মুয়ায বিন জাবাল রাঃ আনহু - এর জীবনী

মুয়ায বিন জাবাল রাঃ আনহু - এর জীবনী

May 7, 2025 - 22:32
 0  1
মুয়ায বিন জাবাল রাঃ আনহু - এর জীবনী

হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল (রা) মহানবী (স)-এর বিশিষ্ট সাহাবী। তিনি হাদীস বর্ণনা ও ইসলামের অন্যান্য শাখায় কৃতিত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তিনি ছিলেন একজন আনসারী সাহাবী।

নাম ও পরিচিতি :

তাঁর নাম মুয়ায, উপনাম আবু আবদুল্লাহ, পিতার নাম জাবাল। মুয়ায (রা) মদিনার বিখ্যাত খাযরাজ
বংশে জন্মগ্রহণ করেন।

ইসলাম গ্রহণ :

হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল (রা) ১৮ বছর বয়সে ইসলাম গ্রহণ করেন। দ্বিতীয় আকাবায় রাসূল (স)-এর হাতে বাইয়াত গ্রহণের মজলিসে তিনি উপস্থিত ছিলেন। ঐ আকাবাতে মুয়ায ইবনে জাবালসহ সর্বমোট সত্তর জন আনসার উপস্থিত ছিলেন।

যুদ্ধে অংশগ্রহণ :

বদর যুদ্ধ ছাড়া অন্যান্য সকল যুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করেন। কেউ কেউ বলেন, যেহেতু তিনি দ্বিতীয় আকাবায় ইসলাম গ্রহণ করেন, সেহেতু তিনি বদর যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করার সৌভাগ্য লাভ করেছেন।

রাসুল (স)-এর সাহচর্য লাভ:

তিনি সর্বদা রাসূল (স)-এর স্নেহ ও আদর লাভে ধন্য হয়েছেন। উঠতে বসতে সর্বক্ষণ রাসূল (স)-এর নিকট শিক্ষার সুযোগ লাভ করেছেন। রাসূল (স) তাঁকে এত মহব্বত করতেন যে, অধিকাংশ সময় তাঁকে নিজের বাহনের পেছনে বসার সুযোগ দান করে নানা রকম ইলম ও মারেফত শিক্ষা দিতেন।

গুণাবলি :

হযরত মুয়ায (রা) ছিলেন অনন্য গুণাবলির অধিকারী। সততা, মহত্ত্ব, বীরত্ব, কোমলতা ও নৈতিকতা ছিল তাঁর চরিত্রের ভূষণ । আকাবার দ্বিতীয় শপথের সময় রাসূল (স) তাঁকে লক্ষ্য করে বলেন- نِعْمَ الرَّجُلُ مُعَاذُ بْن جَبَلٍ অর্থাৎ, মুয়ায ইবনে জাবাল কতই না উত্তম পুরুষ।

রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন :

মক্কা বিজয়ের পর রাসূল (স) তাঁকে ইয়েমেনের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। এছাড়া হযরত আবু বকর এবং ওমর (রা)-এর শাসনামালেও তিনি ইসলামের নিরলস সেবক হিসেবে কাজ করে যান।

হাদীস বর্ণনা :

তিনি রাসূল (স) হতে সর্বমোট ১৫৭টি হাদীস বর্ণনা করেন। সাহাবী ও তাবেয়ীদের অনেকে তাঁর নিকট হতে হাদীস বর্ণনা করেছেন।

ইন্তেকাল :

হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল (রা) ১৮ হিজরীতে ৩৮ বছর বয়সে হযরত ওমর (রা)-এর শাসনামালে طاعون عمواس তথা প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়ে বায়তুল মাকদাস ও দামেশক-এর মধ্যবর্তী এবং জর্দান নদীর তীরবর্তী ‘বীসান' নামক স্থানে ইন্তেকাল করেন। এ রোগে তাঁর দু’ন্ত্রী ও পুত্র আবদুর রহমানও মারা যান।

রুণ বয়সে মুসলমান। সত্তর জন আনসারী সাহাবীর সাথে ‘আকাবা’ প্রান্তরে ছিলেন। মহানবী ﷺ তাঁর সাথে জা’ফর বিন আবূ তালিবকে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করেছিলেন। তিনি বদর, উহুদ, খান্দাকসহ অনেক সমর অভিযানে অংশগ্রহণ করেছিলেন। নবীজী ﷺ-এর দর্শনে নিজের চোখ জুড়িয়েছেন। সব সময় নবীজী ﷺ-এর সাথে ছায়ার ন্যায় ছিলেন। রাসূলে আকরাম ﷺ তাঁকে নিজের খেদমতে লাগিয়েছেন, বাহনের পেছনে উঠিয়েছেন, সহযাত্রী করেছেন এবং তাবূক যুদ্ধের পর ইয়েমেন দেশের অধিবাসীদের জন্য বিচারক ও দিকনির্দেশক হিসেবে পাঠিয়েছেন। সেখানে তাদের পরামর্শক হিসেবে নবীজী ﷺ-এর জীবনাবসান হওয়া পর্যন্ত ছিলেন।

আবূ বকর রা. রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার পর তিনি মদীনায় ফেরত আসেন। এর কিছুদিন পর হযরত আবূ উবাইদাহ রা.-এর সাথে তিনি সিরিয়া অভিযানে অংশগ্রহণ করেন। আবূ উবাইদাহ রা. আক্রান্ত হলে তিনি মুয়ায রা.কে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করেন। যা হযরত উমর রা.ও বহাল রাখেন। তরুণ আনসারদের মাঝে তিনি ছিলেন সহনশীলতায়, দানে, যুহদ ও দুনিয়া বিমুখিতায় সর্বশ্রেষ্ঠ। আল্লাহ তাআলার কাছে তিনি যখনই কোন কিছু চাইছেন তিনি তাকে তাই দিয়েছেন। বুদ্ধিমত্তায় আর বীরত্ব-সাহসে তিনি হযরত উমর রা.-এর মতো ছিলেন।

ইলম আর জ্ঞানে এমন মাত্রায় ছিলেন যে, তাঁর ব্যুৎপত্তি দেখে নবীজী ﷺ তাঁর ব্যাপারে বলেছিলেন, (অনুবাদ) আমার উম্মতের মধ্যে হালাল ও হারামের ব্যাপারে সর্বাধিক জ্ঞানের অধিকারী হলেন মুয়ায বিন জাবাল। (তিরমিযী, হাদীস: ৩৭৯০)। তাঁর বুদ্ধি ও আকলের পরাকাষ্ঠা দেখে মহানবী ﷺ তাঁর বুকে হাত মেরে বলেছিলেন, (অনুবাদ) প্রশংসা আল্লাহর যিনি তাঁর রাসূলের রাসূল (দূত)কে তাওফীক দিয়েছেন। (তিরমিযী, হাদীস: ১৩২৭; আবূ দাউদ, হাদীস: ৩৫৯২)। মহানবী ﷺ তাঁকে বলেছিলেন, (অনুবাদ) মুয়ায, আমি তোমাকে ভালোবাসি। (আবূ দাউদ, হাদীস: ১৫২২; মুসতাদ্রাকে হাকেম, ১/২৭৩)। কেয়ামত দিবসে মানুষের সামনে মুয়ায বড় বড় পদক্ষেপে আসবে। (তাবাকাতে ইবনে সা’দ: ২/১০৭)

একবার হযরত উমর রা. তাঁর ইলম-জ্ঞান ও প্রজ্ঞার তারিফ করেছিলেন এই বলে, (অনুবাদ) নারীরা মুয়াযের মতো কোন সন্তান জন্ম দিতে অক্ষম হয়ে গেছে। আরও বলেছিলেন, মুয়ায না থাকলে উমর ধ্বংস হয়ে যেতো। হযরত ইবনে মাসউদ রা. তাঁর অবস্থার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, নিঃসন্দেহে মুয়ায আল্লাহ একনিষ্ঠ, অনুগত ও বিনয়ী ব্যক্তি; যিনি একাই একটি উম্মতের প্রতীক। একদিন তিনি তাঁর এক গোলামকে নিয়ে বসে আছেন। উপদেশ ছলে তাকে বললেন, নামায যখন পড়ো বিদায়ী নামাযের ন্যায় পড়ো। মনে করবে আর নামায পড়ার সুযোগ হবে না। স্মরণ রাখবে, মুমিন লোক মারা যায় দু’টি নেকি ও ভালো কাজের মাঝে মারা যায়। একটি নেকি সে জীবদ্দশায় করে থাকে, যার সুফল সে মৃত্যুর পর পেয়ে থাকে। অন্যটি হল, যে নেকির কার্যক্রম মৃত্যুর পর শুরু হয়।

মাথার শীর্ষভাগ থেকে পায়ের তলা পর্যন্ত একটা শ্রদ্ধাবোধজনিত ভয়ের আবহ বিরাজমান ছিল তাঁর মাঝে। আসরে বসলে লোকজন তাঁর চারপাশে বসে থাকতো। সাহাবা কেরামের মাঝে কথা বললে সবাই তাঁর দিকে কেমন শঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো। লজ্জায় সবার চোখ আনত থাকতো।

তাকওয়া আর পরহেযগারি তাঁর হৃদয়কে নিকষিত করেছে। বিশেষ একটা স্বাদ মনে অনুভূত হতো যার সামনে দুনিয়া প্রেমিকদের স্বাদ নস্যি। তাকওয়ার মেঘমালা তাঁকে সবসময় ছায়াবৃত করে রাখতো। আল্লাহ ভীতির অজানা আতঙ্ক বিরাজ করতো তাঁর চারপাশে। হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল রা.-এর দুইজন সহধর্মিণী ছিল। যখন যে বিবির কাছে থাকতেন অন্য বিবির ঘরে কোন কিছু খেতেন না এবং উযূও করতেন না। কাকতালীয়ভাবে উভয় স্ত্রী সিরিয়া থাকাকালে ‘আমাওয়াস’ প্লেগে আক্রান্ত হয়ে একই দিনে মারা যান। মানুষ অন্য কাজে ব্যস্ত থাকায় তিনিই উভয় স্ত্রী-এর কবর খনন করেন। লটারির মাধ্যমে নির্ধারণ করেছিলেন কোন বিবির কবর আগে খনন করবেন।

হযরত মুয়ায বিন জাবাল রা. বিছানায় বসে আছেন। তিনি প্লেগ রোগে আক্রান্ত। এমন সময় তাঁকে দেখতে লোকজন এসে ভিড় করছে। লক্ষ্য করে দেখলেন, এক ব্যক্তি কাঁদছে। হা-হুতাশ করছে। তিনি তাকে বললেন, কেন কাঁদছো? লোকটি বলল, আপনার মাধ্যমে জাগতিক ধনৈশ্বর্য পেয়েছি তা নিয়ে কোন দুঃখ-আফসোস নেই। তবে আপনার মাধ্যমে যে ইলম-জ্ঞান লাভ করছিলাম তা নিয়ে কান্না-কাটি করছি।

তাঁর কাছে একজন জ্ঞান-পিপাসু ও অনুসন্ধিৎসু শিক্ষার্থী এসে বলল, আমাকে কিছু শিখান। তিনি তার দিকে মনোনিবেশ করলেন এবং বললেন, রোযা রাখো বিরতিতে, কিছুদিন সিয়াম সাধনা কর, কিছুদিন বিরতি দাও। নামায পড়ো আবার ঘুমিয়ে বিশ্রামও নিবে। আয়-উপার্জন করবে কিন্তু অবৈধ উপার্জন করবে না। মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ করবে না। মজলুম ও নির্যাতিত মানুষের আহাজারি থেকে বেঁচে থাকো।

হযরত মুয়ায বিন জাবাল রা. মৃত্যু শয্যায় শায়িত। সকাল বেলায় তিনি বলতেন, আমি সেই রাত থেকে আশ্রয় চাই যার প্রত্যুষের পরিণতি জাহান্নাম। হে আল্লাহ! তুমি তো জানো নদী-নালা খনন আর বৃক্ষলতা লাগানোর উদ্দেশ্যে আমি দুনিয়াকে ভালোবাসতাম না। আমি তো দুনিয়াকে ভালোবেসেছিলাম দ্বিপ্রহরে তৃষ্ণার্তকে তৃপ্তি দিতে, কালের দুর্বিপাকে আক্রান্তকে মুক্তি দিতে এবং যিকিরের মজলিসে উলামা কেরাম দিয়ে লোকে লোকারণ্য করতে। এরপর শুরু হয় মৃত্যুযন্ত্রণা। একবার বেহুঁশ হয়ে পড়েন আরেক বার সংজ্ঞা ফিরে পান। পরক্ষণে প্রাণের আকুলতা বোধ করে বলে উঠলেন, পরওয়ারদেগার! তোমার বাসনাই আমার অভিলাষ। আমি কেবল তোমাকেই ভালোবাসি। সিরিয়ার জর্ডান নদীর কাছে হিজরী ১৮ সালে তিনি মারা যান। গাওর নামক স্থানে সমাহিত হন। তাঁর কোন সন্তান ছিল না। নিঃসন্তান অবস্থায় দুনিয়া ছেড়ে চলে যান। আল্লাহ তাআলা তাঁকে বেশি বেশি রহমত দান করুন।

What's Your Reaction?

Like Like 0
Dislike Dislike 0
Love Love 0
Funny Funny 0
Angry Angry 0
Sad Sad 0
Wow Wow 0