ইয়াকুব (আঃ) এর জীবনী | Biography of Jacob in Islam
ইয়াকুব (আঃ) এর জীবনী | Biography of Jacob in Islam

নবী
হজরত ইয়াকুব
يَعْقُوب যাকোব আলাইহিস সালাম
|
|
---|---|
![]() ইসলামি চারুলিপিতে লেখা ইয়াʿকুব
|
|
সমাধি |
পিতৃকুলপতিদের গুহা, হিব্রোণ |
অন্যান্য নাম |
বাইবেলীয়: যাকোব |
দাম্পত্য সঙ্গী |
রাহেল, লেয়া |
সন্তান |
ইউসুফ, বিনিয়ামীন এবং আরও ১০জন |
পিতা-মাতা |
ইসহাক রিবিকা |
হযরত ইয়াকুব(আঃ)এর জীবনী
ইয়াʿকুব (ইংরেজি: Jacob; হিব্রু ভাষায়: יַעֲקֹב, Yaʿakov; প্রাচীন গ্রিক: Ἰακώβ, Iakōb; আরবি: يَعْقُوب, প্রতিবর্ণীকৃত: Yaʿqūb), ইসরাঈল নামেও পরিচিত (হিব্রু ভাষায়: יִשְׂרָאֵל; আধুনিক: Yiśrāʾēl; সপ্ততি গ্রিক ভাষায়: Ἰσραήλ Israēl; আরবি ভাষায়: إِسْرَائِيل), হিব্রু বাইবেল এবং কোরআনের বর্ণনা অনুসারে, তিনি ছিলেন একজন নবী।[১] তার গোত্রের নাম ছিল বনী ইসরাঈল। বনী ইসরাঈল নামে কোরআনে একটি সূরা নাযিল হয়েছে।
জীবনী
পারিবারিক জীবন
জন্ম ও পরিবার
হযরত ইয়াকুব (আঃ) ও তাঁর যমজ ভাই ঈসু ইসহাক (আঃ) ও রেবেকার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। যদিও ঈসু ছিলেন পিতার প্রিয়, ইয়াকুব (আঃ) ছিলেন মাতার প্রিয়। ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী, ছোট ভাই ইয়াকুব (আঃ) নবুয়তের মর্যাদা লাভ করেন।
কুরআন মজীদে হযরত ইয়াকুব (আ)
কুরআন মজীদে নামসহ খোলবার হযরত ইয়াকূব (আ)-এর প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হইয়াছে এবং সর্বনামরূপে আরও কয়েক স্থানে তাহার প্রসঙ্গ আসিয়াছে। যেমন ২ : ১৩২, ১৩৩, ১৩৬, ১৪০; ৩ : ৮৪; ৪ : ১৬৩; ৬ ও ৮৪; ১১ ও ৭১; ১২ : ৬, ৩৮, ৬৮; ১৯ ও ৬, ৪৯; ২১ : ৭২; ২৯ : ২৭; ১৮: ৪৫। এইসব স্থানে হযরত ইয়াকূব (আ) সম্পর্কে যে তথ্যাবলী উক্ত আছে তাহা মূল পাঠসহ নিবন্ধের সংশ্লিষ্ট স্থানসমূহে উদ্ধৃত হইয়াছে।
ইয়াকুব (আ)-এর বৈবাহিক জীবন ও সন্তান-সন্তুতি
ইয়াকূব (আ) মাতুলালয়ে পৌঁছিয়া তাহার গবাদিপশু লালন-পালনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মামার দুই কন্যা ছিল, বড়জনের নাম লিয়া এবং ছোটজনের নাম রাহীল। সাত বৎসর পর ইয়াকূব (আ) মামার ছোট কন্যা রাহীলকে বিবাহ করিতে আগ্রহ প্রকাশ করিলেন। কিন্তু মামা তাঁহার সহিত জ্যেষ্ঠা কন্যা লিয়ার বিবাহ দিলেন। কারণ জ্যেষ্ঠা কন্যাকে অবিবাহিত রাখিয়া কনিষ্ঠা কন্যার বিবাহদান তাহাদের রীতিবিরুদ্ধ ছিল (বিদায়া, ১খ., পৃ. ১৯৫)। অবশ্য পরে আরো সাত বৎসর (বিদায়া, ১খ., পৃ. ১৯৫; বাইবেলের আদিপুস্তক, ২৯ ও ২৭) মামার পশুপাল চরাইবার পর তিনি তাহার কাঙ্খিত মামাত ভগিনী রাহীলকেও বিবাহ করিতে সক্ষম হইলেন। তৎকালে একত্রে দুই বোনকে বিবাহ করা বৈধ ছিল। তাহার কন্যা লিয়ার সহিত জুলফা (সিল্পা) ও রাহীলের সহিত বিলহা নাম্বী দুইটি দাসীও দান করেন। পরে দুই স্ত্রী স্ব স্ব দাসীকেও ইয়াকূব (আ)-এর সহিত বিবাহ দেন (বিদায়া, ১খ., পৃ. ১৯৫)।
আল্লাহ্ তাআলা এই চারজন স্ত্রীর গর্ভে ইয়াকূব (আ)-কে দ্বাদশ পুত্র ও এক কন্যা সন্তান দান করেন। প্রথম স্ত্রী লিয়ার গর্ভে রূবিল (রূবেন=পুত্রকে দেখ), শামউন (শিমিয়ন=শ্রবণ), লাবী (লেবী=আসক্ত), ইয়াহূ (যিহূদা=স্তব), ঈসাখর, অপর বর্ণনায় ইব্নসাখর (ইযাখর=বেতন) ও যাঈন (সবুলুন= বসবাস) নামে পাঁচ পুত্র সন্তান এবং রাহীলের গর্ভে হযরত ইউসুফ (যোশেফ= বৃদ্ধি) ও বিনয়ামীন (বিন্যামিন=দক্ষিণ হস্তের পুত্র), তৃতীয় স্ত্রী এবং রাহীলের দাসী বিলহার গর্ভে দান (বিচার) ও নাফতালী (মল্লযুদ্ধ), চতুর্থ স্ত্রী এবং লিয়ার দাসী যুলফার গর্বে জাদ, অপর বর্ণনায় হায় (গাদ=সৌভাগ্য) ও আশীর (ধন্য) জন্মগ্রহণ করে (বিদায়া, ১খ., পৃ. ১৯৭; আরও দ্র. পৃ. ১৯৫; আল-কামিল, ১খ, পৃ. ৯৫-৬; তাফসীরে তাবারী, বাংলা অনু., ২খ, পৃ. ৩৬৭-৮; বাইবেলের আদিপুস্তক, ২৯ ও ৩২-৩৫; ৩০ : ১-২৪; ৩৫ : ১৮ ও ২৩-২৬)। বিনয়ামীন ব্যতীত ইয়াকূব (আ)-এর সকল সন্তান তাঁহার মাতুলালয় হাররানে (তাবারীর মতে বাবিলে) জন্মগ্রহণ করেন।
ইয়াকূব (আ)-এর উসীলায় আল্লাহ্ তাআলা তাঁহার মামার সম্পদে, বিশেষত গবাদিপশুতে প্রচুর বরকত ও প্রাচুর্য দান করেন। তিনি মোট বিশ বৎসর মাতুলালয়ে অবস্থান করেন (বিদায়া, ১খ., পৃ. ১৯৫)। পরে আল্লাহ তাআলা ওহীর মাধ্যমে ইয়াকূব (আ)-কে তাঁহার পিতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তনের নির্দেশ দান করেন এবং তাঁহাকে সহায়তা দানের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন (বিদায়া, ১খ., পৃ. ১৯৫)। তদনুযায়ী তিনি সপরিবারে প্রচুর সম্পদসহ পিতৃভূমি হেব্রনে ফিরিয়া আসেন। আসার পথে রাহীল “আফরাছ” (ইফরাত বা বেথেলহাম) নামক স্থানে বিনয়ামীনকে প্রসব করার পরপরই ইনতিকাল করেন। ইয়াকূব (আ) তাহাকে এখানেই দাফন করেন এবং তাহার কবরের উপর একটি প্রস্তর স্তম্ভ স্থাপন করেন (বিদায়া, ১খ., পৃ. ১৯৭; বাইবেলের আদিপুস্তক, ৩৫ ও ১৬-২০)।
ইব্ন কাছীর (র) আহলে কিতাবের বরাতে উল্লেখ করেন যে, কানআনে বসবাসকালে ইয়াকূব (আ)-এর একমাত্র কন্যা দীনাকে এতদঞ্চলের রাজপুত্র শিখীম অপহরণ করে। শিখীমের পিতা জামূর (হমোর) তাহার পুত্রের সহিত এই কন্যাকে বিবাহ দেওয়ার প্রস্তাব করিলে ইয়াকূব (আ)-এর পুত্রগণ বলিলেন যে, তাহারা খাতনাহীনদের সহিত আত্মীয়তা করেন না। যদি তাহারা সকলে খাতনা করিতে সম্মত হয় তবে উক্ত প্রস্তাব গ্রহণ করা যাইতে পারে । তাহারা খাতনা করিবার তৃতীয় দিনে অসুস্থ হইয়া পড়িল। এই সুযোগে ইয়াকূব (আ)-এর পুত্রগণ রাজ-পরিবারে আক্রমণ চালাইয়া শিখীম ও তাহার পিতাসহ বহু লোককে হত্যা করেন। এই আক্রমণে রাজবংশের শক্তি খর্ব হইয়া যায় (দ্র. আদিপুস্তক ৩৪ : ১-৩১)। বাইবেলে বর্ণিত এই ঘটনাটি নবী পরিবারের মর্যাদার পরিপন্থী বিধায় গ্রহণযোগ্য নহে।
কুরআন মজীদ হইতেও ইয়াকূব (আ)-এর বারজন পুত্র থাকার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ইউসুফ (আ) তাঁহার পিতার নিকট তাঁহার স্বপ্নের কথা এইভাবে ব্যক্ত করেন :
“হে আমার পিতা! নিশ্চয় আমি দেখিয়াছি একাদশ নক্ষত্র, সূর্য ও চন্দ্রকে, আমি এইগুলিকে আমার প্রতি সিজদাবনত অবস্থায় দেখিয়াছি” (১২ ও ৪)।
ইব্ন আব্বাস (রা)-র মতে একাদশ নক্ষত্র অর্থ ইউসুফ (আ)-এর একাদশ ভ্রাতা এবং সূর্য ও চন্দ্র অর্থ তাঁহার পিতা-মাতা (তাফসীরে ইব্ন আব্বাস, পৃ. ১৯৩; তাফসীরে উছমানী, সৌদী সং, পৃ. ৩১২, টীকা ২; মাআরেফুল কোরআন, সংক্ষিপ্ত সৌদী সং, পৃ. ৬৫১, কলাম ২; তাফহীমুল কুরআন, সূরা ইউসুফ, ৪ নং টীকা)। ইবন আব্বাস (রা)-র মতে ইউসুফ (আ)-এর স্বপ্ন দর্শনকালে তাঁহার হযরত ইয়াকূব (আ) মাতা রাহীল জীবিত ছিলেন (তাফসীরে ইব্ন আব্বাস, পৃ. ১৯৩)। তাফসীরে কুরতুবীতে বলা হইয়াছে যে, তখন তাঁহার মাতা জীবিত ছিলেন না, তাঁহার সত্যতা লিয়া জীবিত ছিলেন। শেষোক্ত মত সত্য হইলে ইয়াকূব (আ) সপরিবারে মিসর গমনকালেও লিয়া জীবিত ছিলেন। কারণ ইউসুফ (আ)-এর রাজ-দরবারে তাহাদের উপস্থিতি প্রসঙ্গে কুরআন মজীদে বলা হইয়াছে :
“এবং ইউসুফ তাহার মাতা-পিতাকে উচ্চাসনে বসাইল এবং তাহারা সকলে তাহার সম্মানে সিজদায় লুটাইয়া পড়িল” (১২ : ১০০)।
বাইবেল হইতে জানা যায় যে, লিয়া ইয়াকূব (আ)-এর জীবদ্দশায় মারা যান (আদিপুস্তক, ৪৯ : ৩১)। তাঁহার অপর স্ত্রীদ্বয় কখন মৃত্যুবরণ করেন সেই সম্পর্কে কিছু জানা যায় না।
হযরত ইয়াকূব (আ) পুত্রগণের মধ্যে বৃদ্ধ বয়সের পুত্র ইউসুফ (আ)-কে সর্বাধিক স্নেহ করিতেন। স্বপ্নের বিবরণ শুনিয়াই তিনি তাঁহাকে নিজ ভ্রাতাদের নিকট তাহা গোপন রাখার উপদেশ দেন, যাহাতে তাহারা তাহার ক্ষতিসাধন করিতে না পারে (দ্র. ১২ : ৫)। ১২ : ৬ হইতে ১৮ আয়াত পর্যন্ত তাহার বিরুদ্ধে সৎ ভ্রাতাদের ষড়যন্ত্র ও তাহা বাস্তবায়নের ঘটনা উল্লিখিত হইয়াছে। সর্বাধিক প্রিয় সন্তানকে হারাইয়া হযরত ইয়াকূব (আ) পুত্রশোকে এক পর্যায়ে দৃষ্টিশক্তি হারাইয়া ফেলেন এবং পরবর্তী কালে ইউসুফ (আ)-এর জামা তাঁহার মুখমণ্ডলে স্পর্শ করাইলে তিনি পুনরায় দৃষ্টিশক্তি লাভ করেন (দ্র. ১২ : ৮৪ ও ৯৬)। এক সময়ে কানআনে দুর্ভিক্ষের প্রাদুর্ভাব হইলে ইয়াকূব (আ) তাঁহার দশ পুত্রকে খাদ্যশস্য সংগ্রহের জন্য মিসরে প্রেরণ করেন। ইউসুফ (আ) তাহাদেরকে দেখিয়া চিনিয়া ফেলেন কিন্তু নিজের পরিচয় গোপন রাখেন, অবশ্য তাহারা তাহাকে চিনিতে পারে নাই (দ্র. ১২ ও ৫৮)। তিনি তাহাদেরকে পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য দান করেন, গোপনে তাহাদের ক্রয়মূল্য ফেরত দেন এবং তাহারা পুনর্বার আসিলে তাহাদের কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে সঙ্গে করিয়া আনিবার জন্য জোর তাগিদ দেন (দ্র. ১২ : ৫৯-৬২)। তাহাদের কনিষ্ঠ ভ্রাতা এবং ইউসুফ (আ)-এর সহোদর বিয়ামীনই ছিলেন তখন ইয়াকূব (আ)-এর সর্বাধিক স্নেহের পাত্র। মিসর হইতে ফিরিয়া আসিয়া তাহারা পিতাকে মিসরের শাসনকর্তার অনুরোধ সম্পর্কে অবহিত করিল এবং বিয়ামীনকে তাহাদের সঙ্গী করা হইলে তাহার নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতিও প্রদান করিল (১২ : ৬৩)। ইয়াকূব (আ) বিদায়কালে বলিলেন :
“আল্লাহই রক্ষণাবেক্ষণে শ্রেষ্ঠ এবং তিনি সর্বশ্রেষ্ট দয়ালু” (১২ ও ৬৪)।
দ্বিতীয়বার তাহারা মিসর পৌঁছিলে ইউসুফ (আ) তাঁহার সহোদরকে সুকৌশলে নিজের কাছে রাখিয়া দেন এবং নিজের পরিচয় সহোদরের নিকট ব্যক্ত করেন (দ্র. ১২ : ৬৯-৭৯)। বিয়ামীন মিসর হইতে প্রত্যাবর্তন না করায় ইয়াকূব (আ) আল্লাহর তরফ হইতে ইঙ্গিত পাইলেন যে, তাঁহার স্নেহের ধন ইউসুফ (আ) এখনো জীবিত আছেন। তিনি পুত্রদের সহিত সাক্ষাতের জন্য ব্যাকুল হইয়া উঠিলেন। এইজন্য তাহার অপর পুত্রগণ তাঁহার প্রতি অনুযোগ (দ্র. ১২ : ৮৬) করিলে তিনি বলেন :
“আমি আমার অসহনীয় বেদনা এবং আমার দুঃখ শুধু আল্লাহর নিকট নিবেদন করিতেছি। আমি আল্লাহর নিকট হইতে জানি যাহা তোমরা জান না” (১২ : ৮৬)। তৃতীয়বার তাহারা মিসর পৌঁছিলে ইউসুফ (আ) তাহাদের সামনে নিজের পরিচয় ব্যক্ত করেন, তাহাদের পূর্বের কৃতকর্মের কথা স্মরণ করাইয়া দেন এবং তাহাদের জন্য ক্ষমা ঘোষণা করেন এবং তাহাদের সকলকে সপরিবারে মিসরে চলিয়া আসিতে বলেন (দ্র. ১২ : ৮৬-৯৩)।
তখন তিনি স্পষ্টভাবে ইউসুফ (আ)-এর নাম উচ্চারণ পূর্বক তাহাদেরকে পুনরায় মিসরে যাইতে বলেন। তাহারা ইউসুফ (আ)-এর দরবারে উপস্থিত হইয়া অনুনয়-বিনয় করিয়া তাহাদের জন্য রসদ সরবরাহের আবেদন জানায়। তিনি তাহাদের সঙ্গে পিতার জন্য নিজের জামা প্রেরণ করেন (দ্র, ১২ : ৯৩)। চতুর্থবারের সফরে হযরত ইয়াকূব (আ) সপরিবারে মিসর গমন করেন। তাহারা শহরদ্বারে পৌঁছিলে ইউসুফ (আ) পিতা-মাতাকে আলিঙ্গনের মাধ্যমে অভ্যর্থনা জানাইয়া নির্ভয়ে ও নিরাপদে রাজধানীতে প্রবেশ করিতে বলেন। রাজ-দরবারে তিনি পিতা-মাতাকে তাঁহার পাশে বসান এবং দশ ভ্রাতা তাঁহাকে রাজকীয় সম্মান প্রদর্শন পূর্বক সিজদা করে (দ্র, ১২ : ৯৯-১০০)। তখন ইউসুফ (আ) বলেন :
“হে আমার পিতা! ইহাই আমার পূর্বেকার স্বপ্নের ব্যাখ্যা, আমার প্রতিপালক উহাকে সত্যে পরিণত করিয়াছেন” (১২৪ ১০০) দ্বাদশ পুত্র হইতে দ্বাদশ গোত্র
হযরত ইয়াকূব (আ)-এর দ্বাদশ পুত্র হইতে আল্লাহ তাআলা দ্বাদশ গোত্রের উম্মেষ ঘটান। এই সম্পর্কে কুরআন মজীদে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত বিদ্যমান ও
“আমি তাহাদেরকে দ্বাদশ গোত্রে বিভক্ত করিয়াছি” (৭ : ১৬০; আরও দ্র. ৫ : ১২; এবং ২ : ৬০)।
পুত্রগণের মধ্যে হযরত ইউসুফ (আ)-এর নবুওয়াত সম্পর্কে কুরআন মজীদে সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে, কিন্তু তাঁহার অবশিষ্ট ভ্রাতাগণ নবী ছিলেন কি না সেই বিষয়ে কোন উল্লেখ নাই। অধিকাংশ তাফসীরকারের মতে তাহারা নবী ছিলেন না (বিদায়া, ১খ, পৃ. ১৯৮)। অবশ্য কতক তাফসীরকার নিম্নোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় তাহারাও নবী ছিলেন বলিয়া মত প্রকাশ করিয়াছেন :
“এবং যাহা নাযিল হইয়াছে ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকূব ও তাহার বংশধরগণের উপর” (২৪ ১৩৬)।
“বল, আমরা ঈমান আনিয়াছি আল্লাহতে এবং আমাদের প্রতি যাহা অবতীর্ণ হইয়াছে এবং ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকূব ও তাহার বংশধরগণের প্রতি যাহা অবতীর্ণ হইয়াছে …….” (৩ : ৮৪)।
“এবং আমি ওহী প্রেরণ করিয়াছি ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকূব ও তাহার বংশধরগণের প্রতি” (৪ : ১৬৩)।
উক্ত আয়াতসমূহে উদ্ধৃত আসবাত শব্দটির (এ.ব. সিবৃত) অর্থ বংশধরও হইতে পারে এবং ইয়াকূব (আ)-এর বারজন পুত্রও হইতে পারে। ইব্ন আব্বাস (রা) ও ইবন জারীর তাবারী (র)-এর মতে আসবাত হইল ইয়াকূব (আ)-এর পুত্রগণ (তাফসীরে ইব্ন আব্বাস, ৩ ও ৮৪, পৃ. ৫১; তাফসীরে তাবারী, বাংলা অনু., ২খ, পৃ. ৩৬৭)। তাবারী আরও বলেন, আসবাত দ্বারা হযরত ইয়াকূব (আ)-এর সন্তানদের মধ্যে যাহারা নবী ছিলেন তাহাদেরকে বুঝায় (পৃ. ৩৬৬)।
ইব্ন কাছীর (র) বলেন, “আসবাত শব্দটি তাহাদের নবুওয়াত লাভের শক্তিশালী দলীল হইতে পারে না। কেননা আসবাত অর্থ শুউব বানী ইসরাঈল (ইসরাঈল-সন্তানগণের গোত্রসমূহ)। তাহাদের কাহারও প্রতি ওহী নাযিল হওয়ার কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না, যেভাবে ইউসুফ (আ) সম্পর্কে পাওয়া যায় (বিদায়া, ১খ., পৃ. ১৯৮-৯)।
সূরা ইউসুফের ঘটনাবলী হইতেও এই শেষোক্ত মতের সমর্থন পাওয়া যায়। পার্থিব স্বার্থকে কেন্দ্র করিয়া নবী-রাসূলগণের পরস্পরের মধ্যে কখনও সংঘাত বাঁধিবার কোন নযির ইসলামী ইতিহাসে বিদ্যমান নাই। অথচ ইউসুফ (আ)-এর সৎ ভ্রাতাগণ তারুণ্যে ও যৌবনে তাঁহাকে কঠিন বিপদে নিক্ষেপ করিয়া সন্ধ্যায় পিতার নিকট উপস্থিত হইয়া বানোয়াট বিবৃতি প্রদান করেন (দ্র. ১২ ৪ ৮-১৮)। প্রাপ্ত বয়সে মিসরে ইউসুফ (আ)-এর দরবারে উপস্থিত হইয়া তাহার ও তাঁহার ভ্রাতা বিয়ামীনের প্রতি চৌর্যবৃত্তির মিথ্যা অপবাদ আরোপ করেন (দ্র, ১২ : ৭৭) এবং ইউসুফ (আ)-এর সাক্ষাত পরিচয় পাওয়ার পর তাহারা মিসর হইতে পিতার নিকট কানআনে ফিরিয়া আসিলে তিনি তাহাদেরকে ইউসুফ (আ)-এর ঘ্রাণ পাইতেছেন বলিয়া জানাইলে তাহারা সত্য ঘটনাকে অস্বীকার করিবার সঙ্গে সঙ্গে পিতাকে বিভ্রান্ত বলিয়া আখ্যায়িত করেন (দ্র. ১২ : ৮৮-৯৫)। অথচ নবী-রাসূলগণ শিশুকাল হইতেই সরল-সহজ ও সৎ মানুষ হিসাবে বাড়িয়া উঠেন (এই সম্পর্কে তাফসীরে উসমানী, সৌদী সং, পৃ. ৩১২, টীকা ৩ দ্র.)। অবশ্য তাঁহার সৎ ভ্রাতাগণ আল্লাহর নিকট তওবা ও ক্ষমা প্রার্থনা করিয়া অনুতপ্ত হইলেন এবং পিতা ও ইউসুফ (আ)-ও তাহাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন (দ্র. ১২৪ ৯২ ও ৯৭-৮)।
হযরত ইয়াকূব (আ)-এর নবুওয়াত লাভ
ইয়াকূব (আ) ছিলেন আল্লাহ তাআলার একজন সম্মানিত মহান পয়গাম্বর, তিনি বিশেভভাবে কাআনবাসীদের মধ্যে আল্লাহর দীন প্রচারের জন্য প্রেরিত হইয়াছিলেন এবং এখানেই তিনি জীবনের অধিকাংশ কাল দীন ইসলামের প্রচার করেন (কাসাসুল কুরআন, উর্দু, ১খ., পৃ. ২৭৯)। মহান আল্লাহ তাঁহার নবুওয়াত সম্পর্কে বলেন
“এবং আমি তাহাকে দান করিলাম ইসহাক ও ইয়াকূব এবং প্রত্যেককে নবী করিলাম” (১৯ ও ৪৯)।
“আমি ওহী পাঠাইয়াছি ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকূব ও তাহার বংশধরগণের নিকট “ (৪ : ১৬৩)।
“বল, আমরা ঈমান আনিয়াছি আল্লাহ্তে এবং আমাদের প্রতি যাহা নাযিল হইয়াছে এবং ইবরাহীম, ইসমাঈল ইসহাক ও ইয়াকূব এবং তাহার বংশধরগণের প্রতি যাহা নাযিল হইয়াছে” (৩ : ৮৪; আরও দ্র. ২৪ ১৩৬ ও ২১ : ৭২)।
নবী-রাসূলগণের প্রধান দায়িত্ব হইল মানবজাতির নিকট আল্লাহর বাণী পৌঁছাইয়া দেওয়া, তাহা বুঝাইয়া দেওয়া এবং বাস্তবক্ষেত্রে তাহা কিভাবে কার্যকর করিতে হইবে তাহা দেখাইয়া দেওয়া। হযরত ইয়াকূব (আ) নবী হিসাবে নিশ্চয় এসব দায়িত্ব পালন করিয়াছেন, কিন্তু তিনি কিভাবে তাঁহার এলাকাবাসীর মধ্যে দীনের দাওয়াত পেশ করিয়াছেন এবং তাহা কতদূর ফলপ্রসূ হইয়াছে, ইতিহাসের গ্রন্থাবলীতে ইহার কোন বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় না। তবে এতখানি জানা যায় যে, তাহার এলাকায় তখনও পৌত্তলিক কাআন বংশীয়রা রাজত্ব করিত। তিনি সপরিবারে তাঁহার মাতুলালয় হইতে কাআনে ফিরিয়া আসিবার পর তাহার কন্যাকে কাআন বংশীয় এক রাজপুত্র অপহরণ করিয়াছিল। পরবর্তীতে ইয়াকূব (আ)-এর সন্তানগণের হাতে উক্ত রাজবংশের পতন ঘটে (দ্র. আদিপুস্তক, ৩৪ : ১-৩১)। এই ঘটনার পর হইতে অত্র এলাকায় ইয়াকূব (আ)-এর দাওয়াতের বরকতে পৌত্তলিকতার অবসান ঘটিতে থাকে এবং জনগণ দীন ইসলাম গ্রহণ করিতে থাকে। এক পর্যায়ে এই এলাকা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে পরিণত হয়। অতঃপর হযরত ইয়াকূব (আ) এখানে আল্লাহর ঘর বায়তুল মাকদিস নির্মাণ করেন। বর্তমান কালে ইহা ইয়াহুদী-খৃস্টান-মুসলিম এই তিন জাতির পবিত্র স্থানরূপে স্বীকৃত।
ইহা ব্যতীত নিবন্ধের বিভিন্ন স্থানে তাঁহার নবুওয়াতের বিষয় সংক্রান্ত আয়াতসমূহ উদ্ধৃত হইয়াছে। হযরত ইয়াকূব (আ)-এর নবী জীবনের অধিকাংশ বিবরণ সূরা ইউসুফ-এ হযরত ইউসুফ (আ)-এর সহিত সংশ্লিষ্ট।
হযরত ইয়াকূব (আ)-এর মিসর গমন ও অন্তিম জীবন
হযরত ইয়াকূব (আ) তাঁহার মাতৃভূমি মেসোপটামিয়া হইতে সপরিবারে প্রত্যাবর্তনের পর জন্মভূমি কাআনেই (ফিলিস্তীন) বসবাস করিতে থাকেন। জীবনের শেষ পর্যায়ে খৃ. পূ. ১৭০৬ অব্দে
হযরত ইয়াকূব (আ)
(বাইবেল ডিকশনারী, পৃ. ২৩), পুত্ৰ ইউসুফ (আ)-এর আবেদনক্রমে ৭০ সদস্যবিশিষ্ট (Americana, ১৫/৬৫) পরিবার-পরিজনসহ তিনি মিসরে গমন করেন (আহলে কিতাব মতে), মিতে ৭৩, অপর মতে ৮৩, আরেক মতে ৩৯০ জন (বিদায়া, ১খ., পৃ. ২১৮)। ৮০ বৎসর পর, হাসান বসরীর (র) মতে ৮৩ বৎসর, কাতাদার (র) মতে ৩৫ বৎসর, ইবন ইসহাকের (র) মতে ১৮ বৎসর এবং আহলে কিতাবমতে ৪০ বৎসর পর পিতা-পুত্রের পুনর্মিলন হয় (বিদায়া, ১খ., পৃ. ২১৭)।
ইব্ন ইসহাক আহলে কিতাবের বরাতে বলেন, হযরত ইয়াকূব (আ) মিসরে আগমনের পর এখানে ১৭ বৎসর জীবিত ছিলেন (বিদায়া, ১খ., পৃ. ২২০; আদিপুস্তক, ৪৭ : ২৮)। কিন্তু Colliers Enyclopedia-তে সাত বৎসর উল্লেখ করা হইয়াছে (১৩ ব., পৃ. ৪২৭)। এই সময়কালে পিতা-পুত্র মিসরে ব্যাপক ভিত্তিতে ইসলাম প্রচার করেন। ফলে গরিষ্ঠ সখ্যক মিসরবাসী দীনে হানীকের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেন। বস্তুত নবী-রাসূলগণের প্রধান কাজই হইল মানবজাতির নিকট আল্লাহর দীনের দাওয়াত পৌঁছানো। তাই তাঁহারা সর্বাবস্থায় দীনের দাওয়াত দিয়াছেন, এমনকি হ্যরত ইউসুফ (আ) সম্পর্কে তো কুরআন মজীদেই বর্ণিত হইয়াছে যে, তিনি অত্যন্ত প্রজ্ঞার সহিত যুক্তি সহকারে জেলখানায় বন্দী অবস্থায়ও তাঁহার সহ-কয়েদীদের মধ্যে দীনের প্রচারকার্য অব্যাহত রাখেন (দ্র. ১২ ও ৩৭-৪০)।
ইব্ন কাছীর (র) বলেন, আহলে কিতাবমতে মিসরে গমনকালে তাঁর বয়স হইয়াছিল ১৩০ বৎসর (বিদায়া, ১খ., পৃ. ২২০), কিন্তু তিনি তাঁহার বয়স মোট ১৪০ বৎসর উল্লেখ করিয়াছেন (পৃ. ২২০)। অথচ বাইবেলে তাহার মোট বয়স ১৪৭ বৎসর বর্ণিত হইয়াছে (আদিপুস্তক, ৪৭ : ২৮; Colliers Ency., ১৩ খ, পৃ. ৪২৭; Americana, ১৫খ, পৃ. ৬৫৫; Ency. Relig., ৭, পৃ. ৫০৩)। মৃত্যুর পূর্বে তিনি ইউসুফ (আ)-কে ওসিয়াত করিয়া যান যে, তাঁহার লাশ যেন তাঁহার পিতৃপুরুষ ইসহাক ও ইবরাহীম (আ)-এর কবরস্থানে দাফন করা হয় এবং তাহার ওসিয়াত প্রতিপালিত হয় (বিদায়া, ১খ., পৃ. ২২০; আদিপুস্তক, ৪৯ ও ৩০-৩৩; আরও দ্র. Colliers Ency., ১৩খ, পৃ. ৪২৭; Ency. Relig., ৭খ., পৃ. ৫০৪; Americana, ১৫খ, পৃ. ৬৫৫)। ইউসুফ (আ)-ই তাঁহার পিতার লাশ কানআনে বহন করিয়া আনেন এবং হেবরনে (বর্তমান আল-খলীল) দাফন করেন (বিদীয়া, ১খ., পৃ. ২২০)। মিসরবাসী তাঁহার জন্য ৭০ দিন শোক পালন করে (ঐ, পৃ. ২২০; আদিপুস্তক, ৫০ ও ৩)।
অন্তিম উপদেশ
হযরত ইয়াকূব (আ) যখন বুঝিতে পারিলেন যে, তাঁহার অন্তিম মুহূর্ত নিকটবর্তী, তিনি তাঁহার সন্তানদেরকে ডাকিয়া সেই উপদেশ দান করিলেন যাহা তাঁহার পিতামহ হযরত ইবরাহীম (আ) তাঁহার পুত্রগণকে দান করিয়াছিলেন। তাঁহার উপদেশ এই ছিল যে, “আল্লাহ এক, তাঁহার কোনও শরীক নাই”। এই মূল ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত দীন ইসলামকে আমৃত্য আকড়াইয়া ধরিতে হইবে। কুরআন মজীদে বিষয়টি এইভাবে উল্লিখিত হইয়াছে :
“এবং ইবরাহীম ও ইয়াকূব এই সম্বন্ধে তাহাদের পুত্রগণকে নির্দেশ দিয়া বলিয়াছিল, হে পুত্রগণ! আল্লাহই তোমাদের জন্য এই দীনকে মনোনীত করিয়াছেন। অতএব তোমরা আমৃত্য মুসলমান থাকিবে। ইয়াকূবের নিকট যখন মৃত্যু আসিল তখন তোমরা কি উপস্থিত ছিলে? সে যখন তাহার পুত্রগণকে জিজ্ঞাসা করিল, আমার পরে তোমরা কিসের ইবাদত করিবে, তখন তাহারা বলিল, আমরা আপনার ইলাহ্-এর এবং আপনার পিতৃপুরুষ ইবরাহীম, ইসমাঈল ও ইসহাকের ইলাহ-এর ইবাদত করিব। তিনিই একমাত্র ইলাহ এবং আমরা তাঁহার নিকট আত্মসমর্পণকারী” (২: ১৩২-৩)।
রাসূলুল্লাহ (স) যখন মদীনা ও তৎপার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহে “আল্লাহ্ এক এবং তাঁহার কোনও শরীক নাই”, এই দাওয়াত দিতেছিলেন এবং বলিতেছিলেন, ইহাই ইবরাহীম (আ)-এর একনিষ্ঠ ধর্ম (দীনে হানীফ), তখন ইয়াহুদী ও খৃস্টানরা দাবি করিল যে, তাহারাই তো ইবরাহীম (আ)-এর ধর্মের অনুসারী। শুধু তাহাই নহে, ইয়াহুদী-খৃস্টানরা তো মুসলমানদেরকে লূতন ধর্ম ত্যাগ করিয়া তাহাদের নিজ নিজ ধর্মের অনুসরণ করিতে বলিতে লাগিল এবং ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকূব (আ) ও তাঁহার বংশধরগণ ইয়াহুদী-খৃস্টান ছিল বলিয়া দাবি করে। মহান আল্লাহর ভাষায়:
“তোমরা কি বল, ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকূব ও তাহার বংশধরগণ ইয়াহূদী কিংবা খৃস্টান ছিল? তুমি বল, তোমরা কি বেশি জান, না আল্লাহ” (২: ১৪০)?
পূর্বোক্ত আয়াত নাযিল পূর্বক ইয়াহুদী-খৃস্টানদের উপরিউক্ত দাবি প্রত্যাখ্যান করিয়া আসল সত্য তুলিয়া ধরা হইয়াছে। আয়াতে প্রদত্ত প্রশ্নাকারে প্রতিবাদের তাৎপর্য অনুধাবন করার জন্য দুইটি বিষয় বিবেচনায় রাখিতে হইবে। (এক) ইয়াহুদী ও খৃস্টান ধর্মের বর্তমান যে কাঠামো তাহা পরবর্তী কালের সৃষ্টি। ইয়াহুদী ধর্মের নামকরণ, উহার ধর্মীয় বিশেষত্ব, অনুষ্ঠানমালা ও নিয়ম-কানুন খৃস্টপূর্ব ৩য়-৪র্থ শতাব্দীতে রূপ লাভ করিয়াছে। অনুরূপভাবে যেসব ধারণা-বিশ্বাস ও বিশেষ ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির সমষ্টিকে খৃস্টবাদ বলা হয় তাহা হযরত ঈসা (আ)-এর বহু পরবর্তী কালে উদ্ভাবিত হইয়াছে। সুতরাং ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকূব ও তাঁহার বংশধরের ইয়াহুদী বা খৃস্টান হওয়ার দাবি অসার কল্পনামাত্র । (দুই) স্বয়ং ইয়াহুদী-খৃস্টানদের নিজস্ব ধর্মীয় গ্রন্থাবলী হইতেও এই কথা প্রমাণিত হইয়াছে যে, হযরত ইবরাহীম (আ)-সহ উক্ত নবীগণ এক আল্লাহ ব্যতীত অপর কিছুর ইবাদত, উপাসনা, আনুগত্যে বিশ্বাসী ছিলেন না এবং আল্লাহ তাআলার সাথে কাহাকেও অংশীদার করিতেন না। অতএব এই কথা সুস্পষ্ট যে, ইয়াহুদীবাদ ও খৃস্টবাদ উভয়ই পূর্বোক্ত নবীগণের আচরিত চিরসত্য পথ হইতে বিচ্যুত হইয়া গিয়াছে (তাফহীমুল কুরআন, সূরা বাকারার ১৩৫ নং আয়াতের ১৩৫ নং টীকা)।
বাইবেলে হযরত ইয়াকূব (আ)-এর মৃত্যুকালীন অবস্থা বিস্তারিতভাবে বর্ণিত থাকিলেও তাহাতে কুরআন মজীদে উক্ত এই মূল্যবান অন্তিম উপদেশের কোনও উল্লেখ নাই। অবশ্য ইয়াহূদীদের তালমূদ গ্রন্থে যে দীর্ঘ উপদেশমালা বর্ণিত আছে, কুরআনের উপদেশের সহিত উহার যথেষ্ট সামঞ্জস্য রহিয়াছে। তাহাতে হযরত ইয়াকূব (আ)-এর এই কথাগুলি পাওয়া যায়? “তোমরা সদাপ্রভু আল্লাহর ইবাদত করিতে থাকিবে। তিনি তোমাদেরকে সকল বিপদ হইতে রক্ষা করিবেন, যেমন করিয়াছেন তোমাদের পূর্বপুরুষদেরকে। নিজ সন্তানদেরকে সদাপ্রভুকে ভালোবাসিতে এবং তাঁহার নির্দেশ মান্য করিয়া চলিতে শিক্ষা দিবে, যাহাতে তাহাদের জীবনের অবকাশ দীর্ঘতর হয়। কেননা যাহারা সত্যের সহিত সকল কাজ সম্পন্ন করে এবং সত্যের পথে ঠিকভাবে চলে, আল্লাহ তাহাদের রক্ষণাবেক্ষণ করেন”। উত্তরে সেই সন্তানগণ বলিল, “আপনি যেই উপদেশ দিলেন তাহা আমরা মান্য করিব, আল্লাহ আমাদের সহায় হউন।” তখন ইয়াকূব (আ) বলিলেন, “তোমরা যদি সদাপ্রভুর সহজ সরল পথ হইতে ডানে-বায়ে ভ্রষ্ট হইয়া না যাও, তবে আল্লাহ নিশ্চয়ই তোমাদের সহায় হইবেন” (তাফহীমুল কুরআন, ২৪ ১৩৩ আয়াতের ১৩৩ নং টীকা)।
বায়তুল মাকদিস নির্মাণ।
আল্লামা ইব্ন কাছীর (র) তাঁহার তাফসীর গ্রন্থে পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবের বরাতে লিখিয়াছেন যে, হযরত ইয়াকূব (আ) সর্বপ্রথম বায়তুল মাকদিস নির্মাণ করেন (তাফসীর ইব্ন কাছীর, বাংলা অনু., ১৩, পৃ. ৫৭৩)। বাইবেলের আদিপুস্তকে উল্লিখিত আছে : “পরে যাকোব প্রত্যুষে উঠিয়া বালিশের নিমিত্ত যে প্রস্তর রাখিয়াছিলেন, তাহা লইয়া স্তম্ভরূপে স্থাপন করিয়া তাহার উপর তৈল ঢালিয়া দিলেন। আর সেই স্থানের নাম বৈথেল (বায়ত ঈল=আল্লাহর ঘর) রাখিলেন—– এবং এই যে প্রস্তর আমি স্তম্ভরূপে স্থাপন করিয়াছি, ইহা আল্লাহর ঘর হইবে” (২৮ : ১৮-২২)।
অতএব হযরত ইয়াকূব (আ)-ই বায়তুল মাকদিস-এর প্রথম নির্মাতা, অতঃপর হযরত সুলায়মান (আ) ইহা পুননির্মাণ করেন (বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ., পৃ. ১৯৪ ও ১৯৬; আল-মাআরিফ, পৃ. ২৩)।
হযরত আবু যার আল-গিফারী (রা) বলেন, আমি বলিলাম,
“হে আল্লাহর রাসূল! পৃথিবীতে সর্বপ্রথম কোন মসজিদ নির্মিত হয়? তিনি বলেন : মসজিদুল হারাম। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, অতঃপর কোনটি? তিনি বলেন : মসজিদুল আকসা (বায়তুল মাকদিস)। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, এই মসজিদ নির্মাণের মধ্যকার (কালের) ব্যবধান কত ছিল? তিনি বলেন : চল্লিশ বৎসর” (বুখারী, আম্বিয়া, বাব ১০, নং ৩১১৬; বাব ৪০, নং ৩১৭৩; মুসলিম, মাসাজিদ, নং ১০৪২-৩; নাসাঈ, মাসাজিদ, বাব আয়ু মাসজিদ উদিআ আওয়ালান; ইবন মাজা, মাসাজিদ, বাব ৭, নং ৭৫৩)।
বাইবেলের বিবরণ ও উক্ত হাদীছের বিষয়বস্তু হইতে প্রমাণিত হয় যে, হযরত ইবরাহীম (আ) কর্তৃক কাবা ঘর নির্মিত হওয়ার চল্লিশ বৎসর পর তাঁহার পৌত্র হযরত ইয়াকূব (আ) বায়তুল মাকদিস নির্মাণ করেন। উক্ত হাদীছের ভিত্তিতে ইবন হিব্বান মত প্রকাশ করেন যে, হযরত ইবরাহীম (আ) ও হযরত সুলায়মান (আ)-এর যুগের মধ্যে মাত্র চল্লিশ বৎসরের ব্যবধান ছিল। তিনি ধারণা করেন যে, হযরত সুলায়মান (আ)-ই বায়তুল মাকদিসের নির্মাতা। তাঁহার এই ধারণা যথার্থ নহে। বস্তুত হযরত সুলায়মান (আ)-এর যুগ ও হযরত ইবরাহীম (আ)-এর যুগের মধ্যে পার্থক্য হাজার বৎসরের অধিক। সুলায়মান (আ) উহা পুনর্নির্মাণ করিয়াছিলেন মাত্র (তাফসীর ইবন কাছীর, বাংলা অনু, ১খ, পৃ. ৫৭৪)।
উটের গোশত ভক্ষণ সংক্রান্ত বিবরণ
হযরত ইয়াকূব (আ) রুচিগত কারণে অথবা অজ্ঞাত কোন ব্যাধির কারণে কোনও কোনও ভাষ্যকার ও ঐতিহাসিক সাইটিকা নামক বাতরোগের কথাও বলিয়াছেন) উটের গোশত ভক্ষণ করিতেন না এবং উহার দুধ পান করিতেন না। তিনি ইহা ব্যক্তিগতভাবে নিজের জন্য নিষিদ্ধ করিয়া লইয়াছিলেন। পরবর্তী পর্যায়ে ইসরাঈলীরা উটের গোশত ও দুগ্ধ নিজেদের জন্য নিষিদ্ধ করিয়া লয়। বিষয়টি সম্পর্কে কুরআন মজীদে এইভাবে ইঙ্গিত করা হইয়াছে :
“তাওরাত নাযিল হওয়ার পূর্বে ইসরাঈল নিজের জন্য যাহা হারাম করিয়াছিল তাহা ব্যতীত বন্দু ইসরাঈলের জন্য যাবতীয় খাদ্যই হালাল ছিল। তুমি বল, তোমরা সত্যবাদী হইয়া থাকিলে তাওরাত আন এবং তাহা পাঠ কর। ইহার পরও যাহারা আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যা রচনা করে তাহারাই যালিম। তুমি বল, আল্লাহ সত্য বলিয়াছেন। সুতরাং তোমরা একনিষ্ঠ হইয়া ইবরাহীমের ধর্মাদর্শ অনুসরণ কর এবং সে মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নহে” (৩ : ৯৩-৯৫)।
দীন ইসলামের মূল ভিত্তি যেসব জিনিসের উপর স্থাপিত, সেই বিবেচনায় পূর্ববর্তী নবীগণের শিক্ষা ও মহানবী (স)-এর শিক্ষার মধ্যে নীতিগতভাবে কোন পার্থক্য নাই। কুরআন মজীদ ও মহানবী (স)-এর আদর্শ ও শিক্ষ সম্পর্কে ইয়াহূদী আলিমগণ যখন নীতিগত কোনও আপত্তি উত্থাপনের সুযোগ পাইল না, তখন তাহারা কতিপয় শরীআতী আইব্নগত আপত্তি উত্থাপন করিতে থাকে। এই প্রসঙ্গে তাহারা প্রশ্ন তুলিল যে, এমন অনেক জিনিসকে হযরত মুহাম্মাদ (স) হালাল ঘোষণা করিয়াছেন, যাহা পূর্বকালের নবীগণের শরীআতে সম্পূর্ণ হারাম ছিল, ইহা কিরূপে সম্ভব হইল :এখানে সেই প্রশ্নের উত্তর দিয়া বলা হইয়াছে যে, আহারের জন্য ইসলামী শরীআতে যে সমস্ত জিনিস হালাল তাহা বনূ ইসরাঈলের জন্যও হালাল ছিল। অবশ্য কোনও জিনিস এমনও ছিল যাহা তাওরাত কিতাব নাযিল হওয়ার পূর্বে বনূ ইসরাঈল স্ব-উদ্যোগে নিজেদের জন্য হারাম ঘোষণা করিয়াছিল। আল্লাহ তাআলা রাসূলুল্লাহ (স)-কে এই প্রসঙ্গে ইহা বলিতে নির্দেশ দিলেন : “তোমরা তাওরাত আন এবং উহা পাঠ কর” (৩ : ৯৩)। কিন্তু তাহারা সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করিতে দুঃসাহস দেখায় নাই। মূলত উটের গোশত ও দুধ তাওরাতে ইয়াহুদীদের জন্য হারাম ঘোষণা করা হয় নাই, হইয়া থাকিলে প্রসঙ্গক্রমে কুরআন মজীদের এই স্থানে তাহার উল্লেখ থাকিত। খাদ্যের মধ্যে কোন্ কোন্ বস্তু তাহাদের জন্য হারাম ছিল কুরআন মজীদে তাহার উল্লেখ আছে এবং তাহাও তাহাদের অবাধ্যাচরণের কারণে শাস্তিস্বরূপ হারাম করা হইয়াছিল। যেমন :
“উত্তম জিনিসসমূহ যাহা ইয়াহুদীদের জন্য হালাল ছিল, তাহাদের সীমালঙ্নের কারণে আমি তাহা তাহাদের জন্য হারাম করিয়াছি, আল্লাহর পথে অনেক লোককে বাধা প্রদানের জন্য, তাহাদের সূদ গ্রহণের জন্য, যাহা তাহাদের জন্য নিষিদ্ধ করা হইয়াছিল এবং অন্যায়ভাবে জনগণের ধন-সম্পদ গ্রাস করার জন্য” (৪ : ১৬০-১৬১)।
“আমি ইয়াহূদীদের জন্য নখরযুক্ত সমস্ত পশু হারাম করিয়াছিলাম এবং গরু ও ছাগলের চর্বিও তাহাদের জন্য হারাম করিয়াছিলাম, তবে এইগুলির পৃষ্ঠের অথবা অন্ত্রের কিংবা অস্থিসংলগ্ন চর্বি ব্যতীত, তাহাদের অবাধ্যতার দরুন তাহাদেরকে এই প্রতিফল দিয়াছিলাম। নিশ্চয় আমি সত্যবাদী” (৬ : ১৪৬)।
উক্ত আয়াতসমূহ হইতে পরিষ্কার প্রতিভাত হয় যে, ইয়াহুদীদের অবাধ্যতার শাস্তিস্বরূপ আল্লাহ তাআলা তাহাদের জন্য এই বিধান দেন। অনন্তর তাহাদের জন্য উটের গোশত ও দুধ হারাম করা হইলে তাহা অবশ্যই উক্ত আয়াতসমূহে উদ্ধৃত হইত। তাহা ছাড়া তাওরাতে উক্ত বিধান বিদ্যমান থাকিলে ৩ : ৯৩ আয়াতের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করিয়া তাহারা মহানবী (স)-এর সামনে তাওরাত কিতাব আনিয়া হাযির করিয়া দেখাইয়া দিত, কিন্তু তাহারা তাহা করিতে অপারগ ছিল। বাইবেলে যে উট ও খরগোশের গোশত হারাম (বাইবেলের লেবীয় পুস্তক, ১১ ও ৪-৬; দ্বিতীয় বিবরণ, ১৪ : ৭) লিপিবদ্ধ রহিয়াছে তাহা পরবর্তী কালের সংযোজন হইতে পারে (তাফহীমুল কুরআন, ৩ : ৯৩-৯৫ আয়াতের ৭৬, ৭৭ ও ৭৮ নং টীকা এবং ৬ ও ১৪৬ নং আয়াতের ১২২ নং টীকা; শায়খুল হিন্দের তরজমায় শাববীর আহমাদ উছমানীর টীকাভাষ্য, ৩ ও ৯৩ আয়াতের ২ ও ৩ নং টীকা, পৃ. ৭৯; ৬ : ১৪৬ আয়াত সংশ্লিষ্ট ২ নং টীকা, পৃ. ১৯৬)।
ইয়াহুদীদের দ্বিতীয় আপত্তি এই ছিল যে, তোমরা মুসলমানগণ বায়তুল মাকদিসকে ত্যাগ করিয়া কাবা ঘরকে কেন কিবলা বানাইয়াছ, অথচ পূর্বকালের নবী-রাসূলগণের কিবলা তো ছিল এই বায়তুল মাকদিস? তাহা হইলে তোমরা কিভাবে মিল্লাতে ইবরাহীমীর অনুসারী হওয়ার দাবি করিতে পার? ইহার উত্তর সূরা আল-বাকারায় (২ : ১৪২-৪৫) দেওয়া ছাড়াও উহার উত্তরে নিম্নোক্ত আয়াত (৩ : ৯৬) অবতীর্ণ হইয়াছে :
“নিশ্চয় মানবজাতির জন্য সর্বপ্রথম যে ঘর প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল তাহা তো বাক্কায় (মক্কায়), উহা বরকতময় ও বিশ্বজগতের দিশারী। উহাতে বহু সুস্পষ্ট নিদর্শন আছে। যেমন মাকামে ইবরাহীম।”
অতএব কাবা ঘর তো হযরত মূসা (আ)-এর আট-নয় শত বৎসর পূর্বে তোমাদের ইসরাঈলীদের প্রথম ও সর্বশ্রেষ্ঠ গোষ্ঠীপতি হযরত ইবরাহীম (আ) নির্মাণ করিয়াছেন এবং ইহাকে কিবলা বানাইয়াছেন। সুতরাং কাবা ঘরের সর্বাগ্রগণ্যতা সম্পর্কে কোন প্রশ্নই উঠিতে পারে না। অথচ বায়তুল মাকদিস পূর্ণাঙ্গ ইবাদতখানা হিসাবে নির্মিত হইয়াছে হযরত মূসা (আ)-এর চার শত বৎসর পর (তাফহীমুল কুরআন, ৩ ও ৯৬ আয়াত সংশ্লিষ্ট ৭৯ নং টীকা অবলম্বনে)।
ইয়াকূব (আ)–এর চারিত্রিক গুণাবলী
নবী-রাসূলগণ হইলেন মানবজাতির মধ্যে আদর্শ মানব। সরাসরি আল্লাহর তত্ত্বাবধানে তাঁহাদের জীবন সৌন্দর্য প্রস্ফুটিত হয়। সততা, নিষ্ঠা, জ্ঞান, প্রজ্ঞা, ধৈর্য, সৎকর্মশীলতা, তাওয়াক্কুল সার্বিক দিক হইতে তাঁহারা মানবজাতির অনুসরণীয় আদর্শ। নবী হিসাবে হযরত ইয়াকূব (আ)-এর মধ্যে এইসব বৈশিষ্ট্য পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান ছিল। বাইবেল যেখানে নবী-রাসূলগণের মহত গুণাবলীর যৎসামান্য বর্ণনা করার পাশাপাশি তাঁহাদের উপর এমন কালিমা লেপন করিয়াছে যে, তাঁহাদের মহৎ গুণাবলী ম্লান হইয়া গিহয়াছে, কুরআন মজীদ সেখানে তাঁহাদের মহৎ গুণাবলী তুলিয়া ধরার সঙ্গে সঙ্গে তাঁহাদের প্রতি আরোপিত অপবাদসমূহ জোরালোভাবে প্রত্যাখ্যান করিয়াছে। কুরআন মজীদ হযরত ইসহাক (আ) ও ইয়াকূব (আ)-সহ বেশ কয়েকজন নবীর উল্লেখ পূর্বক বলিয়াছে: “ইহাদের প্রত্যেককে আমি সৎপথে পরিচালিত করিয়াছি” (৬ : ৮৪), “ইহাদের প্রত্যেকেই সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত” (৬ : ৮৫), “ইহাদের প্রত্যেককে আমি বিশ্ববাসীর উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করিয়াছি” (৬ : ৮৬)।
“আমি তাহাদেরকে মনোনীত করিয়াছিলাম এবং সরল পথে পরিচালিত করিয়াছিলাম” (৬ : ৮৭)।
“আমি তাহাদেরকে কিতাব, হিকমাত ও নবুওয়াত দান করিয়াছি” (৬৪ ৮৯)।
“ইহাদেরকেই আল্লাহ সৎপথে পরিচালিত করিয়াছেন। সুতরাং তুমি (মুহাম্মাদ) তাহাদের পথের অনুসরণ কর” (৬ ও ৯০)।
ইয়াকূব (আ)-এর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ সাক্ষ্য দেন : “এবং সে অবশ্যই জ্ঞানী ছিল, কারণ আমি তাহাকে জ্ঞান শিক্ষা দিয়াছিলাম” (১২ : ৬৮)।
তাঁহার ধৈর্য সম্পর্কে দুই স্থানে বলা হইয়াছে : ১৪ ‘পূর্ণ ধৈর্যই শ্রেয় (১২৪ ১৮ ও ৮৩)।
অর্থাৎ প্রাণপ্রিয় পুত্র ইউসুফ (আ)-এর নিখোঁজ সংবাদ শ্রবণ করিয়া এবং মিসর সম্রাটের হাতে সর্বকনিষ্ঠ পুত্র বিনয়ামীন চুরির দায়ে গ্রেপ্তার হওয়ার সংবাদ শুনিয়া হযরত ইয়াকূব (আ) এই কথা বলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে আরো বলেন :
“তোমরা যাহা বলিতেছ সেই বিষয়ে একমাত্র আল্লাহ আমার সাহায্যস্থল” (১২ : ১৮)। আল্লাহর কাছেই তিনি সাহায্যপ্রার্থী হইলেন। মহানবী (স) ইহাই আমাদেরকে শিক্ষা দিয়াছেন?
“তোমার সাহায্য চাওয়ার প্রয়োজন হইলে আল্লাহর নিকটই সাহায্য প্রার্থনা কর” (তিরমিযী, বাংলা অনু, ৪খ, পৃ. ৩১৩, বাব ৫৯, নং ২৪৫৬, কিয়ামত অধ্যায়)।
হযরত ইউসুফ (আ)-এর অনুরোধে ইউসুফ (আ)-এর সহোদর বিনয়ামীনকে ইয়াকূব-পুত্রগণ তাহাদের সঙ্গে মিসরে লইয়া যাইতে চাহিলে তাহাদের পক্ষ হইতে পিতাকে বিনয়ামীনের পূর্ণ নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় (১২ ও ৬৩)। তখন তিনি নবীসুলভ কণ্ঠে বলিয়া উঠেন ও
“আল্লাহ-ই সর্বোত্তম নিরাপত্তাবিধায়ক এবং তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু” (১২ : ৬৪)।
পুত্রের নিরাপত্তার জন্য পার্থিব নিয়ম অনুযায়ী অন্যান্য পুত্রগণের নিকট হইতে প্রতিশ্রুতি গ্রহণের এবং তাহাদের মিসরে প্রবেশের প্রয়োজনীয় পরার্মশ প্রদানের (১২ ৬৬-৭) পর আল্লাহর মহা ক্ষমতার ও ভরসাস্থল হওয়ার কথা স্মরণ করাইয়া দিয়া তিনি বলিলেন :
“আল্লাহর বিধানের বিরুদ্ধে আমি তোমাদের জন্য কিছু করিতে অক্ষম। বিধান আল্লাহরই। আমি তাঁহারই উপর ভরসা করি এবং যাহারা ভরসা করিতে চাহে তাহারা যেন আল্লাহর উপরই ভরসা করে” (১২ : ৬৭)।
মৃত্যু ও সমাধি
হযরত ইয়াকুব (আঃ) মৃত্যুর পূর্বে তাঁর সন্তানদেরকে আল্লাহর ইবাদতের নির্দেশ দেন। তিনি কেনানে মৃত্যুবরণ করেন এবং তাঁর পিতার পাশে সমাহিত হন।
sourse: ebanglalibrary
https://m.somewhereinblog.net/mobile/blog/axamulalom/30203151
https://www.teachers.gov.bd/blog/details/635160
What's Your Reaction?






