হযরত শাহজালাল (রহ.)-এর পূর্ণাঙ্গ জীবনী | Life Story Hazrat Shahjalal rh. In Bangla
হযরত শাহজালাল (রহ.)-এর পূর্ণাঙ্গ জীবনী | Life Story Hazrat Shahjalal rh. In Bangla

বাংলাদেশ আসাম তথা বৃহত্তর বঙ্গকে ইসলামের আলোকে আলোকিত করার ক্ষেত্রে যাঁর নাম সবচেয়ে উজ্জ্বল এবং এদেশের সূফি, দরবেশ, আউলিয়াগণের মাঝে যাঁর প্রভাব ও মর্যাদা সবচেয়ে বেশি তিনি হলেন হযরত মাওলানা শাহ্জালাল (রহ.)। এতদাঞ্চলে ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণী নির্বিশেষে জনসাধারণের মাঝে তাঁর প্রতি ভালবাসা ও নামের মাহাত্ম ব্যাপক ও অতুলনীয়।
সিলেটে তাঁর মাধ্যমেই ইসলামের বহুল প্রচার ঘটে। সিলেট বিজয়ের পরে শাহজালাল (রহ.) সঙ্গী অনুসারীদের মধ্য হতে অনেক পীর দরবেশ এবং তাদের পরে তাদের বংশধরগণ সিলেটসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে বসবাস করেন। শাহজালাল (রহ.) ও তাঁর সফরসঙ্গী ৩৬০ জন আউলিয়ার সিলেট আগমন ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁকে সিলেটেই কবর দেয়া হয়।
ভারতীয় উপমহাদেশের বিখ্যাত সুফি সাধক হযরত শাহজালাল (রহ.) ৬৭১ হিজরী এবং ১২৭১ খিৃস্টাব্দে তুরস্কে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পুরো নাম শায়খ শাহজালাল কুনিয়াত মুজাররদ। ৭০৩ হিজরী মোতাবেক ১৩০৩ ইংরেজী সালে ৩২ বছর বয়সে ইসলাম ধর্ম প্রচারের লক্ষ্যে বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে এসেছিলেন বলে ধারণা করা হয়। সিলেট আগমনের সময়কাল নিয়ে যদিও বিভিন্ন অভিমত রয়েছে। তদুপরি শাহজালাল (রহ.)’র সমাধির খাদিমগণের প্রাপ্ত পারসী ভাষার একটি ফলকলিপি হতে উল্লেখিত সন-তারিখই সঠিক বলে ধরা হয়। পারসী ভাষায় লিখিত ফলকলিপিটি বর্তমানে ঢাকা যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।
নাম |
হযরত শাহজালাল (রহ.) |
জন্মগ্রহণ |
ভারতীয় উপমহাদেশের বিখ্যাত সুফি সাধক হযরত শাহজালাল (রহ.) ৬৭১ হিজরী এবং ১২৭১ খিৃস্টাব্দে তুরস্কে জন্মগ্রহণ করেন |
মৃত্যু | তার মৃত্যুর সঠিক তারিখ নিয়ে বিতর্ক আছে, তবে ৭৪৬ হিজরিতে (১৫ মার্চ ১৩৪৬ খ্রিস্টাব্দ) মারা গিয়েছিলেন বলে ইবনে বতুতা বর্ণনা করেছেন |
প্রাথমিক জীবন
হিজরী ষষ্ঠ শতকের শেষাংশে মক্কার কোরাইশ বংশের কিছু লোক মক্কা শহর হতে হেজাজ ভূমির দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তে ইয়েমেন প্রদেশে গিয়ে বসবাস করেন। এদের মধ্যে মোহাম্মদ বা মাহমুদ ছিলেন শাহজালাল (রহ.) এর পিতা। মাহমুদের পিতার নাম ইব্রাহিম। ৬৭১ হিজরী - ১২৭১ খ্রিস্টাব্দে শাহজালাল (রহ.) জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর জন্মভূমি ছিল প্রাচীন আরবে আযমের হেজাজ ভূমির তৎকালীন প্রদেশ ইয়েমেন দেশের কুনিয়া নামক শহর। শাহজালাল (রহ.) যখন তিন মাসের শিশু বালক, তখনই তাঁর মাতার মৃত্যু হয়।
শাহজালাল (রহ.) শিশুকালেই মাতৃহীন হন এবং পাঁচ বছর বয়সে পিতাকে হারান। মামা আহমদ কবির তাঁকে পালক নেন। আহমদ কবির আরবী ভাষায় কোরআন হাদিস শিক্ষা দেওয়াসহ ইসলাম ধর্মের প্রাথমিক বিষয়ে (নামাজ, রোজায়) অভ্যস্ত করে তোলেন শাহজালাল (রহ.)কে। পরবর্তিতে আহমদ কবীর শাহজালাল (রহ.)কে ইয়েমেন থেকে মক্কায় নিয়ে যান। মক্কা শহরে আহমদ কবীরের একটি আস্তানা (হোজরা) ছিল। সেখানে অন্যান্য শিষ্যদের সঙ্গে শাহজালাল (রহ.)কেও উপযুক্ত শিক্ষা দিয়ে গড়ে তুলতে সচেষ্ট ছিলেন বলে জানা যায়।
আধ্যাত্মিকতা
শাহজালাল (রহ.)কে সুফি মতবাদে দীক্ষিত করাই আহমদ কবিরের মুল উদ্দেশ্য ছিল বলে জানা যায়। যে কারণে তিনি শাহ জালাল (রহ.)কে নিয়ে মক্কায় আসা। মক্কা শহরে সোহরাওয়ার্দি তরিকার প্রবর্তক সিহাবুদ্দীনের প্রতিষ্ঠিত খানকায় (মরমী স্কুল) তৎকালে আহমদ কবির ছিলেন প্রধান তত্ত্বাবধায়ক। আহমদ কবির ইসলামের শরীয়ত ও মারিফত উভয় ধারায় শিক্ষা দানে দীক্ষিত করেন শাহজালাল (রহ.)কে।
দরবেশী জীবন
জন্মগতভাবে শাহজালাল (রহ.) দরবেশ পরিবারে জন্ম নিয়েছেন। জানা যায়, তাঁর পিতা ছিলেন একজন ধর্মানুরাগী মোজাহিদ। ইয়েমেনে ধর্ম যুদ্ধে তিনি নিহত হন এবং তার মাতার দিক দিয়ে তিনি সৈয়দ বংশের প্রখ্যাত দরবেশ সৈয়দ জালাল সুরুখ বোখারীর দৌহিত্র ছিলেন। তদুপরি দরবেশ আহমদ কবির তাঁর মামা, যিনি শাহজালাল (রহ.) এর শিক্ষা গুরু ছিলেন। তিনিও তৎকালের একজন বিখ্যাত দরবেশ ছিলেন বলে জানা যায়। আহমদ কবির যখন শাহজালাল (রহ.) এর লালন পালনের ভার গ্রহণ করেন সেই ছোটবেলা থেকেই তাঁকে দরবেশী তর-তরিকায় জীবন যাপনের প্রণালী শিক্ষা দিয়েছেন বলেও পাওয়া যায়।
সিলেট আগমন পর্ব
শাহজালাল (রহ.)কে তাঁর মামা ও গুরু সৈয়দ আহমদ কবিরের আস্তানায় আরব দেশে ছিলেন। একদিন শাহজালাল (রহ.) ভারতবর্ষে ধর্ম প্রচার করছেন তা স্বপ্নে দেখলেন, এই কথা সৈয়দ আহমদ কবিরের কাছে ব্যক্ত করেন। মামা ও মুর্শিদ সৈয়দ আহমদ কবির এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিয়ে শাহজালালকে ভারতবর্ষে যাবার পরামর্শ দেন। যাত্রাকালে কবির শাহজালাল (রহ.) এর হাতে এক মুঠো মাটি তুলে দিয়ে বললেনঃ যে স্থানে এই মাটির স্বাদ, গন্ধ ও বর্ণের মিল এক হবে, সেখানেই ধর্ম প্রচারের জন্য আস্তানা গড়বে। মুর্শিদ সৈয়দ আহমদ কবির (রহ) এর দোয়া নিয়ে শাহজালাল (রহ.) ধর্ম প্রচার অভিযানে আরবের মক্কা শরিফ হতে একা একাই যাত্রা শুরু করেন।
হিন্দুস্থানে প্রবেশ
শাহজালাল (রহ.) মক্কা হতে বিদায়কালে যে কয়জন সঙ্গী তাঁর সঙ্গে যাত্রা করেন তাদের মধ্যে প্রধান ছিলেন হাজী ইউসুফ, হাজী খলিল, হাজী দরিয়া। হিন্দুস্থানে আসার পূর্ব পর্যন্ত সমরবান্দ থেকে সৈয়দ ওমর, রোম থেকে করিমদাদ, বাগদাদ থেকে নিজামুদ্দীন, ইরান, জাকারিয়া ও শাহ দাউদ এবং সৈয়দ মুহম্মদ প্রমুখ তার অনুগামী হলেন। তাদের নিয়ে তিনি হিন্দুস্থানে প্রবেশ করলেন। এরপর সুলতান থেকে আরিফ, গুজরাট থেকে জুনায়েদ, আজমীর শরীফ থেকে মুহম্মদ শরীফ, দাক্ষিণাত্য থেকে সৈয়দ কাসিম, মধ্যপ্রদেশের হেলিম উদ্দীন প্রমুখ মুরিদ হয়ে শাহজালাল (রহ.)’র সঙ্গে সঙ্গে চললেন। এভাবে দিল্লী যখন পৌঁছলেন তখন শিষ্যদের সংখা ২৪০ জন বলে ধারণা পাওয়া যায়।
নিজামুদ্দীন আউলিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ
দিল্লিতে আসার পর নিজামুদ্দিন আউলিয়ার জনৈক শিষ্য গুরুর কাছে শাহজালাল (রহ.) নামে কুত্সা প্রচার করে। সঙ্গে সঙ্গে নিজামুদ্দীন কুৎসা রটনাকারী এ শিষ্যকে উপযুক্ত শাস্তিস্বরুপ দরবার থেকে বের করে দিলেন এবং অন্য দুই শিষ্যকে ডেকে তাদের মারফতে শাহজালাল (রহ.) এর কাছে সালাম পাঠালেন। শাহজালাল (রহ.) সালামের উত্তরে উপটৌকন স্বরুপ ছোট একটি বাক্সে প্রজ্জলিত অঙ্গারের মধ্যে কিছু তুলা ভরিয়া নিজামুদ্দীন আউলিয়ার নিকট পাঠালেন। নিজামুদ্দিন আউলিয়া হযরত শাহজালাল (রহ.)’র আধ্যাত্মিক শক্তির পরিচয় পেয়ে তাঁকে সাদরে সাক্ষাতের আমন্ত্রণ জানান। বিদায়কালে প্রীতির নিদর্শন স্বরূপ নিজামুদ্দিন আউলিয়া তাঁকে এক জোড়া সুরমা রঙের কবুতর উপহার দিলেন। সিলেটে মাজার সংলগ্ন এলাকায় সুরমা রঙের যে কবুতর দেখা যায়, তা ওই কবুতরের বংশধর। যা জালালী কবুতর নামে খ্যাত।
শেখ বুরহান উদ্দীনের দেখা ও দুঃখ প্রকাশ
শ্রীহট্টে ইসলাম জ্যোতিসহ বিভিন্ন ঐতিহাসিক গ্রন্থের বর্ণনা অনুসারে তুর্কি বিজয়ের মধ্য দিয়ে শ্রীহট্টে মুসলমান জনবসতি গড়ে ওঠে। সিলেটের টুলটিকর মহল্লায় ও হবিগঞ্জের তরফে তৎকালে মুসলমানরা বসতির গড়ে ছিলেন। এ সময় শ্রীহট্টের গৌড় রাজ্যে গৌড়-গোবিন্দ নামে এক অত্যাচারি রাজা ছিল। গৌড় রাজ্যের অধিবাসী বুরহান উদ্দীন নামক জনৈক মুসলমান নিজ ছেলের জন্ম উৎসব উপলক্ষে গরু জবাই করে গৌড়ের হিন্দু রাজা গৌড় গোবিন্দের কাছে অপরাধি সাবস্ত হন।
ফলে গোবিন্দ বুরহান উদ্দীনের শিশু ছেলেকে ধরে নিয়ে হ্ত্যা করে। বুরহান উদ্দীন বাংলার তৎকলীন রাজা শামস উদ্দীন ফিরুজ শাহের নিকট গিয়ে এই নিষ্ঠুর হ্ত্যাকাণ্ডের অভিযোগ করলে রাজা তাঁর ভাগিনা সিকান্দর গাজীকে প্রখণ্ড সৈন্য বাহিনীর সঙ্গে শ্রীহট্টের গৌড় রাজ্যে প্রেরণ করেন। শাহী সৈন্য যখন ব্রহ্মপুত্র নদী পার হতে চেষ্টা করে তখনই রাজা গোবিন্দ ভৌতিক শক্তির সাহায্যে মুসলিম সৈন্যের উপর অগ্নীবাণ নিক্ষেপ করে সমস্ত চেষ্টাকে বিফল করে দেন। গোবিন্দের ঐন্দ্রজালিক শক্তির প্রভাবে সিকান্দর গাজীর প্রতিহ্ত ও বিফল মনোরথের সংবাদ দিল্লীর সম্রাট আলাউদ্দীন খিলজীর নিকট পৌঁছলে সম্রাট এ সংবাদে মর্মাহত হন।
পরবর্তিতে সম্রাট তাঁর রাজদরবারী আলেম-উলামাসহ জ্যোতিষদের সঙ্গে আলোচনায় এই মর্মে অবহিত হন যে, সুলতানের সেনাবাহিনীতে আধ্যাতিক শক্তি সম্পন্ন এক ব্যক্তি রয়েছে, তাঁর নেতৃত্বে অভিযান প্রেরণ করা হলে গৌড়গোবিন্দের যাদু বিদ্যার মোকাবেলা করে সিলেট বা শ্রীহট্ট জয় সম্ভব হবে। জ্যোতিষরা উক্ত আধ্যাতিক শক্তি সম্পন্ন ব্যক্তির পরিচয়ের পন্থা হিসেবে এও বলেছিল, আগামী দুই/এক রাতের মধ্যে দিল্লী নগরীতে প্রচণ্ড ঝড় বৃষ্টিতে সমস্ত নগরী ভেসে যাবে, প্রতিটি ঘর বাড়ির ভীষণ ক্ষতি লক্ষিত হবে, কোথাও কোন প্রদীপ থাকবে না একটি মাত্র তাঁবু ব্যতিত।
সম্রাট জ্যোতিষদের কথামত অনুসন্ধান করে সেই ঝড় বৃষ্টির রাতে দেখতে পেলেন একজন সাধারণ সৈনিক একটি তাঁবুতে একাগ্র মনে বসে কোরআন পড়ছেন। সম্রাট সেখানে উপস্থিত হয়ে তাঁর সব বিষয় অবগত হয়ে সিলেট অভিযানের নেতৃত্ব নেওয়ার অনুরোধ জানান। তিনি সৈয়দ নাসির উদ্দীন সম্রাটের অনুরোধে সম্মত হলে সম্রাট তাঁকে সিপাহসালার সনদ প্রদানের মাধ্যমে সিকান্দর গাজীর কাছে প্রেরণ করেন। এদিকে গাজী বুরহান উদ্দীন তখন দিল্লীতে অবস্থান করছিলেন। এ সময় শাহজালাল (রহ.)ও তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে দিল্লীতে আসেন। দিল্লীতেই বুরহান উদ্দীনের সাথে শাহ জালালের সাক্ষাৎ হয় এবং এখানেই বুরহান উদ্দীন নিজের দুঃখময় কাহিনী তাঁর নিকট বর্ণনা করেন।
সিপাহশালার নাসির উদ্দীনের দেখা
শাহজালাল (রহ.) দিল্লী হতে বুরহান উদ্দীনকেসহ ২৪০ জন সঙ্গী-সহচর নিয়ে সিলেটের উদ্দেশ্য রওয়ানা হলেন। শাহজালাল (রহ.) সাতগাঁও এসে ত্রিবেণীর কাছে দিল্লীর সম্রাট প্রেরিত অগ্রবাহিনী সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীনের সঙ্গে মিলিত হন। সৈয়দ নাসির উদ্দীন শাহজালাল (রহ.) সম্পর্কে অবগত হয়ে তদীয় শিষ্যত্ব গ্রহণের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। পথে পথে শাহজালাল (রহ.) এর শিষ্য বর্ধিত হতে লাগল। ত্রিবেনী থেকে বিহার প্রদেশে আসলে আরও কয়েকজন ধর্ম যোদ্ধা অনুসঙ্গী হলেন। যাদের মধ্যে হিসাম উদ্দীন, আবু মোজাফর উল্লেখযোগ্য। এখান থেকে সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীনের আনিত এক হাজার অশ্বারোহী ও তিন হাজার পদাতিক সৈন্য সহ শাহজালাল (রহ.) নিজ সঙ্গীদের নিয়ে সোনারগাঁ অভিমুখে সিকান্দর গাজীর সাথে মিলিত হওয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন।
সিকান্দর গাজীর দেখা ও ব্রহ্মপুত্র পার
শাহজালাল (রহ.) সোনারগাঁ আসা মাত্রই শাহ সিকান্দর গাজীর সাথে সাক্ষাৎ ঘটলো। সিকান্দর গাজী শাহজালাল (রহ.)কে সসম্মানে গ্রহণ করলেন। শাহজালাল (রহ.) তাঁর সঙ্গী অনুচর ও সৈন্যসহ শাহ সিকান্দরের শিবিরে সমাগত হয়ে সিকান্দর হতে যুদ্ধ বিষয়ে সব বিষয় অবগত হন। সিকান্দর শাহজালাল (রহ.) এর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে শিষ্য গ্রহণপূর্বক সিলেট অভিমুখে যাত্রা করলেন। এভাবে শাহ জালাল (রহ.) এর শিষ্য সংখ্যা ৩৬০ জনে পৌঁছে। এদিকে গৌড় গৌবিন্দ নিজস্ব চরদ্বারা শাহজালাল (রহ.) এর আগমনের সংবাদ পেয়ে তাঁরা যাতে ব্রহ্মপুত্র নদী পার না হতে পারেন, সে ব্যবস্থা অনুসারে নদীর সমস্ত নৌ চলা-চল বন্ধ করে দেয়। শাহজালাল (রহ.) ভক্তরা বিশ্বাস করেন যে, তিনি তাঁর শিষ্যদের নিয়ে বিনাবাধায় জায়নামাজের সাহায্যে ব্রহ্মপুত্র নদী অতিক্রম করেন।
গৌর গােবিন্দের পরিচয় ও তার অত্যাচার।
প্রকাশ থাকে যে গৌর গােবিন্দের পূর্ব পুরুষ সম্পর্ক তেমন কোন তথ্য পাওয়া যায় না। তবে ঐতিহাসিকদের মতে জানা যায় তিনি এক মহিয়সী মহিলার জারজ সন্তান ছিলেন। কোন ঐতিহাসিক বলেন, গােবিন্দ সমুদ্রের বড় পুত্র। একদিন ত্রিপুরা রাজ্যের এক মহীয়সী রাজার অজান্তে সমুদ্র দেবতার সংগে অবৈধ মেলামেশা করে সেই মিলন সমুদ্র দেবতার গর্ভধারণ করে যে বাচ্চা প্রসব করে তিনিই হল গৌর গােবিন্দ। তার দেহের আকৃতি এমন ভয়ানক ছিল যে তাকে দেখলেই মনে ঘৃণা আসত ও ভয় পেত। সে যাই হােক এক সময় সে তার বুদ্ধির চালে কূটনীতির মাধ্যমে গেীর রাজ্যের অধিপতি হয়ে বসে।
সিলেটের উত্তর অঞ্চলে পাহাড়িয়া উচু টিলার উপর ছিল তার রাজ প্রাসাদ। তার রাজ প্রাসাদ এমন ভাবে নির্মাণ করেছিলেন সেখানে বাইরের কোন শত্রু প্রবেশ করতে পারত না। সে এমন অত্যাচারী ছিল যে এক সময় অনুভব করতে পারলে যে আমার অসংখ্য শত্রু হয়েছে। তখন থেকে প্রসাদের চার পাশে পাহাড়ের গুহায় একদল অস্ত্রধারী প্রহরী নিযুক্ত করল যাতে করে কোন শত্রু রাজার উপর আক্রমণ না করতে পারে। গৌর গােবিন্দের রাজ্যের এখানে সেখানে অসংখ্য মূর্তি ছিল। রাজা মন্ত্রী সভার সদস্যগন সকলেই সর্বদা উহার পূজা করিত। রাজা এমন ভ্রমের মধ্য নিপতিত ছিল যে সেই মাটির তৈরী মূর্তির আদেশ উপদেশ অনুযায়ী নিজেকে পরিচালিত করত এবং রাজ্যও সেই অনুপাতে চালাত। তিনি এমন মনগড়া সংবিধানের উপর প্রতিষ্টিত ছিল যে, তার অস্ত্রগারে একটি বৃহাদাকারের ধনুক ছিল। ভ্রান্ত রাজা উহার মাধ্যমে ভাগ্য নির্ধারণ করত।
এবার আসা যাক তার অত্যাচারের দিকে। গেীর রাজা অত্যাচারের দিক থেকেই বেশী খ্যাতি লাভ করেছিল। সমস্ত সিলেট তিন ভাগে বিভক্ত করে তিনজন রাজা শাসন করত। তার মধ্য গৌর রাজ্যের শাসক ছিল গােবিন্ত। তাইতাে তার নাম হয় গৌর গােবিন্দ । তখন তার মতন অত্যাচারী উৎপীড়নকারী শাসক অন্য কোথাও দৃষ্টিমান হত না। তার অত্যাচারের বিক্রমে সকল স্তরের জনগণ সর্বদা ভয়ে কম্পমান থাকত। তার অত্যাচারের কথা পাশ্ববর্তী দেশগুলাের কারাে অজানা ছিল না। এক সময় তিনি পার্শ্ববর্তী রাজ্যের উপর তার অত্যাচারের হাত বাড়াল। তারাও রক্ষা পেল না। রাজা গােবিন্দ শাসকনীতি পরিহার করে পশুত্বের আচরণের দ্বারা পার্শ্ববর্তী রাজ্য দখল করে নিজ রাজ্যকে বিস্তার করেন। শুধু তাই নয় এক সময় তার রাজ্যকে একটি শক্তিশালী রাজ্যে পরিণত করেছিল।
ওলিয়ে কামেল হযরত শাহজালাল রহমাতুল্লাহ-এর সিলেট আগমনের পূর্বে সারা শ্রীহট্টকে(সিলেট) বিধর্মীরা দখল করেছিল। মুসলমানদের কোন অধিকার ছিল না। সকল শ্রেণীর জনগণকে অত্যাচারী রাজা মূর্তি পূজায় বাধ্য করত। এই কুআচরণ থেকে কেউই রক্ষা পেত না। সকলে ঘরে ঘরে গৃহ, দেবী নির্মাণ করে উহার পূজা অর্চনা করত। সেখানে ১২ মাসে ১৩ পূজার সমরোহ ঘটত। যারা রাজার পায়রুণী করত তারা বেশ সুখে-শান্তিতেই বসবাস করতে পারত।
কিন্তু মুসলমানরা তার অত্যাচারের কারণে তাদের ধর্ম পালনে সকলে ব্যর্থ ছিল। গােবিন্দের শাসনামলে সিলেট মুসলমানদের সংখ্যাও ছিল কম। মাঝে মধ্যে যারা দু’চার জন ছিল তাদের দুঃখ যাতনার সীমা ছিল না। কোন মুসলমান স্বীয় ধর্ম পালনে প্রকাশ্যে কোন কাজ করলে বা গােপনেও কিছু করলে তাকে রাজ দরবারে হাজির করে তার উপর নানা নির্যাতন উৎপীড়ন করত।
কোন স্থানে কোন মুসলান আযান দিলে কুকুরের মত লালায়িত হিন্দু গােষ্ঠীরা তাকে ধরে নিয়ে অত্যাচারী গােবিন্দের কাছে নিয়ে যেত। এক কথায় মুসলমানরা স্বাধীনভাবে তাদের ধর্ম পালন করতে পারতেন না। এমন কি কোন মুসলমান গরু জবাই করতে পারতেন না বা কোরবানীও করতে পারত না।
গােবিন্দের অত্যাচারে সকল মুসলমান অতিষ্ঠিত হয়ে উঠল। সকলেই একা একা ভাবতে লাগল যে আমার শক্তি থাকলে গোবিন্দের বিরুদ্ধে সংগ্রাম জারী করতাম। ঈমানী চেতনা তাদের মধ্যে কম ছিল না, কিন্তু কারাে একার পক্ষে রাজার বিরুদ্ধে কিছু বলার ক্ষমতা ছিল না। এমনকি কোন স্থানে রাজ সভায় হাজির করে নানা উপায়ে শাস্তি দিয়ে মারধর করে পাঠিয়ে দিত।
উচ্চস্বরে আযান একামত দিতে পারত না। নামাজের সূরা বা কোরআন তেলওয়াত করতে পারত না। যারা ধর্মে আগ্রহী ছিল তারা সকলেই চায় যে স্বীয় ধর্ম পালন করি তারই মুসলমানরাও এদের থেকে ব্যতিক্রমধর্মী ছিল না। সকল মুসলমানদের মনেই ধর্ম পালনের আগ্রহ ছিল কিন্তু অত্যাচারী শাসক গোবিন্দের কারণে কোন মুসলমান তাদের ধর্ম পালন করতে পারও না।
গুরু পরিচিতি
শাহ জালাল-এর মামা ও শিক্ষাগুরু শায়েখ সৈয়দ আহমদ কবির সোহরাওয়ার্দি, সাধারণত; আহমদ কবির নামে তিনি বহুল পরিচিত। সৈয়দ আহমদ কবিরের পিতা নাম সৈয়দ জালাল সুরুখ বোখারী। সৈয়দ জালাল সুরুখ বোখারী শাহ জালালের জন্মের আগে ভারতবর্ষে ইসলাম প্রচারের লক্ষে মোলতানের নিকট আউচে এসে বসবাস করেন এবং সেখানেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন সৈয়দ আহমদ কবির সোহরাওয়ার্দির পিতা সৈয়দ জালাল সুরুখ বোখারী ছিলেন তার মুরশীদ।
শাহ জালাল এর পীরদের ঊর্ধ্বতন আধ্যাত্মিক সাধকদের তালিকা নিম্নরূপঃ
- হযরত মোহাম্মদ (সঃ)
- হযরত আলী
- শেখ হাসান বসরী
- শেখ হাবিব আজমী
- শেখ দাউদ তাঈ
- শেখ মারুফ কারখী
- শেখ ছিররিউ সাকতী
- শেখ মমশাদ দিনাওয়ারী
- শেখ আহমদ আসওয়াদ দিন্নুরী
- শেখ আমুবিয়া
- শেখ আজি উদ্দীন সোহরাওয়ার্দী
- শেখ আবু নাজিব সোহরাওয়ার্দী
- শেখ শিহাব উদ্দীন
- শেখ বাহাউদ্দীন জাকারিয়া
- সৈয়দ জালাল সুরুখ বোখারী
- সৈয়দ শায়েখ আহমদ কবির সোহরাওয়ার্দি
- শাহ জালাল
সঙ্গীসকল
- সৈয়দ নাসিরুদ্দিন সিপাহী শালার , শামসুদ্দিন ফিরুজ শাহের সেনাপতি (চৌকিদেখি, সিলেট)
- হায়দার গাজী, সিলেটের দ্বিতীয় ওয়াজির (সোনারগাঁও)
- হাজী ইউসুফ, চৌকিদীঘিতে শাহ জালালের সাথে অবস্থান করেন
- গাজী বুরহানউদ্দিন, সিলেটের প্রথম মুসলমান (তুলটিকার/বুরহানাবাদ, ওয়ার্ড ২৪)
- শাহ্ পরান, তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র (খাদিমনগর, সিলেট সদর)
- আজিজ চিশতি (নিজ গহরপুর, বালাগঞ্জ)
- আদম খাকি (দেওরাইল, বাদরপুর)
- শাহ্ সুলতান (থানাগাঁও, ওসমানীনগর)
- সৈয়দ ইয়াকুব (হরিপুর, বার্লেখা)
- শাহ্ মালুম (রজনপুর, ফেঞ্চুগঞ্জ)
- শাহ্ হালিমুদ্দিন (কানিহাটি, কুলাউড়া)
- শাহ্ মোস্তফা (মৌলভীবাজার)
- নোলাখ শাহ্ পীর (সাহোত্ভিলা, দক্ষিণ সুরমা)
- শাহ্ গাব্রু (গাবুরটেকি, ওসমানীনগর)
- শাহ্ সিদ্দিক (পাঁচপাড়া, ওসমানীনগর)
- খণ্ডা ঝক্মক (রাইনগর, ওয়ার্ড ১৯/২০)
- ছৈয়দ হাতিম আলী (শিবগঞ্জ, সিলেট)
- ফতেহ গাজী (ফতেহপুর-শাহজিবাজার, মাধবপুর)
- পীর গোরাচাঁদ (হাড়োয়া, উত্তর ২৪ পরগনা, পশ্চিমবঙ্গ)
- হযরত চাশনীপীর সিলেট
পরবর্তীকালের সঙ্গীসকল:
- শাহ্ কামাল কুহাফা (শাহারপাড়া, জগন্নাথপুর)
- শাহ্ তাজউদ্দিন (লামা তাজপুর, ওসমানীনগর)
- শাহ্ রুকনউদ্দিন (কদমহাটা, রাজনগর)
- হযরত শাফাই শাহ্ আউলিয়া( রহঃ)( পুরাতন জেলা ময়মনসিংহ) (কিশোরগঞ্জ জেলা বাজিতপুর উপজেলা
সিলেটে প্রবেশ
খ্রিস্টিয় দশম শতকে শ্রীহট্ট ভুমী লাউড়, জয়ন্তীয়া ও গৌড় নামে তিনটি স্বাধীন রাজ্যে বিভক্ত ছিল। উক্ত রাজ্যগুলোর মধ্যে গৌড় অন্যতম রাজ্য হিসেবে বিবেচিত ছিল। এ রাজ্যে প্রাচীন সীমারেখা বর্তমান মৌলভীবাজার জেলাসহ হবিগঞ্জ জেলার কিয়দাংশ নিয়ে বিস্তৃত থাকায় গৌড় রাজ্যের দহ্মিণ সীমাভূমী নবীগঞ্জের দিনারপুর পরগণার পাশে রাজা গোবিন্দের চৌকি ছিল। শাহজালাল (রহ.) তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদী পার হয়ে প্রথমত সেখানে অবস্থান করেন। এখানে গৌড়ের সীমান্ত রক্ষীরা অগ্নীবাণ প্রয়োগ করে তাদেরকে প্রতিহত করতে চায়। কিন্তু মুসলমান সৈন্যের কোন ক্ষতি করতে পারেনি। রাজা গোবিন্দ সমস্ত বিষয় অবগত হয়ে উপায়ন্তর না পেয়ে বরাক নদীতে নৌকা চলাচল নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। শাহজালাল (রহ.) পুর্বের মত জায়নামাজের সাহায্যে বরাক নদী পার হন। বরাক নদী পারাপারে বাহাদুরপুর হয়ে বর্তমান সিলেট জেলার বালাগঞ্জ উপজেলায় ফতেহপুর নামক স্থানে রাত্রি যাপন করেন। উল্লেখিত তথ্য সম্মেলিত প্রাচীন গ্রন্থ তোয়ারিখে জালালীতে উল্লেখ আছে।
সর্ব প্রকার কলাকৌশল অবলম্বন করে রাজা গৌড় গোবিন্দ যখন দেখলেন সকল প্রয়াসই বিফল হচ্ছে, তখন শেষ চেষ্টা করার লক্ষে যাদুমন্ত্র সহ এক প্রকাণ্ড লৌহ ধনুক শাহজালাল (রহ.) এর কাছে প্রেরণ করেন। যার শর্ত ছিল যদি কেহ একা উক্ত ধনুকের জ্যা ছিন্ন করতে পারলে গোবিন্দ রাজ্য ছেড়ে চলে যাবে। শাহজালাল (রহ.) তাঁর দলের লোকদের ডেকে বললেন, যে ব্যক্তির সমস্ত জীবনে কখনও ফজরের নামাজ কাজা হয় নাই বা বাদ পরে নাই একমাত্র সেই পারবে গোবিন্দের লৌহ ধনুকের জ্যা ছিন্ন করতে। অতপর মুসলিম সৈন্য দলের ভেতর অনুসন্ধান করে সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীনকে পাওয়া গেল এবং তিনিই ধনুকের জ্যা ছিন্ন করলেন।
সুরমা নদী পারাপার
উত্তর-পূর্ব ভারতের বরাক নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করার সময় সুরমা ও কুশিয়ারা নদীতে বিভক্ত হয়ে যায়। সিলেট বিভাগের বেষ্টনী হিসেবে এ নদীগুলো প্রাচীনকালে প্রবল স্রোতে প্রবাহিত হত। বর্ষাকালের দৃশ্য প্রায় সাগরের মত দেখাত। ঐতিহাসিক পর্যটক ইবনে বতুতা সুরমা নদীকে ‘নহরি আজরফ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। শাহজালাল (রহ.) ফতেপুর হতে যাত্রা করে যখন সুরমা তীরে অবস্থান নিলেন। এ নদী পার হয়েই গৌড়ের রাজধানী। তখন শাহজালাল (রহ.) আউলিয়ার কেরামতি ও আলৌকিক বিভিন্ন ঘটনায় রাজা গোবিন্দ বীতশ্রদ্ধ হন। গোবিন্দ শক্রবাহিনীকে কিছু সময় ঠেকিয়ে রাখার জন্য সুরমা নদীতে নৌকা চলাচল নিষিদ্ধ করেন। তা সত্ত্বেও শাহজালাল (রহ.) নদী পার হলেন। শাহ্জালাল (রহ.) বিসমিল্লাহ বলে সকল মুরিদকে নিয়ে জায়নামাজে করে অনায়াসে চলে গেলেন নদীর ওপারে।
সিলেট প্রথম আজান ধ্বনি
সিলেট শহরে সর্বপ্রথম হযরত শাহজালাল (রহ.) এর আদেশে সৈয়দ নাসিরুদ্দিন সিপাহসালার আজান দেন।
হযরত শাহজালালের বিদায়ী ভাষণঃ
একথা দিবালােকের ন্যায় উজ্জ্বল যে সকল ওলি আওলিয়ার ভবিষ্যৎ বাণী সম্পর্কে কিছু না জানলেও ইশারা ইংগীতের মাধ্যমেও নিদের্শনের মাধ্যমে ভবিষৎ সম্পর্কে কিছু অবগত হতে পারতেন। তাইতাে হযরত শাহজালাল রহমাতুল্লাহ এক সময় বুঝতে পারলেন যে তার সময় শেষ হয়ে আসছে। সেজন্য তিনি সকল শিষ্য সাগরেদ, ভক্তবৃন্দ সকল অমুসলিম মুসলিমদেরকে ডেকে একত্র করে তাদের উদ্দেশ্যে বিদায়ী ভাষণ দান করলেন।
তিনি তার ভাষণে সকলকে উদ্দেশ্য করে বললেন, হে মানব সমাজ! তােমরা মনে প্রাণে বিশ্বাস কর যে আল্লাহ এক অদ্বিতীয় তার কোন শরীক নেই। তিনি কাকেও জন্ম দেননি বা কারাে থেকে জন্ম নেননি। তিনি কারাে মুখাপেক্ষী নন। তিনি সারা বিশ্বকে সুন্দর করে সৃষ্টি করেছেন এবং তিনিই প্রতিপালন করেন। তিনিই আমাদের একমাত্র উপাস্য। আল্লাহ যখন ১৮ হাজার মাখলুকাত সৃষ্টি করে মানব জাতিকে আশরাফুল মাখলুকাত বলে আখ্যা দিলেন সে ভাবেই তাে আমাদের জীবন যাপন করতে হবে। তােমরা মনে রাখবে মানুষ সকলের চেয়ে সম্মানিত। তাই কোন মানুষকে ঘৃণার চোখে দেখবে না। এ সম্পর্কে আল্লাহ রাব্বধূল আলামীন পবিত্র কোরআনে বলেন, এরশাদ হচ্ছে, যে ব্যক্তি কোন মানুষকে হিংসা করে ও মনে ব্যথা দিবে তার ইবাদত আল্লাহ কবুল করেন না।
একথাও তােমরা স্মরণ রেখ পৃথিবীর মানুষ পাপ পুণ্যে মিশ্রীত। সেহেতু কোন মানুষকে পাপী বলে ডাকবে না। কারণ গভীর রাতের অন্ধকার যেমন আলাের পরশে বিদূরীত হতে পারে, তেমনি পাপী লােকেরাও পূণ্যবান লােকদের সংস্পর্শে এসে পূণ্যবান হতে পারেন। কোন মানুষের সাথে খারাপ ব্যবহার, মানুষে মানুষে বিবাদ ও ভেদাভেদ সৃষ্টি করা ইসলামে অমার্জনীয় অধরাধ আর এসবের মূলে হল নিজের জিহবা। এ সম্পক্যে রাসূলে মকবুল (সঃ) বলেছেন যে ব্যক্তি স্বীয় জিহবা ও লজ্জাস্থান সংবরণ করবে আমি তার বেহেস্তের জামিন হব।
অতএব, বুঝা যায় যে, মানুষের জীবন চলার পথে লজ্জাস্থান ও জিহবাকে সংবরণনচেৎ জীবনে উন্নতির শিখরে আরােহন করা সম্ভব নয়। কোন দুঃখী গরীব দুঃখীদের সাথে কখনও কঠোর ব্যবহার করাে না।তাদের সাথে সৎ ব্যবহার করবে। এবং তাদের সাহায্যের জন্য নিজেকে আত্ম নিয়ােগ কর। প্রতিবেশী অনাহারে, অনিদ্রায় আর তুমি পেটপুরে খাবে এটা ইসলামে গর্হিত কাজ। কখনও ইসলাম তা পছন্দ করে না। সব সময় গরীবদের প্রতি খেয়াল রাখবে।পাপ ছােট হলেও তাকে বড় মনে করে তা থেকে বিরত থাকবে। পক্ষান্তরে পুন্য ছোট হলেও তাকে বড় মনে করে তা আকড়িয়ে ধরবে। হাশরের ময়দানে তােমরা দেখবে সামান্য পাপের কারণেও মানুষ দোযখে যাবে আবার সামান্য সওয়াবের কারণে মানুষ বেহেস্তে যাবে। অতএব, খবরদার পাপের কাজ করাতাে দূরের কথা পাপের পথেও, পা ফেলবে না।
উপস্থিত জনগণ হযরতের বাণী শুনে দুঃখে কান্নায় ঢলে পড়লেন বুঝতে পারলেন যে হযরত শাহজালাল অতি শীঘ্রই আমাদের থেকে চির বিদায় নিবেন। শ্রীহট্টের জনগণ এবারে শােক সাগরে ভাসতে শুরু করলেন। সে যাই হােক পরিশেষে সকলকে নিয়ে হাতে তুলে দোয়া করলেন আয় আল্লাহ! আমি চলে যাচ্ছি তুমি আমার ভক্ত বৃন্দদেরকে সৎপথে চলার তৌফিক দান কর। এরপর তিনি সকলের গুণাহের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে বিদায় সভা সমাপ্ত করলেন।
ইন্তেকালঃ প্রত্যেক মানুষকে মৃত্যুর সাধ গ্রহণ করতে হবে। এ নশ্বর জগতে কেহই অমর হতে পারেনি। কোন নবী পয়গম্বর, ওলি আওলিয়া, রাজা বাদশাহ, কেউই মৃত্যুর তুহিন পরশ থেকে রেহাই পায়নি। হযরত শাহজালাল রহমাতুল্লাহ-এর জীবনেও কোন বিপরীত হয়নি। এক সময় মহা তাপস হযরত শাহজালাল রহমাতুল্লাহ-এরও মৃত্যুর ডাক এল। এ বিশ্বের বুক ঘাের তমসার অন্ধকার কেটে যখন আলাের দিশা পেল এ বাংলার মানুষ এহেন সন্ধিক্ষণেই সুবিশাল জীবনে মহাদায়িত্ব ভার পালন করে তার জীবনের সমাপ্তির রেখা টানলেন।
জনদরদী গরীবের বন্ধু মহাসাধক হযরত শাহজালাল রহমাতুল্লাহ, ১৩৮৪ সালে জিলহজ্জ মাসের ২০ তারিখ সারা বাংলার মানুষকে শােক সাগরের অতল গহবরে ডুবিয়ে দুনিয়া থেকে চির বিদায় নিয়ে চলে যান। ইন্না লিল্লাহে অইন্না ইলাইহে রাজেউন। মহা পুরুষ হযরত শাহজালাল রহমাতুল্লাহ, আজীবন নিষ্কাম কঠোর সাধনা সংযম ও পরিশ্রমের মধ্যেই জীবন কাটিয়েছে। দুনিয়ার আবর্তে যখন তিনি বৃদ্ধাবস্থায় উপনীত হলেন, তখনও কঠোর সাধনায় নিজেকে আত্ম নিয়ােগ করেছেন। এত পরিশ্রম করায় শারীরিক দুর্বল হয়ে পড়াও ছিল স্বাভাবিক। এক সময় তিনি তার শারীরিক দুর্বলতাকে বেশী ভাবেই অনুধাবন করতে পারলেন।
এবারে আল্লাহর ওলি হযরত শাহজালাল রহমাতুল্লাহ, বুতে পারলেন যে তার প্রস্থানের সময় এসে গেছে।সেহেতু এক সময় হিন্দু মুসলিম, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, ধনী, দরিদ্র, অসহায় দুঃস্থদের আহবান করলেন তাদের থেকে বিদায় নেবার জন্য এবার তিনি তার সুললিত কন্টে জনতার উদ্দেশ্য বিদায়ী ভাষণ শুরু করলেন। তার ভাষণের প্রতিটি কথাই শ্ৰেতাৱা অনুধাবন করতে পারলেন বুঝতে পারলেন হুজুর আর বেশী দিন আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন না। তিনি কোন সম্প্রদায়ীকতায় বিশ্বাসী ছিলেন না। কোন দল গােষ্ঠীর মধ্যে তার ওলিত্ব সীমাবদ্ধ ছিল না। তাইতাে উপস্থিত সকল ধর্মের সকল স্তরের মানুষ কান্নায় ঢলে পড়ল। মনে হল দুনিয়ায় নেমে এসেছে এক শােকের অন্ধকার। শুধু মানব জাতিই নয় পশু পাখি,গাছপালা, তরুলতা সকলেই যেন দুঃখের সাগরে ভেসে কান্নায় ভেংগে পড়ল। সকলেই অনুভব করল তাদের প্রিয়জন দুনিয়ার বেশী দিন থাকবে না। সারা ময়দানে দুঃখের প্লাবন বয়ে গেল। ওলঠ পালট হয়ে গেল সকলের অন্তর। জীর্ণ শীর্ণ হয়ে গেল সকলের শরীর। সকলেই ধুকে ধুকে প্রার্থনা করতে লাগল হে প্রভু! এই রহমত আমাদের মাকে আরাে কিছু দিন বিদ্যমান রাখুন।
আল্লাহর লীলাকে বুঝতে পারে। আল্লাহও তার প্রিয়নান্দা কে তার সান্নিধ্যে নেয়ার জন্য সঠিক সময়টি স্থির করে ফেললেন। সে যাই হােক এক সময় বিদায়ী সভা ভেংগে গেল আস্তে আস্তে অসুস্থ হয়ে পড়লেন এবারে তিনি স্বীয় হুজরায় ঢুকে ধ্যানে নিমগ্ন হলেন। অনেকে তার হুজরায় ঢুকতে চাইলে হুজুর তাদেরকে নিষেধ করলেন কেউই তার কাছে গেলেন না।
লােকেরা দেখতে লাগল হুজুর হাত তুলে কি যেন বলছেন আর চক্ষু থেকে পানি বয়ে বক্ষদেশ ভিজে জমিনে পড়ছে। তিনি এমন মহাপুরুষ ছিলেন যে তার সময়ও নিজের ব্যক্তিগত কোন স্বার্থের জন্য কাদেননি। এ বলেই তিনি ফরিয়াদ করেছেন হে প্রভূ! আমি আমার দয়িত্ব পূর্ণভাবে পালন করতে পারছি কিনা এ ব্যাপারে নিজেই আমি সন্দিহান। তাইতাে হে প্রভু তুমি আমাকে সকল অপরাধ ক্ষমা করে পরকালেও যেন তােমার প্রেম লাভ করতে পারি সেই তাওফিক দান কর।
এবারে তার শরীরের করুণ অবস্থা দেখে সবাই তার নিকটবর্তী হলেন। এভাবে আপন গতিতে মহামতি আজরাইল হযরত শাহজালাল রহমাতুল্লাহ-এর কাছে আগমন করলেন। হযরত আবার বিষন্ন বদনে সকলকে দূরে যেতে বললেন। আবার সবাই একটু দূরে সরে গেল। কিছুক্ষণ পর সকলে শুনতে পেল হযরত শাহজালাল সুললিত কণ্ঠে কলেমা তাইয়্যেবা ও কলেমা শাহাদাত পাঠ করছেন। সকলে এ দুঃখময় ব্যাপারটা বুঝতে পারল কিন্তু কেউই তার হুজরায় ঢুকল না। সকলে সেখানে দাড়িয়ে রইল। অনেক সময় ধরে কোন টু শব্দটুকু নেই। এবার একজন ঢুকে দেখল হুজুর আর দুনিয়ায় নেই। দুধপায়ী সন্তানের ন্যায় তিনি চির নিদ্রায় শায়ীত হলেন। কেঁদে সকলে জারে জার হয়ে গেল।
সারা বিশ্ব দুঃখের নিঃশ্বাস ফেলে কান্নায় ভেংগে পড়ল। পশু পাখী গাছপালা ঝিমুতে লাগল। | সারা দুনিয়ায় নেমে এল ঘাের অন্ধকার । সকলের চোখেই সরষে ফুল ফুটল। শিষ্য সাগরেদরা এমন কান্না শুরু করল দেখলে মনে হত যেন তাদের আপন জন পিতামাতা | দুনিয়া থেকে বিদায় নিচ্ছে। দেশ-বিদেশ থেকে দলে দলে মানুষ এসে শেষ বারের মত দেখা করতে লাগল সিলেট বাসীরা হযরত শাহজালাল রহমাতুল্লাহ কে পেয়ে ধন্য হয়েছিল। তারা পেয়েছিল তার মাধ্যমে সঠিক পথের সন্ধান।
দেশের মানুষরা নামের পূর্বে লিখত শ্রী সেখানে আজ তারা লিখতে সক্ষম হল নামের শুরুতে মােহাম্মদ। সামাজিক জীবনেও তার অবদান অপরিসীম। সেহেতু এক বাক্যে বলা যেতে পারে হযরত শাহজালাল ছিলেন সলেটের নবজীবনের জন্মদাতা। তাইতাে তার মৃত্যুর শােক সংবাদ শুনে সলেটের সকল স্তরের মানুষের অন্তরে শােকের ঝড় বইল।
হযরত শাহজালাল রহমাতুল্লাহ এর শেষ জীবনঃ
ওলিকুলের শ্রেষ্ঠতম সত্যের মহাসাধক হযরত শাহজালাল রহমাতুল্লাহ মহাসাধনার মাধ্যমে অর্জন করেছিলেন আল্লাহর প্রেম। তাইতাে মানুষ আজ তাকে স্মরণ করে ভক্তি করে। তিনি যেমন ছিলেন ওলিকুলের শিরোমণি সত্যের মহাসাধক ও ইসলাম প্রচারক তেমনি তিনি ছিলেন একজন জনদরদী সমাজ সেবক মহামানব। জনকল্যাণমূলক কাজের জন্যই তিনি আজ সকল শ্রেণীর মানুষের কাছে স্বরনীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন। তিনি একথা জানতেন আল্লাহর সেবা করা মানেই তার সৃষ্ট জীব মানুষের সেবা করা। তাইতাে তার সারাটি জীবনই জনসেবার লক্ষ্যে উৎসর্গ করেছেন।
এমনভাবে তিনি জনগণের কল্যাণের জন্য নিজেকে বিলীন করেছেন যে তিনি নিজের খাওয়া দাওয়ার কথাও ভুলে যেতেন। কিন্তু দুনিয়ার কোন সুখশান্তি তার অন্তরে স্থান পায়নি। তিনি সর্বদা এ নশ্বর জগতের মতিয়া মোহ-লোভ-লালসা, সুখ-শান্তি থেকে নিজেকে দূরে রাখতেন। যাতে করে আল্লাহর প্রেমর কোন ব্যাঘাত ঘটে। তিনি এমন কোন কাজ করতেন না যাতে আল্লাহ নারাজ হয়ে যান। দিনের বেলায় তিনি অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে ইসলাম প্রচার করতেন এবং মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে তাদের সুখ সুবিধা দেখে তাদের মঙ্গলের জন্য উন্নয়নমূলক কাজ করতেন। অবসর পেতেন একটু রাত্রে।
তাও তিনি বিছানায় শুয়ে আরামে নিদ্রা যাননি। সে অবসর সময়টুকুও তিনি আল্লাহর ইবাদতের মাধ্যমে কাটাতেন। তাইতাে তিনি সকল প্রকার জ্ঞান লাভ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি যখন ধর্মের ব্যাপারে আলােচনা করতেন তখন জনগন বুঝত তিনিই একজন শ্রেষ্ঠ সমাজ সংস্কার ও রাজনীতিবিদ ও সুদক্ষ রাষ্ট্র পরিচালক। আবার যখন তিনি অর্থনীতির দিকে আলােকপাত করতেন, তখন সকলের মনে হত হযরত শাহজালাল রহমাতুল্লাহ একজন অন্যতম অর্থনীতিবিদ কারণ তার ঐকান্তিক ইচ্ছা ছিল ধর্ম নীতির সাথে রাজনীতি, অর্থনীতির সমাজনীতির সমন্বয়ে রাষ্ট্রকে সাধন ও প্রতিষ্টিত করা। ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান তাই জীবন চলার পথে সর্বক্ষেত্রের প্রয়ােজন মেটাতেই ইসলাম সক্ষম। আর এ আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন হযরত রাসূলে করীম (সঃ) ও খােলাফায়ে রাশেদিন।
হযরত শাহজালাল রহমাতুল্লাহ ছিলেন রাসূলের সুন্দরতম পূর্ণ আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত। সেহেতু তিনি রাসূলের ন্যায়ই সকল কাজ করার চেষ্টা করতেন। ইসলাম যেমন ব্যাপক তিনি তেমনি ব্যাপক ভাবেই প্রচার করতেন। ইসলামকে কোন প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের মধ্যে সীমিত রাখেননি। শুধু কেবল কলেমা, নামাজ, রােজা হজ্জ, যাকাত, তাসবীহ তাহলিল, মসজিদ ও খনকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেনি। তিনি ইসলামের সকল নীতির উপর কড়া নজর রেখে সঠিক নীতির গুরুত্ব দান সহকারে ইসলাম প্রচার করেছেন।ইসলাম শব্দের অর্থ ব্যাপক ভাবে পর্যালােচনা করে সেই ভাবেই প্রচার করতেন। তিনি সমস্ত জীবন একেবারেই সাদাসিদের মধ্যে কাটিয়েছেন। বৃদ্ধাবস্থায়ও তার কোন পরিবর্তন ঘটেনি। শুধু মানুষ হিসেবে দেহিক অবস্থা একটু দুর্বল হয়েছিল। তিনি তার জীবনে যাই কিছু করতেন আল্লাহর রেজামন্দি হাসেলের জন্যই করতেন। তাইতাে তিনি লাভ করেছিলেন আল্লাহর সন্তুষ্টি।
What's Your Reaction?






