রফিক আজাদ জীবনী। Biography of Rafiq Azad

রফিক-আজাদ-জীবনী-biography-of-rafiq-azad

May 12, 2025 - 12:03
May 13, 2025 - 18:46
 0  1
রফিক আজাদ জীবনী।  Biography of Rafiq Azad

জন্ম

রফিক আজাদ ১৯৪১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইল থানার গুণগ্রামের এক অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা সলিম উদ্দিন খান ছিলেন একজন প্রকৃত সমাজসেবক এবং মা রাবেয়া খান ছিলেন আদর্শ গৃহিণী। দুই ভাই-এক বোনের মধ্যে তিনি সর্বকনিষ্ঠ। প্রকৃতার্থে তারা ছিলেন তিন ভাই-দুই বোন। কিন্তু তার জন্মের আগে মারা যায় সর্বজ্যেষ্ঠ ভাই মাওলা ও তৎপরবর্তী বোন খুকি। রফিক আজাদ যখন মায়ের গর্ভে তখন অকাল প্রয়াত বড় বোন অনাগত ছোট ভাইয়ের নাম রেখেছিলেন ‘জীবন’। রফিক আজাদ ‘জীবনের’ই আরেক নাম।

শিক্ষাজীবন

১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র রফিক ভাষা শহিদদের স্মরণে বাবা-মায়ের কঠিন শাসন অস্বীকার করে খালি পায়ে মিছিল করেন। ভাষার প্রতি এই ভালোবাসা পরবর্তী জীবনে তাকে তৈরি করেছিল একজন কবি হিসেবে, আদর্শ মানুষ হিসেবে।[] ১৯৫৬ সালে সপ্তম শ্রেণির ছাত্র থাকা অবস্থায় একবার বাবার হাতে মার খেয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন বাড়ি থেকে। উদ্দেশ্য, পি.সি সরকারের কাছে জাদু শেখা। ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ স্কুলের হেডমাস্টার তাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে বাড়িতে পাঠান। কৈশোরে লাঠি খেলা শিখতেন নিকটাত্মীয় দেলু নামক একজনের কাছে।

তিনি সম্পর্কে রফিক আজাদের দাদা। দেলু দাদা ছিলেন পাক্কা লাঠিয়াল। গ্রামে নানা কিংবদন্তির প্রচলন ছিল তার নামে। সলিম উদ্দিনের চেয়ে তিনি বয়সে বড় হলেও গা-গতর দেখলে পালোয়ান বলেই মনে হতো। দেলু দাদা খুব আদর করতেন রফিক আজাদকে। বার-বাড়িতে শিক্ষা দিতেন লাঠি খেলা। এছাড়া গুণী গ্রামের পাশেই মনিদহ গ্রাম।

এখানকার ষাট শতাংশ অধিবাসী ছিল নিম্নশ্রেণির হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত। সুতার, ধোপা, দর্জি, চাষা ইত্যাদি। এই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েরাই ছিল রফিক আজাদের শৈশব-কৈশোরের বন্ধু। সাধুটী মিডল ইংলিশ স্কুল থেকে অষ্টম শ্রেণি পাস করে ভর্তি হলেন কালিহাতি রামগতি শ্রীগোবিন্দ হাই ইংলিশ স্কুলের নবম শ্রেণিতে।

বাড়ি থেকে প্রায় তিন-চার মাইল দূরত্বে স্কুল। কালিহাতি সংলগ্ন গ্রাম হামিদপুরের এক দরিদ্র গেরস্থের বাড়িতে পেইং গেস্ট হিসেবে থেকে তিনি পড়াশোনা করেন। হামিদপুরে আগের মতো আর সেই বিধিনিষেধ নেই। কালিহাতি হাই স্কুলে পড়ার সময় বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে সতীর্থ মাঈন উদ্দিন আহমদের সঙ্গে। সে ছিল ক্লাসের ফার্স্ট বয় এবং অত্যন্ত মেধাবী। 

সাহিত্যপাঠে আগ্রহ ছিল তার। এই মাঈনই রফিক আজাদের আড্ডার প্রথম গুরু। হামিদপুরে তার সঙ্গে শুরু হয় তুখোড় আড্ডা। তার মুখেই প্রথম মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম শোনেন। দিবারাত্রির কাব্য, পুতুল নাচের ইতিকথা, পদ্মানদীর মাঝি প্রভৃতি উপন্যাসের সঙ্গে পরিচিত হন। মাঈন একদিন সন্ধ্যাবেলা ফটিকজানি নদীর তীর ঘেঁষা ডাকবাংলোর বারান্দায় বসে রবীন্দ্রনাথের ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতাটি পুরো আবৃত্তি করে শুনিয়েছিল তাকে। সেই কবিতা শুনে স্বপ্নাবিষ্ট হয়ে পড়েছিলেন কিশোর রফিক আজাদ।

 অবাধ স্বাধীনতা, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় পড়ে নবম শ্রেণিতে ভালোভাবে পাস করতে পারলেন না আড্ডাপ্রিয় রফিক আজাদ। মাঈনও প্রথম থেকে তৃতীয় স্থানে চলে আসে। আড্ডার অন্য বন্ধুদের অনেকেই একাধিক বিষয়ে ফেল করে বসল। সারা বছর অহেতুক আড্ডা দিয়ে পরীক্ষায় এই দশা। অবশেষে ব্রাহ্মণশাসন হাই স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় অংশ নিয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করেন।

কর্মজীবন

রফিক আজাদ ১৯৭২ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত বাংলা একাডেমির মাসিক সাহিত্য পত্রিকা উত্তরাধিকার এর সম্পাদক ছিলেন। রোববার পত্রিকাতেও রফিক আজাদ নিজের নাম উহ্য রেখে সম্পাদনার কাজ করেছেন। তিনি টাঙ্গাইলের মওলানা মুহম্মদ আলী কলেজের বাংলার লেকচারার ছিলেন। কাজ করেছেন বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশন, উপজাতীয় কালচারাল একাডেমি ও জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রে।[] রফিক আজাদের প্রেমের কবিতার মধ্যে নারীপ্রেমের একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে।

মুক্তিযুদ্ধ

রফিক আজাদ ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৭১ সালে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন কাদেরিয়া বাহিনীর হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন এই কবি।

প্রকাশিত গ্রন্থ

  • অসম্ভবের পায়ে
  • সীমাবদ্ধ জলে` সীমিত সবুজে
  • চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া
  • এক জীবনে
  • পাগলা গারদ থেকে প্রেমিকার চিঠি
  • প্রেমের কবিতাসমগ্র
  • বর্ষণে আনন্দে যাও মানুষের কাছে
  • বিরিশিরি পর্ব
  • রফিক আজাদ শ্রেষ্ঠকবিতা
  • রফিক আজাদ কবিতাসমগ্র
  • হৃদয়ের কী বা দোষ
  • কোনো খেদ নেই
  • সশস্ত্র সুন্দর
  • হাতুড়ির নিচে জীবন
  • পরিকীর্ণ পানশালায় আমার স্বদেশ
  • প্রিয় শাড়িগুলো

পুরস্কার ও সম্মানন

  • হুমায়ুন কবির স্মৃতি (লেখক শিবির) পুরস্কার (১৯৭৭)
  • কবিতালাপ পুরস্কার (১৯৭৯)
  • বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮১)
  • আলাওল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮১)
  • ব্যাংক পুরস্কার (১৯৮২)
  • সুহৃদ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৯)
  • কবি আহসান হাবীব পুরস্কার (১৯৯১)
  • কবি হাসান হাফিজুর রহমান পুরস্কার (১৯৯৬)
  • বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা (১৯৯৭)
  • একুশে পদক (২০১৩)

মৃত্যু

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫৮ দিন লাইফ সাপোর্টে থাকার পর ২০১৬ সালের ১২ মার্চ রফিক আজাদ মৃত্যুবরণ করেন।

এই সবুজ দুপুরের প্রান্ত ছুঁয়ে এই পৃথিবীতে কেটে গেছে আমাদের বেশ ক’টি সভ্যতার সকাল। আমি রয়ে গেছি আজও, তুমি সভ্যতার ওপার। এপারে আমি।

প্রথমদিন থেকেই তৃতীয় বর্ষ অনার্স, এবং এমএ ক্লাসের ছাত্রীরা আমার ক্লাস লেকচারে বিমুগ্ধ, অভিভূত। মাইকেল মধুসূদনদত্তের মহাকাব্য ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ অতি সহজ ও তরল করে পড়াতে পেরেছি—এটাই আমার প্রাথমিক যোগ্যতা বিচারক ছাত্রীদের কাছে। অতপর সাহিত্যতত্ত্ব ও ছন্দ পড়িয়ে আরও জনপ্রিয় শিক্ষক হয়ে উঠেছিলাম অল্পদিনেই। বিভিন্ন বিভাগের সিনিয়র সহকর্মীরা আমার জন্যে পাত্র খোঁজেন ভালোবেসে, তারা আড়ে-ঠারে কথা বলেন—বুঝতে পারি সব। কিন্তু শৈল চূড়ায়নীড় বাঁধার মতো আমার মনের মধ্যে যে বাসা বেঁধেছে শতবর্ষ, সাধনার ধন ‘প্রেমরোগ’। এই রোগে আক্রান্ত আমি, সে কথা কাউকেই জানাতে পারি না আর।

কী করবো আমি? কী করা উচিত, বুঝতে পারছিলাম না যেন কিছুতেই। কবির প্রতি দুর্বার টান অধিকন্তু তার অসহায়, পর্যুদস্ত অবস্থা বিবেচনায় এনে একজন নবীন কবি হিসেবে প্রতিভাধর বিখ্যাত এ রকম একজন কবিকে অগ্রাহ্য করা কঠিন হয়ে পড়ছিল। বারবার শক্তি হারিয়ে ফেলি, নিজের কাছে নিজেকেই খুব অচেনা মনে হয়। বাইরের কঠিন খোলস ভেদ করে ফুলের রেণুর মতোকোমল ও সোনালি হৃদয় নিয়ে বসে আছেন যে কবি, কী করে ফেরাই তাকে।

সারাক্ষণ মাথার মধ্যে একই চিন্তা, কী করে ফেরাই তাঁকে?
সংসার-ঝঞ্জালে বাঁধা যে জীবন তাকে নিয়ে আর যাই হোক সময়ক্ষেপণও সঙ্গত নয়। এ রকম শতমুখ কণ্টকে ছিন্নভিন্ন সময়ের প্রহরী দুজনেই আমরা। কোথাও নিরিবিলি বসার মতো জায়গা নেই। প্রথম থেকেই একটি ‘রেস্তোরাঁ অ্যান্ড বার সাকুরা’ই ছিল আমাদের আলাপনের নিভৃতি স্থল। সেটি ছিল কবির উপার্জনের তুলনায় ব্যয়বহুলই বটে। তবু এছাড়া আর কোনো উপায়ও আমাদের ছিল না। এ যুগের মতো এত সাহসী ছিলো না সে যুগের সেই প্রেম। লুকিয়ে-চুরিয়েই নিজের পথ করে নিতে হতো তাকে। মধ্যযুগের ‘কাম’ সবে আধুনিক যুগে এসে তবে না ‘প্রেম’নাম ধারণ করেছে। কাজেই দিন-ক্ষণ-সময়ের জন্যে অপেক্ষা করতে হতো আমাদের। ধরা পড়লে প্রাচীন যুগের মতো মৃত্যুদণ্ড হয়তো হতো না, কিন্তু সমাজের দণ্ডমুণ্ডদের সঙ্গে জীবনপণ লড়াইটিও কিছু কম নয়—যা জীবনরস শুষে নেয় অনেকটাই।

‘সাকুরা’র বাইরে প্রথম সকাল দশটা থেকে ২টা অবধি ৪ ঘণ্টা আমরা সময় কাটিয়েছিলাম একসঙ্গে, ঢাকার ঐতিহাসিক বোটানিক্যাল গার্ডেনে। প্রস্তাবটি ছিল কবির দিক থেকে। না করতে পারিনি। এত ভালোবাসা তো পাইনি জীবনে, এমন কী দেখিওনি অন্যের জীবনে। কাজেই না করবো কোন্ দুঃসাহসে।

ওর হাত ধরে সেই আমার প্রথম ঢাকার বোটানিক্যাল গার্ডেন দেখা। নানারঙ বাহারি ফুলের সমাবেশ ছাড়িয়ে খুঁজে পেতে ঘন বাঁশঝাড়ের ছায়াচ্ছন্ন তলায় বসে, ঝড়াপাতার কার্পেটের মর্মরধ্বনি শুনে কাটিয়েছিলাম সময়টুকু। কথক আমি, ফুলঝুড়ির মতো কথা ছোটে আমার, কবি কেবলি নির্বাক শ্রোতা। সবিস্ময়ে কেবলি শুনলেন। বললেন খুব কম।

এর পরদিন তিনি দুটি কবিতা লেখেন ‘তোমাকে কাছে পেয়ে’ এবং ‘একটি দুপুর’। কবিতা দুটোই কবির ‘একজীবনে’ কাব্যগ্রন্থে ঠাঁই পেয়েছে। শুরুটা করেছিলেন এভাবে:

সমস্ত শরীরময় বেজে ওঠে সুখের সঙ্গীত,
ধমনীতে উদ্দাম নৃত্যের শব্দ শুনি,
শিরায়-শিরায় দ্রুত শিহরণ জাগে:
চতুর্দিক ব্যেপে আনন্দ, আনন্দ শুধু—
হ্রদয়তন্ত্রীতে ওঠে গুঞ্জরিত সুরের লহরী;
সারা জীবনের সকল বিষাদ খেদ
মুহূর্তেই ঝ’রে যায়,—পাপ-তাপ, ব্যর্থতার গ্লানি
ধুয়ে মুছে যায়;
বেঁচে থাকা খুব অর্থময় হ’য়ে ওঠে—
প্রকৃতিও অপূর্ব সৌন্দর্য তার মেলে ধরে আজ
এই হতদরিদ্রের চোখের সম্মুখে;
অকৃপণ উদারতা জেগে ওঠে হ্রদয়ে আমার:
ধুলোকাদা থেকে আমি ভালোবেসে কোলে তুলে নিই
শত্রুর সন্তান;
অপরাহ্ণে পেয়ে যাই ভোরের আস্বাদ,
……………..
তোমার কথার পাখি
খুশিতে বিহবল হ’য়ে ডানা ঝাপ্টে চ’লে আসে দ্রুত
আমার আকাশে
দিনমান ব্যেপে শুধু পাখি-ডাকা ভোর
জেগে রয় আমাদের ঘিরে;
আন্দোলিত হ’তে থাকে
বাতাসে উড্ডীন ভালোবাসার পতাকা;
মেদে-মাংসে স্থূলকায় এই দেহ ফিরে পায় দ্রুত
ব্যালে-শিল্পীর শরীর,
আনন্দে-আবেগে-প্রেমে জেগে উঠি সুখের সঙ্গীতে।

soures :   wikipedia

What's Your Reaction?

Like Like 0
Dislike Dislike 0
Love Love 0
Funny Funny 0
Angry Angry 0
Sad Sad 0
Wow Wow 0