সুফিয়া কামাল জীবনী | Biography of Sufia Kamal

সুফিয়া কামাল জীবনী | | Biography of Sufia Kamal

May 12, 2025 - 11:00
May 13, 2025 - 01:16
 0  1
সুফিয়া কামাল জীবনী | Biography of Sufia Kamal

সুফিয়া কামাল

নারী জাগরণের কবি ও নেত্রী। ১৯১১ জন্ম: ২০ জুন মঙ্গলবার বেলা ৩টা,জন্মস্থান: রাহাত মঞ্জিল, শায়েস্তাবাদ,বরিশাল। পৈত্রিক নিবাস। শিলাউর, কুমিল্লা।পিতা: সৈয়দ আবদুর রাব্বী, মাতা: সৈয়দা সাবেরা খাতুন। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে ইসমে আজম করতে গিয়ে সুফি মতাবলম্বী পিতা সৈয়দ আবদুল বারী’র চিরতরে গৃহ ত্যাগ। ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে কোলকাতায় রোকেয়ার সাথে প্রথম সাক্ষাৎ। ১৯২৩ খ্রি. মামাতো ভাই সৈয়দ নেহাল হোসেনের সাথে বিয়ে। শায়েস্তাবাদ থেকে বরিশাল শহরে গমন। বরিশাল থেকে প্রকাশিত ‘তরুণ’ পত্রিকায় সুফিয়া এন. হোসেন নামে প্রথম লেখা ‘সৈনিক বধূ’ (গল্প) প্রকাশ। কবি কামিনী রায়ের বরিশাল আগমন, সুফিয়া এন. হোসেনের বাসায় এসে লেখার জন্য উৎসাহ প্রদান। ১৯২৫ খ্রি. বরিশাল মাতৃমঙ্গলের একমাত্র মুসলিম সদস্যা হিসেবে সামাজিক কর্মকাণ্ডেআত্মনিয়োগ। গান্ধীজীর বরিশাল আগমন, নিজ হাতে চরকায় সুতা কেটে প্রকাশ্য জনসভায় গান্ধীজীর হাতে অৰ্পণ ।


১৯২৬ খ্রি. ‘সওগাত’ পত্রিকায় প্রথম লেখা (কবিতা-‘বাসন্তী) প্রকাশ। প্রথম কন্যা সন্তান আমেনা খাতুন দুলুর জন্ম ।
১৯৩০ খ্রি. ‘সওগাত’ এর প্রথম মহিলা সংখ্যায় ছবিসহ লেখা প্রকাশ ।
১৯৩১ খ্রি. ইন্ডিয়ান উইমেন্স ফেডারেশনের প্রথম মুসলিম মহিলা সদস্য মনোনীত।
১৯৩২ খ্রি. স্বামী সৈয়দ নেহাল হোসেনের অকাল মৃত্যু।
১৯৩৩ খ্রি. ‘কলিকাতা কর্পোরেশন স্কুল’-এ শিক্ষকতা শুরু (১৯৩৩-১৯৪১)।
১৯৩৭ খ্রি. প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘কেয়ার কাঁটা’ প্রকাশ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিনে একটি কবিতার মাধ্যমে তাঁকে শুভেচ্ছা জ্ঞাপনের পর আলমোড়া থেকে কবিতায় কবিগুরুর প্রত্যুত্তর লাভ ।


১৯৩৮ খ্রি. প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সাঁঝের মায়া’ প্রকাশ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ‘সাঁঝের মায়া’ গ্রন্থটি উপহার পাঠালে তাঁর কাছ থেকে আশীর্বাদপত্র লাভ। ১৯৩৯ খি, চট্টগ্রামের ১৯৪৬ কামাল উদ্দিন আহমেদ খানের সাথে বিবাহ। খ্রি. সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় কোলকাতায় লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে আশ্রয়কেন্দ্র পরিচালনা। এ সময় দাঙ্গা-বিরোধী কর্মকান্ডে শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে প্রথম পরিচয়। দাঙ্গার পর মোহাম্মদ মোদাব্বের, শিল্পী কামরুল হাসান, তাঁর ভাই হাছান জান ও অন্যান্য মুকুল ফৌজ কর্মীদের নিয়ে কংগ্রেস একজিবিউশন পার্কে (পার্ক সার্কাস) ‘রোকেয়া মেনেরিয়াল স্কুল’ নামে কিন্ডারগার্টেন পদ্ধতির স্কুল চালু।


১৯৪৭ খ্রি. দেশ বিভাগের পূর্বে বাংলা ভাষায় মুসলমানদের প্রথম সচিত্র সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘বেগম-এর প্রথম সম্পাদিকার দায়িত্ব গ্রহণ। দেশ বিভাগের পর স্বামীর সাথে ঢাকায় আগমন। ঢাকায় প্রখ্যাত মহিলা নেত্রী লীলা রায়,জুঁইফুল রায় ও আশালতা সেন-এর সঙ্গে পরিচয়। তাঁদের সাথে শাস্তি কমিটির কাজে যোগদান।


১৯৪৮ খ্রি. পূর্ব পাকিস্তান মহিলা সমিতির সভানেত্রী মনোনীত।
১৯৫১ খ্রি. ‘মায়া কাজল’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ। ‘ঢাকা শহর শিশুরক্ষা সমিতি’র সভানেত্রী নির্বাচিত।
১৯৫২ খ্রি. ভাষা আন্দোলনের সময় ঢাকায় মহিলাদের সংগঠিত করে মিছিলের আয়োজন। মিছিলে নেতৃত্বসহ সামগ্রিক আন্দোলনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ।পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনের কার্য-নির্বাহী কমিটির সহ সভানেত্রী নির্বাচিত।১৯৫৪ খ্রি. ‘ওয়ারী মহিলা সমিতি’র প্রতিষ্ঠা এবং এর প্রথম সভানেত্রী নির্বাচিত।১৯৫৬ খ্রি. দিল্লীতে সাহিত্য সম্মেলনে যোগদান। তাঁর বাসভবনের আঙ্গিনায় (তারাবাগের বাসা) অনুষ্ঠিত সভায় জাতীয় শিশু সংগঠন কেন্দ্রীয় কচি কাঁচার মেলা’র প্রতিষ্ঠা। ১৯৫৯ খ্রি. ‘বাফা’ (বুলবুল ললিতকলা একাডেমি) পুরস্কার লাভ ।১৯৬০ খ্রি. সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে ঢাকায় ‘বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত স্মৃতি কমিটি’ গঠন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রীনিবাসের নাম ‘রোকেয়া হল’ করার প্রস্তাব পেশ। রবীন্দ্র জন্ম শতবার্ষিকী উদযাপন কমিটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত।
১৯৬১ খ্রি. ‘ছায়ানট’ সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিষ্ঠা, এর সভানেত্রী নির্বাচিত।
পাকিস্তান সরকারের ‘তম্‌ঘা-ই ইমতিয়াজ’ পুরস্কার লাভ।
১৯৬২ খ্রি. কাব্য সাহিত্যে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ।
১৯৬৪ খ্রি. ‘বেগম ক্লাব’ পুরস্কার লাভ। ‘উদাত্ত পৃথিবী’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ।
১৯৬৫ খ্রি. ‘দীওয়ান’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ। মস্কোয় ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ উৎসবে যোগদানের উদ্দেশ্যে প্রথম সোভিয়েত ইউনিয়ন গমন। ‘সাঁঝের মায়া’র ২য় সংস্করণ প্রকাশ ।
১৯৬৭ খ্রি. ‘কেয়ার কাঁটা’র ২য় সংস্করণ প্রকাশ ।
১৯৬৮ খ্রি. ‘সোভিয়েটের দিনগুলি’ (ভ্রমণ কাহিনি) প্রকাশ ।
১৯৬৯, ১৯৭০খ্রি. ‘অভিযাত্রিক’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ। মহিলা সংগ্রাম কমিটি’র চেয়ারম্যান নির্বাচিত। আইয়ুব বিরোধী গণ-অভ্যুত্থানে ঢাকায় মহিলাদের সমাবেশে সভানেত্রীত্ব ও মিছিলে নেতৃত্ব দান। আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ ‘তম্ঘা-ই-ইমতিয়াজ’ প্রত্যাখান । খ্রি. সোভিয়েট ইউনিয়নের সম্মানসূচক ‘লেনিন পদক’ লাভ। ‘মহিলা পরিষদ’ গঠন ও সভানেত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ। ‘৭০-এর ঘূর্ণিঝড়ে দক্ষিণ বাংলায় রিলিফ বিতরণে নেতৃত্ব। ‘মৃত্তিকার ঘ্রাণ’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ। ‘সমাজ উন্নয়ন সংস্থা’র সভানেত্রী নির্বাচিত।


১৯৭১ খ্রি. মার্চ মাসে ঐতিহাসিক “অসহযোগ আন্দোলন’-এ ঢাকায় মহিলাদের সমাবেশ ও মিছিলে নেতৃত্ব দান। মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকার ধানমন্ডিস্থ নিজবাড়িতে অবস্থান করে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য-সহযোগিতা প্রদান। পাক হানাদার বাহিনীর ভয়ভীতি ও মানসিক নির্যাতন উপেক্ষা করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ। বড় মেয়ে দুলু’র স্বামী আব্দুল কাহ্হার চৌধুরীর মৃত্যু। পাকিস্তানের পক্ষে স্বাক্ষরদান প্রস্তাবের বিরোধিতা। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জনসভায় সভানেত্রীত্ব। একাত্তরের ডায়েরি পান্ডুলিপি প্রস্তুত। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম টেলিভিশন অনুষ্ঠানেরউদ্বোধন।১৯৭২ খ্রি. ‘মোর যাদুদের সমাধি পরে’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ। মহিলা পরিষদ-এর সভানেত্রী হিসেবে বুলগেরিয়া, পূর্ব জার্মানি ও সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর।দুঃস্থ পুনর্বাসন সংস্থা গঠন ও সভানেত্রীর দায়িত্ব পালন।
১৯৭৫ খ্রি. ‘আন্তর্জাতিক নারী দশক’ উপলক্ষে বাংলাদেশ জাতিসংঘ সমিতির ‘অনন্যা নারী’ পদক লাভ। বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকান্ডের পর স্বৈরাচার বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ‘মোর যাদুদের সমাধি ‘পরে’- কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদ ‘Where my darlings lie buried’ প্রকাশ ।


১৯৭৬ খ্রি. ‘স্বনির্বাচিত কবিতা সংকলন’ প্রকাশ। বাংলাদেশ সরকারের ‘একুশে পদক’ ও লেখিকা সংঘের ‘নুরুন্নেছা খাতুন বিদ্যাবিনোদিনী’ পুরস্কার লাভ ।
১৯৭৭ খ্রি. স্বামী কামাল উদ্দিন মাহমুদ খান-এর মৃত্যু। নাসির উদ্দিন স্বর্ণপদক ও শেরে বাংলা জাতীয় সাহিত্য পুরস্কার লাভ।
১৯৭৮ খ্রি. কুমিল্লা ফাউন্ডেশন পুরস্কার লাভ। পারিবারিক উদ্যোগে প্রথম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গমন।
১৯৮১ খ্রি. ‘নওল কিশোরের দরবারে’ কিশোর কবিতা গ্রন্থ প্রকাশ । চেকোশ্লোভাকিয়ার ‘সংগ্রামী নারী পুরস্কার’ ও ঢাকা লেডিস ক্লাব পুরস্কার লাভ ।
১৯৮২ খ্রি. রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মেলন পরিষদের সভানেত্রী নির্বাচিত। মুক্তধারা মহিলা পুরস্কার ও ফুলকলি (চট্টগ্রাম) শিশু পুরস্কার লাভ।
১৯৮৪ খ্রি. মস্কো থেকে ‘সাঁঝের মায়া’র রুশ সংস্কারণ ‘বলশেভনী মুমেরকী’ প্রকাশ ।
১৯৮৫ খ্রি. শহীদ নূতন চন্দ্র সিংহ স্মৃতি পদক (চট্টগ্রাম) ও কবিতালাপ (খুলনা) পুরস্কার লাভ।
১৯৮৬ খ্রি. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাব পুরস্কার লাভ।
১৯৮৮ খ্রি. বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভানেত্রী নির্বাচিত। রুনা স্মৃতি পুরস্কার (খুলনা) লাভ ।
‘একালে আমাদের কাল’ (স্মৃতিকথা) প্রকাশ। বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন ও বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব নিউ ইংল্যান্ড-এর আমন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্র গমন।১৯৮৯ খ্রি. ‘একাত্তরের ডায়েরি’ (স্মৃতিচারণ) প্রকাশ। বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন ও বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব নিউ ইংল্যান্ড-এর আমন্ত্রণে দ্বিতীয়বার যুক্তরাষ্ট্র গমন। জসীম উদ্দীন পদক (ফরিদপুর) লাভ। বাংলাদেশ সোসাইটিঅব নিউইয়র্ক-এর মেম্বার অব কংগ্রেস (যুক্তরাষ্ট্র) সনদ লাভ ।১৯৯০ খ্রি. ঐতিহাসিক স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে কার্ফু ভেঙ্গে প্রতিবাদী মৌন মিছিলে নেতৃত্ব দান।
১৯৯৩ খ্রি. কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসরের ৪০ বছর পূর্তিতে শহীদুল্লাহ কায়সার স্মৃতি পদক লাভ।
১৯৯৪ খ্রি. খ্রি. ত্রিভুজ পরিষদের ত্রিভুজ পুরস্কার লাভ। তৎকালীন সরকারের মন্ত্রীর
হাতে পুরস্কার গ্রহণে অস্বীকৃতি জানালে উদ্যোক্তারা তাঁর বাসভবনে গিয়ে পুরস্কার প্রদান করেন। জাহানারা ইমামের মৃত্যুতে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আহবায়িকা নির্বাচিত।
১৯৯৬ খ্রি. ফাদার অব দি নেশন পুরস্কার লাভ।
১৯৯৭ খ্রি. নারীমুক্তি আন্দোলনে অনন্যসাধারণ ভূমিকার জন্যে বাংলাদেশ সরকার প্রবর্তিত বেগম রোকেয়া স্বর্ণপদকে ভূষিত। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক তদীয় বাসভবনে গিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে পদক প্রদান।
১৯৯৮
খ্রি. বাংলাদেশ সরকারের সর্বোচ্চ সম্মানজনক পদক স্বাধীনতা পদকে ভূষিত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর বাসভবনে এসে আনুষ্ঠানিকভাবে এই পদক প্রদান করেন। জাতীয় পর্যায়ে নজরুল জন্মশত বার্ষিকী উদযাপন কমিটির সভাপতি নির্বাচিত। বন্যা দুর্গতদের সাহাযার্থে বেসরকারিভাবে গঠিত জাতীয় ত্রাণ কমিটির আহ্বায়ক মনোনীত (আগস্ট ৩১-১৯৯৮)।মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্যে বাংলাদেশস্থ রাশিয়ান কালচারাল সেন্টারের রজত জয়ন্তী সম্মাননায় ভূষিত [নভেম্বর, ১৯৯৮]।প্রখ্যাত এ মহিয়সী ২০০০ খ্রিস্টাব্দে ২০ নভেম্বর সাঁঝের মায়া কাটিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন

বেগম সুফিয়া কামাল

 বাংলাদেশের একজন প্রথিতযশা কবি, লেখিকা, নারীবাদী এবং আধুনিক বাংলাদেশের নারী প্রগতি আন্দোলনের পথপ্রদর্শক। তিনি ১৯১১ সালের ২০ জুন বরিশালের শায়েস্তাবাদে এক অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা সৈয়দ আবদুল বারি পেশায় ছিলেন উকিল। সুফিয়ার যখন সাত বছর বয়স, তখন তাঁর বাবা গৃহত্যাগ করেন।

নিরুদ্দেশ বাবার অনুপস্থিতিতে তিনি নানাবাড়িতে মা সৈয়দা সাবেরা খাতুনের স্নেহ-পরিচর্যায় বড় হন।

সুফিয়া কামাল তেমন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করেননি। তখনকার পারিবারিক ও সামাজিক প্রতিকূল পরিবেশে বাস করেও তিনি নিজ চেষ্টায় হয়ে ওঠেন স্বশিক্ষিত ও সুশিক্ষিত। ১৯২৩ সালে মামাতো ভাই সৈয়দ নেহাল হোসেনের সঙ্গে সুফিয়ার বিয়ে হয়।

বিয়ের পর তিনি সুফিয়া এন হোসেন নামে পরিচিত হন। সৈয়দ নেহাল হোসেন সুফিয়াকে সমাজসেবা ও সাহিত্যচর্চায় উৎসাহ দেন। সাহিত্য ও সাময়িক পত্রিকার সঙ্গে সুফিয়ার যোগাযোগও ঘটিয়ে দেন তিনি। ফলে তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
১৯২৩ সালে তিনি রচনা করেন তাঁর প্রথম গল্প সৈনিক বধূ, যা বরিশালের তরুণ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় এবং ১৯২৬ সালে তাঁর প্রথম কবিতা বাসন্তী প্রকাশিত হয়।

১৯৩২ সালে তাঁর স্বামী মারা যান। ১৯৩৯ সালে তিনি চট্টগ্রামের লেখক ও অনুবাদক কামালউদ্দীন আহমদের সঙ্গে পুনরায় পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। সেই থেকে তিনি ‘সুফিয়া কামাল’ নামে পরিচিত হন।

সুফিয়া কামাল অনেক ছোটগল্প এবং উপন্যাস রচনা করেছেন।

কেয়ার কাঁটা (১৯৩৭) তাঁর একটি উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থ। তাঁর আরো কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো—‘মায়া কাজল (১৯৫১), মন ও জীবন (১৯৫৭), উদাত্ত পৃথিবী (১৯৬৪), অভিযাত্রিক (১৯৬৯) ইত্যাদি।

সুফিয়া কামালের কবিতা চীনা, ইংরেজি, জার্মান, ইতালিয়ান, পোলিশ, রুশ, ভিয়েতনামিজ, হিন্দি ও উর্দু ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা বিশেরও বেশি।

সাহিত্যক্ষেত্রে বিশিষ্ট অবদানের জন্য সুফিয়া কামাল ‘বাংলা একাডেমি পুরস্কার’ (১৯৬২), ‘একুশে পদক’ (১৯৭৬), ‘বেগম রোকেয়া পদক’ (১৯৯৬), ‘দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ স্বর্ণপদক’ (১৯৯৬), ‘স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার’ (১৯৯৭) সহ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক পুরস্কারও লাভ করেন। ১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর ঢাকায় তাঁর জীবনাবসান ঘটে।

 ইন্দ্রজিৎ মণ্ডল

মহিলা কবি হিসেবে নয়, সুফিয়া কামাল নিজের অবস্থান নিয়েছেন বাংলা সাহিত্যের প্রধান সারির কবি হিসেবে। শুধু কবি হিসেবেও নয়, সমাজসেবক হিসেবেও অগ্রগামী। নারীমুক্তি আন্দোলন থেকে তার অবদান মুক্তবুদ্ধিচর্চা, মানবাধিকার পর্যন্ত বিস্তৃত। ভাষা-আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে স্বদেশের নানা প্রয়োজনে তিনি সোচ্চার থেকেছেন, প্রয়োজনে রাজপথে নেমেছেন অধিকার আদায়ের দাবিতে।
 
তার জীবনকাল

পরিব্যাপ্ত ছিল প্রায় ৯০ বছর। ১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর তিনি দেহত্যাগ করেন। দীর্ঘজীবনে তিনি কাছ থেকে দেখেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, কাজী মোতাহার হোসেন, কাজী আবদুল ওদুদ, মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন, বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, শেরে বাংলা, সোহারাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানীসহ গত শতাব্দীর প্রায় সব যুগপুরুষকেই। কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে তার পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। কাজী নজরুল ইসলাম তাকে বোন বানিয়েছিলেন। বেগম রোকেয়াও তাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। বঙ্গবন্ধু তাকে বড়বোনের মতো শ্রদ্ধা করতেন। দেশভাগোত্তর পূর্ববাংলার অনেক কবি, সাহিত্যিকই তার, স্নেহ-মমতা সান্নিধ্য পেয়েছেন। সব মিলিয়ে  কালের সাক্ষী সুফিয়া কামাল।

 ১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর সুফিয়া কামাল মৃত্যুবরণ করেন।

 

What's Your Reaction?

Like Like 0
Dislike Dislike 0
Love Love 0
Funny Funny 0
Angry Angry 0
Sad Sad 0
Wow Wow 0