ইউসুফ (আঃ) এর জীবনী || Biography of Prophet Yusuf (Pbuh)
ইউসুফ (আঃ) এর জীবনী || Biography of Prophet Yusuf (Pbuh)

পরিচয়ঃ
আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সা:) হযরত ইউসুফ আঃ সম্পর্কে বলেন, ‘নিশ্চয়ই মর্যাদাবানের পুত্র মর্যাদাবান, তাঁর পুত্র মর্যাদাবান, তাঁর পুত্র মর্যাদাবান। তাঁরা হলেন ইবরাহীমের পুত্র ইসহাক, তাঁর পুত্র ইয়াকূব ও তাঁর পুত্র ইউসুফ ‘আলাইহিমুস সালাম’ (তাঁদের উপর শান্তি বর্ষিত হৌক!)নবীগণের মধ্যে হযরত ইউসুফ (আঃ) হ’লেন একমাত্র নবী, যাঁর পুরা কাহিনী একটি মাত্র সূরায় ধারাবাহিকভাবে বর্ণিত হয়েছে। সূরা ইউসুফ-এর ১১১টি আয়াতের মধ্যে ৩ থেকে ১০১ আয়াত পর্যন্ত ৯৯টি আয়াতে ইউসুফের কাহিনী বিবৃত হয়েছে। এ ছাড়া অন্যত্র কেবল সূরা আন‘আম ৮৪ এবং সূরা মুমিন ৩৪ আয়াতে তাঁর নাম এসেছে।
ইউসুফ আ.- এর প্রতি ভাইদের হিংসার কারণে
এটা মানুষের স্বভাবগত রীতি যে বিমাতা বা সৎ ভাইয়েরা সাধারণত পরস্পরের বিদ্বেষী হয়ে থাকে। সম্ভবত এই বিদ্বেষ যাতে মাথাচাড়া না দেয়, সে উদ্দেশ্যেই ইয়াকুব আলাইহিস সালাম একই শ্বশুরের পরপর তিন মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন।
তার শ্বশুর ছিলেন আপন মামা। তাই তারা ছিলেন পরস্পরে রক্ত সম্পর্কীয় ও নিকটাত্মীয়। এর পাশাপাশি নবী পরিবারে সার্বক্ষণিক দ্বীনি পরিবেশ ও নৈতিক প্রশিক্ষণ ছিল। তা সত্ত্বেও বৈমাত্রেয় হিংসার কবল থেকে ইয়াকুব আলাইহিস সালামের দ্বিতীয় পক্ষের সন্তানরা রক্ষা পাননি।
তাই বলা চলে, ইউসুফ আলাইহিস সালামের প্রতি তার সত্ভাইদের হিংসার প্রথম কারণ ছিল বৈমাত্রেয় বিদ্বেষ।
দ্বিতীয়ত, সদ্য মাতৃহীন শিশু হওয়ার কারণে তাদের দুই ভাইয়ের প্রতি পিতার স্বভাবগত স্নেহের আধিক্য ছিল। বিষয়টি বড় ভাইয়েরা মেনে নিতে পারেননি।
তৃতীয়ত, ইউসুফ আলাইহিস সালামের ছিল অতুলনীয় রূপ-লাবণ্য, অনিন্দ্যসুন্দর দেহসৌষ্ঠব, আকর্ষণীয় ব্যবহার-মাধুর্য। এটিও ছিল ভাইদের হিংসার কারণ।
চতুর্থত, ইউসুফ আলাইহিস সালামের স্বপ্নবৃত্তান্তের কথা যেকোনোভাবে তাদের কানে পৌঁছে যায়। এই কারণটিই তাদের হিংসার আগুনে ঘৃতাহুতি দেয়।
পঞ্চমত, ইউসুফ আলাইহিস সালাম ভবিষ্যতে নবী হবেন—এ বিষয়টি পিতা ইয়াকুব আলাইহিস সালাম বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তিনি তার প্রতি অধিক স্নেহশীল ছিলেন। এ কারণে সৎ ভাইয়েরা তার প্রতি অধিক হিংসাপরায়ণ ছিলেন। আসলে এই হিংসাত্মক আচরণের মধ্যেই লুকিয়ে ছিল ইউসুফ আলাইহিস সালামের ভবিষ্যৎ উন্নতির সোপান।
এ কারণে হিংসাপরায়ণ হয়ে ইউসুফ আলাইহিস সালামের ভাইয়েরা বলেছিল, ‘অবশ্যই ইউসুফ ও তার ভাই (বিনইয়ামিন) আমাদের পিতার কাছে আমাদের চেয়ে অধিক প্রিয়, অথচ আমরা একটি সংহত দল (তাদের চেয়ে অধিক শক্তিশালী)। আমাদের পিতা তো স্পষ্ট বিভ্রান্তিতেই আছেন। (সূরা ইউসুফ, আয়াত, ৮)
ইউসুফ আ.-এর ভাইদের পরামর্শ
ছোট ভাইয়ের প্রতি বাবার অধিক ভালোবাসার বিষয়টি বড় ভাইয়েরা মেনে নিতে পারেনি। তাই তাদের কেউ কেউ মত প্রকাশ করল যে, ইউসুফকে হত্যা করা হোক। কেউ বললম তাকে কোন অন্ধকূপের গভীরে নিক্ষেপ করা হোক- যাতে মাঝখান থেকে এ কন্টক দূর হয়ে যায় এবং বাবার মনোযোগ তোমাদের প্রতিই নিবদ্ধ হয়ে যায়।
বড় ভাইদের সবার কথাবার্তা শুনে এক ভাই বলল, ইউসুফকে হত্যা করো না। যদি কিছু করতেই হয় তবে, কুপের গভীরে এমন জায়গায় নিক্ষেপ কর, যেখানে সে জীবিত থাকবে এবং কোনো পথিক কূপে পানি নিতে এসে তাকে উঠিয়ে নিয়ে যাবে। এভাবে একদিকে তোমাদের উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়ে যাবে এবং অপরদিকে তাকে নিয়ে তোমাদেরকে কোন দূরদেশে যেতে হবে না। কোন কাফেলা কূপ থেকে উঠিয়ে তাকে সাথে করে দূর-দূরান্তে পৌঁছে দেবে।
ইউসুফ আ.-কে কূপে নিক্ষেপ
ভাইয়েরা পরামর্শ করে ইয়াকুব আলাইহিস সালামের কাছে খেলার কথা বলে ইউসুফ আলাইহিস সালামকে দূরে নিয়ে গেল এবং সেখাকে তাকে কূপে ফেলে দিল। এসময় আল্লাহ তায়ালা ওহীর মাধ্যমে ইউসুফ আলাইহিস সালামকে শান্ত্বনা দিয়েছিলেন। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে,
فَلَمَّا ذَهَبُوۡا بِهٖ وَ اَجۡمَعُوۡۤا اَنۡ یَّجۡعَلُوۡهُ فِیۡ غَیٰبَتِ الۡجُبِّ ۚ وَ اَوۡحَیۡنَاۤ اِلَیۡهِ لَتُنَبِّئَنَّهُمۡ بِاَمۡرِهِمۡ هٰذَا وَ هُمۡ لَا یَشۡعُرُوۡنَ
অতঃপর যখন তারা তাকে নিয়ে গেল এবং তাকে গভীর কূপে নিক্ষেপ করতে একমত হল। এমতাবস্থায় আমি তাকে (ইউসুফকে) জানিয়ে দিলাম, ‘তুমি তাদেরকে তাদের এই কর্মের কথা অবশ্যই বলে দেবে; যখন তারা তোমাকে চিনবে না।’ (সূরা ইউসুফ, (১২), আয়াত, ১৫)
বাপের কাছে বানোয়াট কাহিনী
এবার দশ ভাই ফন্দি আঁটলো বাপের কাছে এসে কি বলবে? যারা মিথ্যা বলতে পারে, তাঁদের জন্যে কোন একটা ফন্দি এঁটে নেয়া তো কঠিন নয়। ইউসুফকে কূপে ফেলে দেয়ার সময় তাঁরা তাঁর জামাটা রেখে দিয়েছিলো। একটা পশু যবাই করে এবার ইউসুফের জামায় সেটার রক্ত মেখে নিলো। সন্ধ্যার পর ভান করে কাঁদতে কাঁদতে দশ ভাই বাড়ি ফিরে এলো। ইউসুফের রক্তমাখা জামা বাপের সামনে রেখে দিয়ে বললো- “বাবা, আমরা দশভাই দৌড় প্রতিযোগিতা করছিলাম। এদিকে ইউসুফকে বসিয়ে রেখেছিলাম আমাদের জিনিসপত্রের কাছে। হঠাৎ এক নেকড়ে এসে ওকে খেয়ে ফেলে। আমরা সত্য কথা বলছি বাবা, জানি, আমরা যতই সত্য বলিনা কেন আপনি আমাদের কথা বিশ্বাস করবেননা।” (সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ১৭)
দেখলেন তো মিথ্যাবাদীদের সত্য বলার ধরন। তাঁদের পিতা মহান নবী হযরত ইয়াকুব এতো বড় ঘটনা ঘটে যাবার পরও কেবল আল্লাহর সাহায্য চেয়ে ধৈর্য ধারন করলেন।
রাখে আল্লাহ মারে কে?
এদিকে ইউসুফের কি হলো? ইউসুফ কি বেঁচে আছেন, না কূপে ডুবে মারা গেছেন? আল্লাহ যাকে বাচান তাঁকে মারার শক্তি কার আছে? আল্লাহ কূপের মধ্যে ইউসুফের বেঁচে থাকার ব্যবস্থা করেন। ইউসুফ সুস্থ শরীরে বেঁচে আছেন। ইতোমধ্যে সেখানে একটি বাণিজ্য কাফেলা এসে অবতরন করলো। তাঁরা তাঁদের একজনকে কূপ থেকে পানি উঠাতে পাঠালো। সে যখন পানির জন্যে বালতি ফেললো, ইউসুফ তাঁর বালতি ধরে উঠে এলেন। লোকটি চিৎকার করে উঠলো- কি চমৎকার, এ যে এক বালক। তাঁরা তাঁকে নিয়ে গিয়ে পণ্যদ্রব্য হিসেবে বিক্রি করে দিলো। বিক্রি করলো মাত্র সামান্য কয়েক দিরহামে।
মিশরে ইউসুফ
মিশরের ‘আযিয মিশর’ উপাধিধারী এক বড় মন্ত্রী ইউসুফকে বিনিকদের কাছ থেকে কিনে নেন। তিনি ইউসুফকে বাড়ি নিয়ে গিয়ে তাঁর স্ত্রীকে বললেন- ‘একটি ছেলে কিনে এনেছি। ওকে যত্ন করে রেখো। ও আমাদের উপকারে আসতে পারে, আর নয়তো তাঁকে আমরাই পুত্র বানিয়ে নেবো।’
এবার দেখুন আল্লাহর ক্ষমতা। তিনি কিভাবে ইউসুফকে বাঁচিয়ে নিয়ে এলেন সেকালের শক্তিশালী রাজ্য মিশরের ক্ষমতাবানদের ঘরে। আল্লাহ বলেন-
“এভাবে আমি ইউসুফের জন্যে সে দেশে প্রতিষ্ঠিত হবার পথ বের করে দিলাম। সেই সাথে আমি তাঁকে সবকিছুর মর্ম বুঝার শিক্ষাও দান করলাম।”
এ ঘরে ইউসুফ রাজপুত্রের সমাদরে বড় হতে থাকলেন। এখানেই তিনি যখন পূর্ণ যৌবনপ্রাপ্ত হলেন, তখন আল্লাহ তাঁকে নবুয়্যত দান করেন। তাঁকে নবুয়্যত দান করে আল্লাহ বলেন – “আমি নেক লোকদের এভাবেই প্রতিদান দিয়ে থাকি। ” (সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ২২)
কারাগার
ইউসুফ যখন কারাগারে প্রবেশ করলেন তখন তার সাথে আরও দু'জন কয়েদিও কারাগারে প্রবেশ করল। তাদের একজন বাদশাহকে মদ্যপান করাত এবং অপরজন বাবুর্চি ছিল। তারা উভয়েই বাদশাহর খাদ্যে বিষ মিশ্রিত করার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছিল। একদিন তারা বললঃ আমরা আপনার কাছে আমাদের স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানতে চাই। তাদের একজন যে বাদশাহকে মদ্যপান করাত সে বললঃ আমি স্বপ্নে দেখলাম যে, আঙ্গুর থেকে শরাব বের করছি। এবং দ্বিতীয় জন যে বাদশাহর বাবুর্চি ছিল সে বললঃ আমি স্বপ্নে দেখলাম যে, আমার মাথায় রুটিভর্তি একটি ঝুড়ি রয়েছে। তা থেকে পাখিরা ঠুকরে ঠুকরে আহার করছে। ইউসুফ তাদের স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিলেন যে, তোমাদের একজন মুক্তি পাবে এবং চাকুরীতে পুনর্বহাল হবে। অপর জন অপরাধ প্রমাণিত হবে এবং তাকে শূলে চড়ানো হবে। পাখিরা তার মাথার মগজ ঠুকরে খাবে।
যে ব্যক্তি মুক্তি পাবে বলে ইউসুফের ধারণা ছিল তাকে বললেনঃ যখন তুমি মুক্তি পাবে এবং বাদশাহর চাকুরীতে পুনর্বহাল হবে, তখন বাদশাহর কাছে আমার বিষয়ে আলোচনা করো। কিন্তু কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ঐ ব্যক্তি ইউসুফের কথা ভুলে গেল৷ ফলে ইউসুফকে সাত বছর কারাগারে থাকতে হলো৷
মৃত্যু
ইউসুফ ১১০ বছর জীবিত ছিলেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি ইসরাইলীদের শপথ করিয়ে বলেন, যখন তারা মিশর ত্যাগ করবে তখন তার হাড় তাদের সাথে নিয়ে যেতে পারে। তার মৃত্যুর পর তার মৃত দেহ মিশরের একটি কফিনে সংরক্ষণ করা হয়।[২৫] ইসরাইলীরা তাদের কর্তৃক শপথ মনে রেখে ছিল, যখন তারা মিশর ত্যাগ করে মুসা সাথে তখন তারা ইউসুফের হাড় তাদের সাথে ইসরায়েলে নিয়ে যায়।[২৬] তার হাড় সেচেমে কবর দেওয়া হয়েছে, এই জায়গাটি ইয়াকুব দিনাহ্ ছেলের কাছ থেকে কিনে ছিলেন।
What's Your Reaction?






