অমিয় চক্রবর্তী জীবনী | Biography of Amiya Chakravarty

অমিয় চক্রবর্তী জীবনী | Biography of Amiya Chakravarty

May 12, 2025 - 00:04
May 12, 2025 - 01:55
 0  0
অমিয় চক্রবর্তী জীবনী | Biography of  Amiya Chakravarty
অমিয় চক্রবর্তী
জন্ম: এপ্রিল ১০, ১৯০১ - মৃত্যু: জুন ১২, ১৯৮৬) বাঙালি সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ।বিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যের অন্যতম ব্যক্তিত্ব। বাংলা আধুনিক কবিতার ইতিহাসে তিরিশের দশক এবং বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, জীবনানন্দ দাশ ও বিষ্ণু দে'র সঙ্গে কবি অমিয় চক্রবর্তীর নাম অবিনাশী বন্ধন ও সমসাময়িকতার বিস্ময়ে জড়িয়ে আছে। শীর্ষস্থানীয় আধুনিক কবি এবং সৃজনশীল গদ্যশিল্পী অমিয় চক্রবর্তী শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে ডি.ফিল. ডিগ্রি লাভ করেন। অমিয় চক্রবর্তী ১৯৪৮ থেকে ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত হাওয়ার্ড, বস্টন প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক প্রাচ্য ধর্ম ও সাহিত্য বিষয়ে অধ্যাপনা করেন। সেই সময় জর্জ বার্নাড'শ, আলবার্ট আইনস্টাইন, কবি ইয়েটস, রবার্ট ফ্রস্ট, আলবার্ট সোয়ইটজর, বোরিস পাস্তেরনাক, পাবলো কাসালস প্রভৃতি বিখ্যাত মনীষীর সান্নিধ্যে আসেন। তার পিতা দ্বিজেশচন্দ্র চক্রবর্তী উচ্চ শিক্ষিত; তিনি ইংরেজিতে এম. এ. এবং বি.এল. পাস করে আসামে গৌরীপুর এস্টেটের দেওয়ান হিসেবে কর্মরত ছিলেন।তার মা অনিন্দিতা দেবী ছিলেন সাহিত্যিক -- তিনি "বঙ্গনারী" ছদ্মনামে প্রবন্ধ-নিবিন্ধ প্রকাশ করতেন। তিনি সংস্কৃতে পারদর্শী ছিলেন আর চার সন্তানকে সংস্কৃত শিখিয়েছিলেন নিজেই। গৌরীপুরের সংস্কৃত টোল থেকে প্রখ্যাত পণ্ডিতকে তিনি নিযুক্ত করেছিলেন কালিদাস, ভবভূতি, ভারবি প্রমুখের রচনা পাঠের সুবিধার্থে। এভাবেই অমিয় চক্রবর্তী শৈশবেই ব্যাকরণে পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন।

শিক্ষাজীবন

অমিয় চক্রবর্তীর বয়স যখন অল্প তখন জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা অরুণ চক্রবর্তী আত্মহত্যা করে।] ভাইয়ের মৃত্যুতে তীব্র শোকে আক্রান্ত হন অমিয় চক্রবর্তী। তার স্বভাবে চিরস্থায়ী পরিবর্তন আসে; চঞ্চলতা ও ক্রীড়ানুরাগ তিরোহিত হয়ে আসে অন্তর্মুখীনতা; তিনি স্বল্পবাক ও ভাবুক হয়ে ওঠেন। এরপর কলকাতায় এসে হেয়ার স্কুলে ভর্তি হলেন আর থাকতেন মামার বাড়িতে। উচ্চ শিক্ষিত মামাদের সংস্পর্শে তরুণ অমিয় চক্রবর্তীর মানস জগৎ আলোকিত হয়ে ওঠে। তার বড় মামা নিখিলনাথ মৈত্র হয়ে উঠেন তার "চিন্তা-কল্পনার প্রধান অধিনায়ক।" সঙ্গীত ও সাহিত্যে তার বিশেষ অণুপ্রেরণা ছিল। বন্ধুস্থানীয় সেজ মামা সোমনাথ মৈত্রের প্রভাবও ছিল বেশ। তিনিই অমিয় চক্রবর্তীকে বীরবল ও সবুজপত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। তার ভাষায় : “সবুজ পত্রের আসরে এবং পরে বিচিত্রার সভ্যরূপে সাহিত্যে সঙ্গীতের প্রেরণা জীবনে প্রতিষ্ঠিত হল।”

কলকাতার হেয়ার স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাসের পর হাজারিবাগে আইরিশ মিশনের সেন্ট্ কোলাম্বাস কলেজ থেকে আই.এ. পাস করেন। একই কলেজ থেকে ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজি সাহিত্য, দর্শন, বটানিতে বি.এ. ডিগ্রি লাভ করেন। কিন্তু ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দ থেকেই বিশ্বভারতীর কাজে কর্মে জড়িয়ে পড়লেন ঘনিষ্ঠভাবে। ফলে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে যোগ দেয়ার যে আশৈশব স্বপ্ন তার ছিল তা’ এক নিমেষে উবে গেল। প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখার সুযোগ হলো সংর্কীণ। তিনি এম. এ. পরীক্ষা দিলেন বটে, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত ছাত্র হিসেবে নয়, পাটনায় প্রাইভেট ছাত্র হিসেবে। শেষাবধি পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম. এ. ডিগ্রী লাভ করেন তিনি ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে। অবশ্য পরে আবারো প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখার সুযোগ হয়। তিনি বিলেতের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলিয়ল কলেজের ছাত্র হিসেবে ১৯৩৪-৩৭ পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন, কবি টমাস হার্ডির কাব্য নিয়ে গবেষণার জন্য ডি. ফিল. লাভ করেন ১৯৩৭-সালে।

অমিয় চক্রবর্তী তিরিশের অন্যান্য কবিদের তুলনায় ভিন্নরূপ ব্যক্তিত্ব নিয়ে গড়ে উঠেছিলেন। শিবনারায়ণ রায় লিখেছেন: “অমিয়-র কোনো নিজস্ব পত্রিকা অথবা গোষ্ঠী ছিল না। ক্ষীণকায় মৃদুভাষী মানুষটির কিছু গভীর প্রত্যয় ছিল, কিন্তু বিতর্কে তিনি অনাগ্রহী অথবা আস্থাহীন। অপরপক্ষে জীবনানন্দের মতো তিনি সঙ্গ-বিমুখ ছিলেন;- বস্তুত নরনারী, পশুপাখি, শহরগ্রাম, বিশ্বের বিচিত্র অধিবাসী এবং বিভিন্ন অঞ্চলের হরেক রকম প্রাকৃতিক রূপ সম্পর্কে তাঁর কৌতূহল ছিল অপরিসীম। সঙ্গ ভালোবাসতেন, কিন্তু সব সময়েই মনে হয় তাঁর অস্তিত্বের কেন্দ্র এক গভীর নিরাসক্তি তাঁকে সচল রাখত। প্যাশন বা আবেগের আতিশয্যকে তিনি সচেতনভাবে এড়িয়ে চলতেন।

জন্ম ও পরিবার

১৯০১ খ্রিষ্টাব্দ ১০ এপ্রিল তারিখে রবীন্দ্র-পরবর্তী যুগের অন্যতম কবি অমিয় চক্রবর্তীর জন্ম হয়েছিল মামা বাড়িতে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের শ্রীরামপুরে। তার পুরো নাম অমিয় চন্দ্র চক্রবর্তী।, তার পিতা দ্বিজেশচন্দ্র চক্রবর্তী উচ্চ শিক্ষিত; তিনি ইংরেজিতে এম. এ. এবং বি.এল. পাস করে আসামে গৌরীপুর এস্টেটের দেওয়ান হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তার মা অনিন্দিতা দেবী ছিলেন সাহিত্যিক -- তিনি "বঙ্গনারী" ছদ্মনামে প্রবন্ধ-নিবিন্ধ প্রকাশ করতেন। তিনি সংস্কৃতে পারদর্শী ছিলেন আর চার সন্তানকে সংস্কৃত শিখিয়েছিলেন নিজেই। গৌরীপুরের সংস্কৃত টোল থেকে প্রখ্যাত পণ্ডিতকে তিনি নিযুক্ত করেছিলেন কালিদাস, ভবভূতি, ভারবি প্রমুখের রচনা পাঠের সুবিধার্থে। এভাবেই অমিয় চক্রবর্তী শৈশবেই ব্যাকরণে পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন।

শিক্ষাজীবন

অমিয় চক্রবর্তীর বয়স যখন অল্প তখন জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা অরুণ চক্রবর্তী আত্মহত্যা করে।গ[›] ভাইয়ের মৃত্যুতে তীব্র শোকে আক্রান্ত হন অমিয় চক্রবর্তী। তার স্বভাবে চিরস্থায়ী পরিবর্তন আসে; চঞ্চলতা ও ক্রীড়ানুরাগ তিরোহিত হয়ে আসে অন্তর্মুখীনতা; তিনি স্বল্পবাক ও ভাবুক হয়ে ওঠেন। এরপর কলকাতায় এসে হেয়ার স্কুলে ভর্তি হলেন আর থাকতেন মামার বাড়িতে। উচ্চ শিক্ষিত মামাদের সংস্পর্শে তরুণ অমিয় চক্রবর্তীর মানস জগৎ আলোকিত হয়ে ওঠে। তার বড় মামা নিখিলনাথ মৈত্র হয়ে উঠেন তার "চিন্তা-কল্পনার প্রধান অধিনায়ক।" সঙ্গীত ও সাহিত্যে তার বিশেষ অণুপ্রেরণা ছিল। বন্ধুস্থানীয় সেজ মামা সোমনাথ মৈত্রের প্রভাবও ছিল বেশ। তিনিই অমিয় চক্রবর্তীকে বীরবল ও সবুজপত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। তার ভাষায় : “সবুজ পত্রের আসরে এবং পরে বিচিত্রার সভ্যরূপে সাহিত্যে সঙ্গীতের প্রেরণা জীবনে প্রতিষ্ঠিত হল।

কলকাতার হেয়ার স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাসের পর হাজারিবাগে আইরিশ মিশনের সেন্ট্ কোলাম্বাস কলেজ থেকে আই.এ. পাস করেন। একই কলেজ থেকে ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজি সাহিত্য, দর্শন, বটানিতে বি.এ. ডিগ্রি লাভ করেন। কিন্তু ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দ থেকেই বিশ্বভারতীর কাজে কর্মে জড়িয়ে পড়লেন ঘনিষ্ঠভাবে। ফলে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে যোগ দেয়ার যে আশৈশব স্বপ্ন তার ছিল তা’ এক নিমেষে উবে গেল। প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখার সুযোগ হলো সংর্কীণ। তিনি এম. এ. পরীক্ষা দিলেন বটে, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত ছাত্র হিসেবে নয়, পাটনায় প্রাইভেট ছাত্র হিসেবে। শেষাবধি পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম. এ. ডিগ্রী লাভ করেন তিনি ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে। অবশ্য পরে আবারো প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখার সুযোগ হয়। তিনি বিলেতের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলিয়ল কলেজের ছাত্র হিসেবে ১৯৩৪-৩৭ পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন, কবি টমাস হার্ডির কাব্য নিয়ে গবেষণার জন্য ডি. ফিল. লাভ করেন ১৯৩৭-সালে।

অমিয় চক্রবর্তী তিরিশের অন্যান্য কবিদের তুলনায় ভিন্নরূপ ব্যক্তিত্ব নিয়ে গড়ে উঠেছিলেন। শিবনারায়ণ রায় লিখেছেন: “অমিয়-র কোনো নিজস্ব পত্রিকা অথবা গোষ্ঠী ছিল না। ক্ষীণকায় মৃদুভাষী মানুষটির কিছু গভীর প্রত্যয় ছিল, কিন্তু বিতর্কে তিনি অনাগ্রহী অথবা আস্থাহীন। অপরপক্ষে জীবনানন্দের মতো তিনি সঙ্গ-বিমুখ ছিলেন;- বস্তুত নরনারী, পশুপাখি, শহরগ্রাম, বিশ্বের বিচিত্র অধিবাসী এবং বিভিন্ন অঞ্চলের হরেক রকম প্রাকৃতিক রূপ সম্পর্কে তাঁর কৌতূহল ছিল অপরিসীম। সঙ্গ ভালোবাসতেন, কিন্তু সব সময়েই মনে হয় তাঁর অস্তিত্বের কেন্দ্র এক গভীর নিরাসক্তি তাঁকে সচল রাখত। প্যাশন বা আবেগের আতিশয্যকে তিনি সচেতনভাবে এড়িয়ে চলতেন।”

রবীন্দ্রনাথের সাহচর্

পৃথিবীর নানা মনীষার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যোগাযোগ ছিল তার এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল ১৯২৬ থেকে ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য-সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।এ সময় তিনি শান্তিনিকেতনে থাকতেন। তার কাজ ছিল, বিদেশী অতিথিদের পরিচর্য করা, ক্লাস নেওয়া, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নানা গ্রন্থ-তথ্য সংগ্রহরে দিয়ে সাহায্য করা, তার বিদেশ যাত্রার সঙ্গী হওয়া ইত্যাদি।

শৈশবেই দৃঢ় ব্যক্তিত্ব নিয়ে গড়ে উঠেছিলেন অমিয় চক্রবর্তী। ফলে মাত্র পনের বৎসর বয়সেই রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লিখে যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন। একইভাবে প্রমথ চৌধুরীর সঙ্গেও সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। প্রথমে “ডাকঘর” ও পরে “ফাল্গুনী”-তে অভিনেতা রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রথম দর্শন ঘটে। পরে প্রমথ চৌধুরীর বাড়িতে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ হয়। তারপর কবির আহ্বানে তিনি শান্তিনিকেতনে যান। সেটি ১৯১৮ খিষ্টাব্দের কথা। সেখানেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের সূত্রপাত। শান্তিনিকেতনের সঙ্গে যোগাযোগ তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। শান্তিনিকেতনের-এর জীবন প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন :

“একান্ত উৎসাহে ভাস্বর সেই অভিজ্ঞতা আজ পর্যন্ত আমার মানসিক অধিকারের বাইরে রয়ে গেছে। শালবীথির তপ্ত ছায়াবৃত মর্মর, ছাতিমতলার শুভ্র স্তব্ধ পাথর এবং উৎকীর্ণ মন, রবীন্দ্রনাথের গভীর বাক্যালাপ এবং অজস্র আতিথ্য, প্রমথবাবুর হাস্যকৌতুকময় প্রখর মননশীল আলোচনা ও বন্ধুত্বের অযাচিত দান একটি অপরিণত, অজ্ঞাত বাঙালি ছেলের সাহস আশা-কল্পনাকে ছাপিয়ে অপরূপ হয়ে দেখা দিয়েছিল। আজও বুকে জেগে আছে আকাশ মাঠ খোয়াইয়ের পাণ্ডুর উজ্জ্বল বলয়-চক্র, দারুণ গ্রীষ্মে উৎফুল্ল আমলকী-সারি এবং বহু দূরে পাড়-বসানো সবুজ তালতড়ি। আশ্রমেরই অভিন্ন অন্তর্গত রূপে সেই দৃষ্টি আমার কৈশোর জীবনে প্রসারিত”।

১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে স্থায়ীভাবে শান্তিনিকেতনে চলে আসেন অমিয় চক্রবর্তী। পরের বছর রবীন্দ্রনাথের উদ্যোগেই তার বিয়ে হল ড্যানিশ কন্যা কোপেনহেগেনবাসী হিয়োর্ডিস সিগার্ড (Hjordis Siggaard)-এর সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ বিদেশিনী নববধূর নাম দিয়েছিলেন হৈমন্তী। এ-বিয়েতে কন্যাসম্প্রদানের দায়িত্ব পালন করেছিলেন রবীন্দ্র-সহচর এণ্ড্রুজ। ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে বার্মিংহামে থাকাকালীন সময়ে তাদের একটি কন্যা সেমন্তী (ভট্টাচার্য)-এর জন্ম হয়। সেমন্তী স্বামী ড. সুব্রত ভট্টাচার্য ও পুত্রকন্যাসহ শিকাগো-তে বাস করছেন।

১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য সচিব হিসেবে কাজ করেছেন। সাহিত্য সচিব হিসেবে যে-কাজ তাকে করতে হয়েছে কবি নিজে তার বর্ণনা দিয়েছেন : “কবিতা এবং অন্যান্য সব রচনার পাণ্ডুলিপি রক্ষাভার ছিল আমার ওপরে। তা’ ছাড়া নবরচিত গানের দ্রুত কয়েকটি কপি ক’রে দিনুবাবু (দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর) এবং শিক্ষার্থী তরুণ-তরুণীদের হাতে তা’ বিলি করতাম।”

বারবার পাণ্ডুলিপি সংশোধন করতেন রবীন্দ্রনাথ। এমনকী ছাপা হ’য়ে যাওয়ার পরও চলতো সংস্কার। আর ফলে ফর্মা ছাপা হয়ে যাওয়ার পরও বিশ্বভারতীর প্রেসে ছুটে যেতে হয়েছে অমিয় চক্রবর্তীকে। খসড়ার পর বারবার ঘষা-মাজার অভ্যাস দাঁড়িয়ে যায় রবীন্দ্রনাথের সবুজ পত্রের যুগ থেকে। ফলে একই রচনা বারবার কপি করতে হতো। এই কপি করার কাজেও অক্লেশে নিয়মিত অংশ নিতেন অমিয় চক্রবর্তী ও স্ত্রী হৈমন্তী। রবীন্দ্রনাথের জরুরি প্রয়োজনে একবার সারারাত জেগে তাকে ''মুক্তধারা'' নাটকটির কপি তৈরি করতে হয়েছিল।

সাহিত্য সচিবের দায়িত্ব ছাড়াও পরে অবশ্য বিশ্বভারতীর সকল প্রকার কাজেই অমিয় চক্রবর্তীকে জড়িয়ে পড়তে হল ; বিশেষ ক’রে রবীন্দ্রনাথ ও রথীন্দ্রনাথের অনুপস্থিতিতে। বিশ্বভারতীর কাজেকর্মে রথীন্দ্রনাথ, প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবিশ, অপূর্বকুমার চন্দ প্রমুখের সঙ্গে অমিয় চক্রবর্তী ধীরে-ধীরে নেতৃস্থানীয় দায়িত্ব পালন করছেন। রবীন্দ্রনাথের উপদেশকদের মধ্যে অল্পদিনের মধ্যেই তিনি ঠাঁই পেয়েছেন। প্রাথমিকভাবে তার কাজ ছিল রবীন্দ্রনাথের পরিকল্পনাগুলোর ওপর প্রতিবেদন তৈরি ক’রে সবাইকে জানিয়ে সে-সব বাস্তবায়নের সূত্রপাত করা।

একবার ঠিক হল ১৩৩৯ বঙ্গাব্দ থেকে ১৩৪৭ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত লিখিত কবিতাগুলো রবীন্দ্রনাথের ১৩৪৭-এর জন্মদিনে একত্রে গ্রন্থনা ক’রে প্রকাশ করা হ’বে। কিন্তু কবিতা সবগুলো এক মেজাজ বা ধাঁচের ছিল না। অমিয় চক্রবর্তী প্রস্তাব করলেন অন্তত দু’টি গ্রন্থে ভিন্নধর্মী এই কবিতাগুলো সংকলণের জন্যে। একগুচ্ছ কবিতায় রয়েছে সুরের প্রাধান্য, "ভাব-রুচির চেয়ে হৃদয়বৃত্তির আলাপ” ; সেগুলো গ্রন্থিত হল ''সানাই'' নামে। আর অন্য গুচ্ছ যাতে কবিগুরুর “জীবনের দর্শন দুঃখ-মৃত্যু ছায়াকে অতিক্রম করে গেছে” সেগুলো সংগ্রন্থিত হল ''নবজাতক'' নামে।

বিশ্বপথিক অমিয় চক্রবর্তী

১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত তার “কবির নির্বাসন ও অন্যান্য ভাবনা নামক বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থটি অমিয় চক্রবর্তীকে উৎসর্গ করেছেন এই লিখে: “কবি ও মনীষী সহৃদয় বিশ্বনাগরিক অমিয় চক্রবর্তী শ্রদ্ধাভাজনেষু”।, আক্ষরিক অর্থেই কবি অমিয় চক্রবর্তী ছিলেন একজন বিশ্বনাগরিক। পৃথিবীর নানা দেশে তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন। কখনও জীবিকার তাগিদে, কখনও-বা নিছক পরিব্রাজক হিসেবে। ভ্রমণে আমৃত্যু ছিলেন অক্লান্ত।

জীবনের শুরুতেই সূচনা হয় বিশ্ব পর্যটনের। অমিয় চক্রবর্তীর বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রবীন্দ্র-ভক্ত এণ্ড্রুজের বন্ধু হরেস আলেকজান্ডার। তিনি অমিয় চক্রবর্তীকে বিলেতের বার্মিংহামের উডব্রুক কলেজে আমন্ত্রণণ জানালেন। ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে সেই কবির প্রথম বিদেশ যাত্রা। সেখানে প্রায় এক বৎসর ধরে ভারতবর্ষ ও আন্তর্জাতিকতা এবং ধর্মবিষয়ে বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগ হল। পরে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি অধ্যয়ন ও গবেষণা করেছেন। অক্সফোর্ডের ব্রেজনোস্‌ কলেজে সিনিয়র রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করেছেন ১৯৩৭ থেকে ১৯৪০ সাল অবধি। এ-সময় ব্যাপকভাবে ভারতবর্ষ-ইরান-আফগানিস্তান সফর করেছেন আধুনিক কালে ধর্মআন্দোলন বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের জন্যে।

সঙ্গীত

ছেলেবেলা থেকেই সঙ্গীতে ছিল তার বিশেষ আকর্ষণ। তার শৈশব কেটেছে আসাম-গৌরীপুরে। গৌরীপুরে যাত্রা-নাটক আর জারি-সারি, বাউল-কীর্তণের আসরে তার নিয়মিত যাতায়াত ছিল। অন্যদিকে মামার বাড়িতে ইয়োরোপীয় সঙ্গীতের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। ইয়োরোপীয় ধ্রূপদী সঙ্গীতের সঙ্গে তার এই পরিচয় ছিল অসামান্য। রাশিয়ার ববোডিন, জার্মানির প্রাতিভ এবং পিয়ানো, ভায়োলিন ও অর্কেষ্ট্রার শ্রেষ্ঠ কম্পোজারদের সঙ্গীতের সঙ্গে-সঙ্গে ভারতীয় মার্গসংগীতের নিত্য শ্রোতা ছিলেন তিনি। তারপর এক সময় গান লিখতে শুরু করেন। আর তাতে কখনও কখনও তিনি নিজেই সুরারোপ করেছেন।

কাব্য

  • কবিতাবলী (১৩৩২ বঙ্গাব্দ)
  • উপহার (১৩৩৪ বঙ্গাব্দ)
  • খসড়া (১৯৩৮)
  • এক মুঠো (১৯৩৯)
  • মাটির দেয়াল (১৯৪২)
  • অভিজ্ঞান বসন্ত (১৯৪৩)
  • দূরবাণী (১৯৪৪)
  • পারাপার (১৯৫৩)
  • পালাবদল (১৯৫৫)
  • ঘরে ফেরার দিন (১৯৬৪)
  • হারানো অর্কিড (১৯৬৬)
  • পুষ্পিত ইমেজ (১৯৬৭)
  • অমরাবতী (১৯৭২)
  • অনিঃশেষ (১৯৭৬)
  • নতুন কবিতা (১৯৮০)

গদ্য রচনা

 
  • চলো যাই (১৯৬০)
  • সাম্প্রতিক (১৯৬৩)
  • পুরবাসী
  • অমিয় চক্রবর্তীর প্রবন্ধ সংগ্রহ

What's Your Reaction?

Like Like 0
Dislike Dislike 0
Love Love 0
Funny Funny 0
Angry Angry 0
Sad Sad 0
Wow Wow 0