বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের জীবনী । Begum Rokeya Shakhawat Hossain Biography
বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের জীবনী । Begum Rokeya Shakhawat Hossain Biography

জন্ম |
রূপকথার রাজকন্যাদের মতনই ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর, রংপুর জেলার পায়রাবন্দের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম জমিদার বাড়ির ঘর আলো করে আসেন বেগম রোকেয়া । |
বিবাহ |
১৮৯৮ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সেই ভাগলপুরের উর্দুভাষী ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সাথে বেগম রোকেয়া বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হন । |
সন্মাননা |
রংপুর বিভাগের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ‘রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়’ ৮ অক্টোবর ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় । |
মৃত্যু |
১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বের বেগম রোকেয়া কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন । |
জন্ম
রূপকথার রাজকন্যাদের মতনই ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর, রংপুর জেলার পায়রাবন্দের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম জমিদার বাড়ির ঘর আলো করে আসেন বেগম রোকেয়া । কিন্তু পরবর্তীতে এই মহান মহিয়সী যে বাংলার সমাজটাও আলোকিত করে তুলবেন, তা কিন্তু কেউ ভাবতেও পারেনি ।
বেগম রোকেয়ার পিতা জহিরুদ্দিন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের আর মাতা রাহাতুন্নেসা সাবেরা চৌধুরানী । তাঁরা দুজনেই ছিলেন বেশ উঁচ্চবংশীয় এবং জমিদার শ্রেণিভুক্ত ।
বিবাহ
১৮৯৮ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সেই ভাগলপুরের উর্দুভাষী ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সাথে বেগম রোকেয়া বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হন । উল্লেখ্য, বেগম রোকেয়া ছিলেন সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের দ্বিতীয় স্ত্রী । তাঁর স্বামী ছিলেন আধুনিকমনস্ক বেগম রোকেয়াকে তিনিই লেখালেখি করতে উৎসাহিত করেন । বিয়ের পর রোকেয়ার আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার পড়ালেখা পুরোদমে শুরু হয় এবং সাহিত্যচর্চার পথটাও তাঁর জন্য খুলে যায় । তবে রোকেয়ার বিবাহিত জীবন বেশিদিন স্থায়ী হয়নি । ১৯০৯ সালের ৩ মে সাখাওয়াত হোসেন মারা যান । ইতঃপূর্বে তাঁদের দুটি কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করে অকালেই মারা যায় ।
সাহিত্যে অবদান ঃ
১৯০২ সালে ‘পিপাসা’ নামক একটি গল্প লিখে বাংলা সাহিত্য জগতে বেগম রোকেয়া তাঁর পথচলা শুরু করেন । তিনি তাঁর নিজস্ব প্রকাশভঙ্গি, স্বকীয়তা ও স্বীয় বৈশিষ্ট্য দ্বারা সমসাময়ি নারীদের সাহিত্যকর্ম অতিক্রম করতে সক্ষম হন । এই নিয়ে বিশিষ্ট সাহিত্যিক কাজি আবদুল ওদুদ বলেন, ‘বাস্তবিকই মিসেস আর.এস. হোসেন একজন সত্যিকার সাহিত্যিক, তাঁর একটি বিশিষ্ট স্টাইল আছে । সেই স্টাইলের ভিতর দিয়ে ফুটেছে তাঁর তীক্ষ্ম দৃষ্টি আর কান্ডজ্ঞান আর বেদনাভরা অথবা মুক্তি অভিসারী মন ।’
বেগম রোকেয়া
বৈচিত্র্যপূর্ণ সাহিত্যেজীবনে অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করেন । তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য রচনা ‘Sultana’s Dream‘ যার অনূদিত নাম ‘সুলতানার স্বপ্ন’ । তাঁর অন্যান্য গ্রন্থগুলো হলো ‘পদ্মরাগ (১৯২৪), অবরোধবাসিনী (১৯৩১), মতিচুর (১ম খন্ড-১৯০৪, ২য় খন্ড ১৯২২) । প্রত্যেকটিতে রয়েছে নারীর অবরোধের কাহিনী । তাঁর কবিতাগ্রন্থের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য – বাসিফুল, শশধর, চাঁদ, নলিনী ও মুকুদ, কাঞ্চনজঙ্ঘা, সওগাত, আপীল, নিরূপম বীর । তাঁর ব্যঙ্গধর্মী রচনা হলো ঃ পরী-টিবি, তিনকুড়ে, বিয়েপাগলা বুড়ো ইত্যাদি । প্রবন্ধের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- চাষার দুক্ষু, সিসেম ফাঁক, এন্ডিশিল্প, বঙ্গীয় নারী শিক্ষা সমিতি, লুকানো রতন, রাণী ভিখারিণী । নবনূর, সওগাত, মোহাম্মদী ইত্যাদি পত্রিকায় তাঁর লেখা নিয়মিত প্রকাশিত হতো ।
নারী শিক্ষার প্রসার
স্বামীর মৃত্যুর পর নিঃসঙ্গ রোকায়া নারীশিক্ষা বিস্তারে আত্মেনিয়োগ করেন । ১৯০৯ সালের ১ অক্টোবর স্বামীর প্রদত্ত অর্থে মাত্র ৫ জন ছাত্রী নিয়ে তিনি ভাগলপুরে ‘ সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’ স্থাপন করেন । কিন্তু পারিবারিক কারণে রোকেয়া ভাগলপুর ছেড়ে কলকাতায় এসে বসবাস শুরু করেন । ১৯১১ সালের ১৬ মার্চ, কলকাতার ১৩ নং ওয়ালিউল্লাহ লেনের একটি বাড়িতে মাত্র আটজন ছাত্রী নিয়ে তিনি নবপর্যায়ে ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করেন । রোকেয়ার অক্লান্ত প্রচেষ্টায় ১৯১৭ সালে এই স্কুল মধ্য ইংরাজি গার্লস স্কুলে এবং ১৯৩১ সালে উচ্চ ইংরেজি গার্লস স্কুলে রূপান্তরিত হয় । নারীশিক্ষার প্রসারে বেগম রোকেয়া আমৃত্যু কাজ করে গিয়েছেন । নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা, নারীর ক্ষমতায়ন, ভোটাধিকারের জন্য লড়াইটা শুরু করেছিলেন বেগম রোকেয়া । বেগম রোকেয়া তাঁর জীবন সংগ্রামের মাধ্যমে বুঝতে পেরেছিলেন যে শিক্ষা ছাড়া নারীর মুক্তি নেই । কেননা একমাত্র শিক্ষাই পারবে আমাদেরকে মুক্তির আলোয় নিয়ে আসতে, নিজেদের প্রাপ্য সম্মান পাওয়ার জন্য শিক্ষার বিকল্প নেই ।
নারীবাদ নয়, সমতা চাই :
বেগম রোকেয়া সব সময় সাম্যের ডাক দিয়ে গেছেন । তিনি পুরুষতান্ত্রিক কিংবা নারীতান্ত্রিক কিংবা নারীতান্ত্রিক সমাজ গড়তে চাননি । তিনি চেয়েছিলেন সমাজে নারী ও পুরুষ যাতে একসাথে সমান মর্যাদা এবং অধিকার নিয়ে বাচেঁ । উনিশ শতকের দিকে যখন মেয়েরা ঝিমিয়েপড়া নারী পরাধীনতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন । তিনি ‘মেয়েদের এমন শিক্ষায় শিক্ষিত করিয়া তুলিতে হইবে, যাহাতে তাহারা ভবিষ্যৎ জীবনে আদর্শ গৃহিণী, আদর্শ জননী এবং আদর্শ নারীরূপে পরিচিত হইতে পারে ।’ তিনি কখনোই পুরুষকে ছোট করে দেখেননি । তিনি কখনোই পুরুষকে একটি গাড়ির দু’টি চাকার সাথে তুলনা করেছেন । কেননা একটি চাচা ছাড়া পুরো গাড়িটাই অচল । তাই নারী ও পুরুষ যদি মিলেমিশে কাজ করে, তাহলে সমাজে পরিবর্তন আসবেই । সমাজের অর্ধেক অংশকে বাদ দিলে কখনোই রাষ্ট্রের উন্নতি হবে না । তাই তো তিনি ছিলেন সমতার বিশ্বাসী ।
সমাজসেবা :
বেগম রোকেয়া ছিলেন একজন দূরদর্শী সমাজ সংস্কারক । তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগ পর্যন্ত অন্যের জন্য কাজ করে গেছেন । তাঁর সমাজসেবা শুধু বিদ্যালয় তৈরি করা পর্যন্ত থেমে থাকেনি । বাংলার মুসলিম নারীসমাজের অগ্রগতি সাধনের জন্য বেগম রোকেয়া ১৯১৬ সালে ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম’ নামে একটি মুসলিম নারী সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন । এই সমিতির কার্যক্রম প্রসঙ্গে মোতাহার হোসেন সুফি তার ‘বেগম রোকেয়া, জীবন ও সাহিত্য’ গ্রন্থে বলেন, ‘জাতিগঠনমূলক কাজের জন্য আঞ্জুমান নাম ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে । চরিত্রহীন স্বামীর অত্যাচার ও নির্যাতন থেকে বহু অসহায় বধূকে রক্ষা করেছে, বয়ঃপ্রাপ্ত দরিদ্র কুমারীকে সৎপাত্রস্থ করেছে, অভাবগ্রস্ত মেয়েদের শিক্ষাগ্রহণে নানাভাবে সাহায্য করেছে ।’
বেগম রোকেয়া নিজে কখনো বিলাসী জীবনযাপন করেননি । তিনি সর্বদাই অসহায় নারীদের জন্য কাজ করে গিয়েছেন । তিনি নিজস্ব জমিদারী থেকে প্রাপ্ত আয়ের বহুলাংশ তাঁর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাজে ব্যয় করেন। স্কুলের সুপারিনটেনডেন্ট ও প্রধান শিক্ষিকা হিসেবেও কোনো পারিশ্রমিক নিতেন না । একদম সাধারণ ও স্বচ্ছ ছিল তাঁর জীবনদর্শন ।
সন্মাননা:
রংপুর বিভাগের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ‘রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়’ ৮ অক্টোবর ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় । অতঃপর ২০০৯ সালে তাঁর নামকে স্মরণীয় করে রাখতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়টি ‘বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়’ নামকরণ করেন । এটি বাংলাদেশের প্রথম নারীর নামে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় । বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যক্তিদের স্মরণে গুগল তাদের হোমপেজে লোগো পরিবর্তন করে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে বিশেষ ডুডল প্রকাশ করে । বেগম রোকেয়ার ১৩৭ তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে গুগল তাঁর স্মরণে একটি ডুডল তৈরি করে । বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনর স্মরণে বাংলাদেশ সরকার একটি গণউন্নয়নমূলক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছেন । বাংলাদেশের রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার পায়ারাবন্দ গ্রামে পৈতিৃক ভিটায় ৩-১৫ একর ভূমির উপর নির্মিত হয়েছে ‘বেগম রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্র’ । স্মৃতিকেন্দ্রে পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে বাংলাদেশ সরকারের শিশু ও মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয় । মহিয়সী বাংঙালি নারী হিসেবে বেগম রোকেয়ার অবদানকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের আবাসনের জন্য ‘রোকেয়া হল’ নামকরণ করা হয় ।
১৯৮০ সালে বেগম রোকেয়ার জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ দুটি স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করেছিল । এছা়ড়াও ২০০৪ সালে বিবিসি বাংলার ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি’ জরিপে ৬ষ্ঠ নির্বাচিত হয়েছিলেন বেগম রোকেয়া ।
মৃত্যু :
১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বের বেগম রোকেয়া কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন । সেসময় তিনি ‘নারীর অধিকার’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন । তাঁর কবর উত্তর কলকাতার সোদপুরে অবস্থিত যা পরবর্তীকালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক অমলেন্দু দে আবিষ্কার করেন । ক্ষণজন্মা এই মহিলা সাহিত্যিক ও সমাজসেবী আমাদের যে কী উপকার করেছেন, তা হয়তো কখনো লিখে প্রকাশ করা যাবে না । তাঁর হাত বাড়ানোর কারণেই মেয়েরা আজ অবাধে চলাচল করে ভোট দেওয়ার অধিতার অর্জন করেছে, পড়ালেখা করার পাশাপাশি নিজ দেশকে বিশ্ব দরবারে প্রতিনিধিত্বও করছে ।
What's Your Reaction?






