সম্রাট হাম্মুরাবি জীবনী | Biography of Samrat Hammurabi
সম্রাট হাম্মুরাবি জীবনী | Biography of Samrat Hammurabi

জন্ম |
খ্রিস্টপূর্ব ১৮১০ অব্দে জন্ম নেওয়া হাম্মুরাবি ছিলেন আইনের জনক এবং ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্যের ষষ্ঠ রাজা |
পিতা |
সিন-মুবাল্লিতের |
মৃত্যু |
আনুমানিক ১৭৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ইহলোক ত্যাগ করেন হাম্মুরাবি। |
হাম্মুরাবি
বাংলায়, হাম্মুরাবি[ক] (আনু. 1810 – আনু. 1750 BC) ছিলেন প্রথম ব্যাবলনিয়ান রাজবংশের আমরাইত গোত্রের ষষ্ঠ শাসক। [১] তার পিতা সিন-মুবাল্লিত এর মৃত্যুর পর আঠারো বছর বয়সে তিনি ব্যাবিলন নগর রাষ্ট্রের সিংহাসনে বসেছিলেন। এই নগররাষ্ট্রের প্রথম রাজবংশের ষষ্ঠ রাজা হিসেবে হাম্মুরাবি যখন দায়িত্ব নেন, ব্যাবিলন তখন ছোট্ট একটি দেশ। মেসোপটেমিয়া অঞ্চলে এ রকম আরো অনেকগুলো নগর রাষ্ট্র ছিল, আর সেই সব রাজ্যের নিজেদের মধ্যেও লড়াই ছিল।] তবে তার পূর্বপুরুষদের সময়ই বোরসিপ্পা, কিশ এবং সিপ্পার পর্যন্ত রাজ্য বিস্তার করে ব্যাবিলনিয়ানরা আঞ্চলিক রাজশক্তি হয়ে ওঠার পথে খানিকটা এগিয়েছিল।
শামসি-আদাদ, লারসা, এশনুনা আর এলাম-এর মতো আরো কয়েকটি শক্তিশালী প্রতিবেশী রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জিতে প্রকৃতপক্ষে হাম্মুরাবিই ব্যাবিলনিয়ান নগর রাষ্ট্রকে ব্যাবিলনিয়ান সাম্রাজ্যে রূপান্তর করেছিলেন। সে অর্থে তাকেই বলা যায় ব্যাবিলনিয়ান সাম্রাজ্যের প্রথম সম্রাট।
প্রাচীন ইতিহাসে হাম্বুরাবি, হাম্বুরাবি আইন প্রবর্তনের জন্য সুপরিচিত। তিনি নিজে দাবী করেন যে এই আইন তিনি সূর্য় দেব শামাশের কাছ থেকে পেয়েছিলেন। আধুনিক আইনের তুলনায় হাম্বুরাবির প্রবর্তিত আইন বেমানান মনে হলেও তৎকালিন সমাজ ব্যবস্থার বিবেচনায় এবং মানব সমাজে প্রথম লিখিত আইন হিসাবে এর গুরুত্ব অনেক। তৌরাতে বর্ণিত মূসা (আঃ) এর প্রবর্তিত আইনের সাথে এর অনেক মিল রয়েছে।
হাম্বুরাবির প্রণিত আইন
হাম্মুরাবি আইনকানুনের পাথরের খন্ডের উপরের অংশ।
হাম্বুরাবির আইন পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন আইন নয়; Ur-Nammu, Laws of Eshnunna এবং Lipit-Ishtar এর আইন।[৩] হাম্বুরাবীর আইনের চেয়ে প্রাচীন আইন। তবে, হাম্বুরাবী আইন, এই সকল প্রাচীন আইনের চেয়ে আলাদা ছিল। এবং সমাজে এই আনের প্রভাব ছিল অতীতের সকল আইনের চেয়ে বেশি ছিল।
তবে হাম্মুরাবি খ্যাতির কারণ তার যুদ্ধজয় নয়। হাম্মুরাবির আইন নামে বিখ্যাত তার আইন সংকলনই পৃথিবীজোড়া খ্যাতি এনে দিয়েছে তাকে। ১৯০১ সালে এলামিদের প্রাচীন রাজধানী সুসা থেকে আবিস্কৃত হয়েছে অমূল্য এই সংকলন। মোট ১২টি পাথরের টুকরোয় খোদাই করে লেখা ২৮২টি আইনের এই সংকলন পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন লিখিত আইন সংকলন হিসেবে পরিচিত। ব্যাবিলনের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত আক্কাদীয়ান ভাষায় লেখা হয়েছিল এই আইনগুলো, তাই অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন যে কেউ এগুলো পড়তে ও বুঝতে পারতেন।[৬] বর্তমানে প্যারিসের লুভ্র্ জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে এই অমূল্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো।
হাম্মুরাবির উত্থান
প্রাচীন আমোরাইটরা ছিল যাযাবর এক জাতিগোষ্ঠী, যারা খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দের দিকে ‘এবার নারি’ (আধুনিক সিরিয়া) নামক উপকূলীয় অঞ্চল থেকে এসে মেসোপটেমিয়ায় থিতু হয়। ক্রমে ক্রমে তারা ক্ষমতা দখল করে খ্রি.পূ. ১৯৮৪ অব্দের দিকে ব্যাবিলনের রাজ সিংহাসন দখল করতে সক্ষম হয়। আমোরাইট রাজবংশের পঞ্চম রাজা, সিন-মুবাল্লিত প্রজাদের নিকট জনপ্রিয় এক শাসক হলেও রাজ্য বিস্তার কিংবা দক্ষিণে প্রতিদ্বন্দ্বী শহর লারসার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অক্ষম ছিলেন।
উল্লেখ্য, লারসা ছিল তৎকালীন পারস্য উপসাগরের সবচেয়ে লাভজনক বাণিজ্য কেন্দ্র। ব্যবসা বাণিজ্য চাঙ্গা থাকায় শহরটি প্রভূত উন্নতি ও সমৃদ্ধি লাভ করে। দক্ষিণ মেসোপটেমিয়ার বেশিরভাগ শহর ছিল লারসার নিয়ন্ত্রণে। সম্রাট সিন-মুবাল্লিত লারসা দখলের উদ্দেশ্য আক্রমণ করলে লারসা সম্রাট প্রথম রিম সিনের কাছে তাকে পরাজয় বরণ করতে হয়। ব্যর্থতার এই গ্লানি সইতে না পেরে সিংহাসন থেকে পদত্যাগ করেন সিন-মুবাল্লিত, এবং উত্তরাধিকারসূত্রে পিতার কাছ থেকে সিংহাসন প্রাপ্ত হন হাম্মুরাবি।
হাম্মুরাবির শাসন
ক্ষমতা গ্রহণের পর তিনি রাজ্য মানচিত্রের খোলনলচেই পাল্টে দেন। হাম্মুরাবি সিংহাসনে আরোহণের সময় ব্যাবিলন রাজ্যে কেবল ব্যাবিলন, কিশ, সিপ্পার এবং বরসিপ্পা শহরগুলো অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু পর পর কতগুলো সফল সামরিক অভিযান ও রাজনৈতিক কূটকৌশলের মাধ্যমে তিনি কিছু শহরের দখল নিয়ে ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্যরেখা আরও বিস্তৃত করেন।
হাম্মুরাবি তার প্রশাসনিক কাঠামো সুবিন্যস্ত করতে পূর্ণ মনোযোগী ছিলেন। পিতার দেখানো পথে হাঁটার পাশাপাশি তিনি শহরের দেয়াল আরও প্রসারিত ও উঁচু করেন। জনগণের চাহিদার প্রতি তিনি ছিলেন সদা সতর্ক ও যত্নবান। উন্নত সেচ এবং তার নিয়ন্ত্রণাধীন শহরগুলোর অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণের পাশাপাশি দেবতাদের জন্য দৃষ্টিনন্দন মন্দির নির্মাণ করেছিলেন তিনি। এই ফাঁকেই তিনি তার সৈন্যদের নির্দিষ্ট একটি ক্রমানুসারে সাজিয়ে মেসোপটেমিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে প্রচারাভিযানের পরিকল্পনা করছিলেন।
এরই মধ্যে এলামীয়রা মেসোপটেমিয়ার কেন্দ্রীয় সমভূমিতে পূর্বদিক থেকে আক্রমণ করলে হাম্মুরাবি তাদের পরাজিত করার জন্য লারসার সাথে মিত্রতা স্থাপন করেন। ওই যুদ্ধে পরাস্ত হয় এলামীয়রা। এলামীয়দের হারানোর পর তিনি লারসার সাথে সন্ধি ভেঙে দেন। এরপর নিপ্পুর এবং লাগাশের মতো অন্যান্য শক্তিশালী নগর-রাজ্যের সাথে জোট গঠন করে লারসার দখলে থাকা উরুক এবং ইসিন শহর নিজের করায়ত্বে নিয়ে আসেন। উরুক এবং ইসিন জয় করার পর তিনি নিপ্পুর এবং লাগাশের সেনাবাহিনী নিয়ে সরাসরি লারসায় পূর্ণ শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। লারসাও মাথা নত করে তার সামনে। পরাক্রমশালী লারসার রাজা প্রথম রিম সিনের পতনের পর ব্যাবিলনে হাম্মুরাবি বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস আর কারও ছিল না।
মেসোপটেমিয়ার দক্ষিণাংশ নিয়ন্ত্রণে চলে আসায় তিনি এবার নজর দেন উত্তর ও পশ্চিম অঞ্চলগুলোর দিকে। সিরিয়ায় মারির অ্যামোরাইট সাম্রাজ্য দীর্ঘদিন ধরে ব্যাবিলনীয় আমোরাইট সাম্রাজ্যের মিত্র ছিল। সিরিয়ার সম্রাট জিমরি-লিমের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন হাম্মুরাবি। জিমরি-লিম মেসোপটেমিয়ার উত্তরে সফল সামরিক অভিযান চালিয়ে প্রচুর ধন-সম্পদ অর্জন করেছিলেন। ফলে মারি পরিণত হয় মেসোপটেমিয়ার অন্যতম সম্পদ ও ঐশ্বর্যশালী শহরে। ইউফ্রেটিস নদীর তীরে অবস্থিত মারি ছিল তৎকালে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সমৃদ্ধ বাণিজ্য কেন্দ্র। তাই যে কেউ এই শহরের দখল নিতে চাইবে এটাই স্বাভাবিক।
১৭৬১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে হাম্মুরাবি মারিতে আক্রমণ করেন। কিন্তু কিছু বিশেষ কারণে তিনি এই শহর জয়ের বদলে ধ্বংস করে দেন। অন্যান্য বিজিত শহর দখল নেওয়ার পর তা মেরামত ও সংস্কার করা হতো। কিন্তু হাম্মুরাবি কেন এত গুরুত্বপূর্ণ এক বাণিজ্যকেন্দ্রকে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন, তা নিয়ে ইতিহাসবিদদের মাঝে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। তবে অনেকেই মনে করেন, ব্যাবিলন শহরকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসানোর জন্য তিনি মারিকে ধ্বংস করার পথ বেছে নেন। কারণ, তখনকার সময় ব্যাবিলনের সাথে সমৃদ্ধি ও ঐশ্বর্যে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল মারি।
হাম্মুরাবি কোড
যুদ্ধ-বিগ্রহ ও নগর দখলে জীবনের অধিকাংশ সময় ব্যয় করলেও, তার আমলের শিলালিপি, চিঠিপত্র এবং রাজনথি ঘাঁটলে দেখা যায়, তিনি প্রজাদের উন্নয়ন ও কল্যাণসাধনে ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। তাকে ‘ভূমিনির্মাতা’ উপাধিতে ভূষিত করার প্রমাণও পাওয়া যায়, কারণ তিনি সমগ্র অঞ্চলে বহু ভবন এবং খাল নির্মাণের আদেশ দিয়েছিলেন। রাজ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য সম্রাট হাম্মুরাবি আইন-কানুনের লিখিত অনুশাসনও তৈরি করেছিলেন, যা ইতিহাসে ‘হাম্মুরাবি কোড’ নামে পরিচিত।
এই হাম্মুরাবি কোডে প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ অন্যায়ের জন্য নির্দিষ্ট শাস্তি বরাদ্দ ছিল। ব্যাবিলন ও তার ক্ষুদ্র রাষ্ট্রসমূহের প্রত্যেক নাগরিককেই মেনে চলতে হতো প্রণীত সেই নীতিমালা। এ নীতিমালাকে স্থায়ী দলিল হিসেবে রূপ দিতে তা খোদাই করা হয়েছিল পাথরে। এগুলোর মধ্যে কিছু আইন ছিল এরকম-
- যদি কোনো ব্যক্তি মন্দির বা সম্রাটের সম্পত্তি চুরি করে, তবে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে। চুরির মাল যার কাছে পাওয়া যাবে, তার জন্যও একই শাস্তি বরাদ্দ।
- কোনো ব্যক্তি কারও দাসী হরণ করলে, তাকে প্রাণদণ্ড দেয়া হবে।
- পলাতক দাসকে কেউ আশ্রয় দিলে, তার একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।
- যদি কেউ কোনো ব্যক্তির কাছে ঋণজালে আবদ্ধ থাকে, তাহলে তার স্ত্রী, পুত্র, বা কন্যা ওই ব্যক্তির কাছে তিন বছর দাস-জীবন যাপন করতে বাধ্য থাকবে।এরকম প্রায় ২৮২টি আইন লিপিবদ্ধ করে রাজার কাছে পেশ করেন সভাসদেরা। চূড়ান্ত যাচাই-বাছাই ও কাটছাঁটের পর আইনগুলোকে অনুমোদন দেয়া হলে ব্যাবিলনজুড়ে কার্যকর হয় ইতিহাসের অন্যতম প্রাচীন আইন ‘হাম্মুরাবি কোড’। তবে মজার ব্যাপার হলো, হাম্বুরাবির প্রণীত আইন পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন আইন নয়। উর-নাম্মু, এশনুন্নার আইন, এবং লিপিত ইশতারের আইন হাম্বুরাবির আইনের চেয়ে প্রাচীন আইন। নিঃসন্দেহে এই আইন প্রাচীন পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছিল।
১৯০১ সালে এলামীয়দের প্রাচীন রাজধানী সুসা থেকে আবিষ্কার করা হয়েছিল এই অমূল্য রত্ন। মোট ১২টি পাথরের টুকরোয় লেখা এই আইন সংকলন পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন আইন হিসেবে সুপরিচিত। আক্কাদীয় ভাষায় লেখা এই আইনগুলো অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন যে কেউ পড়তে পারতেন।
হাম্মুরাবির মৃত্যু ও উত্তরাধিকার
১৭৫৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বৃদ্ধ হাম্মুরাবি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাই তিনি রাজসিংহাসনের গুরুভার তার পুত্র সামসু-ইলুনাকে সঁপে দেন। দিন যত গড়াচ্ছিল, সম্রাটের অবস্থার তত অবনতি হচ্ছিল। ১৭৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ইহলোক ত্যাগ করেন হাম্মুরাবি। মৃত্যুর পর পিতার অর্জিত রাজ্য সীমারেখা ধরে রাখতে পারেননি তার সন্তান সামসু-ইলুনা। বার বার শত্রুদের আক্রমণে ক্রমশ অঞ্চল হাতছাড়া হতে থাকে। হাম্মুরাবি তার জীবদ্দশায় যে বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন, তার মৃত্যুর এক বছরের মাথায় অনেক নগর ও শহর তাদের স্বায়ত্তশাসন ঘোষণা করে। পরবর্তীতে হাম্মুরাবির উত্তরসূরিরা কেউই পুরো রাজ্যকে আর একত্রিত করতে পারেনি।
What's Your Reaction?






