণয় সম্পর্কও গড়ে ওঠে। তিনি ভদ্রমহিলার অনুপ্রেরণায় ক্যাথলিক ধর্মে দীক্ষিত হন।
নয়-দশ বছর তার কাছেই ছিলেন রুসো। তাদের মধ্যে একপর্যায়ে মনোমালিন্য হলে রুশো লিয়োঁ শহরে চলে যান ও সেখানে গৃহশিক্ষক হিসাবে কিছুদিন কাজ করেন। ১৭৪২ সালে প্যারিসে নিবাস গড়েন। প্রথম দিকে স্বরলিপি নকল করে উপার্জনের চেষ্টা করেন। এরপর মাদাম দুপাঁ নামের জনৈক অভিজাত মহিলার ব্যক্তিগত সহকারীর চাকরি লাভ করলে আর্থিকভাবে খানিকটা সচ্ছল হন। প্রতিভাবান রুশো অল্পদিনের মধ্যেই মারিভো (Marivaux), দিদেরো (Diderot), ফঁতনেল (Fontenelle) প্রমুখ নামককরা চিন্তাবিদের ঘনিষ্ঠতা অর্জনে সক্ষম হন।
দিদেরো তার বিশ্বকোষে লেখার সুযোগ করে দিলে লেখালেখির প্রথম স্বীকৃতি পান। ১৭৪৯ সালে দিজোঁ অ্যাকাডেমি "বিজ্ঞান ও শিল্পকলার অগ্রগতি কি নৈতিকতাকে দূষিত করছে, না পবিত্র করেছে?" শীর্ষক প্রতিযোগিতামূলক রচনা আহবান করে। রুসো নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টির পর তার নিবন্ধটি উপস্থাপন করেন। ১৭৫০ এ রচনাটিই প্রথম পুরস্কার জিতে নেয় এবং এরপর ভিন্ন মতাবলম্বী চিন্তাধারার লেখক হিসাবে রুশোর খ্যাতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। তবে প্যারিসের মার্জিত শহুরে অভিজ্ঞতা তার জন্য সুখকর ছিল না। সারল্য-আভিজাত্যের দ্বন্দ্ব, বঞ্চনা, ও ভাগ্যবিড়ম্বনা তাকে আরো স্পর্শকাতর, রুঢ়স্বভাবের এক খ্যাপাটে মানুষে পরিণত করে এবং তাকে সকল প্রচলিত রীতিনীতি ও প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী এবং শাসক ও সভ্যতার সমালোচক করে তোলে। ১৭৫৫ সালে রুসো রচনা করেন ‘মানব জাতির অসমতার উৎস’( Discourse on the Origin of Inequality) শীর্ষক আরেকটি নিবন্ধ, এ জন্য পুরস্কৃত না হলেও মুখবন্ধে দিজোঁ একাডেমির নাম উদ্যোক্তা হিসাবে উল্লেখ করা আছে।
লেখাটি রুশো তার জন্মস্থান জেনেভা প্রজাতন্ত্রকে উৎসর্গ করেন। প্যারিসের কৃত্রিমতায় অচিরেই তার অনাসক্তি ধরে যায়, ফলশ্রুতিতে শহর ছেড়ে অপেক্ষাকৃত গ্রামাঞ্চলের দিকে বসবাস শুরু করেন। এখানে থাকা অবস্থায়ই তার লেখা রোমান্টিক ধারার বিখ্যাত উপন্যাস Julie, ou la nouvelle Héloïse (১৭৬০) প্রকাশিত হলে নাগরিক জীবনে বীতশ্রদ্ধ এ গ্রন্থাকারের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপ জুড়ে। আমস্টার্ডাম থেকে প্রকাশিত হয় কালজয়ী রাষ্ট্রদর্শন সামাজিক চুক্তি Du Contrat Social, Principes du droit politique (১৭৬২), এবং শিক্ষাদর্শন এমিল Émile (১৭৬২) । গ্রন্থদ্বয় প্রকাশিত হলে রুশো একই সাথে গির্জা ও রাজতন্ত্রের রোষানলে পড়েন। ফরাসি আইনসভা এমিল বইটি পোড়ানোর ও রুসোকে গ্রেফতারের আদেশ দেয়। হল্যান্ড ও সুইজারল্যান্ডেও নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় গ্রন্থটি। ১৭৬৬ সালের দিকে রুশো ইংল্যান্ডে আশ্রয় নেন। দার্শনিক ডেভিড হিউম বন্ধুত্বের সুবাদে তাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করলেও বিতাড়িত পলাতক জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা রুশোকে সন্দেহবাতিক মানুষে পরিণত করে।
তার ধারণা জন্মে যে ইংরেজ সরকার তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছে এবং হিউমের সাথে তার মতান্তর ঘটে। ১৭৭০ সালে প্যারিসে ফেরত আসেন এবং আবার স্বরলিপি রচনায় আত্মনিবেশ করেন। তার স্বরলিপির প্রণালী ছিল স্বউদ্ভাবিত, ব্যাতিক্রমী ধরনের। তিনি লেখা শুরু করেন বিখ্যাত আত্মজীবনী। জঁ জাক রুসোর বিখ্যাত উক্তি- ইংরেজি "Voice of the people is the voice of god." "Each from may be peculiarly adapted to some particular sets of conditions." "Man is born free but everywhere he is in chain."-Jean Jacques Rousseau.জীবনের শেষদিকে সন্দেহপ্রবণতা মানসিক বিকারের পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। সকলেই তাকে অপমানিত ও হেয় প্রতিপন্ন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত এ ধারণা ক্রমেই রুশোর মাঝে বদ্ধমূল হতে থাকে এবং বন্ধুপ্রতিম দিদেরো, হিউম, গ্রিম প্রমুখ সকলকেই শত্রু ভাবতে শুরু করেন।
মানুষ ও সভ্যতা
রুসোর মতে, প্রকৃতি মানুষকে যেভাবে ও যে উদ্দেশ্যে গড়ে, সমাজের দোষে তা ব্যর্থ হয়ে যায়। ললিতকলা ও বিজ্ঞানের বেদীমূলে সৃষ্ট সভ্যতার উপর তার কোন আস্থা ছিল না। মানব উৎকর্ষর সাথে শিল্পকলা ও বিজ্ঞানের বিকাশ সম্পর্কিত রেনেসাঁস ও আলোকময়তা মতবাদের সাথে সম্পূর্ণ দ্বিমত পোষণ করে রুসো বলেন:
সমাজ ও সমাজের বিলাসিতা থেকেই জন্ম নেয় মানববিদ্যা, প্রযুক্তি, ব্যবসাবাণিজ্য, পাণ্ডিত্য এবং সেই সব বাহুল্য যা শিল্পের বিকাশ ঘটায় কিন্তু একই সাথে সমাজকে সমৃদ্ধ ও ধ্বংস করে...বিখ্যাত জাতিসমূহের প্রাচুর্য তাদেরকে যে ক্লেদাক্ত দুঃখ-দুর্দশার দিকে ঠেলে দেয় এই হচ্ছে তার কারণ। একদিকে শিল্প ও মানববিদ্যা যতই উন্নতি লাভ করে, অন্যদিকে করের বোঝায় জর্জরিত শ্রমে-ক্ষুধায় কাতর অনাদৃত কৃষক ততই রুজির সন্ধানে শহরমুখী হয়। আমাদের নগরগুলি যতই দৃষ্টিনন্দন হয় ততই গ্রামাঞ্চল বিরান হতে থাকে। অনাবাদী জমির পরিমাণ বাড়ে। নাগরিক হয় ভিখারি বা ডাকাত, আর ওদের জীবনের ইতি হয় ফাঁসির মঞ্চে বা আবর্জনাস্তুপে। এভাবে রাষ্ট্র একদিকে ফুলেফেঁপে ধনী হয়, অন্যদিকে হয় জনশূন্য বিরান। প্রবল প্রতাপ, সাম্রাজ্য এভাবে অক্লান্ত পরিশ্রমে গড়ে তোলে সমৃদ্ধির সৌধ আর ডেকে আনে জনজীবনে অবলুপ্তি।
রুসো "আদি পাপে" (Original sin) বিশ্বাস করতেন না। তার মতে মানুষের দুর্দশা ও দুর্বলতার কারণ আদি পাপ নয়, বরং এটা হয়েছে তার আপন প্রকৃতির সাথে পরিবেশের দ্বন্দ্ব এবং অসঙ্গতির ফলে। মানুষ জন্মসূত্রে যে সম্ভাবনা নিয়ে আসে, তা অর্জনের প্রয়াস থেকেই তার মাঝে দেখা দেয় চাহিদা ও উচ্চাকাঙ্খা। অন্তহীন সে চাহিদা পূরণে অন্যের সাথে সে নিরন্তর সংগ্রামে লিপ্ত হয়। সমকালীন সমাজ কাঠামো ব্যক্তির বিকাশের পথে অন্তরায়, যা মানুষকে মানুষের মুখোমুখি করে দেয়, তাকে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হতে বাধ্য করে। আদিম মানুষ ছিল স্বাচ্ছন্দ্য, সুখী ও আত্মসমাহিত। সঞ্চিত রাখার মতো সম্পদ ছিল না বলেই আদিম মানুষের মাঝে কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না।
শিক্ষা
রুসো তার শিক্ষাদর্শন গল্পের ঢঙে এমিল বইটিতে বিবৃত করেছেন। বইটিতে এমিল নামের একটি বালকের বেড়ে ওঠার ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। রুসো তাকে শহরের বাইরে গ্রামাঞ্চলে নিয়ে যান, যে শহরে মানুষ শুধু কায়-মনে খারাপ অভ্যাসগুলিই আয়ত্তে আনে। কেননা তার মতে শিক্ষার উদ্দেশ্যই হল নিষ্ঠাবানরূপে বাঁচতে শেখা। শিশুর বিকাশ রুসো তিন ভাগে বিভক্ত করেছেন। বারো বছর পর্যন্ত ১ম ভাগ, যে সময়ে তার মাঝে বিশ্লেষণাত্মক জটিল চিন্তাকাঠামো গড়ে ওঠেনি, শিশু তখন অনেকটা পশুতুল্য। বারো থেকে ষোল পর্যন্ত ২য় ভাগ, যখন তার মাঝে যৌক্তিকতার বিকাশ হয়। ষোল-পরবর্তী সামনের দিকে শেষ ভাগ যখন সে সাবালকত্ব লাভ করে।
ফরাসি বিপ্লবে অবদান
রুশোকে ফরাসি বিপ্লবের মূল কারিগর মনে করা হয়। তিনি তার লেখনীর মাধ্যমে ফরাসি বিপ্লবের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ জাগ্রত করতে সক্ষম হন।তিনিই প্রথম উল্লেখ করেন, "মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন, কিন্তু সমাজ তাকে শৃঙ্খলিত করে। (Man is born free but everywhere he is in chains)" তিনি উল্লেখ করেন পূর্বে মানুষ প্রকৃতির রাজ্যে স্বাধীন ছিল। কিন্তু ব্যক্তিমালিকানার ধারণা সৃষ্টি হলে সমাজে বৈষম্য সৃষ্টি হয়। এর ফলে প্রতারণা ও অতৃপ্ত বাসনা মানুষের জীবনের নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করে। তাই মানুষ ব্যক্তিগত ইচ্ছাকে সামষ্টিক ইচ্ছার কাছে সর্মপন করে। এভাবেই রাষ্টের সৃষ্টি। তাই জনতার অধিকার রয়েছে বিপ্লবের দ্বারা রাজতন্ত্রের পতন ঘটাবার। "লা কস্তা সোসিয়াল" গ্রন্থে উল্লেখিত এই বাণী ফরাসি জনগণকে বিপ্লবে অনুপ্রাণিত করে। তাই রুশোকে ফরাসি বিপ্লবের মূল প্রবক্তা বলা হয়।
রচনাবলি
রুসো বিভিন্ন বিষয়ে লিখেছেন। এগুলির মধ্যে আছে উপন্যাস, নাটক, রাষ্ট্রনীতি, সমাজনীতি, শিক্ষা, সংগীত, উদ্ভিদবিদ্যা প্রভৃতি বিষয়ক গ্রন্থ।
- Julie, ou la nouvelle Héloïse (১৭৬০)
- Le Devin du Village (১৭৫২)
- Émile ou de l'éducation (১৭৬২)
- Du contrat social (১৭৬২)
- Les Confessions (১৭৭০)
রোম্যান্টিক’ বিদ্রোহ
তখন মোটামুটি ইউরোপে নতুন চিন্তাভাবনার জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। মানুষ বুঝতে পারছে, মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে পদার্পণে এখন দরকার নতুন ধরনের জ্ঞান-বিজ্ঞান, শাণিত বুদ্ধি, এবং পরিপক্ক প্রজ্ঞা। এসবের পক্ষে বক্তব্য রাখছেন বিভিন্ন মনীষী। রুশো তাদের সমসাময়িক, যোগাযোগও রাখছেন তাদের সাথে। তবুও রুশোর চিন্তাভাবনা কিছুটা ব্যতিক্রমী, প্রাচীনপন্থীও বলে কেউ কেউ। অনেকে বলে রোম্যান্টিক।
রুশোর উত্থান মূলত একটা প্রবন্ধের মাধ্যমে। বিজ্ঞান ও শিল্পকলার অগ্রগতি নৈতিকতাকে পবিত্র নাকি কলুষিত করছে, তা-ই ছিল প্রবন্ধের মূল বিষয়। প্রবন্ধে রুশো বিস্তারিত মত প্রকাশ করেন যে প্রকৃতপক্ষে জ্ঞান-বিজ্ঞান-কলা যত অগ্রগতি হচ্ছে, মানুষ নৈতিকভাবে তত দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। প্রকৃতির সন্তান হিসেবে মানুষের যে স্বাভাবিক স্বাধীনতা ও সুযোগ সুবিধা থাকার কথা, জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রসরে মানুষ তা ক্রমে হারাচ্ছে। অর্থাৎ তৎকালীন প্রচলিত জ্ঞান-বিজ্ঞান-কলার অগ্রগতির জোয়ারে গা না ভাসিয়ে রুশো প্রাচীনপন্থী রোম্যান্টিক চিন্তাভাবনা প্রকাশ করেন। বলাই বাহুল্য, প্রবন্ধটি প্রথম পুরস্কার জিতে নেয়, প্রভাবশালী চিন্তাবিদ হিসেবে আবির্ভাব হয় রুশোর।
ইউরোপে তখন যুক্তিবাদীরা অগ্রগণ্য। আধুনিক সমাজকে বুদ্ধি, বিজ্ঞান, ও প্রজ্ঞা কীভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে, সেটাই বোঝাচ্ছিলেন তারা। বিস্ময়করভাবে এ যুগের মানুষ হয়েও রুশো ভিন্নমত ধারণ করতেন। তিনি এসবের চাইতেও সভ্যতার মূল ভিত্তি হিসেবে ‘মোরাল ইনট্যুইশন’কে (শ্রদ্ধা, বিশ্বাস, নৈতিকতা) বেশি গুরুত্ব দিতেন। রুশো বলতেন বুদ্ধি হলো ভয়ঙ্কর কারণ তা শ্রদ্ধাকে বিনষ্ট করে, বিজ্ঞান হলো ধ্বংসাত্মক কারণ তা বিশ্বাসের বিপরীত, প্রজ্ঞাও খারাপ কারণ তা নৈতিকতাকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়। রুশো রাষ্ট্রদর্শনে নৈতিক অনুভূতিকে মহৎ করে দেখান।
তৎকালীন যুক্তিবাদের জোয়ারে রুশোর এ ধরনের দর্শন কিঞ্চিত উচ্চবিলাসী ছিল। তাকে বলা হতো অযুক্তিবাদী (Irrationalism), বলা হতো যুক্তির বিপরীত রোম্যান্টিক প্রতিক্রিয়া (Romantic Reaction)। ব্যক্তিজীবনেও তার এই ধ্যানধারণার ছবি দেখা যেতে লাগল। প্যারিসের জাঁকজমক জীবন ছেড়ে তিনি কিছুটা গ্রামাঞ্চল এলাকায় বসবাস করতে লাগলেন। রুশো মনে করতেন, আমরা যে নগরজীবন গড়ে তুলছি, সেটা এক বিরাট বন্দিশালা। একদিকে বিরাট অট্টালিকা, আরেক দিকে জীর্ণ কুটির। সমতা ও স্বাধীনতার বালাই নেই এখানে। তার চেয়ে গ্রাম অপেক্ষাকৃত সরল। রাজতন্ত্র ও সামন্তবাদের বিপক্ষে বলতে শুরু করলেন তিনি। অধিকার হরণকারী এসব প্রতিষ্ঠানের কোনোরকম সংস্কার নয়, বরং সমূলে উচ্ছেদ চেয়েছিলেন। সব মানুষের কাছে স্বাধীনতা পৌঁছে দেয়াই ছিল তার মূল বক্তব্য।
সামাজিক চুক্তি
১৭৬২ সালে প্রকাশিত হয় The Social Contract, সমাজবিজ্ঞানের ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বই। এই বইয়ে রুশো প্রকৃতির রাজ্য, আধুনিক সিভিল সোসাইটিতে উত্তরণ, সমস্যা, সমাধান, কাঠামো ইত্যাদি বর্ণনা করেছেন।
রুশোর আদর্শ প্রকৃতির রাজ্যে সুখ শান্তি বেশিদিন থাকেনি। জ্ঞান-বিজ্ঞান-শিল্পকলার প্রসারে প্রকৃতির রাজ্যে বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হতে লাগল। বিশেষ করে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে ব্যক্তিগত সম্পত্তি অর্জনের প্রবণতা মাত্রাধিক বৃদ্ধি পায়। ফলে এক ধরনের টানাপোড়েন ও বিশৃঙ্খলা দেখা যেতে শুরু করল। ক্ষীণ হতে শুরু করল সাম্য ও স্বাধীনতা। এমন অবস্থায় সংগঠন, চুক্তি, আইন প্রণয়নের মতো বিষয়গুলো মানুষ ভাবতে শুরু করল। রুশোর মতে,
“The problems is to find a form of association which will defend and protect with whole common force the person and goods of each association.”
উদ্ভূত সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য মানুষ নিজেদের মধ্যে এক ধরনের সামাজিক চুক্তির বন্ধনে যুক্ত হয়, গড়ে তোলে সম্মিলিত জীবনব্যবস্থা। এই সম্মিলিত জীবনব্যবস্থাটা নিজেই স্বতন্ত্র। এই ব্যবস্থা কারো সাম্য ও স্বাধীনতা নষ্ট করবে না, বরং সবার সাম্য ও স্বাধীনতা রক্ষা করতে নৈতিক ও যৌথ সংস্থা হিসেবে কাজ করবে। এই সংস্থাকে রিপাবলিক হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে।
সাধারণ ইচ্ছা
এখন পর্যন্ত আমরা আছি এই অবস্থায় যে – প্রকৃতির রাজ্য থেকে সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে মানুষ একটা আনুষ্ঠানিক কাঠামোয় আসল। এখন এই সমাজে সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত কিভাবে নেয়া হবে? কীভাবে রক্ষা হবে সাম্য ও স্বাধীনতা? এই প্রশ্নে রুশো সামনে আনলেন সাধারণ ইচ্ছা তত্ত্ব।
সাধারণ ইচ্ছার উদ্ভব সামাজিক চুক্তির মাধ্যমেই। সাধারণ ইচ্ছা দ্বারা রুশো বুঝিয়েছেন সমাজের প্রত্যেক সদস্যের সামষ্টিক কল্যাণের ইচ্ছাকে। এটা একা বা কয়েকজনের ইচ্ছা নয়, এমনকি শুধু সবার ইচ্ছাও নয়, বরং সবার সেই ইচ্ছা যা নৈতিকভাবে সঠিক এবং যা দ্বারা সবার কল্যাণ ও মঙ্গল বয়ে আসবে। বিষয়টি সহজভাবে বর্ণনা করার জন্য রুশো ‘সকলের ইচ্ছা’র সাথে ‘সাধারণ ইচ্ছা’র কিছু পার্থক্য দেখিয়েছেন। তিনি বলেছেন যে ‘সকলের ইচ্ছা’ হচ্ছে সেই ইচ্ছা যা কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সংগঠন বা সংখ্যাগরিষ্ঠের উদ্দেশ্য সার্ভ করে। অন্যদিকে, সাধারণ ইচ্ছা সকল নাগরিকের কল্যাণের উদ্দেশ্য সার্ভ করে। পরিচ্ছন্ন সংজ্ঞা ও রাষ্ট্রের ভূমিকা নির্ধারণে অ্যাবস্ট্রাক্টনেসের কারণে রুশোর সাধারণ ইচ্ছা তত্ত্বের সমালোচনা করা হয়। আসলে নৈতিকতার প্রতি রুশোর দুর্বলতা ছিলো, সাধারণ ইচ্ছা দ্বারা সমাজ ও রাষ্ট্রে রুশো নৈতিকতাকেই আরোপ করেছেন।
সার্বভৌমত্ব
সার্বভৌমত্বের ধারণা রুশোর মৌলিক নয়, রুশোর আগেও অনেকেই সার্বভৌমত্বের কথা বলে গেছেন; বিশেষ করে হবস চরমতন্ত্র (Absolutism) এবং লক জনসার্বভৌমত্বের (Popular Sovereignty) ধারণা দিয়ে গেছেন। রুশো তাদের থেকে একটু ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখেছেন। রুশোর সার্বভৌমত্ব এসেছে সামাজিক চুক্তি ও সাধারণ ইচ্ছার ধারাবাহিকতায়। হবস ও লক যেখানে সরকারের সাথে সার্বভৌমত্বের সম্পর্ক দেখিয়েছেন, রুশো সেখানে সরকারকে উপেক্ষা করে সার্বভৌমত্বকে এককভাবে জনসাধারণের সাধারণ ইচ্ছার কাছে ন্যস্ত করেছেন। রুশো বলেছেন, সার্বভৌম ক্ষমতা কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা সরকারের হাতে নয়, বরং সরাসরি জনগণের সাধারণ ইচ্ছার কাছে ন্যস্ত থাকে। সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে মানুষ একটা আইনগত কাঠামোতে নিজেদের অধিকার অর্পণ করবে। যে ক্ষমতার কাছে অর্পণ করবে, সেটাই হচ্ছে সার্বভৌম ক্ষমতা। এই ক্ষমতা ব্যক্তিবিশেষের নয়, বরং পরস্পরের। সার্বভৌম ক্ষমতাকে রুশো একক, অবিভাজ্য, স্থায়ী এবং অসীম বলে বর্ণনা করেছেন।
ফরাসি বিপ্লব
“I prefer liberty with danger than peace with slavery.”
রুশোর মৃত্যু হয় ১৭৭৮ সালে। এর আশেপাশে কয়েক বছরের মধ্যেই মানুষের ইতিহাসে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে যায়। ১৭৭৬ সালে আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষণা এবং ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লব। দু’টি ঘটনাতেই জ্যঁ রুশোর অবদান ছিলো। রুশো ছিলেন মানবতাবাদী, তিনি রাজতন্ত্র ও সামন্তবাদের বিরোধী ছিলেন। শুধু সংস্কার নয়, বরং পুরো ব্যবস্থাটাই সমূলে উৎপাটনের কথা বলেছেন তিনি। বিভিন্ন লেখা ও বক্তব্যে প্রচার করেছেন নিজের বক্তব্য, ‘মানুষের কথাই ঈশ্বরের কথা’। তিনি বলেছেন, এইসব স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে জনগণের শাসন আনতে হবে যার ভিত্তি হবে সাম্য ও স্বাধীনতা। যে সমাজে সাম্য ও স্বাধীনতা নাই সে সমাজে মানুষ নিজেই নিজেকে বন্দি করে রাখে শিকলে।
তিনি তার গ্রন্থে প্রগতিশীল শিক্ষা ব্যবস্থার কথা বলেছেন। ফলে শাসকগোষ্ঠী তার উপর ছিল খ্যাপা। ১৭৬২ সালে তার The Emile প্রকাশিত হলে বইটাকে ফ্রান্সে পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দেয়া হয়। কয়েক বছর পর ফ্রান্স থেকে বিতারিত করা হয় রুশোকে। এমনকি ইউরোপের আরো কয়েকটা দেশে নিষিদ্ধ হন, শেষ পর্যন্ত আশ্রয় নেন ইংল্যান্ডে। শেষ বয়সে ভালো সময় কাটেনি তার। কিন্তু তার সাম্যের দর্শনেই বিল্পব হলো, পালটে গেল দুনিয়া। তার দর্শনকে সামনে রেখেই ফ্রান্সের মানুষ অধিকারের প্রশ্নে একত্রিত হলো। বিপ্লবের আগুন জ্বলল দুর্গে দুর্গে।
জ্যাঁ জ্যাক রুশো কত সালে মৃত্যুবরণ করেন
৫ বছর পর তাকে ফ্রান্সের জাতীয় বীরের মর্যাদা প্রদান করা হয়। : ফরাসি বিপ্লবের ১ বছর পূর্বে অর্থাৎ ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে এই মহান দার্শনিক মারা যান। তার মরদেহ স্থানান্তর করে জাতীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়। পরিশেষে বলা যায় যে, অন্য যেকোনো দার্শনিকের চেয়ে রুশোর জীবন ছিল নানা ঘটনায় পরিপূর্ণ।
What's Your Reaction?






