সুলতানুল আরেফিন হযরত বায়েজিদ বোস্তামি (র.) এর জীবনী

সুলতানুল আরেফিন হযরত বায়েজিদ বোস্তামি (র.) এর জীবনী

May 8, 2025 - 22:45
May 9, 2025 - 01:09
 0  0
সুলতানুল আরেফিন হযরত বায়েজিদ বোস্তামি (র.) এর জীবনী

মহান রাব্বুল আলামিন মানবজাতিকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য দুটি অলৌকিক শক্তি সৃষ্টি করেছেন। প্রথমত: নবুয়্যত, এ নবুয়্যতপ্রাপ্তরা হলেন নবী-রাসুলগণ। দ্বিতীয়ত: বেলায়ত, এ বেলায়তের অধিকারি হলেন আউলিয়ায়ে কেরাম। যারা নবীগণের সাহায্যকারী ও প্রতিনিধি। সৃষ্টির সূচনা লগ্ন থেকে এ দুই শ্রেণীর মাধ্যমে হেদায়তের কার্যক্রম চলে আসছে। সর্বশেষ নবী মুহাম্মদ (দ.) এর ইন্তেকালের পর এ দায়িত্ব এককভাবে পালন করে আসছেন হক্কানী-রব্বানী আলেম, আউলিয়ায়ে কেরাম। যে সব মহামনীষির পদধূলির বদৌলতে এ অঞ্চলে সর্বপ্রথম ইসলাম প্রচার-প্রসার হয়েছে, তাঁদের মধ্যে সুলতানুল আরেফিন হযরত বায়েজিদ বোস্তামি (র.) অন্যতম। তিনি পশ্চিম এশিযার ক্ষমতাধর রাষ্ট্র ইরানের রাজধানী তেহরানের পার্শ্ববর্তী কুমিস প্রদেশের অন্তর্গত খোরাসানের প্রসিদ্ধ শহর বোস্তাম বা বিস্তামের মোবদান নামক এলাকার সম্ভ্রান্ত ১২৮ হি/৭৪৫ খ্রি. জন্মগ্রহণ করেন। 

তাঁর জন্মস্থান বোস্তাম বা বিস্তামের দিকে সম্পর্ক করে তাঁকে বোস্তামি/ বিস্তামি বলা হয়। তাঁর সম্মানিত পিতার নাম ঈসা, তিনি তাবেয়িনদের সাক্ষাতপ্রাপ্ত তবেতাবেয়িন। পিতামহের নাম সরূশান,যিনি প্রথম জীবনে অগ্নিপূজক ছিলেন। পরে কোন একজন মুসলিম ধর্ম প্রচারকের নিকট ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁর মাতা সতী সাধ্বী লজ্জ্বাবতী এবং অতি পর্দাশীন চরিত্রবান মহিলা ছিলেন। তাঁর পিতামাতা নিজেরা সৎভাবে জীবনযাপনের পাশাপাশি যোগ্য সন্তানের আশায় তাঁদের দাম্পত্য জীবনের কোন বিষয়ে শরীয়তের বিন্দু পরিমাণও যেন লঙ্ঘন না হয় সেদিকে খুব সতর্ক থাকতেন। তারই ফলশ্রুতিতে তাঁদের তিন সন্তান আদম, বায়েজিদ ও আলী সুফি সাধক এবং বুজুর্গ ছিলেন। তাঁর বংশধারা হল -আবু ইয়াজিদ তাইফুর বিন ঈসা বিন সরূশান/ আদম বিন ঈসা বিন আলী আল বোস্তামী।

জন্মগ্রহণ

ইরানের রাজধানী তেহরানের পার্শ্ববর্তী কুমিস প্রদেশের অন্তর্গত খোরাসানের প্রসিদ্ধ শহর বোস্তাম বা বিস্তামের মোবদান নামক এলাকার সম্ভ্রান্ত ১২৮ হি/৭৪৫ খ্রি. জন্মগ্রহণ করেন। 

ওফাত

একি শহরে ৮৭৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ওফাত বরন করেন।
শাহরুদ এর কাছে বায়েজিদ বোস্তামির মাজার অবস্থিত।

ধারা 

সূফীবাদ
ভাবশিষ্য

ইকবাল, মনসুর হাল্লাজ

ইন্তেকাল 

১১ শাবান ২৬১ হি/ ৮৭৪ খি 


মাতৃভক্তি :

হযরত বায়েজিদ বোস্তামি (র.) এর মহীয়সী জননীর প্রতি তাঁর ভক্তির বিষয়টি বিশ্বব্যাপী পরিচিত। পিতা তাঁর বাল্যকালেই ইন্তেকাল করেন বিধায় পিতার সেবা করার সুযোগ না হলেও মায়ের যে খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন তা খুবই আশ্চর্যজনক। একদিন বায়েজিদ বোস্তামী(র.) ’র মা গভীর রাতে হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে পানি খেতে চাইলেন। বালক বায়েজিদ পানি আনতে গিয়ে দেখলেন কলসিতে পানি নেই। তিনি রাত দুপুরে ছুটলেন বহু দুরের ঝর্ণা হতে পানি আনতে। কিন্ত পানি এনে দেখলেন মা জননী আবারো ঘুমিয়ে পড়েছেন। ঘুম থেকে মাকে জাগানো ঠিক হবে না ভেবে তিনি সারারাত পানির গøাস হাতে মায়ের শিয়রে দাঁড়িয়ে প্রতিক্ষায় রইলেন মায়ের ঘুম ভাঙ্গার? সেই রাতটি ছিল শীতের রাত, চারদিকে যেন কনকনে ঠান্ডা । রাত শেষে পূর্ব আকাশে ফুটে উঠল ঊষার আলো । সকাল হল। মা জেগে দেখলেন পুত্র বায়েজিদ তখনো দাঁড়িয়ে আছে গøাসে পানি নিয়ে । মায়ের প্রতি এই ভক্তি দেখে মা আবেগ তাড়িত হয়ে কেঁদে ফেলেন । আল্লাহর দরবারে হাত উঠিয়ে দোয়া করলেন- আমার ছেলেকে আপনার নেক বান্দা হিসাবে কবুল কর! আর মায়ের দোয়ার বরকতে হযরত বায়েজিদ বড় হয়ে হিজরি তৃতীয় শতাব্দীর বিশ্ব বরেণ্য আউলিয়াদের তালিকায় স্থান করে নিলেন। এ ঘটনার স্মতিচারনে রচিত কবি কালিদাস রায়ের মাতৃভক্তি কবিতাটি বেশ বিখ্যাত।


শিক্ষা জীবন:

হযরত বায়েজিদ বোস্তামি (র.) যেমনি ছিলেন তীক্ষè মেধার অধিকারী, তেমনি পড়ালেখায় বিশেষ মনোযোগী। ফলে শিক্ষা জীবনের প্রথম পর্যায়েই শিক্ষকদের শুভ দৃষ্টি তাঁর ওপর পড়ে। তাঁর চলাফেরা,কথাবার্তা, আদব-ভক্তি এবং নিয়মিত যাতায়াত ও পড়াশোনা শিক্ষকগণকে মুগ্ধ করে। কুরআন-হাদিস, ফিক্হ, তাসাউফ এবং শরীয়তের পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান লাভের মহান লক্ষ্যকে সামনে রেখে মায়ের অনুমতি এবং দোয়া নিয়ে শামসহ বিভিন্ন দেশের দিকে যাত্রা করেন। দীর্ঘ তিন বছরে প্রায় একশত সত্তর জন যুগ বিখ্যাত মুহাদ্দেস, ফক্বীহ এবং বিজ্ঞ আলেমগণের সান্নিধ্যে গিয়ে পবিত্র কুরআন-হাদিসসহ শরীয়তের বিভিন্ন শাখা উপশাখায় গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। এ তিন বছর জ্ঞানার্জনে এমন সাধনা করেছিলেন যে, পানাহার, আরাম-আয়েশ এবং নিদ্রা পরিত্যাগ করতঃ বিরামহীনভাবে এক দেশ হতে অন্য দেশে, এক জ্ঞানির জ্ঞান আহরণ করে অন্য জ্ঞানির সন্ধানে ছুটে ছিলেন।


ইবাদত -রিয়াযত :

যুগশ্রেষ্ট আল্লাহর প্রিয় বান্দাগণ বেলায়েতের উচ্চ মকাম অর্জন করেছেন ইবাদত রিয়াযত এবং কঠোর সাধনার বিনিময়ে। হযরত বায়েজিদ বোস্তামি (র.) বলেন, তোমরা যদি এমন কোন ব্যক্তি দেখ, যার কাছে অনেক কারামত, সে বাতাসে উড়ছে, তা সত্তে¡ও তোমরা আশ্চর্য হবে না। (তাকে অলি মনে করবে না) বরং তাকে দেখ, সে শরীয়তের আদেশ-নিষেধ মেনে চলে কিনা? এবং শরীয়তের সীমারেখা হেফাজত করে কিনা? তিনি আরো বলেন, যে ব্যক্তি শরিয়ত এবং সুন্নতের অনুসরণ ব্যতীত নিজকে তরীক্বত পন্থি বলে দাবি করে সে মিথ্যুক। কেননা শরীয়তের অনুসরণ ব্যতীত তরিক্বত অর্জন অসম্ভব। আমি দীর্ঘ চল্লিশ বছরের কঠোর সাধনায় আল্লাহর নৈকট্য ভাজন হওয়ার জন্য শরীয়তের জ্ঞান এবং সে অনুযায়ী আমলের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ অন্য কিছু পাই নি।


বায়েজিদ বোস্তামী বোস্তামের এক মসজিদে একাধারে চল্লিশ বছর বিরামহীনভাবে ইবাদত- রিয়াযতে অতিবাহিত করেন। উক্ত মসজিদ পরিত্যাগ করে অন্য কোথাও গমন করেন নাই এবং ক্ষণিকের জন্যও আল্লাহর ধ্যান হতে বিমুখ হন নি। এ চল্লিশ বছরে তিনি একটি রাতেও নিদ্রাসুখ উপভোগ করেন নি। কখন অলসতার শিকার হয়ে যান, এ ভয়ে বিরামহীন দÐায়মান অবস্থায় ইবাদতে মশগুল থাকতেন। এমনকি কোন বস্তু বা দেয়ালের সাথে ঠেস পর্যন্ত দেন নাই। তিনি সর্বদা আল্লাহর জিকিরে মগ্ন থাকতেন। তার পরও বলতেন, ওহে মাবুদ! সারা জীবন আমি আপনার নাম স্মরণ করেছি একান্ত উদাসীনভাবে। আমি এক চরম অকৃতজ্ঞ। জানিনা, আপনার সাথে আমি সাক্ষাতের যোগ্য বলে বিবেচিত হবো কি না।


খেলাফত লাভ :

আল্লাহর প্রেমের শরাব এবং জ্ঞানার্জনের প্রবল আগ্রহই ছিল তাঁর একমাত্র পাথেয়। তাঁর জ্ঞান-গরিমা, চরিত্র আদর্শ এবং আদব ভক্তি দেখে তাঁর প্রিয় শিক্ষক ও পীর মুর্শিদ আলে রাসূল (দ.) হযরত ইমাম জাফর সাদেক (রা.) তাঁকে খেলাফত প্রদান করেন।
মানব সেবা : হযরত বায়েজিদ বোস্তামি (র.) সারা জীবন ইবাদত- রিয়াযত ও আল্লাহর ধ্যানে মশগুল থাকা সত্তে¡ও আল্লাহর বান্দাদের সেবা ও নিঃস্ব দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়ানোসহ দেশ ও জাতির খেদমতে নিজকে যেভাবে সম্পৃক্ত রেখেছেন তা রীতিমত আশ্চর্যজনক। বোস্তামে এক নিতান্ত গরিব ইহুদি পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করত। একদা ইহুদি কোথাও ভ্রমণে গেল। ঘরে তেমন কিছু ছিল না বিধায় ইহুদির স্ত্রী কষ্ট করে ছেলেমেয়েদের নিয়ে কোন রকম দিন অতিবাহিত করছে। তবে রাতের বেলায় বাতি জ্বালানো সম্ভব হত না। অন্ধকার ঘরে ছোট বাচ্চারা সম্পূর্ণ রাত কান্নাকাটি করত। হযরত বায়েজিদ বোস্তামি (র.)অবগত হয়ে প্রতিদিন সন্ধ্যা বেলায় ইহুদির ঘরে বাতি জ্বালিয়ে দিয়ে আসতেন। অনেক দিন পর ইহুদি ভ্রমণ হতে ফিরে আসলে স্ত্রী সম্পূর্ণ ঘটনা তাকে বর্ণনা দিলে সে আশ্চর্য হয়ে স্ত্রীকে বলল,এমন এক বুজুর্গ আমাদের প্রতিবেশী, আর আমরা পথভ্রষ্টতার মধ্যে জীবন অতিবাহিত করব, কতই না আফসোসের বিষয়? অতঃপর সবাই গিয়ে হযরত বায়েজিদ বোস্তামি (র.) এর হাতে কলমা পড়ে মুসলমান হয়ে গেল। তাঁর জীবনীতে দেখা যায়, সীমান্ত পাহারা দেয়ার মত রাষ্ট্রীয় এবং জনকল্যাণমূলক গুরুত্বপূর্ণ কাজটিও তিনি সানন্দেচিত্তে আদায় করেছেন।
ইসলাম প্রচার : হযরত বায়েজিদ বোস্তামী (র.) জ্ঞানার্জন, বুজুর্গ সূফী সাধকের ফয়েজ বরকত লাভ এবং ইসলাম প্রচারের নিমিত্তে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় সফর করেছেন। তিনি একবার ইসলামের দাওয়াত নিয়ে এক গির্জায় প্রবেশ করেন। গির্জায় পাদ্রি তাকে অসংখ্য প্রশ্ন করলে তিনি সেই প্রশ্নের উত্তর সঙ্গে সঙ্গে প্রদান করেন । তার অপূর্ব উত্তর শুনে ঐ মজলিসে পাদ্রি ও তার হাজার হাজার অনুসারী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।


হযরত বায়েজিদ বোস্তামি (র.) পারস্য অঞ্চল হতে প্রথমে সিন্ধুতে আসেন। পরে তাঁর শিক্ষক হযরত আবু আলী সিন্ধি (র.) আদেশে খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীতে সমুদ্র পথে চট্টগ্রাম আসেন। বিভিন্ন ঐতিহাসিকগণের রচিত গ্রন্থের ভাষ্যমতে, হযরত বায়েজিদ বোস্তামি (র.) চট্টগ্রামের নাসিরাবাদের কুমাদান পাহাড়ে ইবাদত রিয়াযত এবং ধ্যানে মগ্ন থেকে সাধনায় সিদ্ধি লাভ করার পাশাপাশি চট্টগ্রাম ও পার্শ্ববর্তী অন্যান্য জেলা ও অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করে ইসলামের গোড়াপত্তন করেন। ঐতিহাসিকগণ একথাও লিখতে কার্পণ্য করেন নি যে, এদেশে ইসলাম প্রচারের ইতিহাসে তাঁর অবদান অবশ্যই স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। বাংলাদেশের মানুষের মনে ইসলামের রওশনী বিকিরণে তাঁর ভূমিকা অসাধারণ।

বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.)-এর কিছু মূল্যবান নছিহত


একবার বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.)-এর কাছে প্রশ্ন করা হলো, মানুষ আত্মশুদ্ধির চূড়ান্ত অবস্থায় কখন পৌঁছাতে পারে? তিনি জবাব দিলেন, যখন মানুষ সৃষ্টিজগৎ থেকে পৃথক হয়ে নির্জনে নিজের দোষত্রুটির কথা চিন্তা-ভাবনা করে এবং তা থেকে নিজেকে শুধরে নেয়। তিনি আরও বলেন, এর দ্বারা আল্লাহর নৈকট্যও হাসিল হয়।
বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.)-কে লোকেরা জিজ্ঞেস করল, হুজুর! নামাজের খাঁটি ও আসল পরিচয় কী? তিনি জবাব দিলেন, যার দ্বারা দিদারে এলাহি হতে পারে, সেটাই প্রকৃত নামাজ। তবে তা খুব কঠিন কাজ, কিন্তু মানুষের সাধ্যাতীত নয়।


আমি ভেবে দেখলাম যে, আমার শাস্তি পাওয়ার মূল হেতু কোন বস্তু? দেখা গেল গাফিলতি (আলস্য) ছাড়া আর কিছু নয়। পরে তিনি বললেন, মানুষের সামান্য গাফিলতি দোজখের আগুনের কারণ হবে। অতএব সাবধান হও।


বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.) বেশি বেশি আল্লাহর জিকিরে মগ্ন থাকতেন। তারপরও বলতেন, ওহে মাবুদ! সারা জীবন আমি আপনার নাম স্মরণ করেছি একান্ত উদাসীনভাবে। আমি এক চরম অকৃতজ্ঞ। জানি না, আপনার সঙ্গে আমি সাক্ষাতের যোগ্য বলে বিবেচিত হবো কি না। তিনি মানুষকে বেশি বেশি জিকিরের প্রতি তাগাদা দিতেন।
বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.) বলতেন, আমি দুনিয়া পরিত্যাগ করে সম্পূর্ণ একাকী অবস্থায় বলতে লাগলাম, হে মাবুদ! তুমি ছাড়া আমার আর কেউ নেই। তবে তুমি যখন আমার আছ, আমার সব কিছুই আছে। আল্লাহ্ তায়ালার মেহেরবানির ফলে আমার মানসিক অবস্থা ও অনুভূতির পরিবর্তন ঘটল। অনুভব করলাম, যারা আল্লাহর আদেশ পালন করেছে, তারা পুরস্কার লাভ করেছে ও পুরস্কারের প্রতি আসক্ত হয়েছে, কিন্তু আমি প্রভু আল্লাহ্ তায়ালা ছাড়া অন্য কিছুতেই আসক্ত হইনি।
আল্লাহর প্রেমের নিদর্শন হলো, তিনি তাঁর প্রেমিককে ৩টি জিনিস দান করে থাকেন। সমুদ্রের মতো বদান্যতা, সূর্যের মতো দয়া এবং পৃথিবীর মতো নম্রতা।


বায়েজিদ বোস্তামির দরগাহ শরীফ :

সফরকালীন সময়ে যেখানেই তিনি অবস্থান করে ইবাদত-রিয়াযত ও সাধনা করেছেন, সেখানেই গঠিত হয়েছে খানকাহ তথা দরগাহ শরীফ। গবেষণায় দেখা যায়, বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে প্রায় চল্লিশটির মত তাঁর দরগাহ শরীফ বিদ্যমান। শুধু মিশরের মধ্যেই তিনটি। চট্টগ্রামের নাসিরাবাদস্থ কুমাদান পাহাড়ের চূড়ায় যে স্থানটি ইবাদত-রিয়াযতের জন্য নির্বাচিত করে খানকাহ তৈরি করেছিলেন এবং যেখানে সাধনার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করেন, সেই স্থানটিই বর্তমান “হযরত বায়েজিদ বোস্তামী (র.) দরগাহ শরীফ ” নামে পরিচিত। নবী-রসূল ও অলি আল্লাহদের ইবাদতস্থল তথা খানেকাহ এবং তাঁদের ব্যবহৃত কিংবা সম্পর্কিত বস্তু যে অন্যদের জন্য ইবাদতগাহ, আল্লাহর রহমত অবর্তীণের কেন্দ্রস্থল এবং দোয়া কবুলের বড় মাধ্যম সে ব্যাপারে পবিত্র কুরআন- হাদীসের অসংখ্য দলিল ও হক্কানী ওলামায়ে কেরামের গবেষণামূলক বক্তব্য দ্বারা প্রমাণিত এবং শরীয়ত সম্মত ।

পবিত্র কুরআনুল করিমে ইরশাদ হচ্ছে- “যারা এ কাজে (আসহাবে কাহাফের মাযার সংরক্ষণের ব্যাপারে) প্রবল ছিল, তারা (সুন্নী) বলল : আমরা অবশ্যই আসহাবে কাহাফের (মাযারের) উপর একটি মসজিদ নির্মাণ করবো।” (সুরা কাহাফ:২১) তাই হযরত বায়েজিদ বোস্তামী (র.) দরগাহ শরীফে দীর্ঘ প্রায় বারশত বছর ধরে প্রতিনিয়ত হাজার হাজার মানুষ যিয়ারত করে ইহকালীন ও পরকালীন সফলতা অর্জন করে আসছেন শুধু তা নয়, বরং ইতিহাস সাক্ষ্য যে, যুগ যুগ ধরে হক্কানী ওলামায়ে কেরাম এবং বুজুর্গানে দ্বীনও উক্ত দরগাহ শরীফে যিয়ারত করে ফয়েজ-বরকত হাসিল করেছেন। চট্টগ্রাম-এ-তাঁর দরগাহর এই অবয়েব সর্বপ্রথম ১৮৮৩ সালে পাহাড়ের উপরিভাগে একটি দেয়ালঘেরা আঙ্গিনার মাঝে পরিলক্ষিত হয় । পরবর্তীতে দরগাহটি আধুনিক কাঠামো দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয় । দরগাহ পাহাড়ের পাদদেশে একটি তিন গম্বুজ বিশিষ্ঠ মোঘলরীতির আয়তাকার মসজিদ এবং একটি বিশালাকার দীঘি আছে। স্থাপত্যশৈলী থেকে ধারণা করা হয় মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব এর আমলে মসজিদটি নির্মিত। আর এ বিশাল দীঘিতে রয়েছে কাছিম ও গজার মাছ । আঞ্চলিকভাবে এদের মাজারী ও গজারী বলে আখ্যায়িত করা হয়। বোস্তামীর কাসিম আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি অত্যন্ত বিরল এবং চরমভাবে বিপন্নপ্রায় প্রজাতি।

এই প্রজাতির কচ্ছপ এতই দুর্লভ যে, ১৯১৪ সালে প্রাণিবিজ্ঞানী এন এনানডেলের ও অন্য প্রাণিবিজ্ঞানী এম শাস্ত্রী এক গবেষণায় উল্লেখ করেন, বোস্তামীর কচ্ছপ বর্তমানে শুধু চট্টগ্রামের হযরত বায়জিদ বোস্তামী(র) দরগাহ সংলগ্ন পুকুরেই টিকে আছে। পৃথিবীর কোথাও এই প্রজাতির কচ্ছপ আর দেখা যায় না। ২০০২ সালে পরিবেশ ও প্রকৃতি সংরক্ষণে আন্তর্জাতিক সংস্থা “আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ” (ওটঈঘ) কর্তৃক বোস্তামী কচ্ছপকে চরমভাবে বিলুপ্ত প্রায় প্রজাতি হিসাবে তালিকাভুক্ত করা হয় । তাই এই কচ্ছপেরর ওপর ২০০৭ সালে ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেল এক ডকুমেন্টারি তৈরি করে নিয়ে যায় । এগুলোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য- আকারে এই কচ্ছপ অনেক বড় হয় এবং ওজনও বেশি হয়। কালের সাক্ষ্যি হয়ে শত শত বছর এদের বেঁচে থাকার অপূর্ব ক্ষমতা আছে। দুঃখজনক হলো সত্য যে, জীব বৈচিত্রের নিদর্শন নিরীহ এই কচ্ছপগুলোকে ২০০৪ সালের মে মাসে একবার পুকুরে বিষ ঢেলে এদের বংশ র্নিবংশ করার চেষ্টা করা হয়েছিল কিন্তু জাতীয় বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ চট্টগ্রামের ত্বরিত পদক্ষেপে কোনমতে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পায় কচ্ছপ গুলো।

বোস্তামির মাজারের বিস্ময়কর কাছিম


চট্টগ্রাম নগরীর একটি পাহাড়ে অবস্থিত বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.)-এর প্রতিরূপ মাজার। এই মাজারের অবয়ব সর্বপ্রথম ১৮৩১ সালে পাহাড়ের উপরিভাগে একটি দেয়ালঘেরা আঙিনার মাঝে আবিষ্কার করা হয়। মাজারটির পাদদেশে রয়েছে একটি বিশালাকার পুকুর। আর ওই পুকুরের মূল আকর্ষণ বিস্ময়কর কচ্ছপ বা কাছিম বা গজার মাছ। স্থানীয়রা তাদের মাজারি ও গজারি বলেই আখ্যায়িত করেন। এ কচ্ছপ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অত্যন্ত বিরল এবং বিপন্নপ্রায় প্রজাতি। বর্তমানে বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.)-এর মাজার ছাড়া তাদের বিশ্বের আর কোথাও দেখা যায় না। তাই দেশি-বিদেশি পর্যটকদের জন্য খুব আকর্ষণীয় এ কচ্ছপ। বিশালাকার কচ্ছপগুলো দেখলে বিস্ময়ে হতবাক হতে হয়। এই কচ্ছপগুলোর অনেকেরই বয়স প্রায় ২০০-২৫০ বছর। মাজারের বড়ো বড়ো এ কচ্ছপগুলোকে প্রতিদিনই দর্শনার্থীরা খাবার দেন। ১৯৩১ সালে প্রাণিবিজ্ঞানী ম্যালকম স্মিথ তার ‘ফনা অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া গ্রন্থে’ উল্লেখ করেন, ভারতবর্ষে ‘নিলসোনিয়া নিগরিকেন টার্টেল’ বা বোস্তামি কাছিম একমাত্র বায়েজিদ বোস্তামির মাজারেই পাওয়া যায়। স্থানীয় লোকজনের বিশ্বাস, হযরত বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.) ইরান থেকে চট্টগ্রামে আসার সময় এ কাছিমগুলো নিয়ে আসেন। প্রাণিবিজ্ঞানীদেরও ধারণা ছিল বোস্তামি কাছিম উপমহাদেশ অঞ্চলের প্রাণী নয়। সা¤প্রতিক এক গবেষণার মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা দাবি করছেন, বোস্তামি কাছিম বাংলাদেশ অঞ্চলের নিজস্ব প্রাণী।

ইন্তেকাল : 

১১ শাবান ২৬১ হি/ ৮৭৪ খি হযরত বায়েজিদ বোস্তামি (র.)মহান প্রভুর ডাকে সাড়া দিয়ে লক্ষ লক্ষ ভক্ত অনুরোক্তদের শোক সাগরে ভাসিয়ে আল্লাহ ও রাসূলের দিদারে চিরকালের জন্য চলে গেলেন। ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন।

What's Your Reaction?

Like Like 0
Dislike Dislike 0
Love Love 0
Funny Funny 0
Angry Angry 0
Sad Sad 0
Wow Wow 0