ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ
(ফার্সি/উর্দু:فخر الدين مبارك شاه) (শাসনকাল : ১৩৩৮-১৩৪৯) চৌদ্দ শতকে বাংলার স্বাধীন শাসক ছিলেন। তার শাসনাধীন এলাকা বর্তমান বাংলাদেশের পূর্ব ও দক্ষিণপূর্বাঞ্চল নিয়ে গঠিত ছিল।
জন্ম ও বংশ
কিছু ইতিহাসবিদদের মতে, মুবারক একটি সুন্নি মুসলিম খান্দানে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বর্তমান নোয়াখালী জেলার পূর্বাংশের একটি গ্রামে। এই গ্রামের সঠিক অবস্থান খুঁজে না পাওয়া গেলেও, কথিত আছে যে এটি কবিরহাট উপজেলায়, এবং সর্বোচ্চ সম্ভাবনা রয়েছে এই উপজেলার চাপরাশিরহাট ইউনিয়নে। তাঁর বংশ ছিল "কারাউনা" নামক একটি তুর্কী উপজাতি। মুবারক সিলাহদার হিসাবে চাকরী পেয়েছিল সোনারগাঁওয়ের শাসক বাহরাম খানের দরবারে।
বাংলায় স্বাধীন সুলতানি শাসনের সূচনা ও ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ
১২০৪ খ্রিস্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজির মাধ্যমে বাংলায় মুসলিম শাসনের সূচনা হয়। বখতিয়ারের বাংলা বিজয়ের পর থেকে ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত যেসব শাসক বাংলা শাসন করেছেন, তাঁদের অধিকাংশই দিল্লির সুলতানদের দ্বারা নিয়োগপ্রাপ্ত ছিলেন। তবে দিল্লির কেন্দ্রীয় শাসনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বাংলার শাসকরাও প্রায়শই স্বাধীন হওয়ার চেষ্টা করতেন। এজন্য বাংলাকে "বুলঘাকপুর" বা বিদ্রোহের নগরীও বলা হত।
১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ সোনারগাঁও-এ স্বাধীন সুলতানি যুগের সূচনা করেন। এরপর প্রায় দু'শ বছর বাংলা অবিচ্ছিন্নভাবে স্বাধীনতা ভোগ করে। এ সময় বাংলার সুলতানরা শাসনব্যবস্থা সুসংহত করেন, শিক্ষার বিকাশ ঘটান এবং জনকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। তাই এই সময়কালকে বাংলার "গৌরবময় যুগ" বলা হয়।
উত্থান পর্ব
দিল্লির সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের শাসনামলে বাংলা তিনটি প্রশাসনিক অঞ্চলে বিভক্ত ছিল—সোনারগাঁও, লখনৌতি ও সাতগাঁও। ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে সোনারগাঁওয়ের শাসনকর্তা বাহরাম খান (তাতার খান) মৃত্যুবরণ করলে তাঁর এক সিলাহ্দার (বর্মরক্ষক) ফখরুদ্দিন স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং "মুবারক শাহ" উপাধি গ্রহণ করেন।
এ সময় দিল্লির সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলক সাম্রাজ্যের বিভিন্ন বিদ্রোহ দমনে ব্যস্ত থাকায় বাংলায় কোন অভিযান পাঠাতে পারেননি। এই সুযোগে ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ বাংলার ক্ষমতা সুদৃঢ় করেন এবং বাংলায় স্বাধীন শাসনের সূচনা হয়।
বিদ্রোহ দমন ও সোনারগাঁও পুনরুদ্ধার
ফখরুদ্দিন মুবারক শাহের স্বাধীনতা ঘোষণার পর লখনৌতির গভর্নর কদর খান ও সাতগাঁও-এর গভর্নর মালিক ইজুদ্দিন ইয়াহিয়া তাঁর বিরুদ্ধে যৌথভাবে আক্রমণ চালান। এতে তিনি পরাজিত হয়ে বর্তমান টাঙ্গাইলের মধুপুরের জঙ্গলে আশ্রয় নেন এবং সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন।
কিছুদিন পর শত্রুপক্ষ দুর্বল হয়ে গেলে ফখরুদ্দিন কৌশলে সোনারগাঁও পুনরুদ্ধার করেন। তিনি বর্ষা মৌসুমের অপেক্ষায় ছিলেন, কারণ সোনারগাঁও ছিল নিম্নভূমি, যা বর্ষায় প্লাবিত হলে শত্রুপক্ষ দুর্বল হয়ে পড়বে। সুযোগমতো তিনি পাল্টা আক্রমণ করেন এবং শত্রুসৈন্যদের দুর্নীতিগ্রস্ত করে নিজের পক্ষে নিয়ে আসেন। শেষ পর্যন্ত লড়াইয়ে কদর খান পরাজিত ও নিহত হলে ফখরুদ্দিন বাংলার নিয়ন্ত্রণ পুনরায় প্রতিষ্ঠা করেন। এই সোনারগাঁও-ই ছিল স্বাধীন বাংলার প্রথম রাজধানী।
ফখরুদ্দিন মুবারক শাহের অবদান
ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ ছিলেন বাংলার প্রথম স্বাধীন সুলতান। তিনি নিজ নামে মুদ্রা জারি করেন এবং রাজ্যসীমা দক্ষিণ-পূর্ব দিকে সম্প্রসারণ করে চট্টগ্রাম বিজয় করেন। তাঁর শাসনামলে চাঁদপুর থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত একটি রাজপথ নির্মাণ করা হয়।
তিনি ইসলাম প্রচার ও ধর্মীয় শিক্ষার প্রসারে আউলিয়া, পীর-দরবেশ ও ফকিরদের উদার পৃষ্ঠপোষকতা করেন, যার ফলে চট্টগ্রামসহ সমগ্র পূর্ববঙ্গে ইসলামের প্রচার ও প্রসার ঘটে।
ইবনে বতুতার বিবরণী
ফখরুদ্দিন মুবারক শাহের শাসনামলে বিখ্যাত মুসলিম পর্যটক ইবনে বতুতা বাংলায় আসেন (১৩৪৫-৪৬ খ্রি.)। তাঁর "রেহেলা-ই-ইবনে বতুতা " গ্রন্থে তিনি বাংলার কৃষি, বাণিজ্য, সামাজিক অবস্থা, ধর্মীয় সম্প্রীতি ও নারীর মর্যাদার প্রশংসা করেছেন। ইবনে বতুতা সিলেটে বিখ্যাত সুফি সাধক হযরত শাহজালালের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং পরে চীনের উদ্দেশ্যে বাংলা ত্যাগ করেন।
ফখরুদ্দিন মুবারক শাহের মৃত্যু
ফখরুদ্দিন মুবারক শাহের দক্ষ শাসনব্যবস্থা বাংলার গৌরবকে উজ্জ্বল করে তোলে। তাঁর শাসনামলে বাংলার সীমানা চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। অবশেষে ১৩৪৯ খ্রিস্টাব্দে (৭৫০ হিজরি) তিনি সোনারগাঁয়ে মৃত্যুবরণ করেন।