উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী জীবনী | Biography of Upendrakishore Ray Chaudhuri

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী জীবনী | Biography of Upendrakishore Ray Chaudhuri

May 18, 2025 - 20:06
 0  1
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী জীবনী | Biography of Upendrakishore Ray Chaudhuri

জন্ম
১২ই মে। ১৮৬৩ সালের এই দিনে ময়মনসিংহ জেলার (বর্তমান কিশোরগঞ্জ জেলা) কটিয়াদি উপজেলার মসুয়া গ্রামে বহুমখী প্রতিভাধর এ মানুষটি জন্মগ্রহণ করেন।

মারা গেছে

২০ ডিসেম্বর ১৯১৫ (বয়স ৫২)
কলকাতা , বাংলা, ব্রিটিশ ভারত
জাতীয়তা

ব্রিটিশ ভারতীয়

জন্য পরিচিত

লেখক, চিত্রশিল্পী

স্বামী/স্ত্রী

বিধুমুখী দেবী ( দ্বারকানাথ গাঙ্গুলির কন্যা এবং কাদম্বিনী গাঙ্গুলির সৎ কন্যা )

শিশুরা

শুকলতা রাও ও সুকুমার রায় সহ ৬ জন

আত্মীয়স্বজন

সত্যজিৎ রায় (নাতি)

শিশু সাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী 

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১২৭০ বঙ্গাব্দের ২৭ শে বৈশাখে অর্থাৎ ইংরেজি ১৮৬৩ সালের ১২ ই মে। ময়মনসিংহের বর্তমান কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদি উপজেলার অন্তর্গত মসূয়া গ্রামে তাঁর জন্ম হয়, যা বর্তমানে বাংলাদেশে অবস্থিত। তাঁর পিতার নাম কালিনাথ রায়, যিনি ছিলেন একজন সুদর্শন এবং আরবি, ফারসি ও সংস্কৃত এই তিন ভাষায় সুপণ্ডিত। তাঁর মায়ের নাম ছিল জয়তারা দেবী। উপেন্দ্রকিশোরের নাম রাখা হয়েছিল কামদারঞ্জন রায়।

উপেন্দ্রকিশোর মাতা পিতার আটজন সন্তানের মধ্যে ছিলেন তৃতীয় পুত্রসন্তান। পাঁচ বছর বয়সে, পিতার অপুত্রক আত্মীয়, জমিদার হরিকিশোর রায়চৌধুরী  কামদারঞ্জনকে দত্তক নেন। এরপর জমিদার হরিকিশোর নিজের দত্তক পুত্রের পূর্ব নাম পরিবর্তন করে দিয়ে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী রাখেন। হরিকিশোরের বাড়িতে যথেষ্ট আদর ও যত্ন সহকারে মানুষ হয়েছিলেন উপেন্দ্রকিশোর। লীলা মজুমদার উপেন্দ্রকিশোর রায়ের সম্পর্কে নিজের স্মৃতিকথায় লিখছিলেন, ‘ছেলে তো নয়, হরিকিশোর সিংহের বাচ্চা ঘরে এনেছিলেন। তারা কখনো পোষ মানে না, সর্বদা নিজের বুদ্ধিতে চলে।’

প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন

তিনি উন্নত ব্লকমেকিং প্রক্রিয়া নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন এবং ব্লকমেকিং সম্পর্কে তাঁর বেশ কয়েকটি প্রযুক্তিগত প্রবন্ধ ব্রিটেন থেকে প্রকাশিত পেনরোজ বার্ষিক খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছিল।  তাঁর নিজের জীবদ্দশায়, বিদেশের একজন মুদ্রণ বিশেষজ্ঞ মন্তব্য করেছিলেন যে উপেন্দ্রকিশোরের অবদান ইউরোপ এবং আমেরিকার তার প্রতিপক্ষদের তুলনায় অনেক বেশি মৌলিক ছিল, "যা আমরা যখন বিবেচনা করি যে তিনি প্রক্রিয়া কাজের কেন্দ্র-কেন্দ্র থেকে কতটা দূরে আছেন তখন আরও অবাক করে"। 

তিনি হাফটোন ব্লকমেকিং সম্পর্কিত বেশ কয়েকটি কৌশল আবিষ্কার করেছিলেন, যার মধ্যে প্রসেস ক্যামেরার স্বয়ংক্রিয় ফোকাসিংয়ের জন্য "স্ক্রিন-অ্যাডজাস্টিং মেশিন"ও ইংল্যান্ডে তার নকশা অনুসরণ করে একত্রিত করা হয়েছিল।  ব্রিটিশ হ্যান্ডবুক অফ প্রিন্টিং টেকনোলজি, পেনরোজ অ্যানুয়াল, ভলিউম X, 1904-05, একটি সম্পাদকীয় নোটে তার সম্পর্কে উল্লেখ করেছে যে, "মিঃ রে স্পষ্টতই গাণিতিক মানের অধিকারী এবং তিনি অর্ধ-টোন কাজের সমস্যাগুলি অসাধারণভাবে সফলভাবে যুক্তিযুক্তভাবে সমাধান করেছেন ... (তার মুদ্রণ উন্নয়ন) অপারেটরকে সম্পূর্ণ স্নাতক এবং বিশদ সহ এবং নেতিবাচক-তৈরি এবং খোদাইয়ের ক্ষেত্রে ন্যূনতম পরিমাণে হেরফের দক্ষতার সাথে অভিন্ন কাজ করতে সক্ষম করে।" 1905-06 সালের পেনরোজ অ্যানুয়াল ভলিউম XI হাফটোন ব্লকমেকিংয়ে 60-ডিগ্রি স্ক্রিনের নতুন কৌশল সম্পর্কে তার গবেষণাপত্র প্রকাশ করে।

শিশু সাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর শিক্ষাজীবনের অভিজ্ঞতা 

উপেন্দ্রকিশোর মেধাবী ছাত্র ছিলেন বলে পড়াশোনায় প্রতি ক্লাসেই ভাল ফল করতেন। তবে ছোটোবেলা থেকেই এই স্বনামধন্য সাহিত্যিকের পড়াশোনার চেয়ে বেশি অনুরাগ ছিল কিছু বাদ্যযন্ত্র যেমন বাঁশী, বেহালা এবং পাশাপাশি সঙ্গীতের প্রতিও। উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং এর জন্য বৃত্তিও লাভ করেন। তারপর তিনি পরবর্তী শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে কলকাতায় এসে পড়েন। উপেন্দ্রকিশোর কলকাতায় প্রেসিডেন্সী কলেজে ভর্তি হন। মাত্র একুশ বছর বয়সে কলকাতায় বিএ পাস করে নেওয়ার পর উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী ছবি আঁকা শিখতে শুরু করেন। ১৮৮৪ সালে মেট্রোপলিটন ইনসটিটিউট থেকে তিনি বি.এ পাশ করেন।

উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর ব্রাহ্মসমাজে যোগদান

কলকাতায় আসার পর ব্রাহ্মসমাজের সর্বজন শ্রদ্ধেয় মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ এবং দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে উপেন্দ্রকিশোরের পরিচয় হয়। ক্রমে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে। স্বভাবতঃই উপেন্দ্রকিশোরও ব্রাহ্মসমাজের সদস্যদের সাথে মিলে মিশে ব্রাহ্মধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। সেই সূত্রেই জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে তাঁর যাতায়াত শুরু হয়। সে সময় তিনি ব্রাহ্ম সমাজে যোগ দেন। তবে ব্রাহ্ম সমাজের সদস্য হওয়ার পর থেকে তাঁর অনেকজন আত্মীয়ের সঙ্গেই মনোমালিন্য ঘটতে শুরু করে, তখন সনাতন হিন্দু ধর্মের বিচারে দেখতে গেলে উপেন্দ্রকিশোরের জীবনধারা পূর্ব থেকে বেশ আলাদা হয়ে যায়।

অন্যদিকে নতুন যে কোনো কিছু জানার ব্যাপারে প্রবল ঝোঁক ছিল উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর। তিনি কলকাতায় থেকে নতুন নতুন বই পড়ার সুযোগ পান এবং তার মধ্যেই ডুবে যান। এই সময়েই তিনি একটা বিষয় নিয়ে চিন্তা করে দেখেন যে, দেশের ছোটদের উদ্দেশ্যে ভাল কোনো লেখা বা আঁকার ছাপা বই নেই! এই ধরনের অভাব দূর করার জন্য ছোটদের উদ্দেশ্যে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করার চিন্তা তাঁর মাথায় আসে এবং সেই মত তিনি লেখা শুরু করেন। 

উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর সাহিত্য জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা, 

ছাত্র বয়সী সময় থেকেই উপেন্দ্রকিশোর ছোটোদের জন্যে লিখতে শুরু করে দেন। ধীরে ধীরে সেই সময়কার কিছু পত্রিকা যেমন সখা, সাথী, মুকুল এবং জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি থেকে প্রকাশিত ‘বালক’ নামক মাসিক পত্রিকাগুলিতে তাঁর লেখাগুলো প্রকাশ করা শুরু হয়েছিল। প্রথমদিকের সময়ে অর্থাৎ ১৮৮৩ সালের দিকে সখা পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর লেখাগুলির বেশিভাগই ছিল জীববিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ। এর পরবর্তিতে চিত্র অলঙ্করণ যুক্ত গল্পসমূহ প্রকাশ হতে শুরু হয়।

কিছুকাল পর যোগীন্দ্রনাথ সরকারের “সিটি বুক সোসাইটি” থেকে উপেন্দ্রকিশোরের প্রথম বই প্রকাশিত হয়। বইটির নাম ছিল “ছেলেদের রামায়ণ”, উক্ত বইটি সেসময়ে সমাজে অতি আদরের সঙ্গে সমাদৃত হয়, কিন্তু এর মুদ্রণ সম্বন্ধে অতৃপ্ত ছিলেন উপেন্দ্রকিশোর; তাই ১৮৮৫ সালে তিনি বিদেশ থেকে তখনকার সময়ের আধুনিকতম মুদ্রণ যন্ত্রাংশাদি একেবারে নিজের খরচায় আমদানি করে নেন।

এরপর কলকাতার ৭ নম্বর শিবনারায়ণ দাস লেনে একটি নতুন বাড়ি ভাড়া নিয়ে ‘ইউ রায় অ্যান্ড সন্স’ নামে এক নতুন ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানকারই একটি কামরাতে তিনি নিজের আঁকার স্টুডিও শুরু করেন এবং পাশাপাশি সেখানে হাফটোন ব্লক প্রিন্টিং নিয়েও অনেক পরীক্ষা নিরিক্ষা করেন তিনি। তাছাড়া ক্যামেরা কিনে নিয়ে তার সাহায্যে আলো ছায়ার রহস্য নিয়ে নানা রকমের পরীক্ষা নিরীক্ষা করতেন তিনি।

উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর বিখ্যাত কিছু কবিতা ও গান :  খুকুমণি, রেলগাড়ির গান, কমলা নাপিত, বেচারা, শিশুর কথা, সুখের চাকুরী, শিশুর জাগরণ, চাঁদের বিপদ, প্রার্থনা, বাবার চিঠি, ময়মনসিংহের চিঠি, ঋতু, মধুপুরের চিঠি, গান, পাখির গান, গ্রীষ্মের গান, যখন বড় হব, ব্রহ্মসংগীত , অসন্তোষ।

উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর লেখা উল্লেখযোগ্য গল্প : কাজির বিচার, কুঁজো আর ভূত, খুঁত ধরা ছেলে, গল্প নয় সত্য ঘটনা, গল্প-সল্প, ঘ্যাঁঘাসুর, ছোট ভাই, জাপানী দেবতা, জেলা আর সাত ভুত, ঠাকুরদা, তিনটি বর, দুঃখীরাম, দুষ্ট দানব, নরওয়ে দেশের পুরান

নুতন গল্প, পণ্ডিতের কথা, পাকা ফলার, ফিঙে আর কুঁকড়ো, বানর রাজপুত্র

উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর ব্যক্তিগত জীবনের বিভিন্ন ঘটনা

১৮৮৬ সালে এই শিশু সাহিত্যিক বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক ব্রাহ্মসমাজের দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম পক্ষের কন্যা বিধুমুখীর সঙ্গে ২৩ বছর বয়সী উপেন্দ্রকিশোরের বিবাহ হয়। এরপর তখনকার কলকাতার কর্নওয়ালিস স্ট্রীটে অবস্থিত ব্রাহ্ম সমাজ মন্দিরের বিপরীত দিকে লাহাদের বাড়ির দোতলায় তিনি কয়েকটি ঘর ভাড়া নিয়ে নেন এবং সেখানেই উপেন্দ্রকিশোরের সাংসারিক জীবন শুরু হয়। পরবর্তীতে উপেন্দ্রকিশোরের ঘরে তিন ছেলে ও তিন মেয়ের জন্ম হয়।

ছেলেদের নাম রাখা হয় সুকুমার, সুবিনয় এবং সুবিমল, অন্যদিকে মেয়েদের নাম রাখা হয়েছিল সুখলতা, পুণ্যলতা এবং শান্তিলতা। তবে পরবর্তী সময়ে উপেন্দ্রকিশোরের পুত্র-কন্যা প্রত্যেকেই শিশু সাহিত্যে নিজেদের অবদান রেখেছেন। তাদের মধ্যে জ্যেষ্ঠা কন্যা সুখলতা রায় এবং জ্যেষ্ঠ পুত্র সুকুমার রায়ের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। তিনি বড় ছেলে সুকুমারকে ১৯১১ সালে ফোটোগ্রাফী ও মুদ্রণ সম্বন্ধে উচ্চশিক্ষা লাভ করার জন্যে বিলাতে পাঠিয়ে দেন।

উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর জীবনাবসান

সাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর গিরিডির ভাড়াবাড়িতে দু’দিন রোগযন্ত্রণায় একদম অচৈতন্য হয়ে পড়েছিলেন। চিকিৎসার জন্য তাঁকে কলকাতায় নিয়ে আসা হল, যদিও তিনি আসতে চাইছিলেন না। অনেক আগে থেকেই অতিরিক্ত শারীরিক আর মানসিক পরিশ্রমে তাঁর স্বাস্থ্য ভাঙতে শুরু করেছিল। তিনি মধুমেহ রোগে আক্রান্ত ছিলেন। কিন্তু এর চিকিৎসার জন্য তখনও ইনসুলিনের আবিষ্কার হয়নি, তবে তার জন্য বিদেশ থেকে ওষুধ আসতো, কিন্তু প্রথম মহাযুদ্ধের কারণে সেই ওষুধও আসা বন্ধ হয়ে যায়।

এদিকে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী আর কলকাতায় থাকতে রাজি নন, তাঁর মন টান ছিল গিরিডির জন্যই। প্রাণপ্রিয় গিরিডিতে সেই ছিল তাঁর শেষ যাওয়া। সেখানে গিয়ে ডা. দ্বিজেন্দ্রনাথ মৈত্রের ‘রুবি লজ’ বাড়িতে উঠেছিলেন। কনিষ্ঠ পুত্র সুবিমল রায় উক্ত ঘটনা সম্পর্কে লিখেছিলেন যে, “বাবার অসুখ কিছুতেই সারছিল না, তাই তাঁকে কলকাতায় নিয়ে আসা হল। বড় বড় ডাক্তারেরা দেখলেন, কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। কঠিন অসুখের মধ্যেও বাবা শান্ত থাকতেন। বলতেন, “আমি খুব আনন্দে আছি।” ১৯১৫ সালের ২০শে ডিসেম্বর উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরি পরলোক গমন করেছিলেন। মৃত্যুকালে এই বহুমুখী যোগ্যতা সম্পন্ন শিশুসাহিত্যিকের বয়স ছিল মাত্র বাহান্ন বছর। 

sourse : wikipedia

What's Your Reaction?

Like Like 0
Dislike Dislike 0
Love Love 0
Funny Funny 0
Angry Angry 0
Sad Sad 0
Wow Wow 0