নিকোলাস কোপার্নিকাস || Nicolaus Copernicus
নিকোলাস কোপার্নিকাস || Nicolaus Copernicus

মিকোলাই কপের্নিক :
নিকোলাস্ কোপের্নিকুস্; তৎকালীন পোলীয় ভাষা: Mikołaj Kopernik মিকল্বাই কপের্নিক্, আধুনিক পোলীয় ভাষা: মিকউয়াই কপর্নিক্ ; ১৯ ফে., ১৪৭৩–২৪ মে, ১৫৪৩ খ্রি.) ছিলেন একজন বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী। তিনি তাঁর নামের লাতিন রূপ অর্থাৎ নিকোলাস কোপার্নিকাস নামেই অধিক পরিচিত। তিনিই সর্বপ্রথম আধুনিক সূর্যকেন্দ্রিক সৌরজগতের মতবাদ প্রদান করেন। যেখানে তিনি পৃথিবী নয়; বরং সূর্যকে সৌরজগতের মূলকেন্দ্র হিসাবে উল্লেখ করেন এবং ১৮শ শতকের আগে এমন একটি মডেল প্রণয়ন করেন, যখন চারদিকে টলেমী ও এরিস্টটলীয় মতবাদ চলছিল।
তার মৃত্যুর কিছুদিন আগে কোপার্নিকাস তার বই (দি রেভলিউসনিবাস অরবিয়াম কোয়েলেস্তিয়াম ) প্রকাশ করা হয়। বইটি বিজ্ঞানের ইতিহাসে বড় একটি ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও কোপার্নিকান বিপ্লব সৃষ্টি এবং বৈজ্ঞানিক বিপ্লবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
কোপার্নিকাসের জন্ম ও মৃত্যু একই জায়গায়; রয়েল প্রুশিয়া, যেটি ১৪৬৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পোল্যান্ড সম্রাজের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তিনি একাধারে গণিতবিদ, জ্যোতির্বিদ, পদার্থবিদ, আধুনিক পণ্ডিতবিদ, অনুবাদক, গভর্নর কূটনীতিক এবং অর্থনীতিবিদ ছিলেন। ১৫১৭ সালে তিনি অর্থের একটি পরিমাণ তত্ত্ব বের করেন যাকে অর্থনীতির প্রধান ধারণা বলা যায়। এছাড়াও ১৫১৯ সালে তিনি অর্থনীতির একটি সূত্র প্রদান করেন, যা পরবর্তীতে গ্রিসমের সূত্র নামে পরিচিত।
জীবনী:
নিকোলাস কোপার্নিকাস ১৪৭৩ সালের ১৯ শে ফেব্রুয়ারি পোল্যান্ড সম্রাজ্যের রয়েল প্রুসিয়া প্রদেশের থর্ন (আধুনিক তোরন) শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা কারাকোর একজন বণিক ছিলেন এবং তার মা ছিলেন তোরনের একজন ধনী বণিকের কন্যা। নিকোলাস চার ভাই বোনের মধ্যে সবার চেয়ে ছোট ছিলেন। তার বড় ভাই এন্দ্রু ফ্রনবার্গের একজন অগাস্টিয়ান কেনন ছিলেন। তার বড় বোনের নাম ছিলো বারবারা, তার মায়ের নামের সাথে মিলিয়ে। তার বোন ছিলো একজন মঠবাসিনী বা সন্নাসী। তিনি ১৫১৭ সালে মারা যান। কোপার্নিকাসের আরেক বোন ক্যাথরিন যিনি কিনা তোরনের ব্যবসায়ী এবং শহরের কাউন্সিলর বার্থেল গার্টনারকে বিয়ে করেন। তাদের পাঁচ জন সন্তান ছিল। কোপার্নিকাস মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার বোনের সন্তানদের দেখাশোনা করেছেন। কোপার্নিকাস কোন বিয়ে করেননি এবং তার কোন সন্তান ছিলো না। তবে ১৫৩১ থেকে ১৫৩৯ সাল পর্যন্ত তার আনা সিলিং নামে এক গৃহকর্মীর সাথে সম্পর্ক ছিলো।
ভাষা:
কোপার্নিকাস ল্যাটিন ও জার্মান ভাষায় সমান দক্ষ ছিলেন। তিনি পোলিশ, গ্রীক এবং ইটালিয়ান ভাষাতেও কথা বলতে পারতেন। তবে তিনি কাজ করেছেন বেশিরভাগ ল্যাটিন ভাষায়। কারণ, তখনকারদিনে ইউরোপের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ল্যাটিন ভাষা ব্যবহৃত হত। এছাড়াও ল্যাটিন, রোমান ক্যাথলিক চার্চে ও পোল্যান্ডের রাষ্ট্রীয় আদালতের প্রধান ভাষা ছিল। আর এভাবেই ল্যাটিন ভাষায় চার্চ এবং পোলিশ শাসকদের সাথে নিকোলাসের যোগাযোগ ছিল। কোপার্নিকাসের লিখা কিছু তথ্য প্রমাণ জার্মান ভাষায়ও আছে। এই বিষয়টি জার্মানির দর্শন বিভাগের অধ্যাপক মার্টিন ক্যারিয়ার উল্লেখ করেন। কারণ হলো কোপার্নিকাসের স্থানীয় ভাষাও ছিল জার্মান।
কোপার্নিকাস খুব ভালো জার্মান বলতে পারতেন তার অন্যতম কারণ হলো তিনি জার্মান ভাষাভাষী একতি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৪৯৬ সালে তিনি যখন বলগনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছিলেন তখন তিনি জার্মান ভাষার একটি দলে(সংগঠনে) যোগদান করেন। ১৪৯৭ সালের সংবিধান অনুযায়ী এই সংগঠনটির সদস্য তারাই হতে পারতেন যাদের মাতৃভাষা ছিল জার্মান। যাই হোক, ফরাসি দর্শবিদ আলেকজান্দ্রে কোয়রের মতে, কোপার্নিকাস নাটিও সংগঠনে জার্মান ভাষা জানতো বলে যোগদান করেনি বরং সে নিজেকে জার্মান ভাবত তাই যোগ দিয়েছিলো। তখন প্রুশিয়া এবং সিলেসিয়া থেকে নিয়মিত ছাত্র শ্রেনীভুক্ত করা হতো যা জার্মান ভাষাভাষী শিক্ষার্থীতের জন্য জাতিগতভাবে গর্বের ছিলো।
নাম:
কোপার্নিক হল বংশীয় উপাধি। এই কপার্নিগ নাম ১৩৫০ সালে কারাকাও থেকে সংগ্রহ করা হয়। ১৮৪৫ সালের পূর্বে সিলেসিয়া এর ডিচি অব নাইসা গ্রামের লোকদেরকে কোপের্নিগ বলা হতো। ১৪৯৩ সালে দি নুরেমবার্গ ক্রোনিকল প্রকাশিত হয় যেখানে বলা হয় গ্রামের মানুষের স্থানীত মাতৃভাষা ছিল পোলিশ। ১৩৮৬ সালে নিকোলাস কোপার্নিকাসের প্রপিতামহ কারাকাওতে নাগরিকত্ব লাভ করে বসবাস করতে শুরু করে। বর্তমান কপার্নিকি নামটি মূলত এসেছে জার্মান কপার এবং পোলিশ অর্থ ডিল(কপার) হতে। নিক এবং বহুবচন নিকি যা পোলিশ শব্দে বিশেষ্য হিসেবে কাজ করে। সেই সময়ের মধ্যে সাধারণ হিসাবে, উভয় শীর্ষস্থানীয় এবং উপাধির বানানে ব্যাপকভাবে পরিবরতন হয়েছে। কোপার্নিকাস এসব ব্যাপারে অনেকটা উদাসীন ছিলেন।
তার শৈশবের সময় ১৪৮০ সালে তোরনে একবার তার বাবার নাম নিকোলাস কোপেরনিইগক সংগ্রহ করা হয়। কারাকাওতে তিনি ল্যাটন ভাষায় নিজের নাম নিকোলাস, নিকোলাসে পুত্র নিবন্ধন করেন। ১৪৯৬ সালে তিনি নাটিও জার্মান সংগঠনে তার নাম ডমিনাস নিকোলাস কোপার্নিক নিবন্ধন করেন। পাদুয়াতে তিনি নিজের নাম নিকোলাস কোপার্নিক স্বাক্ষর করলেও পরে তা কোপার্নিকাসে পরিবর্তন করেন। ল্যাটিন ভাষায় Coppericus লিখার সময় তিনি প্রথমে দুইটি “P” ব্যবহার করতেন, কিন্তু পরবর্তীতে তিনি একটি “P” ব্যবহার করেন। তার গ্রন্থ “দি রিভলিউশনিবাস” এর শিরোনামে “নিকোলাই কোপার্নিকি” উল্লেখ করা হয়।
শিক্ষা:
আর্মিটাজের মতে তিনি পরে ক্যাথোড্রল বিদ্যালয়ে ভর্তি হন যা পরবর্তিতে কারাকাও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে সাহায্য করে। ১৪৯৩-৯৪ সালের শীতকালীন সেমিস্টারে তার ভাই এন্ড্রুর সাথে কারাকাও বিশ্ববিদ্যালয় শুরু করেন। কোপার্নিকাস কলা বিভাগে ভর্তি হন (১৪৯১-১৪৯৫)। জান ব্রোজেকের মতে কোপার্নিকাস আলবার্ট ব্রুজসকির(যিনি এরিস্টটলীয় দর্শন এর শিক্ষক ছিলেন) ছাত্র ছিলেন। কোপার্নিকাস তার কারণে জগ ভন পিউবাগাস এর “থিউরিকা নোভা প্লান্টারাম” পড়েছিলেন। তিনি সব ধরনের জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কিত ক্লাস করতেন। এদের মধ্যে বার্নাড অব বিস্কুপে, ওজচিক ক্রিপা, অন্যতম। এছাড়াও জান অব গ্লোগো, মাইকেল রোকলা, ওজচিকনিউই এবং মারচিন বেলিকার জ্যোতির্বিদ্যার ক্লাসে অংশগ্রহণ করতেন।১৪৯৫ সালে ক্রাকোভে পড়ালেখা শেষ না করে হটাৎ করেই মামা ওয়াতজেনরদের কাছে চলে আসেন। তার মামা ১৪৮৯ সালে ওয়ারমিয়ার বিসপ নির্বাচিত হন। অজানা কারণেই ওয়াটজেনোদে তার দুই ভাগিনাকে ইতালির ক্যাননে আইন পরতে পাঠিয়ে দেন। ধারণা করা হয় এতে করে তাদের ভবিষ্যৎ উন্নতি এবং ওয়ারমিয়াতে তাদের প্রভাব বিস্তারের জন্যই এমন করা হয়। ১৪৯৬ সালের মাঝামাঝি তিনি অধ্যাপক চ্যান্সেলর জেরির সাথে ওয়ারমিয়া ত্যাগ করেন যিনি ইতোমধ্যে ইতালি যাচ্ছিলেন। অক্টোবর মাসে তিনি বলগ্নাতে আসেন। এর কয়েকমাস পর ১৪৯৭ সালে তিনি সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের নিবন্ধন করেন যেখানে সিলিয়া,প্লিসিয়া ও অন্যান্য জাতীয়তার ছাত্রদের পাশাপাশি পোলিশ ছাত্রদেরও ভর্তি করা হয়।
গ্রহ পর্যবেক্ষণ:
কোপারনিকাস বুধের তিনটি পর্যবেক্ষণ করেন যার মধ্যে ত্রুটি ছিল ৩,-১৫,১ মিনিট চাপ। তিনি ভেনাসের পর্যবেক্ষণ করেন যার ত্রুটি ছিল -২৪ মিনিট চাপ। মঙ্গলের চারটি পর্যবেক্ষণ করেন করেন যার ত্রুটির মান ছিল ২,২০,৭৭,১৩৭ মিনিট চাপ। জুপিটার পর্যবেক্ষণে ৪ টি ত্রুটি পাওয়া যায় সেগুলো হল ৩২,৫১,-১১ এবং ২৫ মিনিট চাপ। শনির সাথেও ৪ টি পর্যবেক্ষণ ত্রুটি ছিল ৩১, ২০,২৩ এবং -৪ মিনিট চাপ।
হেলিওসেন্ট্রি সম:
কোপার্নিকাস তার আদর্শ, চিন্তা-ভাবনাকাজের একটি সারাংশ তৈরী করেন যা তার বন্ধুরা সহজেই পড়তে ও জ্ঞান অর্জন করতে পারে। ১৫১৪ সালে তিনি এই হেলিওসেন্ট্রিকের প্রাথমিক ধারণা দেন। এর মধ্যে ৭ টি ধারণা ছিলো। তিনি পরবর্তিতে আরও কাজ করেন এবং তথ্য ও ডাটা সংগ্রহ করেন। ১৫৩২ সালে তিনি তার “দি রিভিউলিসানবাস ওরবিয়া কেলেসটিয়াম” এর কাজ শেষ করেন। তার কাছের বন্ধুদের আপত্তি থাকা স্বত্তেও তিনি তার বইটি সবার জন্য উন্মুক্ত করতে চান। ১৫৩৩ সালে জন আলবার্ট ইউডমান্সটার রোমে কোপার্নিকাস ত্বত্তের ধারাবাহিক বক্তব্য দেন। পোপ ক্লেমেন(সপ্তম) এবং ক্যাথোলিক কার্ডিনাল এতে খুশী হন এবং এই ত্বত্তের উপর আগ্রহ প্রকাশ করেন।
১৫৩৩ সালের ১ নভেম্বর কার্ডিনাল নিকোলাস রোম থেকে কোপার্নিকাসের নিকট একটি চিঠি প্রদান করেন-
কয়েক বছর আগে আমি আপনার কাজ সম্পর্কে অবগত হয়েছি। সে সময় থেকেই আমি অনেক দুঃখ পেয়েছি কারণ আমি জেনেছি আপনি অন্যসব প্রাচীন জ্যোতির্বিদদের মতো নন। আপনি ভিন্ন কিছু করছেন, নতুন কিছু করছেন। আপনি বলেছেন পৃথিবী ঘুরছে সূর্যের চারিদিকে যা মহাবিশ্বের কেন্দ্র। আমি আপনার কাছ থেকে এসব শিখেছি জনাব। যদি আপনার অসুবিধা না হয় তাহলে আপনার এই আবিষ্কারগুলো জ্যোতির্বিদদের কাছে পাঠান এবং আপনার লেখাগুলো একত্র করে আমার কাছে পাঠান। এরপরই ইউরোপের শিক্ষিত লোকের কাছে কোপার্নিকাসের কাজ পৌছুতে থাকে। কোপার্নিকাসে এরপরও তার বইটি প্রকাশ করতে দেরী করেন। তার অন্যতম কারণ ছিলো তিনি তৎকালীন সমাজের অবস্থা সম্পর্কে ভীত ছিলেন। বিদ্বান, পণ্ডিত লোকেরা কোপার্নিকাসের দর্শন ও জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কে ভিন্ন মত পোষন করেন এবং তিনি ধর্মীয় দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন ছিলেন
মৃত্যু:
১৫৪২ সালের শেষের দিকে কোপার্নিকাস হঠাত প্যারালাইসিস রোগে আক্রান্ত হন এবং ২৪ শে মে, ১৫৪৩ সালে ৭০ বছর বয়সে মারা যান। তার মৃত্যু কিছুদিন আগে তিনি তার বইয়ের সর্বশেষ সংস্করণ প্রকাশ করেন এবং তার সকল কাজের বিদায়ী শুভেচ্ছা দেয়া হয়। ধারণা করা হয়- তিনি কোমাতে হঠাত হৃদযন্ত্রের ব্যাথা অনুভবে জেগে উঠেন এবং তার বইটি দেখেন এরপর শান্তিতে মৃত্যুবরণ করেন।
What's Your Reaction?






