হজরত নুহ (আঃ) এর জীবন কাহিনী | Biography of Nuh Alaihis Salam
হজরত নূহ (আ.) এর জীবনী | Biography of Nuh Alaihis Salam

অন্যান্য নাম |
নোহ (হিব্রু ভাষায়: נוֹחַ) |
---|---|
পরিচিতির কারণ |
নূহের নৌকা |
উপাধি |
নবী |
পূর্বসূরী |
ইদ্রিস |
উত্তরসূরী |
হুদ |
দাম্পত্য সঙ্গী |
নয়মা |
হযরত নূহ (আঃ) ইসলামের ধর্মীয় গ্রন্থ কুরআনের বর্ণনা অনুসারে একজন নবী ছিলেন। কুরআনে নূহ শিরোনামে একটি পূর্নাঙ্গ সূরা নাযিল হয়েছে যেখানে তার এবং সমকালীন বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে বলা হয়েছে। মুসলমানগন তাকে হযরত নূহ আলাইহিসালাম নামে সম্বোধন করেন। খ্রিস্ট ধর্মের মূল ধর্মীয় গ্রন্থ বাইবেলও তার সম্পর্কে বিশদ বিবরণ পাওয়া যায়।ইসলাম ধর্মের বর্ণনা অনুসারে নূহ আল্লাহর আদেশে বিশাল এক নৌকা নির্মাণ করেন এবং প্রত্যেক প্রানীকুল এক জোড়া করে এবং তার সময়ের ঈমানদার অর্থাৎ যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছিল তাদের নিয়ে সাগরে রওনা দেন। তারপর আল্লাহ তার গোত্রে মহা প্লাবনের সৃষ্টি করেন। আর তাতে পাহাড় পর্বতও পানির নিচে তলিয়ে যায়। এবং কাফের সহ সব প্রানীকুল ধ্বংস হয়ে যায়। পরে আল্লাহর নির্দেশে প্লাবনের পানি কমে গেলে নবী তার সহযাত্রীদের নিয়ে আবার নতুন করে জীবন ধারণ করা শুরু করেন ।
নূহ আঃ এর জন্ম
বর্তমান ইরাকের মুছেল নগরীর উত্তর প্রান্তে নূহ আঃ এর জন্ম হয়েছিল। তার চারটি পুত্র ছিল। হাম, সাম, ইয়াফিস ও ইয়াম বা কেনআন। প্রথম তিন জন নূহ আঃ এর প্রতি ঈমান আনেন, শেষজন কাফের হয়ে মহা প্লাবনে ডুবে মারা যায়। মহাপ্লাবনের শেষে তার তিন পুত্র হাম, সাম, ও ইয়াফিস এর বংশধর বেঁচে ছিলেন। (তাফসীর ইবনে কাসীর, সূরা ছাফফাত- ৭৭)। আল্লাহ তাআলা বলেন,
আমি তার (নূহ আঃ) বংশধরগণকেই অবশিষ্ট রেখেছি। (সূরা ছাফ্ফাত- ৭৭)
ফলে ইহুদী খ্রিষ্টানসহ সকল ধর্মের লোকেরা নূহ আঃ কে তাদের আদি পিতা হিসেবে মর্যাদা দিয়ে থাকে।
ইবনে আব্বাস রাঃ বলেন, নূহ আঃ ৪০ বছর বয়সে নবুওয়াত প্রাপ্ত হন এবং মহাপ্লাবনের পর ৬০ বছর বেঁচে ছিলেন। (তাফসীর ইবনে কাসীর, সূরা আনকাবুত- ১৪/১৫)
হজরত নূহ (আলাইহিস সালাম) ছিলেন পিতা হজরত আদম (আলাইহিস সালাম) এর দশম অথবা অষ্টম অধঃস্তন পুরুষ। তিনি ছিলেন দুনিয়াতে প্রথম রাসূল। তাকে মানবজাতির দ্বিতীয় পিতা বলে আখ্যায়িত করা হত।
নূহ (আঃ)-এর বিরুদ্ধে পাঁচটি আপত্তি
কওমের অবিশ্বাসী নেতারা জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য নূহ (আঃ)-এর বিরুদ্ধে পাঁচটি আপত্তি উত্থাপন করেছিল। যথাঃ (১) আপনি তো আমাদের মতই একজন মানুষ। নবী হ’লে তো ফেরেশতা হতেন। (২) আপনার অনুসারী হ’ল আমাদের মধ্যকার হীন ও কম বুদ্ধিসম্পন্ন লোকেরা (৩) কওমের উপরে আপনাদের কোন প্রাধান্য পরিদৃষ্ট হয় না (হূদ ১১/২৭)। (৪) আপনার দাওয়াত আমাদের বাপ-দাদাদের রীতি বিরোধী (৫) আপনি আসলে নেতৃত্বের অভিলাষী (মুমিনূন ২৩/২৪-২৫)। অতএব আপনাকে আমরা মিথ্যাবাদী মনে করি (হূদ ১১/২৭)।
জনগণকে ক্ষেপিয়ে তোলার জন্য নূহ-এর দাওয়াতকে ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক আন্দোলন বলে আখ্যায়িত করে কাফের নেতারা বলল,
فَقَالَ الْمَلَأُ الَّذِينَ كَفَرُوْا مِنْ قَوْمِهِ مَا هَذَا إِلاَّ بَشَرٌ مِّثْلُكُمْ يُرِيدُ أَن يَّتَفَضَّلَ عَلَيْكُمْ وَلَوْ شَآءَ الله ُلَأَنزَلَ مَلَآئِكَةً مَّا سَمِعْنَا بِهَذَا فِيْ آبَائِنَا الْأَوَّلِيْنَ- (المؤمنون ২৪-২৫)-
‘এ লোক তো তোমাদের মতই একজন মানুষ। আসলে সে তোমাদের উপরে নেতৃত্ব করতে চায়। আল্লাহ ইচ্ছা করলে তো একজন ফেরেশতা পাঠাতে পারতেন। তাছাড়া এ লোক যেসব কথা বলছে, তাতো আমরা আমাদের বাপ-দাদাদের কাছে কখনো শুনিনি’। ‘আসলে লোকটার মধ্যে পাগলামী রয়েছে কিংবা তার সাথে কোন জিন রয়েছে। অতএব তোমরা এ ব্যক্তির দিকে ভ্রুক্ষেপ কর না। বরং কিছুদিন অপেক্ষা কর’ (মুমিনূন ২৩/২৪-২৫)। (এভাবে) ‘তারা তাঁকে সরাসরি পাগল বলে এবং (প্রাণে মারার) হুমকি দেয়’ (ক্বামার ৫৪/৯)।
আপত্তি সমূহের জওয়াব :
(১) গোত্রের নেতাদের উপরোক্ত আপত্তি ও অপবাদ সমূহের জবাবে নূহ (আঃ) বলেন,
ﻗَﺎﻝَ ﻳَﺎ ﻗَﻮْﻡِ ﺃَﺭَﺃَﻳْﺘُﻢْ ﺇِﻥْ ﻛُﻨْﺖُ ﻋَﻠَﻰ ﺑَﻴِّﻨَﺔٍ ﻣِّﻦ ﺭَّﺑِّﻲْ ﻭَﺁﺗَﺎﻧِﻲْ ﺭَﺣْﻤَﺔً ﻣِّﻦْ ﻋِﻨْﺪِﻩِ ﻓَﻌُﻤِّﻴَﺖْ ﻋَﻠَﻴْﻜُﻢْ ﺃَﻧُﻠْﺰِﻣُﻜُﻤُﻮْﻫَﺎ ﻭَﺃَﻧﺘُﻢْ ﻟَﻬَﺎ ﻛَﺎﺭِﻫُﻮْﻥَ – ) ﻫﻮﺩ ২৮ ( –
‘হে আমার কওম! আমি যদি আমার প্রভুর পক্ষ হ’তে স্পষ্ট দলীলের উপরে থাকি, আর তিনি যদি তাঁর পক্ষ হ’তে আমাকে রহমত দান করেন, আর সেসব থেকে যদি তোমাদের চক্ষু অন্ধ থাকে, তাহ’লে কি আমি তা তোমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তোমাদের উপরে চাপিয়ে দিতে পারি? (হূদ ১১/২৮)। একথা দ্বারা বুঝানো হয়েছে যে, নবুওয়াত ও রিসালাত চেয়ে পাওয়া যায় না। এটা সস্পূর্ণরূপে আল্লাহর ইচ্ছাধীন। তিনি মানুষের জন্য কোন ফেরেশতাকে নয়, বরং তাঁর মনোনীত কোন মানুষকেই নবী করে পাঠিয়ে থাকেন স্পষ্ট দলীল-প্রমাণ সহকারে।
নূহ (আঃ) তাঁর কওমকে আরও বলেন,
ﺃَﻭَﻋَﺠِﺒْﺘُﻢْ ﺃَﻥْ ﺟَﺎﺀَﻛُﻢْ ﺫِﻛْﺮٌ ﻣِّﻦ ﺭَّﺑِّﻜُﻢْ ﻋَﻠَﻰ ﺭَﺟُﻞٍ ﻣِّﻨﻜُﻢْ ﻟِﻴُﻨْﺬِﺭَﻛُﻢْ ﻭَﻟِﺘَﺘَّﻘُﻮﺍ ﻭَﻟَﻌَﻠَّﻜُﻢْ ﺗُﺮْﺣَﻤُﻮْﻥَ – ) ﺍﻷﻋﺮﺍﻑ ৬৪ ( –
‘তোমরা কি এ বিষয়ে আশ্চর্যবোধ করছ যে, তোমাদের পালনকর্তার পয়গাম তোমাদের মধ্য থেকেই একজনের মাধ্যমে তোমাদের কাছে এসেছে, যাতে সে তোমাদের ভীতি প্রদর্শন করে ও তার ফলে তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহপ্রাপ্ত হও’ (আ‘রাফ ৭/৬৩)। আল্লাহ বলেন, ‘কিন্তু তারা নূহকে মিথ্যা সাব্যস্ত করে। তখন আমরা তাকে ও তার নৌকারোহী সাথীদেরকে মুক্ত করি এবং আমাদের আয়াত সমূহে মিথ্যারোপকারীদের ডুবিয়ে মারি। বস্ত্ততঃ তারা ছিল জ্ঞানান্ধ’ (আ‘রাফ ৭/৬৪)।
মুসলিম উম্মাহর মধ্যে একদল লোক শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে ‘নূরের নবী’ বলে পরোক্ষভাবে তাঁকে ‘ফেরেশতা নবী’ বানাতে চায়। এভাবে তারা বিগত যুগের কাফিরদের সন্দেহবাদের অনুসরণ করে মাত্র। অথচ আল্লাহ বলেন,
ﻭَﻟَﻮْ ﺟَﻌَﻠْﻨَﺎﻩُ ﻣَﻠَﻜًﺎ ﻟَّﺠَﻌَﻠْﻨَﺎﻩُ ﺭَﺟُﻼً ﻭَﻟَﻠَﺒَﺴْﻨَﺎ ﻋَﻠَﻴْﻬِﻢ ﻣَّﺎ ﻳَﻠْﺒِﺴُﻮْﻥَ – ) ﺍﻷﻧﻌﺎﻡ ৯ ( –
‘যদি আমরা কোন ফেরেশতাকে রাসূল করে পাঠাতাম, তবে সে মানুষের আকারেই হ’ত। কিন্তু এতেও তারা ঐ সন্দেহই প্রকাশ করত, যা এখন করছে’
(আন‘আম ৬/৯)।
(২) তাদের দ্বিতীয় আপত্তির জবাবে নূহ (আঃ) বলেন,
ﻭَﻣَﺎ ﺃَﻧَﺎ ﺑِﻄَﺎﺭِﺩِ ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﺁﻣَﻨُﻮْﺍ ﺇِﻧَّﻬُﻢ ﻣُّﻼَﻗُﻮْ ﺭَﺑِّﻬِﻢْ ﻭَﻟَـﻜِﻨِّﻲْ ﺃَﺭَﺍﻛُﻢْ ﻗَﻮْﻣﺎً ﺗَﺠْﻬَﻠُﻮْﻥَ، ﻭَﻳَﺎ ﻗَﻮْﻡِ ﻣَﻦ ﻳَّﻨْﺼُﺮُﻧِﻲْ ﻣِﻦَ ﺍﻟﻠﻪِ ﺇِﻥْ ﻃَﺮَﺩﺗُّﻬُﻢْ ﺃَﻓَﻼَ ﺗَﺬَﻛَّﺮُﻭْﻥَ؟ – ) ﻫﻮﺩ ২৯-৩০ ( –
‘আমি কোন (গরীব) ঈমানদার ব্যক্তিকে তাড়িয়ে দিতে পারি না। তারা অবশ্যই তাদের পালনকর্তার দীদার লাভে ধন্য হবে। বরং আমি তোমাদেরই মূর্খ দেখছি’। ‘হে আমার কওম! আমি যদি ঐসব লোকদের তাড়িয়ে দেই, তাহ’লে কে আমাকে আল্লাহর পাকড়াও থেকে রক্ষা করবে? তোমরা কি উপদেশ গ্রহণ করবে না? (হূদ ১১/২৯-৩০; শো‘আরা ২৬/১১১-১১৫)।
(৩) তৃতীয় আপত্তির জবাবে তিনি বলেন,
ﻭَﻻَ ﺃَﻗُﻮﻝُ ﻟِﻠَّﺬِﻳﻦَ ﺗَﺰْﺩَﺭِﻱ ﺃَﻋْﻴُﻨُﻜُﻢْ ﻟَﻦ ﻳُﺆْﺗِﻴَﻬُﻢُ ﺍﻟﻠﻪ ُﺧَﻴْﺮﺍً ﺍﻟﻠّﻪُ ﺃَﻋْﻠَﻢُ ﺑِﻤَﺎ ﻓِﻲ ﺃَﻧﻔُﺴِﻬِﻢْ ﺇِﻧِّﻲ ﺇِﺫﺍً ﻟَّﻤِﻦَ ﺍﻟﻈَّﺎﻟِﻤِﻴﻦَ – ) ﻫﻮﺩ ৩১ ( –
‘তোমাদের দৃষ্টিতে যারা দীনহীন-অবাঞ্ছিত ব্যক্তি তাদেরকে আল্লাহ কোনরূপ কল্যাণ দান করবেন না। তাদের মনের কথা আল্লাহ ভাল করেই জানেন। সুতরাং এমন কথা বললে আমি অন্যায়কারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব’
(হূদ ১১/৩১)।
অতএব দুনিয়াবী প্রাধান্য মূলতঃ কোন প্রাধান্য নয়। পরকালীন উচ্চ মর্যাদাই হ’ল প্রকৃত মর্যাদা।
(৪) চতুর্থ আপত্তির জবাবে তিনি পয়গম্বরসুলভ উত্তর দিয়ে বলেন, ﻗَﺎﻝَ ﻳَﺎ ﻗَﻮْﻡِ ﻟَﻴْﺲَ ﺑِﻲْ ﺿَﻼَﻟَﺔٌ ﻭَﻟَﻜِﻨِّﻲْ ﺭَﺳُﻮْﻝٌ ﻣِّﻦ ﺭَّﺏِّ ﺍﻟْﻌَﺎﻟَﻤِﻴْﻦَ، ﺃُﺑَﻠِّﻐُﻜُﻢْ ﺭِﺳَﺎﻻَﺕِ ﺭَﺑِّﻲْ ﻭَﺃَﻧْﺼَﺢُ ﻟَﻜُﻢْ ﻭَﺃَﻋْﻠَﻢُ ﻣِﻦَ ﺍﻟﻠﻪِ ﻣَﺎ ﻻَ ﺗَﻌْﻠَﻤُﻮﻥَ ) ﺍﻷﻋﺮﺍﻑ ৬১-৬২)- ‘হে আমার কওম! আমার মধ্যে কোনই পথভ্রষ্টতা নেই। বরং আমি বিশ্বপালকের পক্ষ হ’তে প্রেরিত রাসূল’। ‘আমি তোমাদের নিকটে আমার প্রভুর রিসালাত পৌঁছে দেই এবং আমি তোমাদেরকে সদুপদেশ দিয়ে থাকি। কেননা আমি আল্লাহর পক্ষ থেকে এমন বিষয় জানি, যা তোমরা জানো না’ (আ‘রাফ ৭/৬১-৬২)।
অতএব আল্লাহ প্রদত্ত রিসালাত তথা অহী-র বিধান পালন করা ও তা জনগণের নিকটে পৌঁছে দেওয়াই আমার দায়িত্ব ও কর্তব্য- পিতৃধর্ম পালন করা নয়। বস্ত্ততঃ বাপ-দাদার ধর্মের দোহাই নূহ (আঃ) থেকে শুরু করে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) পর্যন্ত সবাইকে দেওয়া হয়েছিল। আর সেকারণে প্রায় সকল নবীকেই স্ব স্ব জাতির নিকট থেকে চরম নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছিল।
(৫) অতঃপর নেতৃত্ব লাভের আশায় নূহ (আঃ) লোকদের নিকটে দাওয়াত দিচ্ছেন মর্মে তাদের পঞ্চম আপত্তির জবাবে তিনি স্পষ্টভাষায় বলে দেন যে,
ﻭَﻳَﺎ ﻗَﻮْﻡِ ﻻَ ﺃَﺳْﺌَﻠُﻜُﻢْ ﻋَﻠَﻴْﻪِ ﻣَﺎﻻً ﺇِﻥْ ﺃَﺟْﺮِﻱَ ﺇِﻻَّ ﻋَﻠَﻰ ﺭَﺏِّ ﺍﻟْﻌَﺎﻟَﻤِﻴْﻦَ – ) ﺍﻟﺸﻌﺮﺍﺀ ১০৯ ( –
‘এই দাওয়াতের বিনিময়ে আমি তোমাদের কাছে কোন মাল-দৌলত বা কোন বিনিময় কামনা করি না। আমার পুরষ্কার তো কেবল বিশ্বপালকের (আল্লাহর) নিকটেই রয়েছে’ (শো‘আরা ২৬/১০৯; ইউনুস ১০/৭২; হূদ ১১/২৯)।
বস্ত্ততঃপক্ষে সকল নবীই একথা বলেছেন। শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর কাছে এসে তাঁর কওমের নেতারা যখন নেতৃত্ব গ্রহণের অথবা মাল-দৌলতের বিনিময়ে তাওহীদের দাওয়াত পরিত্যাগের প্রস্তাব দিয়েছিল, তখন তিনি তা প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, ‘যদি তোমরা আমার ডানহাতে সূর্য ও বামহাতে চন্দ্র এনে দাও, তথাপি আমি যে সত্য নিয়ে আগমন করেছি, তা পরিত্যাগ করব না’ (আর-রাহীক্ব পৃঃ ৯৭)।
বস্ত্ততঃ শিরকের মাধ্যমে দুনিয়া অর্জন সহজলভ্য হয় বিধায় যুগ যুগ ধরে দুনিয়াপূজারী এক শ্রেণীর বকধার্মিক লোক মূর্তি, কবর ও মাযার নিয়ে পড়ে আছে। লোকেরা তাদেরকে আল্লাহর অলী ভাবে। অথচ ওরা মূলতঃ শয়তানের অলী। ইবরাহীম (আঃ) এদের উদ্দেশ্যেই বলেছিলেন,
ﺭَﺏِّ ﺇِﻧَّﻬُﻦَّ ﺃَﺿْﻠَﻠْﻦَ ﻛَﺜِﻴﺮًﺍ ﻣِّﻦَ ﺍﻟﻨَّﺎﺱِ ﻓَﻤَﻦْ ﺗَﺒِﻌَﻨِﻲْ ﻓَﺈِﻧَّﻪُ ﻣِﻨِّﻲْ ﻭَﻣَﻦْ ﻋَﺼَﺎﻧِﻲْ ﻓَﺈِﻧَّﻚَ ﻏَﻔُﻮْﺭٌ ﺭَّﺣِﻴْﻢٌ – ) ﺇﺑﺮﺍﻫﻴﻢ ৩৬ ( –
‘হে প্রভু! এ মূর্তিগুলি বহু লোককে পথভ্রষ্ট করেছে। এক্ষণে যারা আমার অনুগামী হয়েছে, কেবল তারাই আমার দলভুক্ত। আর যারা আমার অবাধ্যতা করেছে (তাদের ব্যাপারে আপনিই সবকিছু), নিশ্চয়ই আপনি ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (ইবরাহীম ১৪/৩৬)। নিঃসন্দেহে যারা শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর সত্যিকারের অনুসারী হবে, কেবল তারাই আখেরাতে মুক্তি পাবে। যেহেতু ‘শিরকপন্থীদের জন্য আল্লাহ জান্নাতকে হারাম করেছেন’ (মায়েদাহ ৫/৭২), সেহেতু শিরকের মাধ্যমে দুনিয়া অর্জনকারী লোকেরা এবং মুশরিক ব্যক্তিরা মুখে আল্লাহকে স্বীকার করলেও ওরা চিরস্থায়ীভাবে জাহান্নামের অধিবাসী হবে। অতএব হে মানুষ! শিরক হ’তে সাবধান হও!!
গযবের কারণ :
আল্লাহ বলেন,
ﻣِﻤَّﺎ ﺧَﻄِﻴﺌَﺎﺗِﻬِﻢْ ﺃُﻏْﺮِﻗُﻮْﺍ ﻓَﺄُﺩْﺧِﻠُﻮْﺍ ﻧَﺎﺭﺍً ﻓَﻠَﻢْ ﻳَﺠِﺪُﻭْﺍ ﻟَﻬُﻢ ﻣِّﻦ
ﺩُﻭْﻥِ ﺍﻟﻠَّﻪِ ﺃَﻧﺼَﺎﺭﺍً – ‘তাদের পাপরাশির কারণে তাদেরকে (প্লাবনে) ডুবিয়ে মারা হয়েছিল। অতঃপর তাদেরকে (কবরের) অগ্নিতে প্রবেশ করানো হয়েছিল। কিন্তু নিজেদের জন্য আল্লাহর মুকাবেলায় কাউকে তারা সাহায্যকারী পায়নি’ (নূহ ৭১/২৫)। উপরোক্ত আয়াতে বুঝা যায় যে, পথভ্রষ্ট সমাজনেতাদের সাথে পুরা সমাজটাই পাপে নিমজ্জিত হয়েছিল। যেজন্য সর্বগ্রাসী প্লাবনের গযবে তাদেরকে ডুবিয়ে ধ্বংস করা হয়। এমনকি মৃত্যুর পর বরযখী জীবনে তাদেরকে কবর আযাবের অগ্নিকুন্ডে প্রবেশ করানো হয়েছে, সেকথাও আল্লাহ বলে দিয়েছেন। এতদ্ব্যতীত ক্বিয়ামতের দিন তাদের জন্য জাহান্নাম যে সুনিশ্চিত, সেকথাও বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। কেননা তারা সেদিন মুক্তির জন্য কোন সুফারিশকারী পাবেনা।
নৌকার আরোহীগন :
তূফানের আলামত প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে নূহ (আঃ)-কে হুকুম দেওয়া হ’ল, ﻗُﻠْﻨَﺎ ﺍﺣْﻤِﻞْ ﻓِﻴْﻬَﺎ ﻣِﻦْ ﻛُﻞٍّ ﺯَﻭْﺟَﻴْﻦِ ﺍﺛْﻨَﻴْﻦِ ‘জোড় বিশিষ্ট প্রত্যেক প্রাণীর এক এক জোড়া করে নৌকায় তুলে নাও’ (হূদ ১১/৪০; মুমিনূন ২৩/২৭)। এর দ্বারা কেবল ঐসব প্রাণী বুঝানো হয়েছে, যা নর ও মাদীর মিলনে জন্মলাভ করে এবং যা মানুষের দৈনন্দিন জীবনে অতীব প্রয়োজনীয়। যেমন গরু-ছাগল, ঘোড়া-গাধা ও হাঁস-মুরগী ইত্যাদি পশু-পক্ষী।
এরপর নূহ (আঃ)-কে নির্দেশ দেওয়া হয় কেবল তাঁর পরিবারসহ ঈমানদার নর-নারীকে নৌকায় তুলে নিতে। যাদের সংখ্যা অতীব নগণ্য ছিল (হূদ ৪০)। কিন্তু সঠিক সংখ্যা কুরআন বা হাদীছে উল্লেখিত হয়নি। তবে আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হয়েছে যে, তাদের সংখ্যা ছিল চল্লিশ জন করে পুরুষ ও নারী মোট আশি জন। প্লাবনের পর তারা ইরাকের মূছেল নগরীর যে স্থানটিতে বসতি স্থাপন করেন, তা ‘ছামানূন’ বা আশি নামে খ্যাত হয়ে যায়।
প্লাবনে মুক্তিপ্রাপ্তদের ‘সূমর’ (ﺳﻮﻣﺮ ) জাতি বলা হ’ত। ‘জূদী’ (ﺟﻮﺩﻯ) পাহাড়ে গিয়ে নৌকা নোঙর করে (হূদ ১১/৪৪)। এ পাহাড়টি আজও ঐ নামেই পরিচিত। এটি নূহ (আঃ)-এর মূল আবাস ভূমি ইরাকের মূছেল নগরীর উত্তরে ‘ইবনে ওমর’ দ্বীপের অদূরে আর্মেনিয়া সীমান্তে অবস্থিত। বস্ত্ততঃ এটি একটি পবর্তমালার অংশ বিশেষের নাম। এর অপর এক অংশের নাম ‘আরারাত’ পর্বত। প্রাচীন ইতিহাসে উল্লেখ রয়েছে যে, ইরাকের বিভিন্ন স্থানে উক্ত কিশতীর ভগ্ন টুকরা সমূহ অনেকের কাছে সংরক্ষিত আছে। যা বরকত মনে করা হয় এবং বিভিন্ন রোগ-ব্যধিতে আরোগ্যের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়।
উল্লেখ্য যে, নূহের পুত্র কাফিরদের দলভুক্ত হওয়ায় মহাপ্লাবনে ধ্বংস হয়েছিল। কিন্তু নূহের স্ত্রী সম্পর্কে এখানে কিছু বলা হয়নি। এতে স্পষ্ট হয় যে, তিনি আগেই মারা গিয়েছিলেন (ইবনু কাছীর, হূদ ১১/৪০)। তিনি গোপনে কুফরী পোষণ করতেন ও কাফিরদের সমর্থন করতেন। নূহের স্ত্রী ও লূত্বের স্ত্রী স্ব স্ব স্বামীর নবুঅতের উপরে বিশ্বাস স্থাপনের ক্ষেত্রে খেয়ানত করেছিল বলে স্বয়ং আল্লাহ বর্ণনা করেছেন। নবীদের স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও কুফরীর কারণে তারা জাহান্নামবাসী হয়েছেন (তাহরীম ৬৬/১০)। সম্ভবতঃ মহাপ্লাবনের সময় নূহের স্ত্রী জীবিত ছিলেন না। সেকারণ গযবের ঘটনা বর্ণনায় কেবল পুত্র ইয়ামের কথা এসেছে। কিন্তু তার মায়ের কথা আসেনি।
কুরআনের বর্ণনা
ইসলামের বর্ণনায়, আদম এর বংশধর নারী পুরুষরা তার শিক্ষা অনুসারে এক আল্লাহর উপাসনা করত। তাদের মধ্যে অনেক ধার্মিক ব্যক্তি ছিলেন যাদেরকে তার সম্প্রদায়ের মানুষ সম্মান ও মান্য করত। বলা হয় যে, যখন এই ধার্মিক লোকেরা মারা যায় তখন তাঁদের ভক্তরা তাঁদের বসার জায়গাগুলোকে উপাসনালয় বানিয়ে নেয় এবং তাঁদের চিত্রও সেখানে ঝুলিয়ে দেয়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, এভাবে তারা তাঁদেরকে স্মরণ করে তারাও তাঁদের মত আল্লাহর উপাসনা করবে। তারপর যখন কিছু কাল অতিবাহিত হল, তখন তারা এই চিত্রগুলোর মূর্তি নির্মাণ করল। আরও কিছু কাল পর পরবর্তী বংশধররা শয়তানের প্ররোচনায় এসব মূর্তির উপাসনা করতে শুরু করে। এসব পথভ্রষ্ট মানুষদের সঠিক দিক নির্দেশনা দেয়ার দায়িত্ব দিয়ে আল্লাহ হযরত নূহকে তাদের মাঝে নবি হিসাবে প্রেরণ করেন।কুরআনে ৪৩ বার নূহ নবীর উল্লেখ পাওয়া গেছে। কুরআন অনুসারে, নূহ সাড়ে নয়শত বছরের দীর্ঘ বয়স লাভ করেছিলেন এবং সারা জীবন মানুষকে সঠিক পথে আনার জন্য কাজ করেন। কিন্তু তার জাতি তাঁকে প্রত্যাখ্যান করে। ফলে তার জাতি ভয়াবহ বন্যায় ধ্বংস হয়ে যায়।
কুরআনে বলা হয়েছে,
"নিশ্চয় আমরা নূহ্কে পাঠিয়েছিলাম তার সম্প্রদায়ের প্রতি এ নির্দেশসহ যে, আপনি আপনার সম্প্রদায়কে সতর্ক করুন তাদের প্রতি যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি আসার আগে। তিনি বললেন, ‘হে আমার সম্প্রদায়, নিশ্চয় আমি তোমাদের জন্য স্পষ্ট সতর্ককারী - এ বিষয়ে যে, তোমরা আল্লাহ্-র উপাসনা করো, তাঁকে ভয় করো এবং আমার আনুগত্য করো। তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করবেন এবং তোমাদেরকে অবকাশ দেবেন এক নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত। নিশ্চয় আল্লাহ্ কর্তৃক নির্দিষ্ট সময় উপস্থিত হলে তা বিলম্বিত করা হয় না; যদি তোমরা এটা জানতে’।"
তার সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে কুরআনে বলা হয়েছে,
"আর তারা বলে, ‘তোমরা তোমাদের উপাস্যদের বর্জন করো না। বর্জন করো না ওয়াদ, সুওয়া', ইয়াগূছ, ইয়া‘ঊক ও নাসরকে’।"
নূহের বিরুদ্ধে তাদের যুক্তি সম্পর্কে কুরআনে বলা হয়েছে,
"অতঃপর তার সম্প্রদায়ের নেতারা যারা কুফরী করেছিল, তারা বলল, ‘আমরা তো তোমাকে আমাদের মত একজন মানুষ ছাড়া কিছু দেখছি না এবং আমরা দেখছি যে, কেবল আমাদের নিচু শ্রেণীর লোকেরাই বিবেচনাহীনভাবে তোমার অনুসরণ করেছে। আর আমাদের উপর তোমাদের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব আমরা দেখছি না; বরং আমরা তোমাদেরকে মিথ্যাবাদী মনে করি’।"
আরও বলা হয়েছে,
"অতঃপর তার সম্প্রদায়ের নেতারা, যারা কুফরী করেছিল, তারা বলল, ‘এ তো তোমাদের মতই একজন মানুষ, সে তোমাদের উপর শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করতে চাচ্ছে। আর আল্লাহ্ ইচ্ছে করলে ফেরেশতাই পাঠাতেন। আমরা তো আমাদের পূর্বপুরুষদের কালে এরূপ ঘটেছে বলে শুনিনি। সে কেবল এমন এক লোক, যার মধ্যে পাগলামী রয়েছে। অতএব তোমরা তার সম্পর্কে কিছুকাল অপেক্ষা করো’।"
তাদের যুক্তির জবাবে কুরআনে বলা হয়েছে,
"আর যদি রাসূলকে ফেরেশতা বানাতাম তবে তাকে পুরুষ মানুষই বানাতাম। ফলে তারা যে সন্দেহ করে, সে সন্দেহেই তাদেরকে রেখে দিতাম।"
"তিনি (নূহ) বললেন, ‘হে আমার সম্প্রদায়, তোমরা আমাকে বল, আমি যদি আমার রব প্রেরিত স্পষ্ট প্রমাণে প্রতিষ্ঠিত থাকি এবং তিনি যদি আমাকে তার নিজের পক্ষ থেকে অনুগ্রহ দান করে থাকেন, অতঃপর সেটা তোমাদের কাছে গোপন রাখা হয়, আমরা কি এ বিষয়ে তোমাদেরকে বাধ্য করতে পারি, যখন তোমার এটা অপছন্দ কর? আর হে আমার সম্প্রদায়, এর বিনিময়ে আমি তোমাদের কাছে কোনো সম্পদ চাই না। আমার প্রতিদান শুধু আল্লাহর কাছে। যারা ঈমান এনেছে, আমি তাদের তাড়িয়ে দিতে পারি না। নিশ্চয় তারা তাদের রবের সাথে সাক্ষাৎ করবে। কিন্তু আমি তো দেখছি তোমরা এক অজ্ঞ জাতি’।"
তারপরও তার সম্প্রদায় বিশ্বাস না করে আল্লাহ্-র শাস্তি নিয়ে আসতে বলেছে এবং তাঁকে মৃত্যুর হুমকিও দিয়েছে বলে কুরআনে বর্ণিত হয়েছে,
"তারা বলল, ‘হে নূহ, তুমি আমাদের সাথে বাদানুবাদ করছ এবং আমাদের সাথে অতিমাত্রায় বিবাদ করেছ। অতএব যার প্রতিশ্রুতি তুমি আমাদেরকে দিচ্ছ, তা আমাদের কাছে নিয়ে আস, যদি তুমি সত্যবাদীদের অন্তর্ভুক্ত হও’।"
"তারা বলল, ‘হে নূহ, তুমি যদি বিরত না হও তবে অবশ্যই তুমি প্রস্তরাঘাতে নিহতদের অন্তর্ভুক্ত হবে’।"
দীর্ঘকাল তাওহীদের প্রতি আহ্বানের পর যখন আর কেউ ঈমান আনার সম্ভাবনা থাকল না, তখন কাফিরদের মহাপ্লাবনের মাধ্যমে ধ্বংস করে দেয়া হয় এবং নৌকায় আরোহণ করে নূহ ও অন্য মুমিনরা বেঁচে যায় বলে কুরআনের বিভিন্নস্থানে বলা হয়েছে।
"অতঃপর সে তার প্রতিপালককে আহবান করল যে, ‘নিশ্চয় আমি পরাজিত, অতএব তুমিই প্রতিশোধ গ্রহণ কর’। ফলে আমি বর্ষণশীল বারিধারার মাধ্যমে আকাশে দ্বারসমূহ খুলে দিলাম। আর ভূমিতে আমি ঝর্ণা উৎসারিত করলাম। ফলে সকল পানি মিলিত হল নির্ধারিত নির্দেশনা অনুসারে। আর আমি তাকে (নূহকে) কাঠ ও পেরেক নির্মিত নৌযানে আরোহণ করালাম। যা আমার চাক্ষুস তত্ত্বাবধানে চলত, তার জন্য পুরস্কার স্বরূপ, যাকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল।"
বাইবেলের বর্ণনা
বাইবেলে বর্ণনা অনুসারে, নোয়াহ ছিলেন প্লাবন পূর্ব যুগের দশম শ্রদ্ধেয় নেতা। তার পিতা ছিলেন একজন গোত্রপতি। মাতার পরিচয় জানা যায়নি। নোয়াহর বয়স যখন পাঁচশত বছর তখন সেম, হামম্ এবং যাপেট নামে তার তিন পুত্রের জন্ম হয়।বুক অব জেনেসিসের বর্ণনা
বুক অব জেনেসিসের ৬-৯ পরিচ্ছেদে নূহের প্লাবনের বিশদ বর্ণনা আছে। বর্ণনায় বলা হয়েছে, পৃথিবীর মানুষের বিশাল পাপের কারণে ঈশ্বর পৃথিবীতে মহাপ্লাবনের মাধ্যমে পৃথিবী ধ্বংস করেন। নূহের নৌকায় তুলে নেয়া পৃথিবীর সমস্ত প্রানীর জোড়া থেকে পুনরায় তাদের সৃষ্টি করেন। ঈশ্বর এই মর্মে প্রতিজ্ঞা করেন যে, তিনি আর কোন প্লাবন সৃষ্টি করবেন না।নূহ (আঃ)-এর জীবনী থেকে শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ
১. প্রথম রাসূল নূহ (আঃ)-এর সত্যতার বিরুদ্ধে যে পাঁচটি আপত্তি তোলা হয়েছিল, সর্বশেষ ও শ্রেষ্ঠ রাসূল মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর সত্যতার বিরুদ্ধেও ঐ অভিযোগগুলি তোলা হয়েছিল। শেষনবীর প্রকৃত দ্বীনী উত্তরাধিকারী হিসাবে সমাজ সংস্কারক মুত্তাক্বী আলেমগণের উপরে নবুঅতের বিষয়টি বাদে বাকী চারটি অভিযোগ যুগে যুগে উত্থাপিত হওয়াটাই স্বাভাবিক।
২. নূহ (আঃ) যেমন দীর্ঘকাল যাবত নিজ জাতির পক্ষ হ’তে অবর্ণনীয় নির্যাতন ভোগ করা সত্ত্বেও তাদের হেদায়াতের ব্যাপারে নিরাশ হ’তেন না, প্রকৃত সমাজ হিতৈষী আলেম ও নেতাগণেরও তেমনি নিরাশ হওয়া উচিত নয়।
৩. নবী পরিবারের সদস্য হওয়া সত্ত্বেও ঈমান না থাকার কারণে নূহের স্ত্রী ও পুত্র যেমন নাজাত লাভে ব্যর্থ হয়েছে, তেমনি এ যুগেও হওয়া সম্ভব। কাফির ও মুশরিক সন্তান বা কোন নিকটাত্মীয়ের মাগফেরাতের জন্য আল্লাহর নিকটে দো‘আ করা জায়েয নয়।
৪. ঈমানী সম্পদই বড় সম্পদ। আল্লাহর নিকটে ঈমানদারের মর্যাদা সর্বপেক্ষা বেশী। যদিও সে দুনিয়াবী জীবনে দীনহীন গরীব হয়।
৫. ঈমানহীন সমাজ নেতা ও ধনী লোকদের খুশী করার জন্য ঈমানদার গরীবদের দূরে সরিয়ে দেওয়া যাবে না।
৬. মৃত নেককার মানুষের অসীলায় পরকালে মুক্তি পাওয়ার ধারণার ভিত্তিতে সৃষ্ট মূর্তিপূজার শিরক বিশ্ব ইতিহাসের প্রাচীনতম শিরক। এই শিরকের কারণেই নূহের কওম আল্লাহর গযবে ধ্বংস হয়েছিল। তাই যাবতীয় প্রকারের শিরক থেকে তওবা করা কর্তব্য। সাথে সাথে এই মহাপাপ থেকে জাতিকে রক্ষা করার জন্য আলেমদের এবং সমাজ ও রাষ্ট্র নেতাদের এগিয়ে আসা যরূরী।
৭. সমাজ নেতাদের পথভ্রষ্টতার কারণেই দেশে আল্লাহর গযব নেমে আসে। অতএব তাদেরকেই সবার আগে হুঁশিয়ার হওয়া কর্তব্য।
৮. বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা করার সাথে সাথে সাধ্যমত বাস্তব প্রচেষ্টা চালাতে হয়। যেমন নূহ (আঃ) প্রথমে আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা করেন। অতঃপর গযব থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর হুকুমে নৌকা তৈরী করেন।
৯. আল্লাহ পাক স্বীয় অহী দ্বারা বিভিন্ন নবীর মাধ্যমে যুগে যুগে বিভিন্ন শিল্পকর্মের সূচনা করেছেন, যেমন আদম (আঃ)-এর মাধ্যমে কৃষিকর্ম ও চাকার প্রচলন করেছেন এবং নূহ (আঃ)-এর মাধ্যমে জাহায শিল্পের সূচনা করেছেন।
১০. দুনিয়াবী জৌলুস সত্ত্বেও যালেমরা সর্বযুগেই নিন্দিত ও ধিকৃত হয়। পক্ষান্তরে নির্যাতিত হওয়া সত্ত্বেও ঈমানদারগণ সর্বযুগে নন্দিত ও প্রশংসিত হন।
১১. কিসে মানুষের প্রকৃত মঙ্গল নিহিত রয়েছে, মানুষ নিজে তা নির্ণয় করতে পারে না। তাকে সর্বদা আল্লাহর রহমতের মুখাপেক্ষী থাকতে হয়। তাই ‘আল্লাহর অহি’ তথা পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের হেদায়াতই প্রকৃত হেদায়াত এবং চূড়ান্ত সত্যের মাপকাঠি।
১২. পূর্বতন সকল নবীর দাওয়াত ছিল এক ও অভিন্ন এবং তা ছিল নির্ভেজাল তাওহীদের প্রতি দাওয়াত। মানুষের সার্বিক জীবনে তাওহীদ প্রতিষ্ঠাই হ’ল প্রকৃত অর্থে ইক্বামতে দ্বীন।
১৩. আল্লাহ স্বীয় নেককার বান্দাগণের পক্ষে তাদের শত্রুদের থেকে প্রতিশোধ নিয়ে থাকেন এবং নেক বান্দাদের মুক্ত করেন। যেমন নূহের শত্রুদের থেকে আল্লাহ বদলা নিয়েছিলেন এবং নূহ ও তাঁর ঈমানদার সাথীদের মুক্ত করেছিলেন।
১৪. ঈমানদারগণের বিরুদ্ধে বিশ্ব ইতিহাসের প্রথম তোহমত ছিল এই যে, তারা হ’ল সমাজের দীনহীন ও স্বল্পবুদ্ধির লোক (هم أرَاذَلُنَا بَادِىَ الرأى -হূদ ২৭)। এ যুগেও তার ব্যতিক্রম নয়।
১৫. নবী-রাসূল ও তাঁদের অনুসারী সমাজ সংষ্কারকগণ সমাজের গালমন্দ খেয়েও সমাজ ত্যাগ করেন না। কিন্তু তাঁরা বদ দো‘আ করলে আল্লাহর গযব নেমে আসে।
What's Your Reaction?






